উপন্যাস কিস্তি ২১

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন

Looks like you've blocked notifications!
শিল্পী : তুমুল ইবনে মাহবুব

‘ অচিন পঙ্খীরে! কোন বাতাসে তুমি কই উড়াল দেও!’

‘শাপলা তোলছস?’ মিয়াভাইয়ে জিগায়।

সেয় তার নাওয়ে খাড়া, জুলেখায় খাড়া অর নাওয়ে। আসমানে আর বাইরা মাইস্যা বাইন্না পানিতে সকালের রইদ ঢলকাইয়া ঢলকাইয়া পড়তাছে। পানিতে হালকা-পাতলা জলজ লতাপাতা, আর দুনিয়ার শাপলা। পানি থির, তয় শাওন মাইস্যা বাতাস তারে তিরতিরা কাঁপানি তো দিতাছেই, এট্টু পর পর। অই দূরে দেওভোগ গেরামে শেষ বাড়িখান দেখা যায়। জুলিগো বাড়ি। অখন সেই বাড়ির উত্তরের ভিটায় কেউই নাই। শাপলা তোলতেও আর কেউ আইছে বইল্লা দেখা যাইতাছে না। ক্রোশকে ক্রোশ তিরতিরা কাঁপন পাইতে থাকা বাইন্না পানির উপরে খাড়া থাইক্কা ইসুফ মিয়ায় তার সমোনে এইটা কারে দেখতাছে!

গেলো বছরের ছায়-ছোট্ট ছেড়িটায় তো না এইটা! কেমুন ডাঙর হইয়া গেছে জুলি! মাথায় কত্তো বাড়ছে! পিন্ধনের কইচ্ছা আর হইলদায় মিশানি দেওয়া খোপ খোপ নকশার কাপোড়খান গাছ-কোমর কইরা কোমরে মোড়ানি দেওয়া। মাথার চুলে বেড়াবেনি। এগারো বচ্ছর না অওনের কতা অর! এইর মিদেই এমুন সিয়ান হইয়া গেছে! মুখখান দেহো তাজা পানপাতার লাহান! কী ঢকের!

অর দিগে চাওন দিয়া য্যান বাক্যিহারা অইয়া যায় ইসুফে। কী কইবো! কী জানি কইতে অইবো অরে! কোনটা জানি! ভিতরে ভিতরে ধোক্কা খাইতে থাকে সেয়। কথা বিছরাইয়া পায় না আর। কতা না কইয়া, খালি চাওন দিয়া থাকোন যায় না মাতা-খরাপটার দিগে?

এদিগে, মিয়াভাইরে আঁতকা দেইক্ষা তো লাফানি দিয়া ওঠছে জুলেখায়। খুশিতে লৌড় দিয়া যাইতেও লইছিলো সেয় মিয়াভাইয়ের দিগে। মিয়াভাইয়ে সেনা নিষেধ দিলো! নাও বোলে ডুইব্বা যাইবো! তাইলে সেয় থমকা খাড়ানি না দিয়া কী করবো! খাড়াইয়া, জুলি কতোক্ষণ বার চায় মিয়াভাইয়ের হুকুমের লেইগা। হেয় কী অরে কিছু করোনের ফরমাইশ দিবো!

কিন্তু জুলি দেখে মিয়াভাইয়ে ক্যান জানি চুপ লাইগ্গা গেছে! সেয় তারে আর কোনো একখান কথাও না কইয়া, কেমুন জানি চিন্তাঅলা চক্ষে চাওন দিয়া রইছে! চাওন দিয়া আছে জুলিরই দিগে। কিন্তুক তাও জুলির ধন্ধ লাগে। মিয়াভাইয়ে কী জুলিরে দেখে; না, সেয় ভাবনা করতাছে কিছু! নাকি কোনো কারোনে সেয় জুলির উপরে গোস্বা!

‘মিয়াভাই!’ জুলিয়ে এট্টু শরমে আর এট্টু ডরে কাচুমাচু হইতে হইতে ডাক দেয়, ‘ আপনে কই যান?’

‘ব! নাওয়ের উপরে ব!’ জুলিরে তার নাওয়ে বইতে কইয়া, ইসুফে নিজের কোষাখানে ধীরে বসে। বইসা একহাত দিয়া জুলির কোষাখানরে ধরে সেয়, নাইলে জুলির নাওখান ঠেলা খাইয়া দূরের দিকে ভাসা ধরবো তো!

‘তুই না শাপলা তোলতে আইছস বোলে? সেই কোন বিয়ানে না আইছস?’ ইসুফ মিয়ায় জিগায়; ‘তাইলে তর নাওয়ে দি একটা শাপলাও তোলা নাই! কিরে? চাচি না চিন্তা করতাছে!’

‘মিয়াভাই!’ জুলি খুশিতে ঝলকলাইয়া ওঠে; ‘একটা শাপলায়ও হাত দিতে পারি নাই!’

‘এইটা খুশির বিষয় হইলো?’

‘অনেক তাজ্জুবের একটা ঘটোনা হইছে, মিয়াভাই!’ জুলির চোখ-মোখ ঝিলিমিলি দিতে থাকে; ‘হোনেন, কী হইছে! বিয়ানের সোমে খালি এইনে আইয়া, নাওরে থির কইরা হাত বাড়ানি দিছি একটা শাপলার দিগে, অমনেই আমার চোখ গেছে পানিত! দেহি কী! অ মাগ্গো মা! এইখান দিয়া দেহি পালে পালে যাইতাছে গজার মাছের পোনা! বহুত বহুত পোনা! এই দুনিয়ার পোনা! কিমুন লাল লাল, তুরতুরা পোনাটি! যাইতাছে তো যাইতাছেই! শেষ আর অয় না।’

‘কস কী!’ পোনাগিলি ধরোনের লেইগা ইসুফ মিয়ার হাত নিসপিসানি শুরু করে। ‘অহন কো পোনাগিলি?’ সেয় জিগায়। ‘তুই ধরলি না?’

‘না না! ধরতে মায়া লাগছে আমার, মিয়াভাই!’ জুলি সিধা জবখান দেয়। ‘পোনাটি গেছে আগে আগে, অগো মায় গেছে সবটির পিছে! হেইর পর হইছে কী, একঝাঁক না গেলো; অম্মা! তার এট্টু পিছে আবার আরেক ঝাঁক! তারবাদে আরেকটা ঝাঁক! আইতাছেই খালি! আমি লড়লে যুদি অরা ডরায়! হেইর লেইগা দেহেন আমি শাপলা তোলতে পারি নাই! ঝুম দিয়া বইয়া আছিলাম। বইয়া থাকতে থাকতে মোনে হইছে কী, তাইলে দেহি না অরা কেমনে কেমনে আউগ্গায়! আমি হেইরে দেখতে আছিলাম; আপনে যেসুম আইলেন, সেইসুম। তাইলে শাপলা কেমনে তুলমু! পারি নাই!’

এই সকালের রইদেই য্যান জুলির মোখটা এট্টু পুইড়া গেছে লাগে! নাইলে এমুন লাল, জলজলাট দেহাই তো না মোখটা! ইসুফ মিয়ার কানে জুলির কথাগিলি যায়, না তার চক্ষের ভিতরে ঢোকতে থাকে—সেয় ধরতে পারে না কিছু। খালি এট্টুক বোঝে যে, উইয়ে বিয়ান তেনে না-খাওয়া! অরে তরা কইরা বাইত পাঠাইয়া দেওন দরকার!

তাইলে অখন আর কী করতে পারে ইসুফে! পারে খালি এইই যে; ধুম তরাতরি সেয় নিজেই জুলেখারে কতাটি শাপলা তুইল্লা দিয়া, বাড়ির দিগে মেলা করাইয়া দিতে পারে। ‘বহুত অইছে গজারের পোনা দেহোন!’ মোখে এই কথা কয় ইসুফে, আর তার হাত নাওয়ের এই মুড়া সেই মুড়া দিয়া ঝুইক্কা গিয়া শাপলা তোলতে থাকে, শাপ্পুর শুপ্পুর।

তোলে, আর জুলির নাওয়ে সেই শাপলা ঝাপ্পর-ঝোপ্পর ফালাইতে থাকে। ‘এই যেই কয়টা শাপলা তুইল্লা দিতাছি, লইয়া জলদি বাইত যা! তর মায় কইলাম চেততাছে!’ ইসুফ মিয়ায় কয়।

মিয়াভাইরে শাপলা তুলতে দিয়া জুলেখায় হাত তুইল্লা বইয়া থাকবো! এইটা কিরুম কতা! জুলেখায়ও শাপলা তোলোনের জন্য হাত বাড়ায়। ‘তর কিছু করোন লাগবো না। ঠান্ডা হইয়া বইয়া থাক!’ ইসুফে অরে থামায়; ‘আমি যে তুলতাছি, তা দিয়া কাম হইবো না? কি রে?’

আইচ্ছা, মিয়াভাইয়ের কতার উপরে জুলি আর কতা কইতে পারবো? পারবো না। সেয় চুপচাপ এট্টু খোন চাইয়া চাইয়া দেখে মিয়াভাইয়ের তুরুত হাতের শাপলা তোলোন। তারবাদে ভালামতোন নজর করে সেয় মিয়াভাইয়ের নাওয়ের দিগে। হের কোষা নাওয়ে একটা য্যান বড়ো পাতি দেহা যায়। মিয়াভাইয়ে পাতি লইয়া কই যায়!

‘আপনে কই যাইবেন মিয়াভাই?’

‘যাইতাছি আখড়া গেরামে, কালীমন্দিরের দোকান তেনে খই-পিট্টি-কদমা কিনতে। মায় নানিগো বাইত লইয়া যাইবো। আউজকা মায় নাইওর যাইবো। আমি আইছি হেরে লইয়া যাইতে।’ জুলি এক কতা জিগায়, কিন্তু ইসুফের পরান ফরফরাইয়া সবটি কতা কইতে থাকে।

‘কদমা কিনতে যান!’ জুলির গলায় একটু য্যান আহ্লাদ বাজতে শোনে ইসুফ মিয়ায়। মোনে হইতে থাকে, আরো কী জানি উয়ে কইবো! কিন্তু অইট্টুক কইয়াই জুলি চুপ হইয়া যায়, আর কিছু কয় না।

‘কী রে?’ শাপলা তোলা বন কইরা ইসুফে অর দিগে চায়।

‘মিয়াভাই, আর লাগবো না। অনেকটি হইয়া গেছে।’

‘কইতাছস?’

‘হ! অনেকটি হইছে।’

‘যা, তাইলে বাইত যা! আমি মেলা দিই।’

‘মিয়াভাই! আমি আপনের লগে লগে এট্টু যাই? আপনেরে আগ্গাইয়া দিয়া আহি গা এট্টু?’ জুলি লগ্গি হাতে নিয়া কয়। ‘অই আট্টু ফারাকে, অই আরো দূরে, আমি কোনোদিন যাই নাই একলা। মায় নিষেদ দিছে যে! যাই আপনের লগে?’

ইসুফ মিয়ার মোনে কইতে থাকে যে, লইয়া যাই পাগলাটারে! কিন্তু তার বুঝ-বিবেকে কইতে থাকে যে, না! না! পোলাপাইন মানুষ! আইবো নে কেমনে উয়ে একলা একলা!

সেয় কয়, ‘যাবি যে, তাইলে একলা ফিরতি আবি নে কেমনে তুই?’

‘আপনে নাও থামাইয়া এট্টু চাইয়া থাইক্কেন? আমি তুরুত আইয়া পড়মু!’

‘না! কাম নাই! আমার দেরি অইয়া যাইবো! এমনেই কইলাম দেরির সীমা নাই!’

অন্তরের ইচ্ছাখানরে অন্তরে গুইজ্জা থুইয়া ইসুফে লগ্গি হাতে নেয়। তারবাদে কোনো রকমে ঠেলা-গুঁতা দিয়া নাওরে আগ্গানি দেওয়া শুরু করে সেয়। বাইরে দিয়া তো তার হাত নাওয়ের নিয়মে নাওরে আগ্গাইতে থাকে, কিন্তু তার ভিতরটা য্যান হাতরথ থুবাইয়া বইয়া পড়তে চাইতে থাকে! চাইতে থাকে যে, সেয় যাইবো না, যাইবো না; আট্টু থাকবো!

মাথা-খরাপটার লগে হুদা কামেই বইয়া বইয়া হাবিজাবি কথা কইবো! আট্টু কথা কইবো! এমুন দবদবাইয়া লগ্গি ফালাইয়া হুমদাম ছুট দেওনের কী কাম! ইসুফ মিয়ায় থাকুক আট্টু। ইসুফ মিয়ার পরান তারে গুপ্তিভাবে এমনে ঠেলতে থাকে। অদিগে, বাইরে তার লাগতে থাকে শরম। সেয় কোন মোখে থাকবো! জুলিরে কী কইয়া বোঝাইবো যে, সেয় আছে দরকারেই। বেহুদা ফেদা প্যাঁচাল পাড়োনের লেইগ্গা বইয়া থাকতাছে না সেয়, জুলির সামোনে!

ভিতরে-বাহিরে এমুন দুই অবস্থার গুঁতাগুঁতি নিয়া ইসুফ মিয়ায় কোনোমতে এট্টু আগ্গায়। অইট্টুক আইসাই তার মোনে হয় যে, একবার তো দেখোনের কাম; মাথা-খরাপটায় কতো দূর গেছে! লগ্গি ফালাইতে ফালাইতে কোনোমতে ঘাড়টা ফিরায় সেয়। দেহো তামশা! যেমুনকার থির নাও জুলির, তেমুন থিরই ভাসতাছে। উয়ে মেলা দেয় নাই। নাওয়ে বওয়া দিয়া একদিষ্টে চাইয়া রইছে ইসুফ মিয়ার যাওনের দিগে।

‘যাস না?’ গলারে যতোখানি উঁছা করা যায়—কইরা, চিল্লানিটা দেয় ইসুফে। দিয়া, নাওয়েরে থির কইরা সেয় পুরা ফিরা খাড়ায় জুলির দিগে; ‘বইয়া বইয়া রইদে পোড়তাছস ক্যান, অই?’ ইসুফ মিয়ায় নাও থামায়, না, য্যান জুলির হুঁশ আসে! লগে লগে সেয় নাও বাওয়া শুরু করে নিজেগো বাড়ির দিগে। থির হাতে লগ্গিতে ভর দিয়া ইসুফ মিয়ায় দেখতে থাকে, নাওয়ে খাড়াইয়া অই যে জুলিয়ে লগ্গি বাইতাছে! অর কইচ্ছা-হইলদা খোপ খোপ কাপোড়ে অই যে, রইদের ঝাপোট লাগতে দেহা যাইতাছে! এই দূরের তেনেও দেহা যাইতাছে! অই যে!

অইটা কে? জুলিয়ে? দূরের তেনে চাইয়া দেখতে দেখতে আঁতকা ইসুফের চক্ষু য্যান উল্টা-সিধা কী দেখতে থাকে। ক্যান জানি অর মোনে অইতে থাকে যে, অইটা কিয়ের জুলি! জুলি না। অইটা হইতাছে বাইন্না পানিতে শাওন মাইস্যা সকালের রইদের ঝিলিকখান!

সদাইপাতি লইয়া যতো তুরুত আওন যায়, আহে ইসুফ মিয়ায়। মায় জিগায়, ‘নাও বান্ধছোস ভাও মতোন?’

পুতে কয়, ‘বান্ধি নাই!’

‘ক্যান? বাইন্ধা না থুইয়া গেলে, বাতাসে নাও কোনদিগে লইয়া যাইবো গা; তার হদিস থাকবো? জলদি নাও বাইন্দা আয়!’

‘বান্ধমু। তয় আগে গিয়া একটা কাম সাইরা আহি! হেইরপর বান্ধমু। নাওটা নিয়া এট্টু দূরে যাওনের কাম আছে মা!’

কী কাম?

বেশি কিছু না! এই দুই-চাইরটা শাপলা তোলবো ইসুফ মিয়ায়, আর লগে কয়টা ডুবও দিয়া আইবো!

শাপলা খাইবো পুতে, হেই কতা আগে কইয়া যাইবো না! তাইলে তো মায়ে এতখোনে কেউরে দিয়া তোলাইয়া, ভাইজ্জা থুইতে পারতো! মায় গ্যাজ গ্যাজ করতে থাকে। এমনে এই সেই আকাম কাম চলতে থাকলে, মায়ে সংসারের সব সিজিল করবো কখন! হাত আজাইর করবো কখন! আর যাইবোই কোনসুম! এমুন করলে মেলা দিতে দেরি অইয়া যাইবো না?

ইসুফ মিয়ায় মায়ের কতারে কানে তোলতে তোলতে, কোষা নাওটারে জোরতে এক ঠেলা দিয়া বহুত দূরে ভাসাইয়া আনে। তারপর বইঠঠাখান হাতে নেয়। যাইবো সেয় এই তো কাছেই। এতো কাছে যাইতে লগ্গির কাম পড়বো না; বইঠঠা দিয়াই সারোন যাইবো।

এইবারের বাইরা মাসে, জুলেখাগো বাড়ির ভিটিটুক খালি কোনোরকমে মাথা জাগনা দিয়া আছে, নাইলে বাইন্না পানি আইয়া পড়ছে এক্কেবারে ভিটির কানায় কানায়। নাওয়েরে একঠেলা দিয়া ভিঁড়াইয়া ইসুফ মিয়ায় জুলেখাগো ঘরের দিগে যায়।

উঠানে এমুন বেসময়ে কেটায় খাড়া? জুলেখার মায়ে রান্ধনঘর তেনে তরাতরি বাইর হইয়া দেখে, ইসুফ মিয়ায় আইছে! কী? কী বিত্তান্ত? কিছুর মিদে কিছু না, আঁতকা ইসুফ মিয়ায় ক্যান এই বাড়িতে। ‘কিরে বাজান?’

না, বিষয় তেমুন কিছু না। হইছে কী, ইসুফ মিয়ার মায় দুখা কদমা দিয়া পাঠাইছে চাচিরে।

লাউ না, গাছের কোনো লতাপাতা না, কোনো ফল-ফাকরি না, পিঠা-চিড়া না; এমুন দোপোরের কালে দিয়া পাঠাইছে এক পোটলা কদমা! আগে যতো যা পাঠাইছে, সব গাছ-গরানের জিনিস; নাইলে ঘরেরে এই-তাই। কদমা তো দেয় নাইক্কা কোনো কালেও!

ভাউজে কদমা পাঠাইছে ক্যান! জুলেখার মায় বুইজ্জা পায় না বিষয়টা কী! তয় সেয় জানে; ইসুফ মিয়ার মায়ে সম্পর্কে জুলির মায়ের ভাশুরের বউ। তার জাল লাগে সেয় ঠিকই—কিন্তু সেয় হইলো গিয়া বড়ো-মাইনষের বউ। তার যেসুম যা করোনের মোনে লয়, সেয় তাইই করে। তার মোনে লইছে কদমা পাঠাইতে, পাঠাইছে।

কদমার পোটলা জুলেখার মায়ের হাতে দিয়া ইসুফ মিয়ায় হুড়াতাড়া পাওয়ে তার নাওয়ের দিগে হাঁটা দেয়। ভিতরে দেখো তার পুরা অন্তর তারে কইতে থাকে, একবার চোখ তুইল্লা দেখি—জুলি হের মায়ের পিছে আইয়া খাড়াইছে; না, খাড়ায় নাই? একবার খালি দেহি! কিন্তু তার শইল সেই কথায় কান দেয় না। শইল হাঁটতে থাকে নাওয়ের দিগে, জোর পাওয়ে। শইল্লের য্যান কোনো ঠেকা নাই কোনো কিছু দেখার! কে কার পিছে আইয়া খাড়াইলো, কী খাড়াইলো না—হেইটা দিয়া তার কাম কী!

দেখছিলো সেইদিন ইসুফ মিয়ায়, মায়ের পিছে আইয়া জুলি খাড়াইছিলো, না খাড়ায় নাই? দেখছিলো? এক্ষণ, এই অসুইক্ষা দেহখান নিয়া পাটিতে কাইত হইয়া পইড়া থাকতে থাকতে, একবার ইসুফের মোনে অইতে থাকে যে, সেয় য্যান দেখছিলো জুলিরে অইসোম! দেখছিলো জুলিরে। শরমে জড়োমড়ো হইয়া কোনোমতে অর মা-র পিছে আইসা খাড়াইছিলো উয়ে! নাওরে জোর ঠেলা দিয়া তাতে চইড়া বইতে বইতে, ইট্টু চোখ তেছরা কইরা সেয় য্যান ঠিকই দেইক্ষা নিছিলো, মায়ের পিছে জুলি খাড়া।

নাকি দেখে নাই! আউজকা, এই একলা অসুইক্ষা শইল নিয়া, এই মেঘ-বাদলার ঝাপোট খাইতে খাইতে আউজকা অক্ষণ, তার মোন দেখো কেমুন খাবিজাবি খাইতাছে! কীসব কতা নিয়া খাবিজাবি খাইতাছে সেয়! কি ফায়াসালা করোনের লেইগা পরান ফাঁপোড় লাগতাছে? না, সেইদিন ইসুফে হাছাই দেখছিলো জুলিরে অর মায়ের পিছে! না কি আসোলে দেখে নাই! দেখছিলো? না কি না?

সঠিক মোনে করতে পারে না অখন ইসুফে। কোনোমোতেই দেহো মোনে আইতাছে না! কিন্তুক মোনে করোনের লেইগা দেহো তো কেমুন হাফোর-ফাপোর লাগতাছে তার। মোনে অইতাছে পরান য্যান ফাইট্টা যাইবো—মোনে করতে না পারলে! কিন্তুক মোনে আইতাছে না তার।

পাটিতে শোওয়া দিয়া আছে না সেয় থির-সুস্থির? আছে তো! তাও ইসুফের ভিতরটা, তার পরানটা কেমুন হরফরাইতাছে! য্যান সেইটা অইয়া গেছে তুফানে-পড়া এক নাও। খালি আউলা-পাতাইল্লা কাইত হইতাছে, খালি কাঁপতাছে, খালি টলতাছে! কোনদিগ তেনে কোনদিগে যে যাইতাছে, হদিস পাওন যাইতাছে না! ঘোলা ঘোলা, ধুঁয়া ধুঁয়া লাগতাছে সবকিছু!

এইত্তো অখন পুবের ঘরের খোলা বারিন্দায় একলা পড়া সেয়! এই যে বেধুম মেঘ নামছে দুনিয়ায়, এইটা তো চক্ষের দেহা ঘটোনা। এই যে এট্টু আগে শিল পইড়া উঠান-পইঠান ছয়লাব হইয়া, অখন আবার মাটির মিদে মিইশ্যা, নাইও হইয়া গেলো গা সেইসগল শিল; এইর সবই তো চক্ষের সামোনের ঘটনা। সেইটিরেও অখন খোনে খোনে ইসুফের মোনে অইতাছে য্যান, এটিও সত্য না! এটি স্বপন। স্বপন দেখতাছে ইসুফে। অই যে কতো কতা মোনে ওঠতাছে, পড়তাছে; সেওও স্বপন। হাছা না। এই যে বিষ্টির ছাঁট গতরে লাগতাছে, এরেও একবার লাগতাছে সত্য। একবার লাগতাছে সত্য না!

মেঘ-পইড়া তাগো উঠানখান ভিইজ্জা কেমুন সুপসুপা হইয়া পড়ছে! সেই উঠানরে দেখতে দেখতে চোখ দুইটায় টাটানি ধরে ইসুফ মিয়ার। সেয় কাহিল চোখ দুইখান খালি বোজে এট্টু, অমনেই অন্তরের কোন গহন ভিতরে, কোন এক ফাগুন মাসে আইসা ফুক্কি দেয়। একটা কুকিলায় ডাক পাড়া ধরে। টু হি! টু হি! টু হু! টু হু! টু হু!

এইটায় আবার আহে কোনহান তেনে! এতো জোরতে ডাক পাড়তাছে ক্যান এই পক্ষীয়ে! ইসুফের কানাপট্টি বয়রা কইরা দিতাছে দেহি অইটায়! ক্যান এতো টু হু! টু হু! টুহু! টুহি টুহি করতাছে এইটায়! একটা ঢিল্লা দিয়া পইখটারে খেদানি দেওনের একটা মানুষ নাই বাইত! সব কই গিয়া মরছে!

দেহো তো! কুকিলায় ডাক দিতাছে একদিগে, আরেকদিগে ইসুফ মিয়ায় জানি কই যাইতাছে গা! কোন এক ফাগুন মাসের পইল্লা দিনে যাইতাছে গা সেয়! কে কয় ইসুফ মিয়ায় শোওয়া! এই ত্তো দেহি সেয় আইসা খাড়াইয়া রইছে তাগো রাই-সইস্যার ক্ষেতের আইলে! নিরালা আইলের শেষ মুড়ায় কে বইয়া রইছে অমুন লেট দিয়া! একলা একলা অইটা কে বওয়া! কেটায় গো?

(চলবে)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন  (কিস্তি ১৩)​
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)​
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)​
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)