বাংলা সন ও পয়লা বৈশাখের উৎস সন্ধান

Looks like you've blocked notifications!

পয়লা বৈশাখ আমাদের দেশের প্রধানতম উৎসবের একটি। সবচেয়ে বড় কথা, উৎসবটি কোনো ধর্মবিশেষের নয়, এটি সমগ্র বাঙালি জাতির এক প্রাণের উৎসব। শুধু আমাদের দেশ কিংবা ওপার বাংলার বাঙালিরাই নন, বিশ্বের যত দেশে বাঙালির বসবাস রয়েছে, সবখানেই অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে পালন করা হয় নববর্ষের দিনটি। এ উৎসবের বর্ণিল ছটায় ভেসে যায় আমাদের দেশে বহুকাল ধরে অবস্থানরত ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনধারাও। পয়লা বৈশাখ অথবা বাংলা সন থেকে উৎসাহ পেয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে নববর্ষ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে এত যে আয়োজন, এবার দেখে নেওয়া যাক এর উৎস কোথায়।

‘সন’, ‘সাল’, ‘তারিখ’—শব্দ তিনটির প্রথমটি আরবি, দ্বিতীয়টি ফারসি ও তৃতীয়টিও আরবি। এদের অর্থ যথাক্রমে বর্ষ বা বর্ষপঞ্জি, বছর ও ইতিহাস। বাংলায় আরবি-ফারসি শব্দের প্রচলনের সঠিক দিনক্ষণ কিংবা হিজরি সনের প্রচলনের ইতিহাস কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলেও বাংলা সনের প্রবর্তন নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। আমরা সবাই জানি, বাংলা সনের জন্ম হয় সম্রাট আকবরের আমলে। তাঁর নির্দেশে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে (৯৯২ হিজরি) বাংলা সনের যাত্রা শুরু হয়। ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রুটিমুক্ত ও বিজ্ঞানসম্মত সন প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বলা হয়ে থাকে, বাংলা সনের মাধ্যমে তাঁর সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছিল। আর সে-সময়ে প্রচলিত হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাঁরই রাজজ্যোতিষী মহাপণ্ডিত আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে নিখুঁত এই সন উদ্ভাবন করেন।

বাংলা সন ছাড়াও এর অনুষঙ্গী হয়ে আরো একাধিক সৌর সনের প্রচলন হয় এ-সন প্রবর্তনের সমসাময়িককালে। এর মধ্যে ইলাহি সন অন্যতম। উল্লেখ্য, এটি তাঁর রাজ্য-সন। তবে তাঁর রাজত্বকাল-শেষে এটি আর টিকে থাকেনি। আকবরের সিংহাসন আরোহণের দিন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল, হিজরি ৯৬৩ সনের ২ রবিউস সানি, শুক্রবার। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার কারণে বাংলা সনসহ আরো কয়েকটি নতুন সনের প্রবর্তন হয় ভারতীয় উপমহাদেশে। এদের মধ্যে অন্যতম উড়িষ্যার আমলি, মহারাষ্ট্রের সুরাসান সন ইত্যাদি। সে-সময়ের নিয়মানুসারে ফসলের মাধ্যমে রাজকর পরিশোধিত হতো। তাই সন প্রতিষ্ঠাকালে ফসলের মৌসুমের দিকে বিশেষ লক্ষ রাখা হয়েছিল বলে এগুলোকে ফসলি সন বলা হয়। বাংলা সনও মূলত ফসলি সন।

এত কিছুর পর মনে প্রশ্ন জাগে, আকবর প্রবর্তিত এই সনকে কেন বাংলা সন বলা হচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানেও কি একে বাংলা সন বলে ডাকা হয়? তা অবশ্য নয়। মোগল-সাম্রাজ্যে বাংলা অধিভুক্ত হয় ১৫৭৬ সালে। এ অঞ্চলের নাম তখন সুবে বাংলা। তখন থেকেই বাংলাদেশে প্রচলিত অন্যান্য সনকে উপেক্ষা করে এই সন প্রবর্তনের ফলে ফসলের মাধ্যমে খাজনা দেওয়ার কাজে সুবে বাংলার কৃষকদের অনেক সুবিধা হতো। বলে রাখা ভালো, সম্রাট আকবর প্রবর্তিত বাংলা সনের আগেও এ দেশে প্রচলিত ছিল সেন রাজবংশের সর্বশেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার স্মারক লক্ষ্মণ সন (১১১৮ খ্রি.)। যা হোক, এই সনের সঙ্গে বাংলার কৃষকদের ব্যক্তি ও সমাজজীবনে একটি নিবিড় ও অচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি হয়। লোকগবেষক শামসুজ্জামান খানের মতে, ‘কৃষি এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের প্রধান অবলম্বন হওয়ায় বাংলা সন মানুষের নিত্যকর্ম ও রুটি-রুজির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। কারণ, উৎপাদন ব্যবস্থা সভ্যতার একটি অঙ্গ। বাংলা সন সেই মূল শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে রয়েছে।’

বলা বাহুল্য, হিজরি সন চান্দ্র সন আর বাংলা ও খ্রিস্টীয় সন সৌর সন। মজার ব্যাপার, বাংলা সন মূলত সৌর সন হলেও এর মাস গণনাপদ্ধতি কিন্তু চাঁদের পরিক্রমণের ওপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ এর মাস চান্দ্র পদ্ধতির। এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়কালকে চান্দ্র মাস বলে। আর এক সংক্রান্তি থেকে আরেক সংক্রান্তি পর্যন্ত সময়কাল সৌর মাস। স্পষ্টতই চান্দ্র ও সৌর সন সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতির। বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আধিক্য থাকায় তাদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণ, শ্রাদ্ধ-শান্তি চাঁদের হিসাব অনুযায়ীই হয়।

চান্দ্র পদ্ধতির হিসাবে প্রতি সৌরবছরের হিসাব থেকে ১০-১১ দিনের পার্থক্য ঘটে। তাই প্রতি তিন সৌরবছরে যখন সাড়ে ৩২ দিনের মতো হয়, তখন বছরের হিসাব থেকে এক মাস অতিরিক্ত ধরে মূল হিসাব থেকে বাদ দেওয়ার রীতি প্রচলিত রয়েছে। অতিরিক্ত এই মাসকে বলে মলমাস বা অতিরিক্ত মাস। সৌর সনের সঙ্গে চান্দ্র মাসের এই মিলকরণকে বলে শাবনমিতি। মলমাসে হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কোনোরকম পূজা-পার্বণ বা শুভকাজ করার বিধান রাখা হয়নি। সত্যিকার অর্থে, একে মাস বলে গ্রাহ্যই করে না তারা। সম্রাট আকবর মলমাসের এদিকটা সম্পর্কে বেশ সচেতন ছিলেন বলে তাঁর প্রবর্তিত সনে যাতে এ রকম দুর্বলতা না থাকে, সে সম্বন্ধে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। সম্রাট নির্দেশিত নতুন সনগুলো প্রবর্তনের পর আঞ্চলিক প্রাচীন সনগুলো ত্রুটিমুক্ত হয়ে আত্মপ্রকাশের সুযোগ লাভ করেছিল। বাংলা সন হলো তার পথপ্রদর্শক।

আরো একটি ব্যাপার উল্লেখ করতে হয়, হিজরি সন থেকে বাংলা সন উদ্ভূত হলেও এর গঠনপদ্ধতি অনেকটা ভারতীয় শকাব্দের মতো, অর্থাৎ সৌর সনের আদল রয়েছে এতে। আর এর মাস ও সপ্তাহের বিভিন্ন দিনের নামও নেওয়া হয়েছে শকাব্দ থেকে, কিছুটা এদিক-ওদিক করে। অবশ্য শকাব্দের মাসগুলোর নামের অনুক্রম বাংলা সন মেনে নেয়নি, যেমন—শকাব্দ শুরু হয় চৈত্র মাসে। বৈশাখ মাস আসে ঠিক এর পরপরই। সুদূর অতীতে অগ্রহায়ণ দিয়ে এই সন শুরু হওয়ার রীতি ছিল। এখন জেনে নেওয়া যাক শকাব্দ থেকে আবির্ভূত বাংলা সনের মাসগুলোর বুৎপত্তিগত নাম। এও বলে নেওয়া ভালো, আকবরের সময়ে মাসের প্রতিদিনের জন্য স্বতন্ত্র নাম ছিল। কিন্তু এগুলো মনে রাখা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হওয়ায় সম্রাট শাহজাহান তাঁর ফসলি সনে সেগুলোকে সাপ্তাহিক পদ্ধতিতে রূপান্তর করেন। ধারণা করা হয়, কোনো এক পর্তুগিজ পণ্ডিতের সহায়তায় ইউরোপে ব্যবহৃত রোমান নামকরণ পদ্ধতির সঙ্গে মিল রেখে এর সপ্তাহের দিনগুলোর নাম রাখা হয়। খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জির মতো বাংলা সপ্তাহ শুরু হতো রোববার দিয়ে। বাংলা সন প্রবর্তনের কিছুকাল পর্যন্ত মাসগুলোরও নতুন নামকরণ করা হয়েছিল। পরে শক রাজবংশের স্মরণার্থে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত শকাব্দ থেকে এ নামগুলো নেওয়া হয়েছে। একেকটি তারকা থেকে বাংলা মাসগুলোর নাম তৈরি হয়েছে। বিশাখা তারকা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃডত্তকা থেকে কার্তিক, অগ্রাইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। উল্লেখ্য, চৈত্র ছিল শক অব্দের প্রথম মাস। যেহেতু ৯৬৩ হিজরির মুহররম মাস বাংলা বৈশাখ মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, সেহেতু চৈত্র মাসের পরিবর্তে বৈশাখকেই বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করা হয়।

আমরা জানি, খ্রিস্টীয় মাসগুলোর দিনসংখ্যা কোনোটির ৩০ বা ৩১, আবার কোনোটির (ফেব্রুয়ারি) ২৮। যেমন—জানুয়ারি মাস যেকোনো খ্রিস্টীয় সালে একই সংখ্যক দিনের হবে, কোনোক্রমেই কমবেশি হবে না; ফেব্রুয়ারির কথা অবশ্য ভিন্ন। যা হোক, সৌর সন বলে কোনো একটি মাসের দিনগুলোর সংখ্যা সে-মাসটিতে অপরিবর্তিত থাকবে, সেটি সম্ভব। কিন্তু বাংলা সন যেহেতু সৌর সন হওয়া সত্ত্বেও মাস গণনা হয় চান্দ্র মাসের ভিত্তিতে, অর্থাৎ মাসের দিন গণনা করা হয় এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়কালকে, আর প্রতি পূর্ণিমার সময়কালের দৈর্ঘ্যও যেহেতু এক নয়, তাই বাংলা সন নিয়ে অনেক সময় বিব্রত হতে দেখা গেছে অনেককে। খ্রিস্টীয় সনের মতো কিংবা খ্রিস্টীয় সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলা মাসের প্রতিটি দিন ধার্য করার ক্ষেত্রে দিনক্ষণ নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম না থাকায় বাংলাদেশের মানুষ বেশ অসুবিধা ভোগ করে আসছিলেন। বাংলা একাডেমি উদ্যোগী হয়ে বেশ কয়েক বছর আগে এই সীমাবদ্ধতা নিরসন করার জন্য বিশেষজ্ঞদের আহ্বান করে। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে এ জটিলতা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হয়ে ওঠে। এখন বাংলা সনের প্রতিটি দিনই খ্রিস্টীয় সনের প্রতিটি দিনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবারই খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জিতে যখন আসে ১৪ এপ্রিল, বাংলা বর্ষপঞ্জিতে তখন হয় পয়লা বৈশাখ, বাংলা বর্ষ শুরুর দিন।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশই তাদের প্রচলিত বর্ষের শুরুর দিনক্ষণটিতে হৈ-হুল্লোড় করে উৎসবে মেতে ওঠে। বাংলা সনের বেলায়ও ঠিক তাই। এ সন প্রবর্তনের শুরুটাই হয়েছিল উৎসবের আমেজ দিয়ে। পাকিস্তান আমলে সামরিক জান্তার নির্দেশে বাঙালি জীবন থেকে আঞ্চলিক সংস্কৃতি মুছে ফেলার যে অপসংস্কৃতি চর্চা শুরু হয়েছিল, তা ঠেকানো গেছে বাঙালির পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠান প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া অনেক লড়তে হয়েছে বাঙালিকে তার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক এ জাতীয় উৎসবে আবহমান বাংলার বর্ণ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ দারুণভাবে ধরা দেয় বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায়।