গল্প
আমার খণ্ডকালীন স্বামীর মৃত্যু
(এন মাধবন সমসাময়িক মালয়ালম সাহিত্যের একজন নেতৃস্থানীয় লেখক, যার ছোটগল্প, উপন্যাস, ফুটবলবিষয়ক কলাম ও ট্রাভেলগ ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। কোচিনে জন্ম তাঁর। কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সময় তিনি লিখতে শুরু করেন। ১৯৭০ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প ‘শিশু’ শীর্ষ পুরস্কার জিতে নেয়। এই গল্পটিই বাংলায় তর্জমা করেছেন মির্জা মোনালিসা। মূল গল্পটির নাম ‘শিশু’ হলেও এখানে তা পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘আমার খণ্ডকালীন স্বামীর মৃত্যু’।)
মুকুন্দন আমার খণ্ডকালীন স্বামী। কারণ সে সব সময় আমার সঙ্গে থাকে না। একই সঙ্গে নানা ভূমিকা তাকে পালন করতে হয়। হ্যাঁ সে একজন পাকা অভিনেতা। কাগজে প্রায়ই লেখা হয় মুকুন্দন থিয়েটারের জাঁদরেল অভিনেতা। সে আমার দুই সন্তানের পিতা, তাদের অভিভাবক, আমার শ্বাশুড়ির প্রিয় দ্বিতীয় পুত্র, সুবীরের বাল্যকালের বন্ধু এবং প্রতিদ্বন্দ্বী। আবার সম্প্রতি পরিচয় হওয়া সাংবাদিক অনিল সাকসেনার সহকর্মী। মুকুন্দনের শখ ছবি তোলা। শখ বললে ভুল হবে। নেশা। প্রায়ই সে তার প্রিয় ক্যামেরাটি নিয়ে বের হয়ে যায়। মানুষের মুখের ছবি ধরে রাখে। ছবি তোলার জন্য কোথায় সে যায় না?
রাজস্থানের মরুভূমি, বরফ আচ্ছাদিত হিমালয়। তবে প্রচণ্ড ইগো তার। একই সঙ্গে তার মধ্যে রয়েছে নানামুখী সত্তা। সে খুবই ভালো বস, আবার দেশের পলিটিকস নিয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শহরের পুরোনো জিনিসপত্রের বাজার থেকে অ্যান্টিক জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসে। জোকস পড়তে ভালোবাসে। তবে এমন জোকসের বই তার পছন্দ যা পড়ে আমার কখনো হাসি পায়নি।
যখন ও বাড়িতে থাকত তখন ড্রইংরুমের সোফার ওপর গুটিশুটি মেরে শুয়ে বাচ্চাদের কমিকস পড়ত। যখন হিচককের ছবি নিয়ে এমনভাবে কথা বলত, মনে হতো হিচককের ছবি বোঝানোর দায়িত্ব স্বয়ং হিচকক তাকে দিয়ে গেছেন। পোশাকের ব্যাপারে মুকুন্দন খুবই শৌখিন। ব্র্যান্ডেড শার্ট পরত সব সময়। আর রাতে অবশ্যই বরফ কুচি দেওয়া হুইস্কির গ্লাসে ঠোঁট তাকে রাখতেই হতো। আমি দেখতাম হুইস্কির মধ্যে ছোট ছোট বরফগুলো কপারের টুকরোর মতো ভাসছে। হুইস্কি পান করার সময় সে পুরোনো গ্রামোফোন রেকর্ড বাজাত। একই সঙ্গে সে আমাদের সন্তানের জন্য গল্প বানাত- এই কাজ সে সব সময় করত। সবচেয়ে বড় কথা সে আমাকে বিছানায় যথেষ্ট আনন্দ দিত।
মুকুন্দন সম্পর্কে যা বলা হলো তা সব অতীতকাল। কারণ দুই মাস হলো সে মারা গেছে। আর তাঁর মৃত্যুর পর আমি জানতে পারলাম এতকাল পুরোপুরি মিথ্যের মধ্যে আমি বসবাস করেছি। যা আমি ভুলতে পারি না একদণ্ডের জন্যও। এই একটি ঘটনা আমাকে এলোমেলো করে দিল। আমার জানা পৃথিবীর দরজা বন্ধ করে দিল সশব্দে। আমি জানতাম চল্লিশ বছর জীবনে মুকুন্দন কিছুই লুকায়নি আমার কাছে। তার সেই জন্ম। ছোট্ট একটি শহরের রেলওয়ে কর্মকর্তা ছিল তার বাবা। তার জন্মের সময় সে বাঁচবে নাকি মাকে বাঁচানো হবে এই নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে যখন চরম টানাপড়েন তখন মানুষের কাছে ঈশ্বর বলে পরিচিত ড. অলকেষ তাকে এবং তার মা দুজনকেই বাঁচিয়ে দেন। এ কথা মুকুন্দন কতবার আমায় বলেছে।
লন্ডনে পড়াশোনা করার সময় সালমান রুশদির সঙ্গে একসঙ্গে পাবে বিয়ার খেয়েছে। তখনো সালমান রুশদি অতটা বিতর্কিত হয়ে ওঠেনি। আমি যোগ করতাম, এই নিয়ে তুমি আমাকে গল্পটি একশোবার বলেছ। মুকুন্দন যেদিন মারা গেল আমার মনে আছে তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। সেদিন বাইরে এমন গরম পড়েছিল যে রাস্তায় বেরুনো যাচ্ছিল না। ধীরে ধীরে রাস্তার সেই গরম আমাদের বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। সেই সময় কোত্থেকে এক দমকা হাওয়া এলো। মুকুন্দন আর আমি টেরাসে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম একটি পরিণত মেঘ জড়ো হচ্ছিল ঈষাণ কোণে। পুরোটা সন্ধ্যা যেন গ্রাফিক ডিজাইনে করা হয়েছে। আমাদের বাগানের অশোক গাছের শাখা এমনভাবে দুলতে লাগল যেন কোনো উর্বশী কত্থক নৃত্য করছিল হাত নাড়িয়ে। প্রথম বজ্রপাতের পরই বৃষ্টি শুরু হলো। সঙ্গে শিলাপাত। যে আমি বৃষ্টি দেখে মোটেও আনন্দিত হই না কখনো, সেই আমিও বৃষ্টির মোহে পড়ে গেলাম। মুকুন্দনকে বললাম তুমি যদি বৃষ্টি দেখতে চাও তাহলে তোমাকে চেরাপুঞ্জি যেতে হবে। মুকুন্দন নিঃশব্দে বৃষ্টি দেখতে লাগল। আমি ভাবলাম আবার আমি একা হয়ে গেলাম। মুকুন্দন কোনো কথা না বলে আমাদের শোবার ঘরের দিকে চলে গেল।
শোবার ঘরের বাইরের দেয়ালে মুকুন্দনের ছোটবেলার ছবি। যেদিন তাকে প্রথম মুখে ভাত দেওয়া হয় সেদিনের ছবি। ছবিটি এখন অনেক ধূসর হয়ে গেছে। চাচার কোলে শিশু মুকুন্দন। মুকুন্দন সেদিকে তাকিয়ে আছে। আমার মনে হলো, এক শিশু আরেকটি শিশুর ছবি দেখছে। মুকুন্দনের ঘাড়ের পেছনে শয়তানের চোখের মতো একটি কালো দাগ আছে। হঠাৎ আমার ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো। আমি পেছন দিক থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। মুকুন্দন ছবির দিকে তাকিয়েই বলে উঠল, শিশুদের জীবন কত সহজ তাই না? আমি মুকুন্দনকে জড়িয়েই আছি। আমি জানতাম এরপর সে কী করবে। কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে সে সেসবের ধারেকাছ দিয়েও গেল না। যখন সে আমাকে পেছনে ফেলে শোবার ঘরে ঢুকল, তখন তাকে অনেক দূরের মানুষ মনে হলো আমার। শোবার ঘর থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেল। আমি গাড়ির হেডলাইটের সামনে বৃষ্টির ধারা দেখলাম। হেডলাইটের আলো ফুলের গাছের ওপর পড়ল। ওটাই ছিল মুকুন্দনকে আমার শেষ দেখা। এরপর তাকে যখন দেখলাম, তখন সব শেষ হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার পরে তাকে দেখলাম কাপড়ের স্তূপের মধ্যে। শুকনো, গাঢ় ঠোঁট, প্রাণহীন ঘুম ঠিক মুকুন্দনের সঙ্গে খাপ খায় না।
আমার শিশুরা তাদের খণ্ডকালীন বাবাকে কি মনে রাখবে?
হৃষিকেশ যখন দশে পা রাখবে, তখন মুকুন্দন মারা গেল। মুকুন্দনের মৃতদেহ দেখে সে আমার চারপাশে ঘুরল বেশ সচেতনভাবে। হৃষিকেশ ছিল আমার আর মুকুন্দনের জীবনের একমাত্র যোগসূত্র। আমরা তখন নবীন দম্পতি। বাচ্চা মানুষ করার কিছুই বলতে গেলে আমরা জানতাম না। বাজার থেকে মুকুন্দন একের পর এক খেলনা কিনে আনত। সে বাদ্যযন্ত্রের মতো শব্দ করতে পারত। হৃষিকেশ যখন বিরক্ত করত, তখন মুকুন্দন দুই ঠোঁট স্ফীত স্তনের মতো করে অদ্ভুত শব্দ করত। সেই শব্দে হৃষিকেশ আরো জোরে কেঁদে উঠত। আমার চার বছরের মেয়ে ছোট্ট ডোরি, মুকুন্দন যখন তার দীর্ঘ পরিভ্রমণ শেষ করে বাড়ি ফিরত, দরজায় বেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে সে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিত। মুকুন্দন তাকে কোলে তুলে নিত। ওর হাতে থাকত অসাধারণ সব খেলনা আর চকলেট। শিশুদের হয়তো এ রকম দু-একটা স্মৃতি থাকবে।
মুকুন্দনের বিদায়ের দিন আমি কেবল দুটো ঘটনা স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি। একটি মেয়ে। কালো সালোয়ার কামিজ পরা। সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গী, লম্বা গলার অধিকারী। বেতস লতার মতো লাগছিল মেয়েটিকে। মুকুন্দনকে যে খাটিয়ায় শোয়ানো হয়েছিল, সে সেই খাটিয়ার পা স্পর্শ করল। হাতে করে নিয়ে আসা ফুলগুলো রাখল তার বুকের ওপরে। তারপর সারি সারি শোকার্ত মানুষের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেল। একটু দূরে মানুষের কাছ থেকে সরে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। দ্বিতীয়টি আমার আকাঙ্ক্ষা। ততক্ষণে আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমি তখন অস্থির, সেই সমস্ত লোকজনের মতো যারা বিদায়ী ট্রেনযাত্রীদের হাত নাড়ার জন্য প্রস্তুত। সমস্ত স্মৃতি যেন নিঃশেষ প্রায়। এ সময় আমার হৃষিকেশ বলে উঠল, গুড বাই আচ্চন। কোনোরকম কান্না ছাড়াই। আমি বুঝতে পারলাম, এ কথাটি বলার জন্য সে কতটা পরিশ্রম করেছে। আমি তার গালে চুমু খেলাম, যা তাকে আত্মসম্বরণের লালিমা এনে দিল।
সেই সন্ধ্যায় সবাই যার যার কর্তব্য শেষ করে চলে গেল, শুধু আম্মা ছাড়া। আর আমি খুবই নিঃসঙ্গ না হয়ে ঘুমে কাঁদা হয়ে গেলাম। কোনো কিছুই মনে না থাকা ঘুম, কেবল শরীরের ক্লান্তির জন্যই সম্ভব। অথবা মন শরীরকে অন্য একটি জগতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরের দিন সকালে আমি গভীর ঘুম থেকে উঠলাম, অলস চোখে জানালা দিয়ে তাকালাম। তুলো গাছটিতে পাখিদের কিচিরমিচির সকাল হওয়া ঘোষণা করছিল। ভোরের সেই বাতাসে তাদের সুর মিশে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে আমার মনে হলো মুকুন্দন আমার সঙ্গে নেই। আমি আমার চোখ বন্ধ করলাম। এবং কোনো রকম কান্না না করে পুরোপুরি অনুভব করতে চেষ্টা করলাম কী হয়েছে আমার। সে সময় আমি বেঁচে থাকাকে মৃত্যুর চেয়ে বড় বলে মনে করলাম। সেই অমোঘ বাণী আমার মনে এলো, একে মৃত্যু বলো না। এটা ঠিক যে জীবনের সমাপ্তি হয়েছে বিশেষত মৃত্যুর ভেতরে। আমার মন অপ্রতিরোধ্যভাবে মৃত্যুর বিষয়ে কথা বলতে লাগল।
আমাদের কুকুর ব্রুনো যে সব সময় বিছানার পাশে শুয়ে থাকে (সেও ভুলে গেছে কিছুক্ষণ আগেও তার প্রভু ছিল) সে শুয়ে আছে কান খাড়া করে, আমি দেখতে পেলাম পোর্চের মাঝে সে শুয়ে আছে। হৃষিকেশ সন্তর্পণে দরজা খুলল, তার ক্রিকেট ব্যাটটি নিয়ে রুমে এলো। আর তাকে অনুসরণ করল ডোরি। তারা দ্বিধান্বিতভাবে একবার আমার দিকে তাকাল। আমার মুখের মধ্যে কোনো রকম বৈসাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করল। আমি যেন ইশারায় তাদের অনুমতি দিলাম এমন ভেবে তারা কাঁদতে শুরু করল। আহারে! তারা এখন কাঁদছে তাদের খণ্ডকালীন বাবাকে স্মরণ করে। তাদের কান্না বিস্তৃত হলো আম্মা এবং আমাদের কাজের মেয়েটির মধ্যে।
গতকালের পত্রিকাগুলোতে প্রায় সবাই মুকুন্দনের মৃত্যু সংবাদ ছেপেছে। মুকুন্দন শহরের একজন জাঁদরেল মঞ্চ অভিনেতা ছিল। নানাজনের শোকবার্তা। একটি পত্রিকা অবশ্য আমাদের মেয়ের নাম ভুল ছেপেছে। ডোরির নাম ইসাডোরা। সে জায়গায় লিখেছে ঐশ্বরিয়া।
মুকুন্দন যখন আমাদের মেয়ের নাম ইসাডোরা রাখল, তখন আমি নিষেধ করেছিলাম।
‘এটা হৃষিকেশের মতো ট্রাডিশনাল নাম নয়।’
‘হৃষিকেশ আমার বাবার নাম। আমরা বাবার নামে সন্তানের নাম রাখার ঐতিহ্য খুব বেশিদিন আগে পাইনি। এটি ওই চিন্তাধারারই বহিঃপ্রকাশ।’ আমি বললাম আমার ছেলের নাম আমি আমার বাবার নামে রাখব।
‘কিন্তু ইসাডোরা’
‘আমাদের মেয়ে ইসাডোরা ডানকানের মতো হবে- সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্তা নিয়ে বেড়ে উঠবে সে।’
এরপর তিনদিন ধরে মুকুন্দন কেবল ইসাডোরা সম্পর্কে বলতে লাগল। ‘ইসাডোরা যে তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নৃত্য করত। নাচের সমস্ত পুরোনো প্রথা ভেঙে ফেলেছিল সে। সে নাচের মুদ্রা এনেছিল গ্রিক দেবদেবীর ভাস্কর্য থেকে। ইসাডোরা কাউকে পরোয়া করত না। সে একের পর এক প্রেমিক পাল্টাতে থাকে। তখন চারদিকে কেবল একটাই নাম ইসাডোরা, ইসাডোরা...’
মুকুন্দন ছিল এ রকম। সে তার কথা বাতাসে ছড়িয়ে দিত। যতক্ষণ না সে যা বলছে তা মানা হচ্ছে।
মুকুন্দন মারা যাওয়ার পর এটাই আমার প্রথম স্মৃতি। আমি জানি না কেন আমার এই স্মৃতিটাই মনে এলো- ডোরির নামকরণ? সে আমার ইচ্ছাশক্তিকে কোথায় চালিত করছে? এটা হলো আমাদের স্মৃতি নির্বাচন যা আমরা আমাদের জীবনী লিখতে ব্যবহার করি। সে সময় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আত্মোৎসর্গের ভূমিকা নেব। আমি মুকুন্দনের খারাপ স্মৃতির কথা মনে করব না। সেগুলো আমি ধ্বংস করে দেব।
আমার সবচেয়ে আনন্দময় স্মৃতি ছিল দুই বছর আগে। এটি ছিল আমার জন্য মন্ত্রমুগ্ধ মে ডে। বাতাস থেকে তখনো ঠান্ডা অনুভূতি দূর হয়নি। এ সময় আমার চিকেন পক্স হলো। বালকের স্তনবৃন্তের মতো গোটায় ভরে গেল আমার সারা শরীর। এ সময় সারা শরীরে জ্বর ছড়িয়ে পড়ল। মে মাস তার ম্যাজিক দেখানো বন্ধ করলে সত্যিকারের গরম পড়ল। এদিকে আমার জ্বর খুবই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেল। দুই সপ্তাহ একনাগাড়ে সে আমার শয্যাপার্শ্বে বসে ছিল। দুই সপ্তাহ পরে সে উঠল। ‘আমি তোমার জন্য একটি গাছ আনতে যাচ্ছি।’ সে কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। গরমে তার সমস্ত মুখ তখন লাল হয়ে গেছে। সে বলল, আমরা এমন একটা জায়গায় থাকি যেখানে কোনো গাছ নেই। এখানে কেবল ইলেকট্রিক খুঁটি। নামেই বসন্তনগর। আমি গাড়ি চালিয়ে অনেক দূর থেকে একটি নিমগাছ এনেছি।’
‘নিমগাছ?’
‘তোমার এখন চিকেন পক্স তাই নিমপাতা সেদ্ধ করে স্নান করতে হবে।’
সেই ঘটনার পর আরো কিছুদিন মুকুন্দন বাড়িতে ছিল। এ সময় আমি অনুভব করতাম হৃষিকেশ কেমন ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠেছে। সারাক্ষণ মুকুন্দন আমার পাশে বসে থাকে। আমাদের শোবার ঘর গাঢ় পর্দায় ঢাকা। যে সময় গুটিগুলো শুকাতে শুরু করল, মুকুন্দন আমাকে গা চুলকানো থেকে বিরত রাখত। সে নিমপাতা সেদ্ধ করে স্নান করাত। সে আমার নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে বলত, আমি চিতা বাঘিনী। আর সে হাসত।
আমার শরীর আবার নতুন পাতার মতো সতেজ হয়ে উঠল। আমি যখন আবার গৃহবধূ হলাম, আমি দেখলাম মুকুন্দন তার কাপড়চোপড় ভাঁজ করছে। একটি সুটকেসে কাপড়, ক্যামেরা, ফিল্ম রোল ভরছে। সে জানাল, আমি যাচ্ছি। আমি এক সপ্তাহ পর ফিরে আসব।
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘আমি একা একা কিছুদিন ঘুরতে চাই।’
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘আমি ভাবছি রাজস্থানের দিকে যাব।’
‘এই গরমে ওই মরুভূমিতে কীভাবে যাবে তুমি?’ আমি অবাক হযে তাকে প্রশ্ন করলাম।
রাস্তাটা ঠিক মরুভূমির মধ্য দিয়ে। আমি একাকী গাড়ি চালাব। শুনেছি সেখানে বেশকিছু হিজড়া থাকে। আমি তাদের ছবি তুলব। আমি একটি অ্যালবাম করতে চাচ্ছি কিছু এ রকম মুখ দিয়ে।
তখন ছিল গরমের ছুটি। যদিও আমি জানতাম এ সময় আমাকে কিংবা বাচ্চাদের সে সঙ্গে নেবে না। যদিও মুকুন্দন কখনো আমাদের অবহেলা করে না। একই সঙ্গে মুকুন্দন নিজের এবং অন্যের স্বপ্ন তার মাঝে ধারণ করে।
মার্চের এক রোববারে মুকুন্দন মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে ফিরে এলো। কোত্থেকে সে একটি পুরোনো গ্রামোফোন রেকর্ড জোগাড় করে এনেছে। সম্ভবত সে এটি পেয়েছে পুরোনো জিনিসপত্রের মার্কেটে। সে খুবই অভিভূত ছিল তার অ্যান্টিক গ্রামোফোনটি নিয়ে। এর ফানেল শেপ স্পিকার। সে যখন ওটি বাজাতে শুরু করল আমি বললাম, তুমি কি ভলিউমটা একটু কমাবে?
‘এর মাঝে কোনো ভলিউম কনট্রোলার নেই।’
হৃষিকেশের পরীক্ষা চলছে।
‘এটি আবদুল করিম খানের মিউজিক।’ মুকুন্দন গ্রামোফোন বন্ধ করতে করতে বলল। বাই দ্য ওয়ে হৃষিকেশ পড়াশোনায় কেমন?
‘তুমি জান না? তুমি তো রিপোর্ট কার্ডে সই করো।’
‘আমার মনে নেই।’
মুকুন্দন তার গাড়ির চাবি নিয়ে উঠে গেল হয়তো আবারও কোনো লোনলি ড্রাইভে যাচ্ছে। এ সময় অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলল, আমি তো একজন অভিনেতা। থিয়েটার করি। থিয়েটার মানে কী? থিয়েটার হলো জীবন। দৈনন্দিন জীবন থেকে নেওয়া খণ্ড খণ্ড চিত্র।
এ কথা বলে যেন সে নিজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে চাইল।
এই খণ্ডকালীন অভিনেতার নাট্যগোষ্ঠী ‘দিল্লি নাটক ফ্যাক্টরি’ প্রতিবছর একটি করে নাটক মঞ্চস্থ করে। তারা তাদের সর্বশেষ নাটক মঞ্চস্থ করেছে কামানি অডিটরিয়ামে। শো মঞ্চস্থ হয়ে যাওয়ার পর আমি বরাবরের মতো সেদিনও মঞ্চের পেছনে সাজঘরে ঢুকলাম তাকে অভিনন্দন জানাতে। আমি মুকুন্দনকে দেখলাম আরো অনেক অর্ধনগ্ন পুরুষদের মধ্যে। তাদের শরীরের ঘাম লাইটের আলোতে চিকচিক করছিল। সে তখনো তার অভিনয়ের মধ্যে ডুবে ছিল। তার চোখ দুটি অনেকক্ষণ পর যেন স্পটলাইটে জেগে উঠল। মুকুন্দন তার চোখ আধবোজা রেখেই বলতে লাগল, এই যে এখানে গাড়ির চাবি। বাড়ি যাও।
‘তুমি?’
‘আমরা এখন ময়ূর হোটেলের ডিসকোতে যাব সেলিব্রেট করতে। আমার ফিরতে দেরি হবে।’
আমি দেখলাম অন্য মহিলারা ঠিকই তাদের পুরুষদের সঙ্গে যাচ্ছে।
গাড়ি চালাতে গিয়ে আমি সামনে যে ক্যাসেট পেলাম সেটাই চালিয়ে দিলাম। জোরে সেটি বাজতে লাগল। এই কৌশল আমি আমার ছোটবেলা থেকে ব্যবহার করি। কোনো খারাপ চিন্তা মনে এলেই আমি গান বাজিয়ে তা বন্ধ করে দেই। যদি সব পুরুষ তাদের স্ত্রীদের নিয়ে ডিসকোতে যেতে পারে, তাহলে আমার যেতে বাধা কোথায় ছিল? কেন আমি সেখানে অপাঙতেয়? কিন্তু এত দৃঢ়ভাবে মুকুন্দন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেনি কখনো। কিন্তু এর পরও আমি তাকে ঘৃণা করতে পারছি না।
বাচ্চাদের সামনে যাতে কাঁদতে না হয় তাই আমি গাড়িটি রাস্তার পাশে অন্ধকারে পার্ক করলাম। আমি স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করলাম। পুরুষরা যেমন নিজেদের আড়াল করার জন্য করে থাকে। সে রাতে মুকুন্দন ৩টার সময় বাড়ি ফিরল। সে আমাকে ঘুমন্ত মনে করে আমার গালে চুমু খেল। আমি চোখ খুলে দেখলাম, সে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে সময় আমার গাল বেয়ে অবিরল ধারায় নোনা পানি বইতে শুরু করল।
‘ফেরার পথে আমি তোমার জন্য একটি অর্কিড কিনে এনেছি।’ সেলোফেন পেপারে মোড়ানো ফুলটি সে আমার দুই স্তনের মাঝখানে রাখল। ফুলটির কলির লম্বা ধারালো হলুদ এবং লাল প্রান্তগুলো ছিল আমার সম্পূর্ণ অচেনা। আমি আমার বাহু দিয়ে তার কণ্ঠ জড়িয়ে ধরলাম। নাটকীয়ভাবে আমি তার হুইস্কি পান করা ঠোটে চুমু খেলাম। সেখান থেকে প্রাচীন ওক গাছের গন্ধ পেলাম।
শরীরবিদ এবং ঝানু অভিনেতার মতো মুকুন্দনের শরীর যন্ত্রের মতো বেজে উঠল। যদিও সে ছিল দক্ষ প্রেমিক কিন্তু কোথায় যেন দূরত্ব অনুভব করলাম আমি। আমার মনে হলো পেছন থেকে কেউ প্রম্পট করছে আর সে অভিনয় করছে। আর আমি ড্রেস সার্কেলে বসে সে অভিনয় দেখছি। এটা হয় আমি আর সে যখন একসঙ্গে থাকি কিংবা একা একা থাকি তখনো মনে হয় কেউ প্রম্পট করছে, আমরা অভিনয় করছি। মুকুন্দনের মৃত্যুর পর আমি আমি অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। তাদের চোখ, কপালের ভাঁজ, তাদের অঙ্গভঙ্গি। তাদের মধ্যে ছিল শোকের চেয়ে মুকুন্দনের অসময়ে চলে যাওয়ার বিরক্তি। যেমনটা হয়েছিল জন লেনন কিংবা এলভিস প্রিসলির মৃত্যুর পর। যারা এসেছিল তারা সবাই ছিল মৃত অভিনেতার প্রিয়জনের মতো। কিন্তু কাউকে তেমনভাবে শুভাকাঙ্ক্ষী বলা যাবে না। আমার যতদূর মনে পড়ে কেবল একটি কণ্ঠস্বরই আমি শুনতে পেয়েছিলাম, মুকুন্দন বলে ডাকছিল। সেই লম্বা মেয়েটি যার পরনের কালো সালোয়ার কামিজ, যা লতার মতো তাকে বেষ্টন করে ছিল।
প্রথমে আমি ভাবলাম- মুকুন্দনের ছোটবেলার বন্ধু সুবীরকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করি। কিন্তু সুবীর কী করে বলবে? ওদের সঙ্গে আমাদের দেখা নেই বহুকাল। ওটা এখন সম্পর্কের ডুবে যাওয়া একটি অধ্যায়। কিছুদিন ধরে থেমে থেমে চলার পর সম্পর্কটি একবারে শেষ হয়ে গেছে। তাই আমি সাংবাদিক অনিল সাক্সেনাকে জিজ্ঞেস করলাম। মুকুন্দনের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর ধরে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সে বোধহয় একা ছিল। তাই প্রথম রিংটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে ফোনটি তুলল। অনিল, আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি কি ওই মেয়েটিকে চেনেন যে মুকুন্দনের শেষকৃত্যের দিন উচ্চস্বরে কাঁদছিল।
না, আমি ভাবলাম আমি তোমাকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করব।
তুমি কখনো তাকে দেখোনি?
কে হতে পারে? তার অফিসের কেউ? স্টেনো?
নানা আমি তাদের সব্বাইকে চিনি।
‘মুকুন্দনের গ্রুপের কেউ? দিল্লি নাটক ফ্যাক্টরির?’
‘না, সে ওখানকার নয়, আমি তাদের প্রত্যেককে চিনি।’
তারপর আমি রবি মিনহাজকে ফোন করলাম। মিনহাজ প্রায় নিয়মিতই মুকুন্দনের নাটকের নির্দেশনা দিত। হ্যাঁ রবি সেই মেয়েটিকে চেনে। তার নাম নলিনী। একটি নাটকের স্কুলের শিক্ষক সে। বয়স টেনেটুনে ২৫-এর বেশি হবে না। ১৯৯৩ সালের ব্যাচ। মাঝেমাঝে সে তার স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে মুকুন্দনের নাটকের রিহার্সাল দেখতে যেত। কলেজের ভেতরেই এক রুমের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। কলেজটি শহরের একমাত্র মার্কেটের পাশে।
আরেকটি শেষ কাজ বাকি ছিল । মুকুন্দনের ছবি বড় করে দেয়ালে টাঙানো। আম্মা, আমি এবং সন্তানরা মিলে মুকুন্দনের মধ্য পঁয়ত্রিশের একটি ছবি দেয়ালে টাঙানোর জন্য ঠিক করলাম। ছবিটি এনলার্জ করতে দেওয়া হলো।
যখন আমি রমা স্টুডিওতে ছবি এনলার্জ করার জন্য গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ করেই অনুভব করলাম আমাকে নলিনীর সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি কখন তার দরজায় বেল টিপলাম মনে নেই। যখন সে দরজা খুলল সে যেন অনেকটা ভব্যতার খাতিরেই বলল, আমি জানতাম তুমি আসবে।
রুমটি অনেক বড়। কিন্তু পাতলা কম দামের পর্দা ভেদ করে ভেতরে সূর্যের আলো আসছিল। তাই রুমটিকে আকৃতির চেয়ে ছোট দেখাচ্ছিল।
ঘরের মাঝে কয়েকটি বেতের চেয়ার এবং ম্যাট্রেস এলোমেলো হয়ে আছে। ঘরটির এককোণে একটি ব্রোঞ্জের কলসি। একটি বাতি পুরো ঘরটিকে স্পট লাইট ফেলে মঞ্চের মতো নান্দনিক করে রেখেছে। একটি গোলমতো ক্যাকটাসের পাত্র রাখা হয়েছে ফুলদানির ওপর। তার পাশে মুকুন্দন এবং নলিনীর ছবি। থিয়েটার সেটের একটি টেবিলের ওপর কাঠের ফ্রেমে মুকুন্দনের ছবি। তাতে তাকে দেখাচ্ছে তিব্বতি শরণার্থীর মতো। লাইট এবং শেডের অলটারনেটিভ ব্যবহার করা হয়েছে এতে। অনেকটা দাবার বোর্ডের মতো।
‘কেন তোমার মনে হলো আমি আসব?’
‘কেন, তুমি কি আসতে চাওনি?’
‘আমি বুঝলাম না।’
‘তোমাকে মুকুন্দন কিছুই বলেনি?’
‘কি?
‘না কিছু না।’
‘কী, কী বলেনি আমায়?’ আমার গলা যেন একটু ওপরে উঠে গেল।
আমি কি তোমার জন্য একটু চা বানাব? নলিনী বেশ শান্ত স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করল।
‘কী? কী বলেনি আমাকে মুকুন্দন?’ সে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল। আমি তার পথ রোধ করে দাঁড়ালাম।
‘কিছু না’, নলিনী তার চোখ নামিয়ে বলল।
‘এসব কি?’ আমি তাকে ধরে ঝাঁকি দিলাম।
হঠাৎ নলিনী কেমন যেন দ্বিধান্বিত হয়ে গেল। আমরা..আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা।
‘মিথ্যে কথা।’ আমি কাঁদতে শুরু করলাম।
নলিনী কিছু কাপড় জড়ো করল এবং বাথরুমের দিকে গেল। যেন আমাকে একা রেখে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে দিয়ে গেল। একটু পরে সে ফিরল। পরনে একটি ময়ুর রঙা গাউন। আমি তার মসৃণ লোমবিহীন পা দুটো দেখতে পেলাম। তখনো পায়ে জল লেগে আছে। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গাঢ় এবং উজ্জ্বল রং তার ঠোঁটে ও চোখের পাতায় লাগাল।
‘আমাকে একটি পার্টিতে যেতে হবে।’
কান্না আমার ততক্ষণে আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। সুতরাং আমি আবার ফোঁপাতে লাগলাম। তবে একে বের হতে দিলাম না। নলিনী আলমালি খুলল এবং একটি পুরোনো নাগাপাড়া নেকলেস গলায় পরল। সবুজ গাউনের সঙ্গে সবুজ রঙের পাথর বেশ খাপ খেয়ে গেল। তাতে একটি পুরোনো আবহ এনে দিল তার আধুনিক পোশাকের ওপর। আমি দেখলাম এটি তাকে অনিন্দ্যসুন্দরী করে তুলেছে। যেন আমি তাকে মুকুন্দনের চোখ দিয়ে দেখতে লাগলাম। মুকুন্দনের একটি অভ্যাস ছিল চোখ ছোট ছোট করে চুলে হাত বোলানো। আমার কান্না আরো জোরে হতে লাগল। এ সময় আমি কাদছিলাম ঈর্ষায়। এই অনুভূতি আমার আগে কখনো হয়নি।
‘মুকুন্দন আমাকে এভাবে সাজতে শিখিয়েছে।’ সে এমনভাবে বলল যেন পড়শির সঙ্গে গালগল্প করছে।
‘কেমন করে?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করাম, জিজ্ঞাসা আমার কান্না থামিয়ে দিল।
‘এমন করে- দাদিমার নাগাপাড়া নেকলেসের সঙ্গে আধুনিক পশ্চিমা পোশাক। সে একে বলত শেকসপিয়র স্টাইল।’
‘শেকসপিয়র স্টাইল?’ আমি এমনভাবে জিজ্ঞেস করলাম যেন তাদের ব্যক্তিগত শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে আমার অনেক আগ্রহ।
‘হ্যাঁ মুকুন্দন প্রায়ই বলত, শেকসপিয়র তার লেখায় প্রচুর শব্দ ব্যবহার করেছেন মূল লাটিন থেকে। এর মধ্যে সে ব্যবহার করেছে বিশুদ্ধ ইংরেজি শব্দ। যেমন দাদিমার নাগাপাড়া নেকলেস।
এটাই তাদের অন্তরঙ্গতার সত্যতা... আমি তাকে ঘৃণা করতে লাগলাম। যেমন সবাই অন্যের ভালোবাসাকে ঘৃণা করে।
‘তোমার কাছে এটা নাগাপাড়া নেকলেস আর আমার কাছে বিধবার আবর্জনা।’
আমার কাছে সে একজন খণ্ডকালীন স্বামী, তোমার কাছে প্রেমিক, আমার কাছে সে এমন একজন যার কাছে আমি টাকা চাইতাম কাগজের লোককে দেওয়ার জন্য, মুদির জন্য, ইলেকট্রিক বিল দেওয়ার জন্য। তোমার কাছে ছিল সে এমন একজন যে তোমাকে শেকসপিয়রের ব্যাখ্যা করত। আমার কাছে সে ছিল যে কব্জিতে পারফিউম লাগাত নতুন ড্রেস পরে, তোমার জন্য সে ছিল কেমন হবে তোমার ড্রেস-আপ। তোমার জন্য.. আমার জন্য... তোমার জন্য... আমার জন্য... আমি বিড়বিড় করতে করতে গাড়ি চালিয়ে বেঙ্গলি মার্কেট থেকে বের হয়ে এলাম।
মুকুন্দনের ছবি নেওয়ার জন্য রমা স্টুডিওর সামনে গাড়ি রাখার সময় কী মনে করে আমি গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললাম। আমি একের পর এক গিয়ার বদলাতে লাগলাম। যেন একটির পর একটি সিঁড়ি ভাঙছি। গাড়িটি বিদ্রোহ করে একটা ঝাঁকি দিল। তারপর চলতে শুরু করল। আমি মান্দি হাউসের সামনে বড় একটা বৃত্ত এঁকে ফিরে এলাম।
সে রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। সে রাতে কেন, এরপর অনেক রাতই আমি ঘুমাতে পারিনি। খালি মনে পড়েছে মুকুন্দন আর নলিনীর নগ্ন দেহ। তারা একে অপরকে জড়িয়ে আছে, হাসছে। তারা যে প্রেমিক-প্রেমিকা। আর আমি মুকুন্দনের বিধবা স্ত্রী। মুকুন্দন ছিল আমার খণ্ডকালীন স্বামী।
এক রাতে দেখলাম স্লিপিং পিল খেয়েও ঘুমাতে পারছি না। আমি রান্নাঘরের কাবার্ড খুললাম। পেয়ে গেলাম সবুজ রঙা হুইস্কির বোতল। মুকুন্দনের পান করা হুইস্কির অবশিষ্ট অংশ তখনো ছিল তলানিতে। আমি একটি কাচের গ্লাসে হুইস্কি ঢাললাম। ফ্রিজ থেকে বরফকুচি নিয়ে তা পূর্ণ করলাম। মাতাল হওয়ার জন্য আমি ড্রইংরুমকে বেছে নিলাম। যেমন করে মুকুন্দন টিভি দেখত, তেমন করে আমি সোফায় বসে বন্ধ টিভির দিকে চেয়ে রইলাম। কখন পেছনে আম্মা এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। আম্মা আমার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিল। এই সব ছাইপাশ কী খাচ্ছ? আমি লাফিয়ে উঠলাম। এক ঝটকায় আম্মার হাত সরিয়ে দিলাম। বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে একের পর এক বালিশ দেয়ালে ছুড়ে দিতে লাগলাম। বুঝতে পারছিলাম বন্ধ দরজার ওপারে আম্মা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দরজায় করাঘাত করার সাহস তার নেই।
দ্বিতীয়বার নলিনীর সঙ্গে দেখা হলো একটি হোটেলে। কনিষ্ক হোটেলের কফিশপে সে আমাকে কফি খেতে ডাকল। যাব কি যাব না করেও আমি গেলাম। যাওয়ার সময় আম্মা এবং বাচ্চাদের বললাম মুকুন্দনের ছবি আনতে যাচ্ছি। কফিশপের যেখানটায় আমরা বসেছিলাম, সেখান থেকে হোটেলের সুইমিং পুল দেখা যায়। নীল সুইমিং পুলে তখন বিদেশি নরনারীর জলকেলি। একজন সুদর্শন পেশিবহুল শরীরের যুবক পানি থেকে উঠে এলো। নলিনী সেদিকে তাকিয়ে আছে। কোন দেশের হবে এই যুবক? উজবেক নাকি তাজাকিস্তানের? আমি একটু হাসলাম। তারপর নলিনীকে প্রশ্ন করলাম-
‘আমি তোমাকে দেখতে চাইব এ রকম মনে হচ্ছিল কেন তোমার?’
আমার প্রশ্নে নলিনী জগতে ফিরে আসে যেন।
‘আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের ব্যাপারটি জানতে। কিন্তু জীবনে প্রথমবার বুঝতে পেরেছিলাম মুকুন্দন তোমাকে বলতে ভয় পেয়েছে, যা তার মাঝে কখনো ছিল না। আমি বিষয়টি শোধরাতে চাই। মুকুন্দনের পক্ষ হয়ে।’
দয়া দেখাচ্ছ? তুমি কে? কার পক্ষ থেকে শোধরাবে? তোমার অকেশনাল প্রেমিকের পক্ষ থেকে?
‘সে আমার জন্য খণ্ডকালীন ছিল না। সব সময় আমার সঙ্গে ছিল। এমনকি এখনো আছে। তার চোখ দুটো জলে ভরে উঠল।’
‘প্রথমবার আমি যখন নাটকে অভিনয় করি সে আমাকে ইন্ডিয়া গেট নিয়ে গিয়েছিল। আমাকে ঘাসের ওপর পা ফেলে হাঁটতে শিখিয়েছে কেমন করে মঞ্চের ওপর হাঁটতে হয়। এ রকম অসংখ্য ঘটনা... যখন আমি রাঁধতে পারতাম না, মুকুন্দন করিমের রুমালি রুটি আর মাংসের তরকারি নিয়ে আসত।’
‘যখন তুমি অসুস্থ থাকতে? কেমন করত মুকুন্দন তখন?’
‘সে ইনা মার্কেট থেকে আধভাঙা চাল নিয়ে আসত। আমার জন্য জাউভাত রাঁধত।
‘সে দিনরাত তোমার হাত ধরে বসে থাকত?’
‘হ্যাঁ, সে ভেজা রুমালে আমার জ্বর কমাত।’
‘যখন সুস্থ হতে তখন তোমাকে রেখে চলে আসত? কয়েক সপ্তাহের জন্য?’
‘না যখন জ্বর কমল, তখন সে আমাকে নিয়ে ম্যাকলাগঞ্জ গেল। সেখানে একটি ধর্মশালায় আমরা ছিলাম। সেখানে তিব্বতি শরণার্থীদের ছবি তুলেছে সে।’
এই প্রথম আমি মুকুন্দনকে ঘৃণা করলাম। ধোঁকা! এত বড় ধোঁকা মুকুন্দন আমায় দিল? রাগে আমি অন্ধ হয়ে গেলাম। সে সময় আমার হাত কোনো অবলম্বন খুঁজছিল। হাতের কাছে পেয়ে গেলাম রুপার কারুকাজ করা ভারী চিনির পাত্র। আমি তাই ছুড়ে মারলাম হোটেল এবং সুইমিং পুলের মাঝখানে কাচের দেয়ালের দিকে। পাত্রটি দেয়ালে লেগে পড়ে গেল আর বরফকুচির মতো চিনির দানা ছড়িয়ে পড়তে দেখলাম আমি। তারপর টেবিলে মাথা নামিয়ে আমি কাঁদতে লাগলাম। হোটেলের সব কর্মচারী তখন আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে। নলিনী তাদের কী বলেছে জানি না। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে গাড়িতে ওঠাল। তারপর বাড়ি পৌঁছে দিল। বাড়ি পৌঁছেই দেখলাম বাচ্চারা দরজার সামনে দাঁড়িযে আছে তাদের বাবার ছবির জন্য।
আচ্চানের ছবি? মুকুন্দনের ছবি? সবার এক প্রশ্ন। আমি চিৎকার করে বললাম, আনিনি। তারপর শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম।
পাঁচ কি ছয়দিন পর আমি রান্না করছিলাম। নলিনী আমাকে ফোন করল।
‘তুমি কি একটু আসবে? জরুরি।’
‘আমি কাউকে দেখতে চাই না।’
‘আমার তো তুমি ছাড়া কেউ নেই।’
এ কথায় আমার কী হয়ে গেল! আমি ওর কাছে গেলাম।
নলিনীর সমস্ত রুম ওলটপালট হয়ে আছে। প্লেটে আধখাওয়া খাবার। তার ওপর পিঁপড়া হাঁটছে। টেবিলে ক্যাকটাস, তার ওপর নলিনী আর মুকুন্দনের ছবি। মেঝেতে একটি কাপে কবেকার পান করা চা। তার ওপর হালকা ফাঙ্গাস জমেছে।
‘আই অ্যাম প্রেগন্যান্ট।’
এই কথাটির মধ্যে আমি যেন পুরোপুরি ডুবে গেলাম। শেষ পর্যন্ত আমি বলতে পারলাম, তুমি এখন কি করবে? একে রেখে দেবে নাকি মেরে ফেলবে?’
আমার স্মৃতি হাতড়াতে লাগল মুকুন্দনের ছবি। আমাদের ঘরের দেয়ালে, হৃষিকেশের ছোটবেলার ছবি সব মিলিয়ে মুকুন্দনের মাঝে আমি এক নিষ্পাপ মুখই দেখতে পেলাম। যে কোনো মূল্যে মুকুন্দনকে মানুষের কথার হাত থেকে বাঁচাতে হবে। আমি মুকুন্দনের নিষ্পাপ মুখ হারিয়ে যেতে দিতে পারি না।
নলিনী তার পোশাক পাল্টে তৈরি হয়ে নিল।
আমার সঙ্গে একটু ক্লিনিকে যাবে?
আমার এখন কী করা উচিত?
তাহলে এর জন্য কাকে যেতে বলব আমি?
গাড়ি চালাতে গিয়ে দেখলাম আমার হাত কাঁপছে। আমরা একটি অটোরিকশা নিলাম। ক্লিনিকে আমরা পাশাপাশি বসে রইলাম। কেউ কোনো কথা বললাম না। যতক্ষণ নলিনীর ডাক না এলো, আমরা সেভাবেই বসে রইলাম। ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে একটি ট্যাক্সিতে ফিরছিলাম। নলিনী আমার গায়ের সঙ্গে সিঁটিয়ে বসে আছে। সারা ট্যাক্সিতে অ্যান্টিসেপটিকের গন্ধ। হঠাৎ নলিনী আমার গলা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
আমার মা নেই। খুব ছোটবেলায় আমার মা মারা গেছে।
আমি তার চিরুনি না চালানো জটা ধরা চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে লাগলাম।
পরের শনিবারে আমি নলিনীকে ফোন করলাম দুপুরে খাওয়ার জন্য।
তুমি কি দুপুরে খেতে আসতে পারবে? আমি কাঁচা আম আর চিংড়ি রান্না করেছি বাচ্চাদের জন্য।
আমি আসব। আমি বাচ্চাদের দেখতে চাই।
আসবার পথে স্টুডিও থেকে মুকুন্দনের ছবিটি আনতে পারবে? তোমার পথেই পড়বে।
ডোরিই প্যাকেটটি খুলল। বাচ্চারা ঘরের প্রত্যেকটি দেয়ালে ছবিটা রেখে দেখছিল কোথায় ওটিকে মানায়। শেষ পর্যন্ত নলিনীই বলল, যেহেতু মুকুন্দন প্রাইভেসি পছন্দ করত, তাই ছবিটা শোবার ঘরেই রাখা উচিত। রান্নাঘরে আমি তাড়াতাড়ি মুকুন্দনের পছন্দের সব রান্না করলাম। রাজমা, ঢেঁড়স ভাসা, দই, কাঁচা আম, চিংড়ির তরকারি এবং ডেজার্ট হিসেবে পুডিং।
নলিনী বাচ্চাদের ঘরে খেলছিল ওদের সঙ্গে। আম্মা নলিনীর বাবা-মা সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করছিল। লাঞ্চের পর ডোরি তাকে ধরে বসল গল্প শোনাবার জন্য। হৃষিকেশও যোগ দিল। নলিনী বাচ্চাদের ড্রইংরুমের কার্পেটের ওপর বসিয়ে দিল। তোমরা হলে প্রথম সারির দর্শক। আমার দিকে তাকিয়ে বলল সে। এবং আম্মা বসবে পেছনের চেয়ারে। ওইটা বেলকনি। নলিনী আমাদের দিকে পেছন দিয়ে দাঁড়াল। তারপর দর্শকদের দিকে ফিরল। তার আঙুলগুলো চুলের মধ্যে চালিয়ে দিল। অবিকল মুকুন্দন যেমন করত। তার নাসারন্ধ্র প্রসারিত হলো, চোখ হাসছিল- যা কেবল মুকুন্দনই পারত। হাত প্রসারিত করে প্রত্যেকটি শব্দ আলাদা আলাদা করে স্পষ্টভাবে ছুড়ে দিল। অবিকল মুকুন্দনের কণ্ঠে বলে উঠল
এখন আমি তোমাদের একটি গল্প শোনাব...
(তর্জমা : মির্জা মোনালিসা)