মুক্তমত
একটি আড্ডা, জাতীয়তাবাদ ও ভাষা প্রসঙ্গ
আমি সব ধরনের জাতীয়তাবাদকে ঘৃণা করি, আমি বিশ্বনাগরিক হতে চাই। সমগ্র বিশ্বের নাগরিক এবং আমি আর্হেন্তিনারও একজন ভালো নাগরিক। আর্হেন্তিনীয় প্রজাতন্ত্র পৃথিবীরই একটি অংশ।
―হোর্হে লুইস বোর্হেস
আলবের্তো কফফাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বোর্হেস উপরোক্ত কথাগুলো বলেছিলেন। তাঁর এই কথাগুলো দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করার কারণ নিবন্ধের ভেতরেই রয়েছে। নিবন্ধটির সূত্র ‘বনলতা রিডিংস’ নামে একটি সাহিত্য আড্ডা। ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী ও ফারহানা মান্নানের বাড়িতে আড্ডাটি অনুষ্ঠিত হয়। লেখক-কবি-কথাসাহিত্যিকদের নিজের রচনা থেকে নির্বাচিত পাঠ নিয়ে এই আড্ডা।
আড্ডাবাজদের বেশির ভাগই কবি; সাধারণত যা হয় আর কি! যত সাহিত্য আসরে যাই, সব কটিই থাকে কবিদের দখলে, কথাসাহিত্যিকের সংখ্যা থাকে খুবই কম। আজও কম ছিল। কবিরা যথারীতি কবিতা পড়লেন। মাসউদুল হক ও তানিম কবির পড়লেন গল্প। ভেবেছিলাম, আমাকে হয়তো কিছু পড়তে-টড়তে হবে না। কিন্তু না, একপর্যায়ে আমারও ডাক পড়ল। পড়তে হবে আমার উপন্যাস ‘কালকেউটের সুখ’ থেকে। ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হলো আমার কাছে। আড্ডায় নিজের কবিতা পাঠের আগে কবি হিজল জোবায়ের বলেছেন, ‘কবিতা আসলে ঠিক শ্রোতাদের উপস্থিতিতে পাঠ করে শোনানোর বিষয় নয়, কবিতা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ার বিষয়। কণ্ঠশিল্পী গান গাওয়ার সময় শ্রোতারা যেভাবে গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে, কবিতা পাঠের সময় কিন্তু ততটা মনোযোগ দিয়ে শোনে না। কবিতা পড়ে শুনিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে কাব্যরস জারিত করা যায় না।’
হিজল জোবায়েরের কথার সঙ্গে আমি আংশিক একমত। আপাতত তাঁর সঙ্গে যদি পুরো একমত হই, তাহলে গল্প তো মোটেই পাঠ করে শোনানোর বিষয় নয়। উপন্যাস তো নয়ই। গল্প পড়তে গেলে শ্রোতাদের বিরক্তির সীমা থাকে না, উপন্যাস পড়তে গেলে তো সবাই আড্ডা ছেড়ে চলে যাবে। সে কারণে উপন্যাস থেকে পাঠ হাস্যকর মনে হলো। কিন্তু কবি মারুফ রায়হান জোর করলেন, আমাকে কিছু-না-কিছু বলতেই হবে। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাইক হাতে নিলাম।
প্রশ্ন করলাম আড্ডার এক কবিকে, এর আগে যিনি তার বক্তৃতায় বাংলা ভাষার করুণ দশা বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর আলোচনার সারসংক্ষেপ ছিল এই, ‘বাংলা ভাষা বর্তমানে করুণ দশায়। কদিন পর ভিক্ষা করতে হবে। এখন আমাদের করণীয় উর্দু, আরবি, পার্সি, ইংরেজি ও সংস্কৃত থেকে শব্দ নিয়ে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করা।’
বাংলা ভাষার করুণ দশাবিষয়ক তার মন্তব্যটি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। আমি কবির কাছে জানতে চাইলাম বাংলা ভাষা কোন দিক থেকে করুণ দশায়? তিনি আমাকে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট ইত্যাদি দেখিয়ে বাংলা ভাষার করুণ দশা বোঝাতে চেষ্টা করলেন। আমার পরিবর্তে বক্তা হয়ে গেলেন তিনি। আমি যখন পাল্টা যুক্তি দিতে শুরু করলাম, একপর্যায়ে তিনি ক্ষেপে গেলেন। তাঁর আচরণে এটাই বোঝা যাচ্ছিল, বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে হলে লেখকদের অবশ্যই উর্দু, আরবি, পার্সি, ইংরেজি, সংস্কৃতসহ বিশ্বের অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ ধার করতে হবে। ধার করাটা বাধ্যতামূলক। করতেই হবে। না করলে অসুবিধা আছে। উত্তেজনার বশে আমার উদ্দেশে তিনি বলেই ফেললেন, ‘আমি কিন্তু আপনাকে ছাড়ব না।’ এই ‘ছাড়ব না’র অর্থ সম্ভবত এই―‘আপনাকে বিদেশি ভাষা থেকে শব্দ নিতেই হবে, নইলে আপনার খবর আছে।’ অর্থাৎ জবরদস্তি। এবং উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্কের এক পর্যায়ে তিনি আরো বললেন, ‘জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনার এগুলোর কোনো মূল্য নেই আমার কাছে। আমি এগুলোকে গুরুত্ব দেই না।’
জাতীয় পতাকা ও শহীদ মিনার সম্পর্কে তিনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এমন উক্তি করেছেন তা সম্ভবত আমি বুঝতে পেরেছি। সম্ভবত তিনি জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতাকে প্রত্যাখ্যান করে বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠার কথা বলেছেন। তিনি হয়তো বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠেছেন, তাই তার কাছে জাতীয় পতাকা বা শহীদ মিনারের কোনো মূল্য নেই। তবে তাঁর এই যুক্তির পাল্টা যুক্তিও কিন্তু আছে। সেই যুক্তিটা আমি বোর্হেসের কাছ থেকেই ধার করলাম। শুরুতে যা বলেছি, বোর্হেস জাতীয়তাবাদকে ঘৃণা করেন, তিনি বিশ্বনাগরিক হতে চান। কিন্তু শেষে এসে বললেন, আর্হেন্তিনীয় প্রজাতন্ত্র পৃথিবীরই একটি অংশ। তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই―বিশ্বনাগরিক হওয়ার জন্য পৃথিবীর সব কটি দেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার দরকার নেই, আর্হেন্তিনার নাগরিকত্ব নিলেই চলবে, কারণ আর্হেন্তিনা প্রজাতন্ত্র পৃথিবীরই একটা অংশ।
একইভাবে বাংলাদেশে বসবাস করে কেউ যদি বিশ্বনাগরিক হতে চান, তাকে আগে বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে, বাংলাদেশের পতাকা ও ভাষাকে স্বীকার করে নিতে হবে। কারণ বাংলাদেশ এই পৃথিবীরই একটি অংশ, এটি পৃথিবীর বাইরের কোনো দেশ নয়। আপনি এই দেশের নাগরিক মানেই বিশ্বনাগরিক। আপনি এই দেশকে স্বীকার করলেন না তো বিশ্বকেই স্বীকার করলেন না। সুতরাং এই বিশ্বে আপনার থাকার অধিকার নেই, নতুন কোনো বিশ্ব আবিষ্কার করে সেখানে চলে যেতে পারেন। একটি অনুষ্ঠান করে আপনাকে সাদরে বিদায় জানানোর জন্য আমরা প্রস্তুত।
যাই হোক, প্রসঙ্গ জাতীয়তাবাদ, জাতীয় পতাকা বা শহীদ মিনার নয়; প্রসঙ্গ বাংলা ভাষা। কবি যে বাংলা ভাষার করুণ দশার কথা বলেছেন, আমি আমার শ্রেণি থেকে বিচ্যুত হয়েও, সকল সীমাবদ্ধতা আর সংকীর্ণতাকে দূরে সরিয়ে রেখেও তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারছি না। বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ পড়তে গেলে একবারও আমার মনে হয় না বাংলা ভাষার দশা করুণ। কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদে মহাভারত, রাজশেখর বসুর অনুবাদে রামায়ণ বা মহাভারত পড়ার সময় কিংবা পঞ্চকবির কবিতা পড়ার সময় কিংবা মানিক, বিভূতি, তারাশঙ্কর, শরৎ, দেবেশ, ওয়ালীউল্লাহ, ইলিয়াস, হাসান আজিজুল, সন্দ্বীপন, মোস্তাফা সিরাজ, সুনীল, শীর্ষেন্দু এবং তৎপরবর্তী আর আর কবি-সহিত্যিকদের কবিতা-গল্প-উপন্যাস পড়ার সময় একবারও মনে হয় না বাংলা ভাষার দশা করুণ। তাঁদের কথা থাক। আজকের আড্ডায় কবি ফরিদ কবির, মারুফ রায়হান বা হিজল জোবায়ের তাঁদের যে তিনটি কবিতা আমাদের পাঠ করে শোনালেন, তাতে একবারও মনে হয়নি বাংলা ভাষার দশা করুণ। তাহলে আলোচ্য কবি কোন যুক্তিকে বলেছেন বাংলা ভাষা করুণ দশায়? তিনি কি এই বলতে চেয়েছেন―আমাদেরকে ফররুখ আহমেদ বা তাঁর ঘরানার কবি-সাহিত্যিকদের মতো করে লিখতে হবে? প্রচুর উর্দু-পার্সি-আরবি শব্দ ব্যবহার করে?
আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, মাননীয় কবি, আপনার মতের সঙ্গে আপাতত একমত হতে পারছি না বলে। একজন নগণ্য সাহিত্যকর্মী হিসেবে এখনো মনে করছি না বাংলা ভাষা সংকটে বা করুণ দশায়। বেশি কিছু দরকার নেই, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘যথাশব্দ অভিধান’, বা ড. আহমাদ জামানের ‘বাংলা বিবিধার্থ অভিধান’ বা ‘বিপরীতার্থ শব্দাভিধান’ বা ‘আঞ্চলিক ভাষা অভিধান’ পড়ে দেখলেই বোঝা যাবে বাংলা ভাষা কত সমৃদ্ধ, কত ঐশ্বর্যবান।
বাংলা ভাষা করুণ দশায়―এই উক্তির মধ্যে আমি স্পষ্টতই ঔপনিবেশিক হীনমন্যতা দেখতে পাচ্ছি। বাঙালি এই হীনমন্যতা থেকে বেরুতে পারছে না। বিদ্যাসাগর পেরেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন, মাইকেল পেরেছিলেন। আরো অনেকে পেরেছিলেন। না পারাদের দলেও আছেন অনেকে। তাঁরা বোধহয় কোনোদিনও এই হীনমন্যতা দূর করতে পারবেন না।
তার মানে এই নয় যে বাংলা ভাষার একজন লেখক হিসেবে আমি অন্য ভাষা থেকে শব্দ নেব না। অবশ্যই নেব। তবে সেই নেওয়াটা হতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত। যেমন একটি অনলাইন পত্রিকার ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত শাহনাজ মুন্নীর ‘বদহজম’ শীর্ষক একটা গল্প পড়ছিলাম। গল্পের কয়েকটা লাইন এ রকম, ‘সারা দেশজুড়ে চলতে থাকা তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনের ডকুমেন্টেশন করা এই বিভাগের মূল কাজ। জোনাকি আর জয়নালের দায়িত্ব তথ্যগুলো কমপাইল করা আর বস হিসেবে তার দায়িত্ব এগুলোকে সুপারভাইজ করে এপ্রুভাল দেওয়া।’
এখানে ‘ডকুমেন্টেশন’, ‘কমপাইল’, ‘বস’, ‘সুপারভাইজ’, ‘এপ্রুভাল’―এই ইংরেজি শব্দগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এসেছে, জবরদস্তিমূলকভাবে নয়। গল্পের বিষয়বস্তুর উপযোগী হয়ে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলোকে আরোপিত মনে হয়নি আমার কাছে। কিংবা ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’য় যেমন, ‘গোশতের খুশবুতে অন্য যে কোনো গন্ধই তো চাপা পড়বে। তবু তমিজের বাপের এই কাজটিকে গফুর কলু অনুমোদন করতে পারে না। থুতু ফেলে সে নাকে হাত দেয়। তার দেখাদেখি এবং তার সম্মানে আরো কয়েকজন নিজ নিজ পাতের সামনে গোশতের সুরুয়া মেশানো আঠালো থুতু ফেলে’। পটভূমির স্বার্থেই মাংসের পরিবর্তে গোশত, ঘ্রাণের পরিবর্তে খুশবু, ঝোলের পরিবর্তে সুরুয়া লিখেছেন ইলিয়াস। এই উর্দু শব্দত্রয় না দিলেও চলত, দিয়েছেন চরিত্রকে ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য, চরিত্রের গভীরে ঢোকার জন্য, চরিত্রকে তলিয়ে দেখার জন্য।
সুতরাং বাংলা ভাষার করুণ দশার কথা বলে কেউ যদি বিদেশি ভাষা থেকে শব্দ আহরণের জন্য জবরদস্তি করেন, আমি মোটেই তাঁর পক্ষে নই। তাঁর জন্য বরং করুণা। এমন উক্তি বাংলা ভাষার অপমান বৈ আর কিছু নয়। বিদেশি ভাষা থেকে শব্দ অবশ্যই নেব। কিন্তু তার আগে দেখতে হবে আমি যে ভাষায় লিখছি সেই ভাষাভাষী জনগণ ওই বিদেশি শব্দগুলো তাদের দৈনন্দিন ভাষায় ব্যবহার করছে কি না। আমি লেখক, কিন্তু জনগণেরই অংশ। আমি মঙ্গলগ্রহের অধিবাসী নই। আমি জনগণের ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করব। বাংলা ভাষা আমার বা আমার বাবার একার জমিদারি নয়। আমি গায়ের জোরে আমার সাহিত্যকর্মে আরবি, উর্দু, পার্সি, ইংরেজি বা সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতে পারি না। আমাকে দেখতে হবে আমার সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিত ওই শব্দগুলো দাবি করছে কি না। যদি দাবি না করে, যদি আমি গায়ের জোরে শব্দগুলো ব্যবহার করি, তা হবে ভাষা দূষণ, ভাষা নৈরাজ্য। দূষণ বা নৈরাজ্য একজন সাহিত্যিকের কাজ হতে পারে না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক