স্মরণ

আহমদ ছফা যেখানে অনন্য

Looks like you've blocked notifications!

‘সফলতা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। জাতির মর্মমূল স্পর্শ করে যদি ব্যর্থও হই, তার একটা আলাদা মূল্য আছে। মামুলি সার্থকতার চাইতে মহৎ ব্যর্থতার মূল্য অনেক বেশি।’ মহৎ ব্যর্থতাকে মূল্য দিয়ে চলতেন যে অসাধারণ মানুষটি তিনি ছফা, আহমদ ছফা, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কথাসাহিত্যিক, সমালোচক ও অনুবাদক। ছফার ছিল মাউন্ট এভারেস্টের মতো ব্যক্তিত্ব, প্রশান্ত মহাসাগরের মতো হৃদয়, ঈগলের মতো দূরদৃষ্টি, আকাশছোঁয়া অট্টালিকাসম জ্ঞান ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার জাদু। সৃষ্টির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন, বাংলাদেশের দুর্দিনে ছিলেন এক অকুতোভয় সহযাত্রী।

কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা এক সংশপ্তক হলেন আহমদ ছফা। নামের বিড়ম্বনায় বহুবার পড়েছেন কিন্তু  পিতৃপ্রদত্ত নামকে বর্জন করেননি,সবকিছুকে উতরে গেছেন নিজ মেধা, প্রচেষ্টা ও যোগ্যতা দিয়ে। নিজেকে ফাপিয়ে ফুলিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা কখনো করেননি। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ভূষণ গ্রহণ না করে স্বতন্ত্র রয়ে গেলেন ছফা।

হাইস্কুলে পড়ার সময়ে হিন্দু হোস্টেলে থাকাকালীন তিনটি কাজ রুটিনমাফিক করার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন: সকালে শয্যা ত্যাগ, মিথ্যা কথা না বলা ও সব কিছু সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করা। একসাথে ছফা অনেক কাজ করতেন। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন উপলব্ধির জন্য তাঁর একটি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ছিল। নিজের প্রতিষ্ঠার চেয়ে অন্যের প্রতিষ্ঠার পানে নজর দিয়েছেন বেশি। ‘পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না’ অভিধাটি ছফার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। নিজেকে পুড়িয়েছেন, দীপশিখা হয়েছেন, অসংখ্য প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিককে সাহিত্যিক হওয়ার পেছনে অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছেন।

হুমায়ূন আহমেদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আবুল হাসান, সাঈদ-উর রহমান, আবু কায়সার, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নূরুল আনোয়ার, রফিক আজাদের মতো বাঘা বাঘা সাহিত্যিকের প্রথম বই তাঁর হাত ধরেই প্রকাশের মুখ দেখে। প্রকাশকের কাছ থেকে নিজের বইয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা নিয়ে নিজের বই না ছাপিয়ে তিনি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম বই 'নন্দিত নরকে' ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। এই বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। নানা মুনির নানা মতে ছফা কখনো ভেঙে পড়েননি। এক ইস্পাতসদৃশ হৃদয় ছিল মানুষটির ভিতরে। ভাইপো নূরুল আনোয়ারকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি আমার জীবন ও কর্মকে এমনভাবে গঠন করতে চাই লোকে ভাত, রুটি যেমন খায় তেমনিভাবে তাদের প্রয়োজনে লাগতে পারি। আমি আমার আপন লোকদের ভালোবাসি, কিন্তু শত্রুদের ঘৃণা করিনে। এইখানে আমার সঙ্গে অনেক মানুষের তফাৎ। আমার মধ্যে আপন-পর কোনো ভেদ নেই। এটা আমার দুর্বল দিক, কিন্তু এটা আমার মহত্ত্বও বটে।’ ছফা কাজে ও কথায় ছিলেন অনুরূপ।

১৯৭৯ সালের ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন নিজের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ের পিড়িতে বসবেন কিন্তু অর্থাভাবে তাঁর পরিবার মেয়ের বিয়ে দিতে অপারগ হয়েছিল। ছফা এই খবর জানার পর তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ ‘সিপাহি বিদ্রোহের ইতিহাস’-এর পাণ্ডুলিপি বিক্রি করে দেন। বিক্রি করা টাকা নিয়ে সরাসরি চলে আসেন ড. নাজমা শাহীনের বাসায়। তাঁর বাবাকে টাকাটা দিয়ে দেন। এই হলেন আহমদ ছফা। মানুষের দুঃখকে নিজের দুঃখ ভাবতেন। ড. নাজমা শাহীনের বাবা অবশ্য ওই টাকা নিতে খুব লজ্জা পেয়েছিলেন। ছফা মূল্যবান গ্রন্থটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে অন্য প্রকাশনী সে বইটি প্রকাশের সুযোগ পায়।

একবার ছফা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নিজের প্রায় সব জামাকাপড় অভাবী মানুষের মাঝে বিতরণ করেন। কিন্তু বিড়ম্বনায় পড়লেন এবার। নিজের এক জোড়া শার্ট-প্যান্ট ও পরনের একটি লুঙ্গি ছাড়া তাঁর কাছে কিছুই অবশিষ্ট নেই। এক অভাবী ব্যক্তি রাতে তাঁর কাছে এলো এবং তার নিজের পরনে থাকা ছেঁড়া লুঙ্গিটার বেহাল অবস্থা দেখাল। যদি ছফা কোনো ভাবে লোকটির একটি লুঙ্গি কেনার টাকার ব্যবস্থা করতে পারেন তো অনেক উপকার হয়। ভ্রাতুষ্পুত্র নূরুল আনোয়ারের ওপর ছফা ভীষণ ক্ষেপে গেলেন এবং তাঁকে বললেন, ‘হারামজাদা, তোরে বললাম ঘরে কোনো লোক ঢুকতে দিবি না। বললাম, লাঠি দিয়ে তাড়াতে।’ কথাগুলো বলার পর ছফা কেঁদে ফেললেন। তিনি ধমক দিয়ে রুম থেকে সবাইকে বের করে দিলেন এবং দরিদ্র লোকটিকে বাইরে দাঁড়াতে বললেন। মিনিট পাঁচেক পরে দরজা খুলে বের হয়ে আসলেন ছফা। বিছানার চাদরখানা নিজের শরীরে পেঁচিয়ে পরনের লুঙ্গিটা ছেড়ে নিয়ে নূরুল আনোয়ারকে বললেন অসহায় ব্যক্তিটিকে দিতে। তিনি নূরুল আনোয়ারকে বলেছিলেন, ‘এটা দিয়ে দাও। এর পর থেকে আর কাউকে যেন না দেখি।’ এই হলেন ছফা। ছফার ভাষায়,

‘আমি তো সামান্য লোক ঘুরি পথে ঘাটে

খুঁজে পাই আপনারে মানুষের হাটে।’

সত্যজিৎ রায়, রবিশঙ্কর ও এস এম সুলতানকে নিয়ে ছফার গর্বের অন্ত ছিল না। তিনি মনে করতেন বাঙালিদের মধ্যে এঁরাই পৃথিবীতে সবচেয়ে সেরা তিন জন ব্যক্তি। জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে তিনি দারুণ কদর করতেন। তাঁর সমালোচনা ছিল খুবই তীক্ষ্ণ। যার যতটুকু প্রাপ্য তাকে ততটুকই দিতেন। কাউকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে কোনো কিছু বলা কিংবা লেখা একেবারেই তাঁর কাছে অপছন্দের ছিল। তাঁর জ্ঞান ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার মাঝে সম্মোহনী শক্তি কাজ করত যেন। সুলতানের নামে তিনি ‘সুলতান পাঠশালা’ নামে দুস্থ ও গরিব পথশিশুদের জন্য একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করান। সাধারণ কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা এই মানুষটি গরিব শিশুদের প্রতি ছিলেন খুবই দয়ালু। তাঁর হৃদয়ে ওদের জন্য মমতা সবসময় জমা থাকত। ওদের মুখের হাসি কিংবা গায়ের গন্ধকে তিনি অকৃত্রিম মনে করতেন। এমনকি তিনি যে কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন এর জন্য গর্ববোধ করতেন।

সুলতান, আরজ আলী মাতুব্বর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এঁদের খুব সম্মান করতেন। তিনি বলতেন যে, গরিব কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসেও এঁরা তিনজন বিখ্যাত। সুলতানকে বিশ্বের দরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ছফা। অজপাড়াগাঁয়ের সুলতানকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন গুরু জ্ঞানতাপস প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের সাথে। সুলতানের জন্য তিনি অনেক কিছু করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সুলতানের চিত্রকর্ম বিশ্বের সেরা চিত্রকরদের সাথে তুলনীয়। দেশের সবচেয়ে সেরা চিত্রকর হিসেবে তিনি সুলতানকে মূল্যায়ন করতেন। জ্ঞানতাপস রাজ্জাকের সাথে সাক্ষাৎ ছফার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তাঁর সান্নিধ্যে আসার পর ছফার আর ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া হয়নি। ছফার ভাষ্য, ‘রাজ্জাক সাহেবের কাছ থেকে যখন আসতাম কোনো কোনো সময়ে মনে হতো আমার মেরুদণ্ডটি তিনি হীরে দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছেন। আমাকে তিনি হীরের মতো কঠিন ও দীপ্তিমান করে সৃষ্টি করেছেন। আমার জীবনে উত্থান-পতনের পরিমাণও অল্প নয়। এমনও সময় গেছে চারপাশে লোক আমাকে দেখলে ধিক্কার ধ্বনি উচ্চারণ করত এবং ছি ছি করত। সে সমস্ত অবহেলা, অপমান, অসম্মান, দুঃখ যন্ত্রণা তুচ্ছজ্ঞান  করে নিজের মেরুদণ্ডের উপর থিতু হয়ে দাঁড়াবার একমাত্র প্রেরণা ছিলেন প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক। আমি কিছু কাজকর্ম করেছি। আমার লেখালেখি হয়তো লোকে পড়ে। কিন্তু সেসবের মধ্যে গর্ব করার মতো কোনো কিছু পাইনে। কিন্তু একটা গর্ব আমি কিছুতেই ছাড়ব না, ছাড়তে পারব না। সেটি হলো- আমি আব্দুর রাজ্জাকের ছাত্র। এটা এমন একটা অনুভূতি আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে যিনি আসেননি তাঁর পক্ষে এই অনুভূতির ঘনত্ব এবং গাঢ়ত্ব উপলব্ধি করা কোনোদিনই সম্ভব হবে না।’ ছফা রাজ্জাকের সান্নিধ্যে যে জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছিলেন ডক্টরেট ডিগ্রির মূল্য তার কাছে যৎসামান্য। ছফা ডক্টর হতে না পারলেও অনেকেই এখন ছফার উপরে ডক্টরেট করছেন, উচ্চতর গবেষণা করছেন। সেই তো অনেক বড় সান্ত্বনা।

এটা অনেকের কাছে অজানা যে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পায় ছফার বিখ্যাত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। টগবগে তরুণ আহমদ ছফা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্দিনে জনমত আদায় করেছিলেন কলকাতায়, শক্ত হাতে কলম ধরে তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা ইতিহাসে মেলা ভার। জাসদ রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন ছফা। নিজের জীবনের হুমকি এসেছে নানা দিক দিয়ে, সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছেন সবকিছু। বঙ্গবন্ধুকে যেদিন হত্যা করা হয় তাঁর আগের দিন ছফা ক্ষমতাসীন দলের কিছু ক্যাডারের হাতেই প্রায় মারা পড়ছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল, সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর কেউ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পত্রিকায় কোনো কিছু লেখার সাহস পাননি। ছফা এখানেও ব্যতিক্রম। তিনিই প্রথম কলম ধরেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘হলিডে’ পত্রিকায়। এমন সাহস কয়জনের হয়! ছফা মনে করতেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত জনের লেখা আছে তন্মধ্যে ছফার লেখাগুলো সর্বোৎকৃষ্ট।

ছফা বলতেন, বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘বলাকা’ নয়, ‘সোনার তরী’ নয়, বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর দুবার সরাসরি সাক্ষাৎও হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁকে একটা কম্বল দিয়েছিলেন। সেই কম্বল তিনি বহুদিন দরদ দিয়ে ব্যবহার করেছেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র নূরুল আনোয়ার পরম আদরে সেই কম্বল সংরক্ষণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আজ থেকে অনেকদিন পরে হয়তো কোনো পিতা তাঁর শিশুপুত্রকে বলবেন, জান খোকা! আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিল যাঁর দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন, দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্নারাতে রূপালি কিরণধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি এবং নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জান খোকা তাঁর নাম? শেখ মুজিবুর রহমান।’

সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের সাথে ছফার খুব হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রক্ষীবাহিনী এক মধ্যরাতে হুমায়ূনের পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এই দুঃসময়ে তাদের পাশে এসে কেউ দাঁড়ায়নি। সারারাত তাদের খোলা আকাশের নিচে কাটাতে হয়েছিল। এই খবর শুনে গণভবনে গিয়ে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে জীবন বিসর্জন দেওয়ার কথা বলেন ছফা। পরে চারিদিকে কথাটি ছড়িয়ে পড়লে কবি সিকান্দার আবু জাফর এসে সমস্যা নিষ্পত্তির আশ্বাস দিলে তবেই তিনি ক্ষান্ত হন। একটি শহীদ পরিবারকে বাঁচাতে সেদিন তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করতে যাচ্ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদকে ছফা খুব মেধাবী মনে করতেন। তাঁর ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসকে তিনি অত্যন্ত সার্থক রচনা হিসেবে চিহ্নিত করেন। ছফা হুমায়ূনের পরবর্তী অনেক লেখাকে বস্তাপঁচা লেখা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

হুমায়ূনের যেদিন ছফার সাথে শেষ সাক্ষাৎ হয় সেদিন ছফা হুমায়ূনকে বলেছিলেন, ‘আপনার যদি টাকা-পয়সার খুব প্রয়োজন হয় আমার কাছে আসবেন। আমি যেখান থেকে পারি জোগাড় করব। টাকার জন্য আজেবাজে লেখা লিখছেন, পড়ে খুব মন খারাপ হচ্ছে।’ এমন সমালোচনা বোধ করি শ্রেষ্ঠ পাঠক ও সমালোচক ছফার মুখেই মানায়। সাদাকে সাদা কিংবা কালোকে কালো বলার সৎসাহস ছফার ছিল। স্বর্ণকার যেমন আসল সোনা চিনতে ভুল করেন না, ছফাও তেমনি সাহিত্যকর্ম পড়ে সহজেই সাহিত্যিকদের মূল্যায়ণ করতে পারতেন।

হুমায়ূন আহমেদেরও খুব আক্ষেপ ছিল। তিনি ‘আহমদ ছফা স্মারকগ্রন্থে’র একেবারে উপসংহারে লিখেছেন, ‘একসময় হয়তো বা ছফা ভাইয়ের হিসেবে কোনো ভালো লেখা লিখে ফেলব। সেই লেখা ছফা ভাই পড়বেন না। এর চেয়ে কষ্টের ব্যাপার আর কী হতে পারে?’ হুমায়ূন আহমেদ অবশ্য পরে অনেক উৎকৃষ্টমানের লেখা উপহার দিয়েছেন কিন্তু ততদিনে ছফা না ফেরার দেশে।

জীবদ্দশায় ছফা কোনো উল্লেখযোগ্য পুরস্কার পাননি। ১৯৯২ সালে তিনি বাংলা একাডেমির ‘সাদাত আলী আখন্দ’ পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। বাংলা একাডেমির পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য কি তিনি ছিলেন না?

‘বাঙালি মুসলমানের মন’, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘শতবর্ষের ফেরারী: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’, ‘সিপাহি বিদ্রোহের ইতিহাস’, ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘ওঙ্কার’ কিংবা ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’-এর মতো কালজয়ী লেখা উপহার দিয়েও পুরস্কার পাননি ছফা। আসলে ছফা পুরস্কারের জন্য লেখেননি। শুধু দুঃখ কুঁড়িয়েছেন সারা জীবন।

ছফা সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তাই মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় তাঁকে দাফন করা সম্ভব হয়নি। এ লজ্জা দেশের, দশের, জাতির, সবার। আহমদ ছফা ইতিহাসের মধ্য থেকে উঠে এসেছিলেন। দেশকে নিয়ে যে কয়জন ব্যক্তি বেশি ভাবতেন, বোধ করি আহমদ ছফা তাদেরই একজন। সবকিছুকে ভেঙে নতুন করে গড়তে চেয়েছিলেন ছফা। কোনো পিছু টানের মায়াবী ফাঁদ তাঁকে আটকাতে পারেনি।

একজন লেখক জাতির ক্রান্তিকালে কত বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেন তা বোধকরি ছফার কাছে না এলে উপলব্ধি করা যায় না। সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, জাতি, ধর্ম, সাহিত্য, দর্শন, সংস্কৃতি, শিল্পকলা প্রভৃতি সম্পর্কে ছফার দূরদর্শিতা মুগ্ধ না করে পারে না। সব বাধা পেরিয়ে নষ্ট সমাজে নিজেকে শক্ত খুঁটির মতো স্থাপন করেছিলেন ছফা। ছফা যেন এক বিদ্রোহের প্রতীক। যা কিছু নষ্ট, পচা, কলুষিত, বিকৃত তার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তিনি। ছফার পুরস্কারের প্রয়োজন নেই। প্রতিষ্ঠান ছফাকে পুরস্কার দিতে পারেনি তো কি হয়েছে! ছফা ঠিকই জাতিকে পুরস্কার দিয়েছেন। ছফার একেকটি সাহিত্যকর্ম জাতির জন্য একেকটি পুরস্কার। মাঝেমাঝে মনে হয় মৃত ছফা, জীবিত ছফার চেয়ে কতই না শক্তিশালী!