উপন্যাস কিস্তি ২৪

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন

Looks like you've blocked notifications!

যেমতে পোলাখানে ঘাউরা নামেরে পায়!

ক্যান! ইসুফ মিয়ারে ভিতর বাড়িতে যাওনে আটকানি দেয় ক্যান এই মাতারি! মংলার মায়ে য্যান এট্টু বেশি মাতবরি দেহাইতাছে! এত বড় কইলজা হইয়া গেছে নি মাইনষের! ইসুফের মাথার ভিতরে গাম্মুর কইরা একখান গরম চেত লাফাইয়া ওঠে!

‘বাজান! আমি ভালা বুইল্লা আপনেরে কইছি কতাটা!’ মংলার মায়ে ভেদের খবর ভাঙতে থাকে, ‘হেগো বাড়ির জুলেখারে দেখতে আইছে ভোলাইল তেনে! বাড়িভরা মাতারি! এইর মিদে আপনে গেলে কোনো সমাদর পাইবেন নি?’

দেখতে আইছে জুলিরে! বিয়ার সম্বন্ধ! জুলির বিয়ার ঘর আইছে! হ, হ! জুলি তো ডাঙর হইছে। বিয়ার ঘর তো আইবোই! তাইলে আর কোনো ঝাঁকি-জালের দরকার নাই ইসুফের। কিছুরই দরকার নাই! ইসুফ মিয়ায় ফিরতি যাওনের লেইগা ঘোরা দেয়।

কিন্তু মংলার মায়ের কথা কিনা শেষ হয় নাই। বাইর হইতে থাকা কথাগো আবার ঠেইল্লা ভিতরে দিলে—তার তো দম-ফাঁপড় দশা হইয়া যাইবো গা! সেই কারণে সেয় তরাতরি ইসুফ মিয়ারে থামায়।

কয়, ‘আরেকখান কথা হুইন্না যান বাজান!’

কোন কথাখান?

‘এই যে জুলির সম্বন্ধের কথা! আইছে ঠিকই সম্বন্ধখান। কিন্তুক এইখানে কাম করোন ভালা হইবো না। পষ্ট দেহা যায় এইটা অপয়া সম্বন্ধ!’ মংলার মায়ে তার গলা আরো নামায়; ‘দেখতে আওনের আগেই কিনা হইয়া রইছে মাইয়ার জ্বর! জুলেখার গাও ভরা ধুমধুমা জ্বর! জুলেখার মায় তো মাইয়ারে মাতারিগো সামোনে আনতেই চায় নাই! আমি না শেষ-কাটালে বুঝ দিয়া কইলাম, বাড়ি বুইল্লা আইছে হেরা! দেহুক, জ্বরে পড়া মাইয়াই দেইক্ষা যাউক! হেগো শরবত বানান্তির লেইগাই ত্তো লেম্বুপাতা নিতে আইছি আমি!’

জুলেখার জ্বর আইছে! এই চিন্তাটাই আইতাছিলো ইসুফের পরানে। যেই দংশনটা খাইছে জুলি হাতে, জ্বর না আইয়া পারে! ঢাল দিয়া নামতে নামতে জুলেখার লেইগা পরানটা এট্টু য্যান কেমুন ছ্যাত ছ্যাত করে ছেড়িটার লেইগা। ছ্যাত ছ্যাত করে।

তারপর আচমকাই ইসুফ মিয়ার ছ্যাতছ্যাত করতে থাকা, খাবিজাবি খাইতে থাকা পরানখানের ভিতরে কেমুন একটা গোস্বা ঝটকা দিয়া ওঠে। আঁতকা য্যান ছেড়িটারে নিদয়া, পাষাণ মোনে হইতে থাকে ইসুফ মিয়ার। হ! নিদয়াই তো অই ছেড়ি! নিদয়া নাইলে কী উয়ে! শইল্লে জ্বর নিয়া পরের তেনে পর, অই কোন অচিন মাতারিগো সামোনে গিয়া যেয় বইতে পারে; সেয় একটাবার বাড়ির কোনোদিগের ঘাটায় আইয়া খাড়াইতে পারে না! কোনোরকমে একটাবার পারে না? উয়ে মোনে মোনে কী জানতাছে না, মিয়াভাইয়ে অর লেইগা পেরেশান অইতাছে!

মোনে মোনে উয়ে জানতাছে ঠিকই। কিন্তু গেরাজ্জি নাই অর। ইসুফরে নিয়া কোনো গেরাজ্জি নাই জুলির! ইসুফে অর কী লাগে! কিছু না। কিছু লাগে না। আইজ বাদে কাইল যারে পাঠানি হইবো খসমের ঘর করতে, হের ইসুফরে মোনে আনার কোন ঠেকা!

এই ভাবনাখান মোনের ভিতরে আহে খালি ইসুফ মিয়ার; অমনেই লগে লগে য্যান তার মাথার ভিতরে কেমুন এক তুফানে ঝাপটা বাড়ি দিতে থাকে। জোর ঝাপটা বাড়ি পড়তে থাকে—ঠাল্লুত-ঠুল্লুত। একবার কেমুন জানি একপ্রকার শরম হইতে থাকে তার নিজের লেইগা; একবার কেমুন জানি চেত ওঠতে থাকে। আবার, কার উপরে জানি সীমাছাড়া গোস্বা লাগতে থাকে।

এইসবের লগে লগে জুলিরেও কেন জানি বিষষের মতোন লাগতে থাকে। মরুক গা অই ছেড়িয়ে! আজাইরা কামে অই ছেড়ির লেইগা উতালা হওনের কোন ঠেকা পড়ছে ইসুফের! কোনো ঠেকা পড়ে নাই। জিন্দিগিতে আর কোনো দিন অই ছেড়ির মোখও দেখবো না ইসুফে!

এতরকম গোস্বা-চেত মাথায় নিয়া চলতে চলতে ইসুফেরে দেখো কোন কানা-অলায় ধরে! চির জন্মের চিনা রাস্তা দিয়া চলতে গিয়াও সেয় রাস্তা হারায়। নিজেগো বাড়ির সিধা রাস্তা থুইয়া আন্ধা-গোন্ধা কোনদিগে যায় গা তার পাও! যাইতে যাইতে তার এট্টু খেয়ালও আসে না যে, সেয় কোনদিগ তেনে কোনদিগে যাইতাছে! ধুছমুছাইয়া সেয় খালি যাইতেই থাকে, যাইতেই থাকে!

শেষে হয় কী, আঁতকা একটা কুঁদানি-বিলাপ-চিক্কুরের ঝাপটা আইসা তার কানেরে ধাক্কা দেয়। সেই ধাক্কা খাইয়া য্যান অর আধা-মাধা কোনোরকম এক-ছটাক হুঁশে আহে। এমনে কুঁদায় কেটায়! ইসুফ মিয়াগো নিজেগো বাড়িতে তো এমুন অসুরের লাহান কুঁদানি দেওনের কেউ নাই! বাইত তাইলে কুঁদায় কে!

তখন ভালা মতোন খেয়াল কইরা ইসুফে দেখে যে, সেয় তো দেহি বাড়ির ঘাটায় খাড়া না! সেয় খাড়া হইয়া রইছে গেরামের আরেক মাথার এক বাড়ির ঘাটায়। কোন সোম সেয় দেওভোগ গেরামের পুবের দিগের শেষ বাড়ির ঘাটায় আইয়া পড়ছে! দেখো, অই বাড়িতে কে জানি ধুম কুঁদাইতাছে! পুব মুড়ার এই শেষ বাড়িটা কাগো! এইটা ফালানির বাপের বাড়ি।

দিশা-বিশা না পাইয়া ইসুফে কতখোন খাড়াইয়া খাড়াইয়া ফালানির বাপের কুঁদানি শোনে। কুঁদানির লগে লগে অই মিয়ায় যে—নানান নাই-কতা কইয়া কারে জানি বকতাছে, সেই নাই-কতার বকাবাজিও শোনে। আবার এট্টু রইয়া-সইয়া ফালানির বাপে যে হুম্মুর-ধুম্মুর কিলানিও দিতাছে, সেই কিলানির আওয়াজও শোনে কতখোন ইসুফে!

অ! এই বাড়িতে মাইর-ধইর চলতাছে! এমুন কাহিনী দেওভোগ গেরামে নতুন নি! প্রায় প্রায় বাড়িতেই নিত্যিই হইতাছে এটি। এই অহন যেমুন অইতাছে ফালানিগো বাইত! ইসুফে বিষয়টারে গোনায় না নিয়া ফিরা-উল্টি দিয়া খালি বাড়ির রাস্তার দিগে এক কদম দিছে, শোনে; ফালানিগো বাড়ির ভিতর তেনে কোন মাতারি জানি জোর চিক্কুর দিতে দিতে আল্লারে ডাকা ধরছে!

ইইসিরে! বহুত মাইর-ধইরেরে তুফান ছুটাইছে তো ফালানির বাপে! ঘরের বৌ-ঝিরে এমনে মারে মাইনষে! মোনে মোনে ফালানির বাপেরে নিন্দা দিতে দিতে সেয় যাওয়া ধরে নিজের পোথে।

এমুন সোমে আবার চিক্কুর দিয়া ওঠে সেই মাতারির গলা, লগে লগে কঠিন-রকম ডুকরাইতে থাকে।

এইবার এই ডুকরানি আর কইলজা-ছিঁড়া চিক্কুরটা শুইন্না ইসুফের কী হয়, মাথাটা কেমুন য্যান চিলিক দিয়া ওঠে। সেয় এক ফালে গিয়া খাড়ায় ফালানির বাপের উঠানে। অইত্তো দেহা যায় ফালানির বাপেরে। ইয়া আল্লা! উঠানে ফালাইয়া দেখো মিয়ায় কেমুন হের বউরে খড়ম-পিটা করতাছে! আবার লগে লগে লাত্থিও দিতাছে! দেখছো বেপারখান!

যত খুশি তোমার ঘরের বিবিরে তুমি কিলাও-গুঁতাও, থয়-থাপ্পড় দেও; সেইটা ঠিক আছে। কিন্তু এই অবলা শইলরে—তোমার হারামি পাওয়ের লাত্থি দেও কোন মোখে! আবার, খড়ম দিয়া যে পিটাইতাছো; সেইটা করতাছো কোন বিচারে! খড়ম হইলো শক্ত-কাঠের জিনিস। সেইটার বাড়ি খাইয়া নাক-মোখ-মাথা-মোথা যে ভাঙবো না—তার কোনো ঠিক আছে! করতাছে কী মিয়ায়!

এমুন বেরহম হাতে মারে মাইনষে! হুদা শয়তানে ভর করছে তো এইটার উপরে।

অন্য সোম হইলে এই মাইর-ধইরের বিষয়খানরে কানে শোনতো ইসুফে, কিন্তু গেরাজ্জি করার দিগে যাইতোই না। হেগো বাড়ির বিষয়, হেরা বোঝবো। গেরামের সগলে চলে তো এই নিয়ম মাইন্না। ইসুফ মিয়ায়ও চলতে শিখছে সেই নিয়ম ধইরাই। কিন্তু আজকা তার কী যে হয়! মাথা আউলাইয়া যায় তার। কোন গোস্বা যে কার উপরে ঢালতে যায় ইসুফে, সেয় নিজেও বোঝে না! সব বিধি-বিধান জাইন্নাও, আজকা দেখো, ইসুফ মিয়ায় গিয়া কিনা ফালানির বাপের হাত জাপটাইয়া ধরে। আজকা কিনা সেয় ফাল দিয়া গিয়া থামানি দেয় ফালানির বাপেরে!

ইসুফে তেইরা এক ছুট দিয়া গিয়া ফালানির বাপের ডাইন হাতখান জাপোইট্টা ধরে। ধইরা তারে কয়, ‘আরে মিয়া কী করতাছেন এটি! এমনে মারে মাইনষে! মাথা ফাইট্টা দি লউ বাইর হইতাছে আপনের বউয়ের! থামেন! থামেন!’

‘কোন হালার পুতে আইয়া হাত ধরে রে!’ ফালানির বাপে কোরোধে দাপাইতে দাপাইতে চাইয়া দেখে, জীবনে না বর্ষে—এইটা কে আইয়া খাড়া তার উঠানে! আইছে আইছে, আবার কিনা তার ডেনায় ধইরা তারে থামোনের হুকুমও দিতাছে! তুমুকগো বাড়ির ইসুফের আঁতকা কোন দর্দ ধরছে এই মাগির লেইগা! কী লো মাগি!

হাত নাইলে বন্ধ আছে, কিন্তু পাও তো খোলা। ইসুফ মিয়ায় আটকানি দেওনের আগেই ফালানির বাপে সেই খোলা পাও দিয়া তার বউরে আরো দুই লাত্থি দিয়া সারে। তার বাদে, হাতের খড়মখান উঁচাইয়া ধইরা সেয়, ইসুফ মিয়ারে গালিগালাইজের ধুম ছুটায়। 

‘আমার বাইত আমার পরিবাররে আমি মারি-কাটি, আমি বুজমু! তুমি হালারপো কেটায় আহো নিষেদ দিতে! ছাড় আমারে! হালার পো! ছাড়! আমার বাইত আইয়া আমার লগে তামশা করো! এত্তা বড়ো কইলজা তর! খাড়া, কইলজা বাইর করতাছি! আজকা তর হাড্ডি গুঁড়া কইরা না দিছি, তয়, আমি মাইনষের জন্ম না! হালার ঘরে হালা! বুঝি না কিছু মোনে করছো?

এই ছিনালে তাইলে তলে তলে রং-তামশা করতাছে তর লগে!’

কী! হুদামিছি ইসুফরে নি কলঙ্কী বানানের মতলব ধরছে এই বুইড়া খাচ্চরে! অর এক হাত তো ইসুফের হাতে ধরা। আরেক হাতে খড়ম-উঁচানি দিয়া ইসুফেরে আবকতালি কুকথা কইয়াই থাকে ফালানির বাপে। ‘তর পয়মালের ছাও! কুকথা কওনের আর জায়গা পাইতাছো না!’ জোর কুঁদানিখান দিয়া ফালানির বাপেরে কঠিন একটা ধাক্কা মারে ইসুফ মিয়ায়। দেখ, বুইড়ার পো বুইড়া!

শয়তানির ফল দেখ!

ইসুফ মিয়ার ধাক্কার চোটে ফালানির বাপে ঘত্তর কইরা মাটিতে গিয়া পড়ে। পইড়া আন্ধা-ঘুন্ধি চিক্কুর দিয়া দুনিয়া ফাটাইতে থাকে সেয়। একদিগে ফালানির মায়ের বিলাপ, আরেকদিগে ফালানির বাপের চিক্কুরে খাবি-জাবি খাওয়া বাড়িখানরে পিছে থুইয়া ইসুফ মিয়ায় নিজেগো বাড়ির দিগে মেলা দেয়।

যাইতে যাইতে, ক্রমে, সেয় দেখে কী, আরে কী সোন্দর! এই হাতাহাতির কর্মখান তো তার বড়ো উপকার করছে! এতক্ষণ, অই যে জুলেখার লেইগা এমুন দাপাদাপি-পোড়াপুড়ি চলতাছিলো তার পরানে; এই মাইর-ধইরের বিত্তান্ত তো দেখি, সেই যাতনারে তো একদম নাই কইরা দিছে! আর তো কোনো জ্বালাপোড়া নিজের ভিতরে দেখতাছে না ইসুফ মিয়ায়! ফালানির বাপেরে মাইরা তো তাইলে সেয় ভালা একটা কাম করছে! ভালা করছে! বহুত ভালা কাম করছে ইসুফে।

পরের দিন দোপোরে সেয় খালি বইছে খাইতে, এক নলা ভাতও মোখে দিছে কিনা ঠিক নাই; মায় কালা আন্ধার মোখে আইসা বয় তার সামোনে। থমথমা হাতে পাতের কিনারে নুন দিতে দিতে জিগায়, ‘ফালানির বাপেরে মারছস তুই?’

‘হ, মারছি।’ ভাত লাড়তে লাড়তে ইসুফে স্বীকার করে। ‘কিন্তুক কোন কারোনে মারছি হেইটা হোনবা না?’

‘এমুন কুপুত নি আমারে পেটে ধরতে অইছে!’ মায়ের গালিগালাইজের ছোলা শুরু হইয়া যায়, ‘ধিক এমুন পুতের! ওটোলোক ছোটোলোকের লগে যায় জোলাইতে! বাপের মান-মর্যাদার দিগে চায় না যেই পুতে, তার পাতে ছাই!’

‘আইচ্ছা তাইলে ছাইই খামু!’ ঘড়াত গলায় জব দেয় ইসুফে একদিগে, আরেকদিগে দেহো তার ডাইন হাতখানে কী করে! ডাইন হাতখানে সাৎ কইরা উল্টাইয়া ফালাইয়া দেয় গরম ভাতের থালেরে। 

আয় হায় হায়! খোদা! ফুবু লৌড়ানি দিয়া আইতে আইতে আল্লারে ডাক পাড়তে থাকে; ‘করলো কী! করলো কী মাথা-গরম পোলাটায়! বাড়া-ভাতেরে নি এমনে ছিদ্দত করে! কিছমত না কাটা যায় এমুন করলে! পাতের ভাত এমনে মাটিতে ফালায় মাইনষে! এমুন করে না বাজান!’

কোনো বুঝের কথার ধারও ধারে না ইসুফ মিয়ায়! সেয় গমগমাইন্না পাওয়ে কোনদিগে জানি হাঁটা দেয়! মাটিতে-পড়া ভাতটিরে মোকাবিলা চক্ষের সামোনে নিয়া মায় বইয়া থাকে য্যান ঠাটা-পড়া লোক। 

এদিগে দেহো, ঠিক কিনা সেই সোমই ইসুফ মিয়াগো রান্ধনঘরের সামোনে খাড়া বেঙির দাদিয়ে। সেয় আইছিলো দুই-মুঠ নুন কর্জ নিতে। সেয় তার চক্ষের সামোনে ঘটতে দেখে এই বাড়ির পোলার হারামি কিরতিখান! মায়ের মোখ বরাবর ভাতের থাল উল্টাইয়া ফালায় যেই পুতে, মোখে তারে তুমি যতোই কিনা ব্যাখ্যান করো; বেঙীর দাদিরে তুমি ভুলাইতে পারবা না!

কিয়ের ভালা এই ছেড়ায়! এয় তো দেহি দুনিয়ার ঘাউরার ঘাউরা! ঘাড়-তেরা, কাইজ্জা-খোর! মিছকা শয়তান! ফালানির বাপেরে তো তাইলে উয়ে হুদামিছিই পিটাইছে!

নুন নিতে আইসা যেই ঘটনা চক্ষের সামোনে হইতে দেখে বেঙির দাদিয়ে, সেইটা পুরা গেরামের মাইনষেরে সেয় আধাবেলার মিদে জানানি দিয়া সারে! সন্ধ্যা-রাইতের মইধ্যে দেওভোগ গেরামের কেউর জানোন বাকি থাকে না যে, হেগো বাড়ির ইসুফেরে ভালা কয় যে, হেয় অহনও মায়ের পেটে বাস করে। এই ছেড়ায় কিয়ের ভালা! ভালা না। এতদিন ভালামাইনষের চেহেরা নিয়া আছিলো ঠিক, কিন্তুক আসোলে ছেড়ায় একটা চাঁড়ালের চাঁড়াল। চক্ষের পাতা উল্টাইন্না নির্দয়! খালি টেকা-অলার পুত দেইক্ষা এতদিন বিষয়টা লোকের নজরে আহে নাই! আলা ভিতরের রূপ বাইর অইতাছে। 

কিয়ের তেনে কী হইয়া গেলো সোনার টুকরা পুতে! ইসুফ মিয়ার মায়ে কাইন্দা জারে-জার হয় তার ননাসের কাছে। এমুন বেত্তমিজ তো তার পুতে জিন্দিগিতেও আছিলো না! জন্মের পর তেনে তো এই ফুবুয়ে দেইক্ষা আইতাছে ইসুফ মিয়ারে; সেয় দেখছে কোনোদিন পোলারে চোখ তুইল্লা একটা কথা কইতে?

না না! কয়দিন আগে তরি ইসুফ মিয়ারে লাগছে য্যান নরম দিলের, বুঝদার পোলা! এই পোলার স্বভাব নিয়া ফুবুর মোনে যদিও এট্টু সন্দেহ খচখচাইছে, তলে তলে সকল সোমই খচখচাইছে—কিন্তু মোখে সেয় কোনোদিন প্রকাশ করে নাই। সন্দেহ আওয়ার লগে লগে ফুবুয়ে নিজের মোনেরে এই বুঝ দিছে যে, আলা কিনা ইসুফে সিয়ানা ডাঙর হইছে! ছোটোকালের পোংটামির খাসলত তো আর তার থাকোনের কথা না!

নাইলে, যেই সর্বনাইশ্যা পোংটা আছিলো এই ইসুফের মায়ের ইসুফে! সীমাছাড়া পোংটা। ‘কিগো বউ, তর কি সেইসগল কথা মোনে নাই?’ ননাসে ইসুফের মায়েরে জিগায়।

‘কী কন বুজি? অমুন সর্বনাইশ্যা কিরতির দাগ কইলজার তেনে মোছে নি কোনোদিন!’ ইসুফের মায়ের চক্ষে আবার অজ্জোর ধারা শুরু হয়। হায় হায় রে! কী বিপদই না গেছে একদিন!

একদিন করছে কী, এই ননাসের বাড়িতেই নাইওর গেছে ইসুফ মিয়ার মায়। তহন ননাসের খসম জ্যাতা। ভরাপুরা সংসার তাগো তহন। মায়ের লগে গেছে তার পোলাপাইনটি। কথা আছিলো পোলাপাইনগিলি লইয়া ইসুফ মিয়ার মায়ে কয়টা দিন থাইক্কা যাইবো ননাসের বাড়িতে।

এতদিন বাদে ভাইয়ের বউ, আর পোলাপাইনটি আইছে তার বাড়িতে! সেই খুশিতে মটকিতে তোলা বিন্নি ধান তরাতরি বাইর করে ইসুফ মিয়ার ফুবু। অতি হাউসের সঙ্গে, আরো তিন তিনজোন মাতারিরে লইয়া পুরা আছরের ওয়াক্ত ভইরা খই ভাজতে থাকে ফুবুয়ে।

খই ভাজোন যাহা-তাহা ঝামেলার কাম না! দুনিয়ার পেরেশানি যায় এই কর্ম সমাধা করতে। সেই কর্ম করতে করতেই ফুবুয়ে দেখে যে, অন্য সগল পোলাপাইনে বাউলি কাটতে কাটতে আইসা ফুবুর খইভাজা দেইক্ষা যাইতাছে ঠিকই, তয় আসতাছে তারা এক ঝলকের লেইগা।

কিন্তু ইসুফে আইয়া যে এক কোণে ঠেটা দিয়া খাড়াইয়া আছে তো আছেই। লড়ে না সরে না। উঠানের খোলা চুলায় জ্বলতাছে দমদমা আগুন। সেই আগুন-ভরা, দুই-মোখা চুলার উপরের তপ্ত খোলায় দেওয়া হইতাছে এট্টু এট্টু ধান। ফুবুর লগে এক মাতারি সেই খোলারে ধুম লাড়তাছে, তার বাদে ফুটফুটন্ত খইয়েরে ঝাপ্পুর-ঝুপ্পুর ফালাইতাছে ঝাঁঝরে! 

ফুবু কতখোন পর পর একমুঠ একমুঠ কইরা খই ইসুফ মিয়ার হাতে দেয়; আর সোনাধন কইরা কয় যে, এমুন আগুনের কাছে থাকোনের কাম নাই পোলার। যাও বাজান, খেলো গা। ওম্মা!
পোলায় তো সরে না। খই খাইয়া লইয়া সোন্দর খাড়াইয়া থাকে, আর খই ফুটন্তি দেখে।

মাগরিবের সোমে বোঝা যায় তার সেই খই-ভাজা দেখোনের মরতবা! হায় হায় হায়! অত্তাটুক পোলায় দেখো কোন তুফান সর্বনাইশ্যা কামখান ঘটাইতে যায় ফুবুর বাড়িতে!

কী করে সেয়? করে কী, মাগরিবের সোমে ইসুফে গিয়া ফুবুর একটা ধানের ডোলে আগুন দিয়া দেয়। ঘরের বড়োরা তহন কাহিল-পেরেশান হইয়া এট্টু জিরাইতাছে। এই মাগরিবের আজান পড়লো বইল্লা। তহন সন্ধ্যাবাত্তি দেওনের লৌড়-ঝাপটাও আইয়া পড়বো! এই সব মোনে নিয়া সগলে যে যার মতোন খালি এট্টু বইছে, তখন বাড়ির পচ্চিমের গোলাঘর তেনে শোনা যায় এই হাড়ুত-মাড়ুত চিল্লা-পাল্লা। কী! কী হইছে! না! উঠানের খোলাচুলার তেনে আংড়া আইন্না ইসুফ মিয়ায় এক ধানের ডোলে আগুন দিছে!

ডোল শুকনা ধানে সোন্দর কানায় কানায় ভরা। শুকনা ধানেরা আগুনের এট্টু হলকাটা পায় খালি, অমনেই দপদপাইয়া জ্বইল্লা ওঠে! হায় হায় হায়!

ক্যান ডোলের ধানে আগুন ধরাইতে হইছে অরে! না; অর বোলে দেখার বাঞ্ছা হইছে যে, ডোলের এই এতাটি ধানের তেনে কতাটি খই পাওয়া যাইবো! হায় হায় রে! কেমুন ডাকাইত পোলা এইটায়! ভালা-বুরার বোধখান নাই! দিছিলো তো আউজকা ফুবা-ফুবুর জন্মের সর্বনাশ কইরা! 

কপাল ভালা যে, আগুনের ঘটনাখান ইসুফ মিয়ার ফুবার চক্ষে পড়ে, প্রায় লগে লগেই। এক কোপে সেয় ডোলের বেড়া কাইট্টা দেয়। শেষে সগল ধান মাটিতে ফালাইয়া আগুন নিভাইতে নিভাইতে এক প্রহর রাইত কাবার হইয়া যায়।

তো, সেই পোংটামির বীজ কী পুরা নাই হইয়া যাইবো গা নি রক্তের তেনে! না। যাইবো না। যায় নাই। সেইটাই এমুন ঘাউরামির চেহারা ধইরা এই জুয়ান বয়সে বাইর হইতাছে। তার বাদে, এমুন করার পিছে আরো বড় এক গুপ্তি কারণ তো আছেই।

কোন কারণ?

অই যে, বৈদেশে বাণিজ্যে যাওনের নিশাখান! 

(চলবে)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৩)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২২)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন  (কিস্তি ১৩)​

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)​

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)​

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)