স্মরণ
আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার পাঠসূত্র
আবদুল মান্নান সৈয়দ বাংলাদেশের সাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী লেখক। সারা জীবন ধরে কেবল একটি কাজই তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছেন—লেখাপড়া। কোনোরকম বাছবিচার না করেই ছাপতে দিয়েছেন লেখা, যেকোনো পত্রিকায়। মাঝেমধ্যে নিজের পূর্বদর্শনকে করেছেন অবহেলা। হয়েছেন সমালোচিত। তবু অনর্গল, ঝরনার মতো ঝরিয়েছেন কলমের কালি।
কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, গবেষণা, সম্পাদনা সব শাখাতেই মূল্যবান, নাতি মূল্যবান ও বিচিত্র রকমের চিন্তাসূত্র গ্রোথিত করেছেন, বিরাট কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির তোয়াক্কা না করেই। অবশ্য স্বীকৃতি নিয়ে, প্রতিষ্ঠা নিয়ে, এমনকি তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত বিতর্ক নিয়ে, আফসোস যে একটু ছিল, তা অনুধাবন করা যায় তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারে। মৃত্যুর আগের দিন একটি জাতীয় দৈনিকে (শিলালিপি, কালের কণ্ঠ) প্রকাশিত ওই আলাপনে তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমি মনে হয় কখনো প্রতিষ্ঠিত হব না। দুবার অসুস্থ হওয়ার পর যখন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি, তখনো যখন আমি স্বীকৃতি পাইনি, তখন আমার মৃত্যুর পরও আমাকে নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকবে। এই আমার বিধিলিপি।’
এখানে স্বীকৃতি বলতে যদি পুরস্কারপ্রাপ্তি হয়, তবে একুশে পদকের কথাই সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন কবি। কেননা, বাংলা একাডেমিসহ আরো বেশ কিছু ছোট-বড় পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। আর বিতর্কের জন্য তাঁর যে আফসোস, তারও জন্মদাতা মূলত তিনি নিজে। প্রথম জীবনে প্রবল প্রগতি চেতনা আর ষাটের অবিশ্বাস্য শিল্পক্ষুধা নিয়ে শুরু করলেও; জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছর মতো অতুলনীয় গ্রন্থ দিয়ে তাঁর কাব্যাভিযাত্রা শুরু হলেও; মাঝপথে তিনি কিছুটা অনির্দেশ্য গতিতে চলেছেন বলে মনে হয়। যেমন প্রচুর লিখেছেন, তেমনি বাম-ডান উদার-অনুদার নির্বিশেষে সকল পত্রিকায় তা ছাপতে দিয়েছেন, গেছেন সব ধরনের মানুষের আমন্ত্রণে। ফলত, আল মাহমুদের ঢঙে কারো কারো অপছন্দের পাত্র হয়েছেন। অতঃপর বিশ শতকের শেষ দশকে যখন সকল প্রশংসা তাঁর (১৯৯৩) নামে সুরা-আয়াত আর ধর্মবন্দনাকেন্দ্রিক কবিতাপুস্তিকা প্রকাশ করেছেন, তাঁর খুব ঘনিষ্ঠপাঠকদেরও তা দেখে ভিরমি খেতে হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই যে জীবনের শেষ মুহূর্তেও তাঁর কবিতা কিংবা অন্যান্য লেখালিখিকে বিজ্ঞানচর্চা হিসেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বিচিত্র রকমের রচনাকর্মকে বলেছেন জীবনানুসন্ধানের ব্যাপার। এবং এই ভাবনাকে সত্য ভেবে এগিয়ে গেলে হয়তো বা সৈয়দের সব ধরনের লেখার প্রতি সুবিচার করা সম্ভব হয়। অবশ্য এতাদৃশ তর্ক-বিতর্ক জিইয়ে থাকলেও আবদুল সৈয়দ যে বড় কবি এবং অসাধারণ সাহিত্য সমালোচক, এ বিষয়ে বিতর্কের বিশেষ পরিসর থাকে না।
২.
ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ (১৯৬৭) হাতে আবদুল মান্নান সৈয়দের অবিস্মরণীয় আবির্ভাব। নামে জন্মান্ধ হলেও টাইরেসিয়াসের মতো ভবিষ্যৎ দৃষ্টি সমৃদ্ধ এই গ্রন্থটি বাংলাদেশের কবিতায় পরাবাস্তব চিত্র-বৈচিত্রের এক অভূতপূর্ব প্রকাশ। জীবনানন্দীয় পরাবাস্তব চেতনা বা সুররিয়ালিজমের ভিন্ন অথচ স্বার্থক অগ্রগমণ বলা যেতে পারে। অথচ তাঁর বন্ধু, সহপাঠী সময়ের অন্যতম সহযোদ্ধা এবং সৈয়দের প্রথম গ্রন্থপ্রকাশের অর্থজোগানদাতা কবি আসাদ চৌধুরীর মুখ থেকে জেনেছি আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ নয়, ওই টাকায় প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল একই সময়ের আরেক অবিস্মরণীয় কবিপ্রতিভা রফিক আজাদের ‘অন্তরঙ্গ দীর্ঘশ্বাস’ নামক কবিতার বইটি। যা হোক ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’তে পাঠক পেয়ে গেলেন এক-একটি অভূতপূর্ব কাব্যপঙক্তি, অতুলনীয় চিত্রকল্প। অদ্ভুত সব উপমা আর অদৃষ্টপূর্ব চিত্ররূপময়তায় ঠাসা কবিতাগুলো কোনো কার্যকারণজাত বাস্তবতার ধার ধারে না, অনির্দেশ্য অবাস্তব এক বাস্তবতাকে কাব্যনান্দনিকতায় উপভোগ্য করে তোলে। অবয়বহীন জ্যোৎস্না সেখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে; দরজায় নীলিমায়, এমনকি গাছেও জ্বলতে থাকে সবুজ মশাল।
অন্যদিকে বাস, পুলিশ, দোকান কীভাবে একেকটি নক্ষত্রের মর্যাদা পায়, বরফাচ্ছাদিত হয়, এটা কেবল কবিই বলতে পারেন। অথবা তিনিও হয়তো পারেন না। পারেন না বলেই চাঁদ ও সূর্যের মতো অন্ধ হয়ে যায় তাঁর চোখ। নাকি চাঁদ-সূর্যের মতো সবকিছু দেখেন, যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা করতে পারেন না ! করা সম্ভব হয় না। ‘অশোক কানন’ কবিতায় দেখা যায়, জ্যোৎস্না তার কাছে ভূত কিন্তু একটি গানের ওপর, দরজা তার কাছে পুলিশ কিন্তু একটি জন্মের ওপর, মৃত্যু তার কাছে দোজখ কিন্তু একটি ফুলের ওপর।
কিংবা ‘রাত্রিপাত’ কবিতায়—দেখেছি ঘাসের মেঝে ছিন্ন, লাল মুণ্ডু নিয়ে খেলে বিনা অপব্যয়ে : সূর্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে কালো রেলগাড়ি; আল্লাহ আছেন তাঁর অবাক সৃষ্টিতে গালে হাত দিয়ে, মানে বৃষ্টি হচ্ছে, যেন ছেলেরা চলেছে স্কুলে।
এটাই হলো পরাবাস্তবতা। পরাবাস্তবতা এমন এক ধরনের বাস্তবতা, যে বাস্তবতার সঙ্গে ব্যবহারিক সত্যজাত বাস্তবতার মিল না থাকতে পারে; আবার থাকতেও পারে। থাকলেও তা সহজ কিংবা সরাসরি যে নয়, তা বলাই বাহুল্য। বস্তুত ‘সুররিয়ালিস্ট বা পরাবাস্তব চেতনার মূল ভিত্তি হলো অযুক্তি ও অবচেতন। গতানুগতিক নৈতিকতাবোধ, প্রচলিত সামাজিক ও শৈল্পিক কনভেনশন, একান্ত বস্তুনির্ভর যুক্তির শৃঙ্খল, এসব ভেঙে ফেলে পরাবাস্তববাদ গুরুত্ব দেয় জীবনের বিস্ময়ের ওপর, যা লুকিয়ে থাকে স্বপ্নে, অবচেতনে বিশৃঙ্খলায়, অতিপ্রাকৃতে, অস্বাভাবিকতায়, ভয়ে, অযুক্তিতে, কুসংস্কারজ্ঞানে, সকল গতানুগতিক নৈতিক ও নান্দনিক আইন-কানুনকে উড়িয়ে দেয়ার মধ্যে।’ (সাহিত্য কোষ/কবীর চৌধুরী)।
উদাহরণযোগে বলতে গেলে পরাবাস্তব কবিতার চিত্রগুলো আমাদের ঘুমের ভেতরে স্বপ্নের মতো। ঘুমের ভেতর ডুব দিলে আমরা যে রকম স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নের ভেতরে ভিন্ন আরো এক বা একাধিক স্বপ্ন দেখি, একটার পর একটা শৃঙ্খলাহীন, ধারাবাহিকতাশূন্য ছবি দেখি, ছবির সঙ্গে যুক্ত হই; চেতন বাস্তবতাকে ভুলে স্বপ্ন-বাস্তবতায় হারিয়ে যাই। অথচ ওই সব চলমান চিত্রমালার একটির সঙ্গে অপরটির কোনো সাযুজ্য খুঁজে পাইনে। তেমনি পরাবাস্তব চেতনাযুক্ত কবিতাতেও একটার পর একটা উপমা-চিত্রকল্পের দেখা পাওয়া যায়, তা চিত্র-প্রতিচিত্র কিংবা কাব্যিক অলংকার হিসেবে যতটা চমৎকার, ততটা বোধগম্য বা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। এবং আবদুল মান্নান সৈয়দ নিজেও কবিতায় সচেতন অপেক্ষা অচেতন বা অবচেতন মনকে কবিতায় গুরুত্ব দিতেন। বলতেন, ‘কবিতায় আমি সচেতনতায় বিশ্বাস করি না, আমি বিশ্বাস করি অবচেতনায়। আর অবচেতনে থাকে কবিতা। আমার ইচ্ছার বাইরে কবিতা। আমি কবিতা লিখতে চাইনি, আমার জীবনাভিজ্ঞতার কথা লিখতে চেয়েছি।’ (সাক্ষাৎকার/ শিলালিপি) । ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’র কবিতাগুলো ঘাঁটলে এ সত্য মূর্তিমান হয়ে ওঠে। যেমন—
১. খটখটে মাটির ভিতর উনিশ বছর আমি ছিপ ফেলে আছি আত্মার সন্ধানে। পায়ের তলায় দয়া চিবিয়ে একটিমাত্র চোখের একজন ভদ্রলোক খুলে দিচ্ছেন আমাকে; ঘৃণা-যন্ত্রণা-আক্রোশ ছোট ছোট নুড়ির মতো আমার কালো-হয়ে-আসা মুখের মণ্ডলে এসে পড়ছে, আমি ভূতের মতো উল্টো-পায়ে পুরোনো এই বাড়িতে উঠছি, নামছি, চাবিহীন হাসছি-কতোদিন আমি কাঁদিনি, মনে হলো : আমার একটিমাত্র কান্নার ফোঁটার উপর বিরাট একটি জাহাজ জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে, নোঙর নেমে গেছে মাটি ভেদ করে পাতালের দিকে, মাল্লারা দড়িদড়া ছুঁড়ে দিচ্ছে চারদিক থেকে, যে-মমতার দড়ি আমাকে ফেলছে বেঁধে। (পাগল এই যাত্রিরা)
২. পরিবর্তনের ছাদ বিড়ালের মতো অন্যমনস্ক হবার সুযোগে পা টিপে-টিপে এগোল আমার খোঁড়া আকাঙ্ক্ষা, বরফের মানুষ নাজেহাল ছোটো-ছোটো নুড়ির আওয়াজে—যখন দর্জি কাপড় হয়ে গেল মাংসভুক চেষ্টায়। (একেকটি দিন একেকটি সবুজভুক সিংহ)
৩. জ্যোৎস্না হয় জল্লাদের ডিমের মতো চুলহীন জলহীন মুণ্ডু, জোড়া-জোড়া চোখ, সাতটি আঙলের একমুষ্টি হাত, রক্তকরবীর অন্ধকার, এবং একগুচ্ছ ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ্বলজ্বলে চীৎকার। ( জ্যোৎস্না)
সন্দেহ নেই, উদ্ধৃতিগুলি অদ্ভুত, অসাধারণ। কিন্তু কবি যে সাক্ষাতে জানালেন—
‘আমার ইচ্ছার বাইরে কবিতা। আমি কবিতা লিখতে চাইনি, আমার জীবনাভিজ্ঞতার কথা লিখতে চেয়েছি’, এই কথাটিকে গুরুত্ব দিলে নতুন প্রশ্ন জাগতে পারে, কবিতা কি সত্যই কবির ইচ্ছার বাইরে? অচেতন বা অবচেতনভাবে কি জীবনাভিজ্ঞতা লেখা সম্ভব? জীবনাভিজ্ঞতা তো বাস্তবতা থেকে উৎসারিত জ্ঞানের সমষ্টি। আর বাস্তবতাকে যুক্তি-বুদ্ধির সমন্বয়ে প্রকাশ করলেই তবে তা যুক্তিগ্রাহ্য জীবনাভিজ্ঞতা হিসেবে গণ্য হয়। তাহলে?’
‘তাহলে এই-ই সত্য যে, বাস্তব সত্য আর কাব্যিক সত্য যেমন এক নয়, তেমনি সাধারণ জীবনাভিজ্ঞতা আর পরাবাস্তব কবিতার জীবনাভিজ্ঞতাও এক নয়। তবে একথাও সত্য যে, পরাবাস্তব কবিতাও অবচেতন মনে লেখা সম্ভব নয়, কোনো কবিতাই (যে কোনো রচনাই) অবচেতনভাবে লেখা সম্ভব বলে মনে হয় না; ইচ্ছার বাইরে তো নয়ই। এমনকি আবদুল মান্নান সৈয়দ নিজে বললেও, তাঁর কবিতাও যে অত্যন্ত সচেতনভাবেই সৃষ্ট, তা উপরের পঙক্তি কতিপয়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবু এই কথাটা ঠিক যে, গতানুগতিক যুক্তি-বুদ্ধি কিংবা সর্বজনগ্রাহ্য সত্যযুক্তির তোয়াক্কা করেন না পরাবাস্তব কবি। অযুক্তির যুক্তি কিংবা বিশেষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যুক্তিমত্তায় তাঁর অধিকতর কাব্য বিশ্বাস।’
‘একরত্তি দেহের তল্লাশে তাই পাজামা ঘোরে বাতাসে বাতাসে; মেয়ে ফানুসের অধিক মেয়ে মানুষেরা গড়ায়, ছড়ায়, ছড়া কাটে শপিং ব্যাগের মতো বিরাট এক এক জোড়া ঠোঁট খুলে । কখনও কাঁচা মাংসের ভূত লুকোনো একটি আলপিন জ্যোৎস্নার মতো বিঁধে ফেলে আর নারীর নর্দমা থেকে কুমারের মতো জেগে ওঠে অভাব ; শ্রুতির ভিতর সিংসং কণ্ঠস্বর পাঁচনের মতো, রমনদূতের মতো বসে থাকে ঈশ্বর ও শয়তানের প্রতিনিধি। কবিতা। হ্যাঁ কবিতাই এখানে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। কবির ভাষায় ‘বাঙালি কবিতা’। এই বাঙালি কবিতার এক বিস্ময়কর সান্ধ্যচিত্র ফুটে উঠেছে পরস্পর কবিতাটিতে, আরকলেবুর মতো ঘোলা সূর্য দেখা যাচ্ছে এখন, কুয়াশা হাবশির মতো তার আলখাল্লা গুটিয়ে চলে যাচ্ছে জানুয়ারির ভিতর,—আমরা পড়তে পারছি পরস্পরকে। দ্যাখো, ঐ স্ট্রিটে এখনো আলপিন ঝরছে অকালসন্ধ্যার মতো।’
এ রকম চেতন-অবচেতন, আধাচেতন-আপাতচেতন চিত্র-উপমাদি ছাড়াও অনেক বাস্তব সম্মত চিত্রগুচ্ছ আবদুল মান্নান সৈয়দের সমগ্রকাব্যচেতনার প্রাণসম্পদ হয়ে আছে। এমনকি পরাবাস্তবতার ঝাণ্ডাধারী জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ কিংবা ‘পরাবাস্তব কবিতা’ নামফলকযুক্ত বইয়ের পাতায় পাতায়। পরাবাস্তবতার পুরোধা কবি, সৈয়দের প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লেখা ‘জীবনানন্দ’ কবিতাটি কিংবা একই কাব্যের (পরাবাস্তব কবিতা ) ‘কম্পোজিটর কিভাবে কবিতা হয়ে উঠে’র মতো অসাধারণ পরাবাস্তব কবিতা বাস্তবতার গভীরতাস্পর্শী কবিহৃদয়ের অতুল্য অনুভূতি থেকেই উৎসারিত হতে পারে শুধু।
আবদুল মান্নান সৈয়দের বিরুদ্ধে একটা প্রচলিত অভিযোগ, তিনি সময়কে গুরুত্ব দেননি। অভিযোগটা অনেকাংশে সত্য।
যে সময়ে বসে কবিতাচর্চা শুরু করেন, সেই ষাটের দশকজুড়ে কিংবা সত্তরের শুরুতে বাংলাদেশি বাঙালির স্বাধিকার আন্দেলনের যে উর্ত্তুঙ্গতা বিরাজ করছিল, সৈয়দ তা এড়িয়ে গেছেন। বাংলাদেশের সকল কবিই যখন একুশের চেতনা, ছেষট্টির ছয়দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থান কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাপ্রসূত সময়ের অনিবার্য বাস্তবতায় কাব্যমুখর ; আবদুল মান্নান সৈয়দ তখন বিস্ময়রকমভাবে ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’, ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’, ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ’, ‘ঘুমের ভিতরে নিদ্রাহীন’ প্রভৃতি পরাবাস্তব, অধিবাস্তব কিংবা শুদ্ধ শিল্পরসঋদ্ধ কবিতা নিয়েই পথ হেঁটেছেন। যদিও কাব্যজীবনের অনেক পরে, একেবারে শেষদিকে এক অল্পপরিচিত কবিতাগ্রন্থ ‘শার্শিকাচ’ এর পাতায় ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১’ নামে দুটো কবিতা লিখেছিলেন তবু তাঁর সমগ্র কবিজীবনের তুলনায় বিন্দুতুল্যও নয়।
অবশ্য কবি নিজেই একথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘আমি যে কবিতা লিখতে চাই, খুবই দুঃখের কথা, পঞ্চাশ বছর ধরে লিখছি,... নিঃসময় কবিতা, সময়হীন কবিতা, দেশকালহীন কবিতা।’ তাহলে কি কবিতায় সময়কে, রাজনীতিকে, দেশকালকে ধারণ করার বিরুদ্ধে ছিলেন কবি ? তাছাড়া দেশকালহীন, নিঃসময় কবিতা লেখা আদৌ কি সম্ভব ? হয়তো না। উত্তরটা জানার জন্য কবির কাছেই যেতে হয় আবার। ‘কবিতাসমগ্র’তে ‘আমার কথা’ শিরোনামে সৈয়দ লিখেছেন, ‘কবিতায় দেশ কাল সমাজ রাজনীতি ধর্ম সব কিছুই আছে। এমনকি আমি তো মনে করি, কবিতা শ্লোগানও হতে পারে। তবে আমি নিজে এক নিঃসময় নির্দেশ অসামাজিক অরাজনীতিক অধার্মিক কবিতা অতিব্যক্তিগত কবিতারই সাধনা করেছি। তারপরও কবিতা ব্যক্তিবিশ্বাসকে ছাড়িয়ে যায় বলেই আমার কবিতাও কোথাও কোথাও স্পর্শ করে আছে সমাজ রাজনীতি ধর্ম দেশ কাল-কে। এবং এসবের মধ্য দিয়ে পাঠককেও। অতিব্যক্তিগত কবিতাও শেষ-পর্যন্ত অতিব্যক্তিগত থাকে না; বরং হয়ে উঠতে পারে সামাজিক, হয়ে ওঠে সামাজিক। মানুষী সংবেদন অনুভূতি অভিজ্ঞতার একটি সামান্যতা আছে : সেখানে আমি আমারই ভেতর দিয়ে গিয়ে অন্যদের হৃদয় ছুঁয়ে থাকি। শেষপর্যন্ত ব্যক্তিগত-অতিব্যক্তিগত বলে কিছু নেই বলেই মনে হয় আজ। যাকে আমি অতিব্যক্তিগত মনে করি তারও ভিতর দিয়ে আমি অসংখ্য মানুষকে আঁকড়ে ধরে আছি।’
প্রসঙ্গটিকে পরিস্ফুটিত করবার স্বার্থেই উদ্ধৃতিটিকে দীর্ঘ করতে হলো। একদিকে কবির কবিতারাজ্যে যে সময়হীনতার, দেশ-কাল-সমাজশূন্যতার প্রমাণ মেলে, কবি নিজেও তা স্বীকার করেন। কেবল স্বীকারই করেন না, স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দেন যে, ‘নিঃসময় নির্দেশ অসামাজিক অরাজনীতিক অধার্মিক কবিতা অতিব্যক্তিগত কবিতারই সাধনা করেছেন তিনি’। কিন্তু কবি সমাজের সর্বোন্নত মেধা ও আবেগসম্পন্ন মানুষদেরই একজন হয়ে কীভাবে দেশ-কাল-সমাজকে অস্বীকার করবেন? যে সমাজের, রাষ্ট্রের তিনি বাসিন্দা, সেই সমাজ-রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ শিকেয় তুলে রেখে কাব্যচর্চা কেন, কোনো চর্চাই সম্ভব নয়। মান্নান সৈয়দও তা পারেননি। পারেননি বলেই তাঁর একান্ত কিংবা অতিব্যক্তিগত কাব্যিক অনুভূতিগুলো অনেকক্ষেত্রেই ব্যক্তিক অনুভূতিকে অতিক্রম করে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠতে চেয়েছে। এবং উঠেছেও। তাই জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছের অশোক কানন, রাত্রিপাত, পাগল এই রাত্রিরা, জ্যোৎস্না, পরস্পর; জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসার রক্তের পলাশবনে কালো ফেরেশতা, ও চৈত্র ও ডানাঅলা ঘোড়া, স্বপ্নের এ্যানটেনা, কিংবা পরাবাস্তব কবিতা নামক কবিতাগ্রন্থের অতিব্যক্তিক কবিতাগুলোও তাই কাব্যমোদি পাঠকের রসগ্রহণে বাধা হয়ে উঠতে পারে না।
বাংলা সাহিত্যে যারা মৌলিক কবি কিংবা কথাশিল্পী হয়েও অপরের কবিতা কিংবা কথাসাহিত্য নিয়েই জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন সৈয়দ। মৌলিক লেখালেখি অপেক্ষা এই সমালোচনামূলক রচনাতেই অধিকতর মূল্যায়িত হয়েছেন এমন লেখকদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ অন্যতম।