মহাশ্বেতা
কালো অক্ষর যার প্রতিবাদের ভাষা
তিনি সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। বাঙালি নারীদের মধ্যে বেগম রোকেয়া-পরবর্তী খুব কম লেখিকাই এমন প্রভাব রেখে গেছেন। সে হিসেবে তিনি বেশ ব্যতিক্রম। নিজের সৃষ্টিশীলতার মাঝে বেঁচে থাকবেন বহু দিন, সেটা সুনিশ্চিত। কিন্তু মানুষ তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে এটা একটা বিষয়। বাবা ছিলেন বিখ্যাত কবি মনীশ ঘটক। মা ধরিত্রী দেবী লেখক ও সমাজকর্মী ছিলেন। চাচা বিখ্যাত চিত্রনির্মাতা ঋত্বিক ঘটক। স্বামী নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য। ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্যও ছিলেন নামি লেখক। কিন্তু এত সব পরিচয়ের মাঝে নিজেকে রাখলেন আলাদা। নিজের পরিচয়ে ছাপিয়ে গেলেন অন্যদের। সদ্য প্রয়াত হলেন মহাশ্বেতা দেবী। আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কিন্তু রেখে গেলেন অসাধারণ সব সৃষ্টি।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি অধ্যাপনা এবং সামাজিক আন্দোলনও চালিয়ে গিয়েছেন সমানতালে। অনগ্রসর শ্রেণির জন্য তাঁর লড়াই চিরস্মরণীয়। আদিবাসীদের মধ্যে, বিশেষ করে লোধা ও শবরদের মধ্যে মহাশ্বেতা দেবীর কাজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও আদায় করে নিয়েছে। ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘অগ্নিগর্ভ’, ‘তিতুমীর’, ‘হাজার চুরাশির মা’সহ তাঁর একাধিক সৃষ্টি চিরন্তন হয়ে গেছে বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে। তাঁর একাধিক রচনা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন পুরস্কারজয়ী ছবি।
পারিবারিকভাবেই যোগসূত্র শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যের জগতের সঙ্গে। শুরুটা ও হয়েছিল ঠিক তেমনই। প্রথম জীবনে সাংবাদিকতা। পাশাপাশি তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিল্পনীতি সমালোচনা করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখতেন মহাশ্বেতা দেবী। শুধু বাংলায় নয়, তাঁর সময়ে ভারতের সবচেয়ে প্রবীণ সাহিত্যিকদের অন্যতম ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। গোটা দেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে সমসাময়িককালে সবচেয়ে সম্মানিত নামগুলোর অন্যতমও ছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের চলমান ঘরানা থেকে বেরিয়ে নতুন ঘরানা সৃষ্টি করেন মহাশ্বেতা। তাঁর ‘হাজার চুরাশির মা’ কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিল। মহাশ্বেতা দেবী মধ্যবিত্ত বাঙালি মায়ের নকশাল করা ছেলেটিকে হারানোর যে বেদনা, সেই বেদনার মধ্য দিয়েই ক্রমশ রাজনৈতিক হয়ে উঠেছিল তাঁর উপন্যাস ‘হাজার চুরাশির মা’। এ উপন্যাসের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে যেন একটা মোচড় এনে দিয়েছিলেন তিনি। আর সেই থেকেই শুরু। এরপর শুধু সাহিত্যচর্চার মধ্যে নয়, প্রান্তিক মানুষ নিয়েও মাঠে নেমেছিলেন মহাশ্বেতা। তুলে ধরেছিলেন তাঁদের দুঃখ, কষ্ট, অধিকার আদায়ের গল্প। এখানেই অনন্য মহাশ্বেতা দেবী! তাঁর উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধে কালো অক্ষরের শব্দে লিখতে থাকলেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা।
জীবনাবসানের আগে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। দীর্ঘ ৬৭ দিনের অসুস্থতার পর, যুদ্ধ শেষ হলো। মৃত্যুকালে বিশিষ্ট এই সাহিত্যিক, মানবাধিকার আন্দোলনকর্মীর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই নানা রোগে ভুগছিলেন এই লেখিকা। অসুস্থ ছিলেন ফুসফুসের সংক্রমণে। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা তো ছিলই। শ্বাসকষ্টেও ভুগছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। তাঁর মৃত্যু সংবাদে গভীর শোকের ছায়া নেমেছে গোটা এপার-ওপার দুই বাংলায়। কী রাজনৈতিক, কী সংস্কৃতিকর্মী, কিংবা সাধারণ ভক্ত। সবাই শোকে শোকাতুর। সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রের জগৎ থেকে তো বটেই, রাজনৈতিক শিবির থেকেও অনেকে শোক জ্ঞাপন করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেরেন্দ্র মোদি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যব্যক্তিত্ব শাঁওলি মিত্র, রুদ্র প্রসাদ সেনগুপ্ত, চিত্রপরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়, গোবিন্দ নিহলানি ও সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তীর মতো মানুষরা তাঁদের শোকের কথা জানিয়েছেন।
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিজয়গড় কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এই সময়েই তিনি একজন সাংবাদিক এবং লেখিকা হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীকালে তিনি পশ্চিমবাংলার আদিবাসী এবং নারীদের ওপর তাঁর কাজের জন্য বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হন। তিনি বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে বিভিন্ন আদিবাসী এবং মেয়েদের ওপর শোষণ এবং বঞ্চনার কথা তুলে ধরেছেন। সরকার কর্তৃক বিপুল পরিমাণে কৃষিজমি অধিগ্রহণ এবং স্বল্পমূল্যে তা শিল্পপতিদের কাছে বিতরণের নীতির তিনি কড়া সমালোচক। এ ছাড়া তিনি শান্তিনিকেতনে প্রোমোটারি ব্যবসার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছেন। সব মিলিয়ে মহাশ্বেতা দেবী একজন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন। মূলত বামপন্থী রাজনীতি করতেন। পরবর্তীকালে তিনি বামপন্থী রাজনীতির আন্দোলনের ধারা থেকে সরে আসেন। রাজ্য-রাজনীতিতে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় তাঁকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় দেখা যায়।
মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায়, ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার চলে যায় ভারতে। সেখানেই ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে প্রথমে শিক্ষকতা, পরে লেখালেখিতে মন দেন। ব্যক্তিজীবনে স্বামী বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে ১৯৫৯ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্য এবং বিজন ভট্টাচার্য মহাশ্বেতার আগেই প্রয়াত হয়েছেন। ঘটনাচক্রে মহাশ্বেতা দেবী এমন একটি তারিখে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন, যার ঠিক তিনদিন পরেই ছেলে নবারুণের মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯৯৬ সালে ভারতে সাহিত্যিকদের শ্রেষ্ঠ সম্মান জ্ঞানপীঠ পান। পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণে সম্মানিত হয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তাঁকে বঙ্গবিভূষণ সম্মানও দিয়েছিল। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। পেয়েছিলেন ম্যাগসেসে পুরস্কারও। প্রচণ্ড মানবতাবাদী, সমবেদনা, সাম্য এবং ন্যায়ের কণ্ঠস্বর মহাশ্বেতা দেবী আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর লেখা হাজার চুরাশির মা, তিতুমীর, অরণ্যের অধিকার অবিস্মরণীয় রচনা হিসেবে বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃত। এগুলো যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন বাংলা সাহিত্যে স্বমহিমায় আলো ছড়াবেন তিনি। কালো অক্ষর হয়তো তাঁর নতুন লেখা আর ছাপা হবে না। কিন্তু তাঁর পুরোনো সব সৃষ্টি আমাদের উদ্ভাসিত করবে মানবতার চেতনায়। সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বলতেই তাঁর মুখচ্ছবি ভেসে উঠবে আমাদের মানসপটে। আর এবাবেই অনন্তকাল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন মহাশ্বেতা দেবী।