বানান বিতর্ক

বাংলা বানানের যম ও নিয়ম (দ্বিতীয় পর্ব)

Looks like you've blocked notifications!

অর্থব্যক্তি না ব্যক্তিগৌরব

‘এরূপ তুচ্ছত্ব বোধক প্রয়োগ সকল বিবেক রহিত অভিমানি প্রভুরা করিয়া থাকেন, অতএব বিজ্ঞ ব্যক্তিদিগের এ সকল প্রয়োগে বিশেষ মনোযোগের প্রয়োজন নাই।’

         —রামমোহন রায়, (‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ,’ পৃ. ৪১)

বাংলায় কেমন করিয়া প্রশ্ন করিতে হয় তাহার বিবরণ রামমোহন রায় বেশ দিয়াছেন। এই বিবরণ অবহেলার বস্তু নয়। ইহাতে দেখিবেন সহি বড় ‘কি’ শব্দের নানা ব্যবহার।

‘ক্রিয়া ও তৎসহচারি পদের শেষ যে স্বর তাহার দীর্ঘ উচ্চারণদ্বারা প্রশ্নের প্রতীতি হয়। ক্রিয়ার আকারের প্রভেদ কিম্বা অন্য কোন অব্যয় কিম্বা কোন শব্দ সংযোগের প্রয়োজন রাখেন না, যেমন তুমি যাইতেছ? তুমি গিয়াছিলে? তুমি যাবে না?

আর কখন প্রশ্নদ্যোতক শব্দ যে “কি” তাহা ক্রিয়ার পূর্ব্বে কিম্বা পরে নিঃক্ষেপদ্বারা প্রশ্নের প্রতীতি হয়, যেমন তুমি কি যাবে? তুমি যাবে কি? তুমি কি না যাবে? তুমি কি যাবে না?

আর কি স্থানে কখন “নাকি” প্রয়োগ করা যায়, যখন প্রশ্নকর্ত্তা ক্রিয়া বিষয়ের কোন উল্লেখ জানিয়া থাকে, যেমন তুমি নাকি যাবে? অর্থাৎ তোমার যাইবার কথা পূর্ব্বে শুনিয়াছি তদর্থে প্রশ্ন করিতেছি।

কখন ক্রিয়া দ্বিরুক্তি হয় তাহার এক ভাবার্থে, দ্বিতীয় অভাবার্থে হইয়া থাকে, আর প্রশ্নের দ্যোতক কি শব্দকে তাহাদের মধ্যে রাখা যায়, যেমন, তুমি যাবে কি না যাবে? অর্থাৎ তুমি যাবে কি না?’ (গৌড়ীয় ব্যাকরণ, পৃ. ৪৯-৫০)

যাঁহারা রামমোহন পড়িতে হোঁচট খাইতেছেন তাঁহাদিগের ঘেন্না প্রার্থনা করিয়া বলিব ‘কখন’ শব্দ ‘কখনো’ ধরিয়া পড়িলে উপকার পাইবেন। রাজা যাহা বলিয়াছেন তাহা যথার্থ কথা। কিন্তু তিনি—মনে রাখিবেন—‘সময়ের অল্পতা প্রযুক্ত কেবল পাণ্ডুলিপি মাত্র প্রস্তুত করিয়াছিলেন পুনর্দৃষ্টিরও সাবকাশ হয় নাই’। আমরা তাই প্রথম অনুচ্ছেদটি ভাঙ্গিয়া তিন অনুচ্ছেদ করিয়াছি মাত্র। অন্য কোন সম্পাদনা করি নাই।

এক্ষণে প্রশ্ন হইতেছে বাংলা ভাষার এই ভাব কোথা হইতে জন্মিল। সংস্কৃতের দিকে যাঁহারা তাকাইতে তাকাইতে চক্ষু মুদিত করিয়াছেন তাঁহারা তো আর দেখিলেন না। এই ঠিকুজির জন্য মুণ্ডা পূর্বনারীদের দিকে তাকাইবেন। আমি তাকাইব। ডাক্তার ক্ষুদিরাম দাস খানিক তাকাইয়াছেন সাঁওতালী নারীদের দিকে। নারী কথাটা গুজব হইতে পাইয়াছি। ইহাতে নাকি ‘প্রকৃতি’ বুঝায়। বাংলা ভাষার স্বভাব বা প্রকৃতি (মানে নারী) মুণ্ডারি জাতির ভাষা হইতে পাওয়া। এই দাবি এখনও প্রতিষ্ঠা পায় নাই। আমি আপাতত দাস মহোদয়ের ভিক্ষা গ্রহণ করিতেছি। মহাশয় লিখিতেছেন:

‘সাঁওতালী বাক্যভঙ্গীর সঙ্গে বাঙলা বাক্যভঙ্গীর কিছু সাদৃশ্য অবশ্যই পাওয়া গেছে। সেটি হ’ল প্রথম কর্তা শেষে ক্রিয়া। ঐ ক্রিয়ার মধ্যে যদিও বিশেষণ অব্যয় কর্তার রূপ প্রভৃতি একত্র যুক্ত হয়, কিন্তু মোটামুটি কর্তা ও ক্রিয়ার মাঝখানে কর্ম, অধিকরণ সম্বন্ধ প্রভৃতি ব্যাপার সাঁওতালীতে বাঙলার মতোই দেখা যায়। শব্দ-সন্ধির বা স্বরসন্ধির ক্ষেত্রে বাঙলার মতো য়-শ্রুতি প্রয়োগও সাঁওতালীতে লক্ষণীয়।

সাঁওতালীতে শব্দে শব্দে জোড়া লেগে উচ্চারণে এক শব্দ হয়ে গেলেও পৃথক শ্বাসাঘাতের জন্য সেগুলি মিলে গিয়ে হ-য-ব-র-ল হয়ে দাঁড়ায় না। এই শ্বাসাঘাত বাঙলা উচ্চারণেরও একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এবং সংস্কৃত-প্রাকৃত থেকে বাঙলা ছন্দের উদ্ভব অল্পবিস্তর এই শ্বাসাঘাতই নিয়ন্ত্রিত করেছে।’ (‘বাঙলা ভাষায় সাঁওতালী উপাদান,’ পৃ. ৮০)

‘তুমি কোন জিনিস রান্না করিতেছ?’ এই অর্থ করিতে যাঁহারা ‘কি’ শব্দটি ব্যবহার করিবেনই তাঁহারা ‘কী’ না লিখিয়া অনায়াসেই লিখিতে পারেন ‘তুমি কিই বা রান্না করিতেছ?’ ইহা সাঁওতালী নিয়মের বাংলা হইত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্বেগ ইহাতে সামান্য প্রশমিত হইতেও পারিত। বাংলা ভাষায় ‘কি’ স্থলে ‘কিই’ লিখিতে অন্যায় নাই। তাহাকে ‘কী’ করিবার বুদ্ধি সংস্কৃতের অনুচিকীর্ষা বৈ নহে। বাংলায় ‘কি’ এবং ‘ই’ পাশাপাশি বসিয়া থাকিতে সক্ষম।

মনীষী ক্ষুদিরাম দাসের কথা আরও একটুখানি শুনিতে হয়। তিনি দেখিয়াছেন, “সাঁওতালীর সঙ্গে বাঙলা বাকরীতির আর একটি সাদৃশ্য স্বরের উত্থান-পতনে। সাঁওতালীতে জিজ্ঞাসাবোধক বাক্যে ‘কি’ শব্দ থাকে না, বাক্যে শেষের দিকে স্বরের উচ্চতা থাকে, আর তাতেই প্রশ্ন বোঝা যায়। বাঙলায় ‘কি’ শব্দ থাকুক না-ই থাকুক, প্রশ্ন-বাক্যে স্বরের উত্থান শেষের দিকে। তুলনায় ইংরেজিতে গোড়ার দিকে এবং ক্রিয়া বা সহায়ককে আগে স্থান দিচ্ছে।”(‘বাঙলা ভাষায় সাঁওতালী উপাদান,’ পৃ. ৮০)

প্রাচীন সংস্কৃতে অর্থব্যক্তির শক্তি তিন প্রকার বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছিল। যথা: অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা। অভিধাশক্তি অন্য অনেক লক্ষণের মধ্যে ব্যবহার দ্বারাই নির্দিষ্ট হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখিয়াছিলেন, ‘অর্থব্যক্তির বিশেষ কোন নিয়ম নাই, তবে দুই একটা সঙ্কেত আছে।’(বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৫৯) “আদালত হইতে যে সকল আজ্ঞা, সকলের জানিবার জন্য প্রচারিত হয়, তাহাকে ইশ্তিহার বলে। ইহার আর একটি নাম ‘বিজ্ঞাপন’।” —এই পর্যন্ত লিখিবার পর বঙ্কিমচন্দ্র যোগ করিয়া বলিলেন,

‘বিজ্ঞাপন’ সংস্কৃত শব্দ, ইশ্তিহার বৈদেশিক শব্দ, এ জন্য অনেকে ‘বিজ্ঞাপন’ শব্দ ব্যবহার করিতে চাহিবেন। কিন্তু বিজ্ঞাপনের একটু দোষ আছে। তাহার অনেক অর্থ হইয়া উঠিয়াছে। গ্রন্থকর্ত্তা গ্রন্থ লিখিয়া গ্রন্থের পরিচয় জন্য প্রথম যে ভূমিকা লেখেন তাহার নাম ‘বিজ্ঞাপন’। দোকানদার আপনার জিনিস বিক্রয়ের জন্য খবরের কাগজে বা অন্যত্র যে খবর লেখে, তাহার নাম ‘বিজ্ঞাপন’। সভা কি রাজকর্ম্মচারীর রিপোর্টের নাম ‘বিজ্ঞাপন’। ‘বিজ্ঞাপন’ শব্দের এইরূপ অর্থের গোলযোগ আছে। এস্থলে, আমি ইশ্তিহার শব্দই ব্যবহার করিব। কেননা, ইহার অর্থ সকলেই বুঝে, লৌকিক ব্যবহার আছে। অর্থেরও কোন গোল নাই।”(বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৫৯-৬০)

এতদিনে আমাদের মনে হইতে পারে বঙ্কিমের উদাহরণটি মরিয়া গিয়াছে। এখন ইশ্তিহার শব্দের সেই লৌকিক ব্যবহার আর নাই। আজিকালি আদালত হইতে প্রচারিত আজ্ঞাসকল আর ইশ্তিহার শব্দে প্রকাশ হয় না।

কিন্তু তাঁহার দ্বিতীয় সঙ্কেতটি এখনও জীবিত রহিয়াছে। বাংলায় জাতি শব্দের নানা অর্থ। বঙ্কিম নিজেই পাঁচ পাঁচটি অর্থের তালিকা লিখিয়াছেন:

‘প্রথম, জাতি (Caste) অর্থে হিন্দুসমাজের জাতি; যেমন ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কৈবর্ত্ত ইত্যাদি। দ্বিতীয়, জাতি অর্থে দেশবিশেষের মনুষ্য (Nation); যেমন ইংরেজজাতি, ফরাসীজাতি, চীনজাতি। তৃতীয়, জাতি অর্থে মনুষ্যবংশ (Race); যেমন আর্য্যজাতি, সেমীয়জাতি, তুরানীজাতি ইত্যাদি। চতুর্থ, জাতি অর্থে কোন দেশের মনুষ্যদিগের শ্রেণীবিশেষ মাত্র (Tribe); যেমন, য়িহুদায় দশজাতি ছিল। প্রথমত, ‘নানানজাতি পক্ষী’, ‘কুক্কুরের জাতি’(Species) বলিলে যে অর্থ বুঝায়, তাই। ইহার মধ্যেও কোন অর্থ প্রকাশ করিতে গেলে, জাতি ভিন্ন বাঙ্গালা অন্য শব্দ নাই। এস্থলে জাতি শব্দই ব্যবহার করিতে হইবে। কিন্তু ব্যবহার করিয়া তাহার পরিভাষা করিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবে যে, কোন্ অর্থে ‘জাতি’শব্দ ব্যবহার করা যাইতেছে। বুঝাইয়া দিয়া উপরে যেমন দেওয়া গেল, সেইরূপ উদাহরণ দিলে আরও ভাল হয়।’ (বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৬০)

শব্দের অর্থব্যক্তির দ্বিতীয় উপায় লক্ষণা। যথা: ‘বাণিজ্যে দেশ ধনশালী হয়’। এখানে ‘দেশ’ শব্দের অভিধাশক্তি দেশ বা স্থান। কিন্তু লক্ষণাশক্তির কারণে এস্থলে দেশ পদে ‘দেশের লোক’ বুঝাইতেছে। (জগদ্বন্ধু মোদক, বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও রচনা-শিক্ষা, পৃ. ১৪৩) রাস্তায় চলিতে চলিতে আপনি যখন ‘এই রিকসা’ বলিয়া হাকডাক শুরু করেন তখন রিকসাওয়ালা চলিয়া আসে। ইহার নামই লক্ষণাশক্তি। ইংরেজি জবানে মেটোনিমি। বাংলায় লক্ষণাশক্তির অজস্র ব্যবহার আছে। নামটা না ধরিলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লক্ষণার ব্যবহার বড় ধরিতে পারিতেন। তাঁহার ‘বাংলা শব্দদ্বৈত’, ‘ধন্যাত্মক শব্দ,’ ও ‘ভাষার ইঙ্গিত’প্রভৃতি প্রবন্ধ লক্ষণার উদাহরণে টইটম্বুর।

অর্থব্যক্তির তৃতীয় পথ ব্যঞ্জনা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার ‘আত্মজীবনী’ পুস্তকে লিখিয়াছেন, “দিদিমা মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব্বে আমাকে বলেন, ‘আমার যা কিছু আছে আমি তাহা আর কাহাকেও দিব না, তোমাকেই দিব।’ আমি তাঁহার বাক্স খুলিয়া কতকগুলি টাকা ও মোহর পাইলাম। লোককে বলিলাম যে, ‘আমি মুড়ি মুড়্‌কি পাইয়াছি।’ সম্পাদক নির্দেশ করিতেছেন, ‘দেবেন্দ্রনাথ সাদা টাকাকে মুড়ি ও হলদে মোহরকে মুড়্‌কি বলিয়াছিলেন’।” (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মজীবনী, পৃ. ২-৩) ইহাই ব্যঞ্জনা। ইংরেজিতে মেটাফর বলিয়া পরিচিত।

দুর্ভাগ্যের মধ্যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যঞ্জনা কি বস্তু বুঝিতে পারেন নাই। আমরা তাঁহার লেখা দুইটি পত্র হইতে দুইটি উদ্ধৃতি লইয়াছি। সেখানে তিনি ‘ব্যঞ্জনা’ ও ‘সার্থকতা’ কথা দুইটি প্রায় একই অর্থে ব্যবহার করিয়াছেন।

কোন শব্দের বানান পরিবর্তন না করিয়াও তাহা নানান পদ আকারে ব্যবহার করাই শুদ্ধ বাংলার কেন, ঢের ভাষারই ধর্ম। আমি এখানে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ হইতে একটি উদাহরণ দিতেছি। বাংলা ‘ভাল’ শব্দটির কথাই ধরিলাম। ‘তিনি আমার ভাল করিবেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।’—এই বাক্যে ‘ভাল’ বিশেষ্য পদ। ‘ভাল ছেলে কাহাকেও গালি দেয় না।’—এই বাক্যে ‘ভাল বিশেষণ পদ। ‘এই ঘোড়াটা ভাল দৌড়াইতে পারে।’—এই বাক্যে ‘ভাল’ ক্রিয়া বিশেষণ। আর ‘ভাল, তাই হোক।’—এই বাক্যে ‘ভাল’ অব্যয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কথা বার বার জলের মতো ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া বলিয়াছেন। ‘একটাতে হ্রস্ব ই ও অন্যটাতে ঈ দিলে উভয়ের ভিন্ন জাতি এবং ভিন্ন অর্থ বোঝবার সুবিধা হয়।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৯০) কোন শব্দ যখন একবার বিশেষ্য, আরবার বিশেষণ, পরের বার অব্যয়— এই ভাবে ব্যবহৃত হয় তখন তার জাতিভেদ হয়, তিনি মনে হয় ইহাই বুঝাইতেছেন। ইহার ফলে শব্দের অর্থও বদলাইয়া যায়। ভাষার গৌরব এমনই। কবির গৌরবে ইহা ধরা পড়ে নাই বলিয়াই তিনি বারংবার বলিয়াছেন অব্যয়, সর্বনাম, ক্রিয়া-বিশেষণ প্রভৃতি ভেদের জন্য, অর্থবৈলক্ষণ্য বুঝাইবার জন্য, বানান বদলাইতে হইবে।

অথচ বঙ্কিমচন্দ্র যে সূত্র বা সঙ্কেত বলিয়া দিয়াছিলেন তাহাই সই: ‘যদি এমন কোন শব্দই পাইলাম না যে তাহাতে আমার মনে ভাব ঠিক ব্যক্ত হয়, তবে যেটি উহারই মধ্যে ভাল, সেইটি ব্যবহার করিব। ব্যবহার করিয়া তাহার পরিভাষা করিয়া বুঝাইয়া দিব।’ (বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৬০) এই সঙ্কেত শুদ্ধ একই জাতি বা পদ হিসাবে ব্যবহার্য শব্দ সম্বন্ধেও খাটে।

শব্দের ব্যবহার অনুসারে তাহার পদ বা জাতি (ইহা ‘জাতি’ শব্দের আরও এক অর্থ প্রকাশক ব্যবহার) স্থির হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জায়গায় স্থির হইতে পারেন নাই। কেন? তাহার একটা কারণ আমি খুঁজিয়া পাইয়াছি যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধির ব্যাকরণে। যোগেশচন্দ্র লক্ষ করিয়াছেন বাংলায় পদের জাতিভেদেরও দুই নিয়ম। শব্দে বিভক্তি বসে কি বসে না— ইহা দেখিয়া প্রথম নিয়ম স্থির হইতেছে। যে সকল শব্দে বিভক্তি বসে সেইগুলি ‘সবিভক্তিক’ (বা সব্যয়) আর যেগুলিতে বিভক্তি বসে না সেগুলি ‘অবিভক্তিক’ (বা অব্যয়)। এই বড় ভাগাভাগিটা হইয়াছে শব্দের রূপ দেখিয়া।

কিন্তু পদ আকারে ব্যবহৃত শব্দের অর্থ বা ভাব দেখিয়াও এক ধরনের ছোট ভাগাভাগি আছে। ইহাকেই বলা হইয়াছে জাতিভেদ। যথা: নাম (সংজ্ঞা বা বিশেষ্য বা আখ্যা), সর্বনাম (প্রতিসংজ্ঞা বা সামান্য নাম), বিশেষণ (আখ্যাত), ক্রিয়া (আখ্যাত) এবং অব্যয়। এই জায়গায় ক্রিয়াও একরকম বিশেষণ। যেমন, রামমোহন লিখিয়াছেন, ‘যে সকল শব্দ বস্তুর অবস্থাকে কহে আর সেই অর্থের সহিত তিন কালের এক কাল প্রতীত হয়, তাহাকে ক্রিয়াত্মক বিশেষণ কহা যায়, যেমন আমি মারিলাম, মারি, মারিব।’ (‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ,’ পৃ. ৩২)

প্রথম ভাগাভাগিটা রূপগত আর দ্বিতীয় ভাগাভাগিটা শব্দের অর্থগত। যোগেশচন্দ্র খেয়াল করিয়াছিলেন একবার দুইভাগে, আরবার পাঁচভাগে- ব্যাকরণের এই দুই রকমের ভাগ সমান ব্যাপক নহে। এই পর্যন্ত তিনি সঠিকই বলিয়াছেন।

ইহার পর যখন তিনি বলেন, ‘প্রথম ভাগ ন্যায়-সঙ্গত, দ্বিতীয় ভাগ ন্যায়-সঙ্গত নহে’ তখন তিনি অস্থির হইতেছেন। আমরা স্থির করিয়া বলিতে পারি কোন শব্দের সঙ্গে যদি পদান্তরে বিভক্তি যোগ না হয় তো তাহা রূপের বিচারে ‘অব্যয়’। ‘যে সকল শব্দের উত্তর বিভক্তি বসে না, পুং-স্ত্রী-ক্লীবলিঙ্গ আকার এক থাকে, সংস্কৃত ব্যাকরণে তৎসমুদয় অব্যয়।’—এই পর্যন্ত লিখিয়া যোগেশচন্দ্র দাবি করিলেন, ‘এই সংজ্ঞা বাঙ্গালায় ঠিক চলে না। কারণ বাঙ্গালাতে বিশেষণ শব্দ অব্যয় হইয়া পড়ে। ছেলেটি ভাল; মেয়েটি ভাল; ভাল করিয়া বলিবে; ভাল, তার পর কি দেখিলে; ইত্যাদি উদাহরণে ভাল শব্দের পরিবর্তন দেখি না।’ (বাঙ্গালা ভাষা প্রথম ভাগ (ব্যাকরণ), পৃ. ২২৯)

নেপথ্যে বলিয়া রাখি, পাঠিকা দেখিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁহার উত্তম উদাহরণটি কোথা হইতে যোগাড় করিয়াছিলেন। শহীদুল্লাহ নাফরমান বান্দা নহেন। তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘তবে শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয়ের বাঙ্গালা ব্যাকরণ যে একটি খাঁটি বাঙ্গালা ব্যাকরণ তাহা সকলেরই স্বীকার করিতে হইবে।’ (বাঙ্গালা ব্যাকরণ, প্রথম সংস্করণের ভূমিকা, ১৩৪২)

রূপ ধরিলে পদ দুই প্রকার— অব্যয় ও সব্যয়। অর্থ ধরিলে সব্যয় শব্দ চারি প্রকার— বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম ও ক্রিয়া। আর অর্থ ধরিলে অব্যয় শব্দও নানা প্রকারের হইতে পারে। ইংরেজি গ্রামার ধরিয়া যোগেশচন্দ্র চারি প্রকারের অব্যয় শব্দ সাব্যস্ত করিয়াছিলেন। কতকগুলি অব্যয় বিশেষণ ও ক্রিয়াকে বিশেষিত করে, কতকগুলি কারক নির্দেশ করে, বাক্য ও পদের সংযোজনা ও বিয়োজনা করে, কতকগুলি মনের হঠাৎ আবেগ প্রকাশ করে। (বাঙ্গালা ভাষা, পৃ. ২২৯-৩০) অর্থাৎ রূপে যাহা অব্যয় ভাবে তাহা ব্যয়বহুলও হইয়া পড়ে। রূপে তোমায় সে ভুলাইবে না, ভুলাইবে ভালোবাসায়।

প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার বৈয়াকরণ পানিনি সকল পদকে তিনভাগে ভাগ করিয়াছিলেন। যথা: সুবন্ত, তিঙন্ত এবং নিপাত। পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য জানাইয়াছেন, ‘সুবন্তের মধ্যে ছিল বিশেষ্য, বিশেষণ ও সর্বনাম। তিঙন্তগুলি ছিল ক্রিয়া বা আখ্যাত। বাদবাকী ছিল নিপাত। বিভিন্ন প্রকার অর্থে বর্তমান থাকে যারা তারাই নিপাত।’ (পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য, বাংলাভাষা, পৃ. ১৯৭)

এই নিপাত অব্যয়েরই অপর নাম। ইংরেজি গ্রামারের তিন রকম অব্যয় ছাড়াও যাহাকে বলে ‘ক্রিয়ার আগাম, বা ক্রিয়া-বিশেষণ তাহাও নিপাত। বাংলায় যাহাদের আমরা উপসর্গ বলিয়া থাকি তাহারাও। ইহাদের রূপে ব্যয়-পরিবর্তন নাই বলিয়াই ইহারা অব্যয়।

রূপের কথা ছাড়িয়া যদি আমরা ভাবের কথা ধরি, তবে সকল ভাবকে মাত্র দুই প্রকারের বলিয়া স্থির করা যায়। যথা: বিশেষ্য ও বিশেষণ। এই বিচারে ক্রিয়াপদও এক ধরনের বিশেষণ। ইহার কর্তব্য বিশেষ্য কি অবস্থায়, কি করিতেছে ইত্যাদি সওয়ালের জওয়াব দেওয়া। রামমোহন রায়ের গৌড়ীয় ব্যাকরণে আমার দাবির সমর্থন মিলিবে। বিশেষ্য শব্দে ‘আখ্যা’ ধরিয়া বিশেষণ শব্দে ‘আখ্যাত’ পড়িলেই হইবে। পার্বতীচরণ বিশেষণকে আখ্যার মধ্যে ফেলিয়াছেন। রামমোহনের বইয়ে বিশেষণ আছে আখ্যাতের দলে। আমরা রামমোহনের গুণই গ্রহণ করিব।

এক্ষণে সিদ্ধান্ত হইতেছে কোন শব্দের একই সঙ্গে ভাবের বিচারে বিশেষ্য ও রূপের বিচারে অব্যয় হইতে বাধা নাই। যথা: ‘তাহার কথা শুনিয়া সভা মধ্যে সাধু, সাধু রব উঠিল’। এই জায়গায় সাধু অব্যয়। আবার যখন বলিবেন, ‘সাধু সর্বদা পরের উপকার করিয়া থাকেন’ তখন সাধু বিশেষ্য। আবার যখন তিরস্কার করিতে বলেন, ‘বেটা সাধু বেশে পাকা চোর অতিশয়’তখন সাধু বিশেষণ। (মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাঙ্গালা ব্যাকরণ, পৃ. ১১৬)

এই জায়গায় আর একটি কথা না বলিলেই নয়। ইহা কোন নিয়মে, কেমন করিয়া সম্ভব? সম্ভব শব্দের অর্থব্যক্তি তিন প্রকারের বলিয়া। ইহাতেই ভাষার গৌরব।

আরও গৌরবের কথা এক অর্থ হইতে আর অর্থে যাইবার পথও একটা নহে। পথ আছে দুই দুইটা। অভিধা হইতে লক্ষণায় যাইবেন এক পথ দিয়া। আবার অভিধা বা লক্ষণা হইতে ব্যঞ্জনায় যাইবেন দ্বিতীয় পথ দিয়া। শব্দের এই সার্থকতা স্থির হয় পদ আকারে ও কতর্ব্যরে অনুরোধে।

যাহা পদ আকারে অব্যয় বা সব্যয় তাহাই পদার্থাকারে বিশেষ্য বা বিশেষণ। এই স্থলে বিশেষণ বলিতে ক্রিয়াও বুঝিতে হইবে। আর বিশেষ্য বলিতে সর্বনামও ধরিবেন। অভিধায় যাহা বিশেষ্য ব্যঞ্জনায় তাহা বিশেষণ হইতে পারে। যেমন, ‘কাঙাল লোকে ভিক্ষা মাগে’— এখানে ‘কাঙাল’ বিশেষণ। ‘কাঙালের কথা বাসি হলে ফলে’— এই বাক্যে ‘কাঙাল’ বিশেষ্য। আবার সম্বন্ধে ষষ্ঠি বলিয়া কথাটা বিশেষণ বলিয়াও গণ্য হইতে পারে, কারণ ইহার বিশেষ্য ‘কথা’।

বাংলা ‘কি’ শব্দটি রূপে অব্যয় জাতীয়। কিন্তু ভাব ইহার নানা প্রকারের হইতে পারে। তাহাতে বানান-পরিবর্তন করিবার দরকার পড়ে না। বানান বদলাইলে মানে ব্যয় করিলে তাহা আর অব্যয় থাকিল কোথায়? যাঁহারা বানান বদলাইবার যুক্তি দিতেছেন তাঁহারা জানেনই না তাঁহারা কি অনর্থ-সাধনই না করিতেছেন! শুদ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগৌরব দিয়া ভাষার বিধান করা ধর্মের কথা নহে।

দেবপ্রসাদ ঘোষ একদা রবীন্দ্রনাথকে সম্মুখে রাখিয়া যাহা বলিয়াছিলেন তাহা এতদিনে সত্য হইল। ‘আপনি নিজে তো সাবধানী লোক, ওজন করিয়া ঝোঁক মাফিক কোন কোন স্থলে ‘কি’ শব্দকে ‘কী’ রূপে লেখেন। কিন্তু আপনার দেখাদেখি যে অর্ব্বাচীনদের হাতে ‘কী’ রূপ প্রাকৃত বাংলাকে ছাইয়া ফেলিল।... এই ক-যুক্ত ঈ-কারের প্লাবনে যে ‘প্রাকৃত বাংলা ডুবু ডুবু— ভাষা-বসুন্ধরাকে এই প্রলয়পয়োধি হইতে উদ্ধার করিতে নূতন করিয়া বরাহ-অবতারের আবশ্যক হইবে মনে হইতেছে- (ইহা) বানান সমিতির কর্ণধারদিগের কর্ম্ম নয়।’(বানান বিতর্ক, পৃ. ১৪৬-৭)

অন্য প্রসঙ্গ ধরিয়া একদা বঙ্কিমচন্দ্র বলিয়াছিলেন, ‘তুমি বিধানকর্ত্তা পুরুষ, তোমার সুতরাং পোয়া বারো। তোমার বাহুবল আছে, সুতরাং তুমি এ দৌরাত্ম্য করিতে পার। কিন্তু জানিয়া রাখ যে, এ অতিশয় অন্যায়, গুরুতর, এবং ধর্ম্মবিরুদ্ধ বৈষম্য।’ (বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৮)

এই বিষয়ে এইখানে আর লিখিব না। তাহার জন্য পৃথক নিবন্ধ কষিতে হইবে। শুধু জিজ্ঞাসা করিয়াই এখানে তুষ্ট থাকিব— একদা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কার সমিতি যাহা ন্যায্য কারণে অন্যায্য ঘোষণা করিয়াছিলেন এত বছর পর গণপ্রজাতন্ত্রী এক দেশের বাংলা একাডেমী কি কারণে তাহাকে ন্যায্য বলিতেছেন? আর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিও দেখি তাহাদের ধামা ধরিতেছেন। বাংলার এখন সত্যই আকাল।

 

পঠ পুত্র ব্যাকরণম্

গৌড়ীয় ভাষাতে কি ক্রিয়াপদে কি প্রতিসংজ্ঞায় কি বিশেষণ পদে লিঙ্গজ্ঞাপনের কোন বিশেষ চিহ্ন নাই। যেমন সে স্ত্রী ভাল পাক করে: সে পুরষ ভাল পাক করে: অতএব লিঙ্গ বিষয়ে আর অধিক লিখিলে অনর্থক গৌরব হয়।

        —রামমোহন রায়, (‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ, পৃ. ১৯)

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ পুস্তকে একটি ঘটনার সরস বিবরণ পাওয়া যায়। দেবেন্দ্রনাথ জানাইতেছেন, “ওদিকে অক্ষয়কুমার দত্ত একটা ‘আত্মীয়-সভা’ বাহির করিলেন, তাহাতে হাত তুলিয়া ঈশ্বরের স্বরূপ বিষয়ে মীমাংসা হইত। যথা, এক দল বলিলেন, ‘ঈশ্বর আনন্দ-স্বরূপ কি না?’ যাহার যাহার আনন্দ স্বরূপে বিশ্বাস আছে, তাহারা হাত উঠাইল। এইরূপ অধিকাংশের মতে ঈশ্বরের স্বরূপের সত্যাসত্য নির্দ্ধারিত হইত।” (আত্মজীবনী, পৃ. ১৭০-৭১)

বাংলা একাডেমী কি উপায়ে বাংলা বানানের নিয়ম নির্ধারণ করিয়াছেন তাহা সাধারণে জানাইবার প্রয়োজন বোধ তাঁহারা করেন নাই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নাহান তাঁহারাও কি ‘কর্মশিবির’ ওরফে ‘কর্মশালা’ বসাইয়াছিলেন? কি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন নিজেদের মধ্যে একাধিকবার আলোচনা করিয়া প্রশ্নতালিকা রচনা করিয়াছিলেন? করিয়া থাকিলে প্রশ্নতালিকাটি কাঁহার কাঁহার কাছে পাঠাইয়াছিলেন? পাঠাইয়া থাকিলে কি কি উত্তর পাওয়া গিয়াছিল? পাওয়া যদি গিয়া থাকে তবে তাহার সারাংশ প্রকাশের কোন উদ্যোগ কি হইয়াছিল?

এইসব প্রশ্নের কোন উত্তর, বলা বাহুল্য, আমার জানা নাই। ইহা বাংলা একাডেমীর কর্তব্য। একাডেমী যখন একবার বানানের নিয়ম নির্ধারণ নিজের কর্তব্য বলিয়া গ্রহণ করিলেন তখন ইহা সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার দায়িত্বও হইয়া দাঁড়াইল। কিন্তু বাংলা একাডেমী সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সহিত পালন করেন নাই। একাডেমীর সমসাময়িক মহাপরিচালক দ্বিতীয় সংস্করণের প্রসঙ্গ-কথায় অনিষ্ঠার সাক্ষ্য দিয়াছেন। তাঁহার সাক্ষ্যানুসারে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। প্রকাশের পর, তিনি জানাইতেছেন, ‘বানানের নিয়ম সম্পর্কে মতামত চেয়ে বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ডিগ্রি কলেজ, মন্ত্রণালয়সমূহ এবং বাংলা একাডেমীর সকল ফেলো, জীবন সদস্য, সদস্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নিকট উক্ত পুস্তিকা প্রেরণ করা হয়।’ কিন্তু প্রকাশের পর কেন? কতজনের কাছে, তাহা বলিলেন না কেন?

বাংলা একাডেমী নিয়োজিত ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য সচিব বশীর আল্‌হেলাল। জনৈক ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে পত্রিকায় তিনি যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা দেখিয়া পাঠিকা স্থির করিবেন বাংলা একাডেমীর পরিণাম। আল্‌হেলাল লিখিয়াছেন, ‘একটা কথা হয়তো স্বীকার করা দরকার যে, বাংলা একাডেমীর নিয়মের কোথাও কোথাও আরও ব্যাখ্যা যোগ করার দরকার ছিল। কিন্তু আমি আগেই বলেছি, এতো শুদ্ধ-অশুদ্ধের প্রশ্ন নয়, যে নিয়মগুলো প্রস্তাব করা হয়েছে তা অভিনবও নয়। এ নিয়মের বানান অভিধানে আছে, উপযুক্ত ব্যাকরণ বইয়ে আছে।’ (বশীর আল্‌হেলাল, বাংলাভাষার নানান বিবেচনা, পৃ. ২০১)

কিন্তু কোথায় সেই ব্যাকরণ? একশত বৎসর আগে এই প্রশ্নের উত্তরেই রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী জানাইয়াছিলেন, নাই, সেই ব্যাকরণ কোথাও নাই। একশত বৎসর পরেও কোন বিশেষ পরিবর্তন হয় নাই— এই কথা আগাম বলিয়া রাখিতেছি। আগে দেখি রামেন্দ্রসুন্দরের সময় অবস্থা কেমন সুন্দর ছিল। তিনি লিখিতেছেন:

‘প্রচলিত বাঙ্গালা ব্যাকরণ গ্রন্থগুলি বালকেরই পাঠ্য; উহা বালকগণকে ভাষা শিখাইবার উদ্দেশ্যে লিখিত। কিন্তু আমি ব্যাকরণ নামে যে বিজ্ঞানশাস্ত্রের উল্লেখ করিতেছি, তাহার উদ্দেশ্য ভাষা শেখান নহে। উহার উদ্দেশ্য নিজে শেখা, ভাষার ভিতর কোথায় কি নিয়ম প্রচ্ছন্ন ভাবে রহিয়াছে, তাহাই আলোচনা দ্বারা আবিষ্কার করা। আগে সেই নিয়ম আবিষ্কার করিতে হইবে; অর্থাৎ ভাষার নিয়ম বাহির করিয়া তাহার সহিত স্বয়ং পরিচিত হইবে; তাহার পর উহা অন্যকে শেখান যাইতে পারিবে। বাঙ্গলা ভাষার সেই ব্যাকরণ এখনও রচিত হয় নাই, কেননা বাঙ্গলা ভাষার মধ্যে কি নিয়ম আছে না আছে, তাহার কেহই আলোচনা করেন নাই। সে সকল নিয়মের যখন আবিষ্কারই হয় নাই, সে সম্বন্ধে কোন আলোচনাই এ পর্যন্ত হয় নাই, তখন বাঙ্গালার ব্যাকরণ এখন বর্ত্তমানই নাই। বাঙ্গালার ব্যাকরণ কি পদার্থ তাহা কেহই জানেন না, রবীন্দ্রবাবুও জানেন না, পণ্ডিত শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রীও জানেন না।’ (‘বাঙ্গলা ব্যাকরণ, পৃ. ৩১)

পাছে কেহ তত্ত্ব করেন বাংলা ব্যাকরণ নামে যে সকল পুঁথি বাজারে বিকাইতেছে সেইগুলির কি হইয়াছে, তাই রামেন্দ্রসুন্দর কহিতেছেন, ‘এখন যাহাকে বাঙ্গলা ব্যাকরণ বলা হয়, উহা বাঙ্গালা ব্যাকরণ নহে। বাঙ্গলা ভাষা সংস্কৃতের নিকট যাহা পাইয়াছে, সংস্কৃতের নিকট যে অংশ ঋণস্বরূপ গ্রহণ করিয়াছে, সেই অংশের ব্যাকরণ। উহা সংস্কৃত ব্যাকরণ, বাঙ্গলা ব্যাকরণ নহে।’ (পৃ. ৩১)

রামেন্দ্রসুন্দরের যুগেও খাঁটি বাংলার ব্যাকরণ অস্তিত্বহীন। ইহা মোটেও অতিকথা নহে। সোজা কথায়, ‘বাঙ্গলার যে অংশ সংস্কৃত হইতে ধার করা নহে, যে অংশ খাঁটি বাঙ্গলা, সে অংশের ব্যাকরণ নাই।’ (বাঙ্গলা ব্যাকরণ, পৃ. ৩২)

বাংলা একাডেমীর বিশেষজ্ঞ বশীর আল্‌হেলাল বাংলা বানানে আরও এক কাঠি সরেস হইয়াছেন। বাংলা যে সকল শব্দ সংস্কৃত হইতে আসিয়াছে অথচ শুদ্ধ উচ্চারণেই নহে, বানানেও বদলাইয়া গিয়াছে তাহাদিগকে পণ্ডিতেরা ‘তদ্ভব শব্দ’ নাম দিয়াছেন। সেইগুলির বানানে— উদাহরণস্বরূপ শ, ষ, না স- কোন অক্ষর বসিবে এই বিষয়ে গোল আছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম করিয়াছিলেন ‘অংশু’ হইতে আসিয়াছে বলিয়া ‘আঁশ’ শব্দে ‘শ’ হইবে। আর ‘আমিষ’ হইতে আগত ‘আঁষ’ বানানে ‘ষ’ থাকিবে। একই যুক্তিতে ‘শাঁস’ হইবে ‘শস্য’ হইতে আগত বলিয়া। আর ‘মশক’ হইতে আসিয়াছে বলিয়া ‘মশা’ হইবে। একইভাবে ‘পিতৃঃশ্বসা’(পিতার বোন) হইতে ‘পিসী’। তথাস্তু।

কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম বা নিয়মের অতিক্রম হইয়াছে। যথা— ‘মনুষ্য’ হইতে ‘মিনসে’, ‘শ্রদ্ধা’ হইতে ‘সাধ’ ইত্যাদি। ‘মৎস্য’ হইতে আসিয়াছে বলিয়া ব্রাহ্মণ কিন্তু ‘মাস’ খাইতেছে না, ব্রাহ্মণ-শুদ্র সকলেই খাইতেছে ‘মাছ’।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই নিয়মের উদাহরণ করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘দেশজ বা অজ্ঞাতমূল শব্দের প্রচলিত বানান হইবে, যথা— ‘করিস, ফরসা (ফরশা), সরেস (সরেশ), উসখুস (উশখুশ)’। বশীর আল্‌হেলাল লিখিয়াছেন, ‘এর মধ্যে ‘সরেস’ শব্দটিকে নেয়া ঠিক হয় নি। কারণ সরেস তদ্ভব শব্দ, সংস্কৃত ‘সরস’থেকে হয়েছে’। (বাংলা ভাষার বানান বিবেচনা, পৃ. ২০৩) স্বীকার করিতে হইবে বাংলা ব্যাকরণ রচনার পথে অগ্রগতি হইতেছে।

বশীর আল্‌হেলালের কথা ভাবিয়াই বোধ করি ত্রিবেদী মহাশয় লিখিয়াছিলেন, সবকিছুতেই সংস্কৃত ‘রস’ খুঁজিতে যাওয়ারও সীমান্ত আছে। ‘আমি মাছ খাইতেছি’— বাক্যের স্থলে বলা যাইতে পারে ‘আমি মৎস্য ভোজন করিতেছি’। ইহা অসম্ভব নহে। কিন্তু আমি ও করিতেছি এই শব্দ দুইটির সংস্কৃত তর্জমা করিলে ভাষাটি সংস্কৃত বা প্রমিত হইতে পারে, বাংলা হইবে না। রামেন্দ্রসুন্দর কি সুন্দর বলিয়াছেন! “কিন্তু এই ‘আমি’ ও ‘করিতেছি’ এতদুভয়ের হাত হইতে অব্যাহতি লাভের উপায় কোন পণ্ডিতই নির্দ্দেশ করিতে পারিবেন না। কেবল কথাবার্ত্তার সময়ই নহে, বিশুদ্ধ সাহিত্য রচনার সময়ও অব্যাহতির আশা নাই। সুতরাং বাঙ্গলা ভাষাতে কতকগুলি শব্দ থাকিবেই, যথা ‘আমি’ও ‘করিতেছি’ যাহা সংস্কৃত মূলক বটে, কিন্তু সংস্কৃত নহে, যাহা খাঁটি বাঙ্গলা।” (‘বাঙ্গলা ব্যাকরণ,’ পৃ. ২০)

রামেন্দ্রসুন্দর কহিতেছেন: “... ‘মৎস্য’ও ‘ভোজন’ এই দুই শব্দ বাঙ্গলাই নহে, উহা[রা] বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ। বাঙ্গলা ভাষা সংস্কৃত হইতে উহাদিগকে গ্রহণ করিয়াছে মাত্র।” এই যুক্তি ফেলিবার নহে। “‘মৎস্য’ ও ‘ভোজন’ শব্দ বর্জ্জন করিয়া বাঙ্গলা, এমন কি, বিশুদ্ধ বাঙ্গলা লেখা ও কহা চলিতে পারে। কিন্তু ‘আমি’ ও ‘করিতেছি’ ইহাদিগকে বর্জ্জন করিলে কোন বাঙ্গলারই অস্তিত্ব থাকে না।” (‘বাঙ্গলা ব্যাকরণ, পৃ. ২০)

অগ্রগতির আরো লক্ষণ দেখিতেছি। ১৯৯২ সালের ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ সংশোধিত আকারে তৃতীয় বার ছাপা হইয়াছে ২০০০ সালে। এই সংস্করণে আগের তিন নিয়মের সহিত আরেক যোগক্রমে চারি নিয়ম দাঁড়াইয়াছে।

শেষ নিয়মের নাম রাখা হইয়াছে ‘ণত্ব-বিধি সম্পর্কে দুই মত’। বয়ানে পড়িতেছি: ‘অ-তৎসম শব্দের যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারেন নি। একটি মতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দে যুক্তাক্ষরে ণ্ট ণ্ঠ ণ্ড ণ্ট হবে। যথা: ঘণ্টা, লণ্ঠন, গুণ্ডা। অন্যমতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ন্ট, ণ্ঠ, ন্ড, ন্ট ব্যবহৃত হবে। যথা: ঘন্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লণ্ঠন, গুন্ডা, পান্ডা, ব্যান্ড, লন্ডভন্ড।’

এই যাত্রা বিশেষজ্ঞ কমিটির উপস্থিত সদস্য চারি জন মাত্র। একজন বিশেষজ্ঞ ইহার মধ্যে অমরলোকেও গিয়াছেন। সদস্য সচিব গিয়াছেন অবসর লোকে। তাঁহার জায়গায় আসিয়াছেন একাডেমীর পদাধিকারী। ভাগ্যের মধ্যে, আমরা জানিতে পারিলাম বাংলা একাডেমীতেও দুই মত থাকিতে পারে।

আগেই জানিয়াছিলাম কোন কোন সদস্য ‘প্রফেসর’, কোন সদস্য ‘অধ্যাপক,’ কোন কোন সদস্য ‘জনাব’। এক্ষণে দেখিলাম গৌড়ীয় ভাষাতে ‘জনাব’ শব্দেও লিঙ্গজ্ঞাপনের বিশেষ চিহ্ন নাই। বশীর আল্‌হেলাল বা জামিল চৌধুরী যেমন, সেলিনা হোসেনও তেমনই ‘জনাব’ হইয়াছেন। আনিসুজ্জামান আর মনিরুজ্জামান ‘প্রফেসর’ বুঝিলাম। কিন্তু নরেন বিশ্বাস কেন ‘অধ্যাপক’? কোন নিয়মে? নমঃশূদ্র বলিয়া? হায়, বাংলা বানানের নিয়ম!

‘প্রায় দুইশত বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপকের অভিমত আলোচনা করিয়া’কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োজিত সমিতি বানানের নিয়ম সংকলন করিয়াছিলেন। উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জানাইয়াছিলেন, ‘বলা বাহুল্য, যাঁহাদের অভিমত সংগৃহীত হইয়াছে তাঁহাদের মধ্যে যেরূপ কতকগুলি বিষয়ে মতভেদ আছে, সেইরূপ মতভেদ সমিতির সদস্যগণের মধ্যেও আছে। বিভিন্ন পক্ষের যুক্তি-বিচারের পর সদস্যগণের মধ্যে যতটা মতৈক্য ঘটিয়াছে তদনুসারেই বানানের প্রত্যেক বিধি রচিত হইয়াছে।’ সমিতির অন্যতর কনিষ্ঠ সদস্য বিজনবিহারী ভট্টাচার্য অনেক দিন পর স্মৃতি হাতড়াইয়া বলিতেছেন, ‘কতগুলি প্রশ্নপত্র পাঠানো হইয়াছিল তাহা এখন বলিতে পারিব না, তিন শ বা চারশ হওয়া সম্ভব। কারণ প্রশ্নের উত্তরই পাওয়া গিয়াছে প্রায় দুই শ।’ (বঙ্গভাষা ও বঙ্গসংস্কৃতি, পৃ. ২৭)

বাংলা একামেডীর বিশেষজ্ঞ কমিটি দুই সত্য অস্বীকার করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। আমরা এতক্ষণে দেখিলাম তাঁহারা বাংলা বানানের সংস্কারই করিতেছেন অথচ বলিতেছেন, ‘না, বাংলা বানানের সংস্কার আমাদের উদ্দেশ্য নয়’। এক্ষণে আমরা দেখিব আরও সত্য অস্বীকারের প্রয়াস। বিশেষজ্ঞ কমিটি বলিয়াছেন, ‘এইসব নিয়ম বা এইসব বানানে ব্যাকরণের বিধি লঙ্ঘন করা হয়নি।’ রামেন্দ্রসুন্দর হইতে মুহম্মদ এনামুল হক কিংবা সুকুমার সেন পর্যন্ত সকল মনীষী সাক্ষ্য দিতেছেন বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ‘এখনও অস্তিত্বহীন’। তো, তাঁহারা কোন্ ব্যাকরণ লঙ্ঘন করেন নাই? তাঁহারা ঘুরিয়া ফিরিয়া একটা কথাই বলিতেছেন, আমরা সংস্কৃত ব্যাকরণের বিধি লঙ্ঘন করি নাই।

বাংলা ব্যাকরণ ষোল আনা রচিত না হইলেও বাংলা ভাষার স্বভাব নানা দিক হইতে আবিষ্কার করা হইতেছে। রাজা রামমোহন রায় সেই চেষ্টা করিয়াছেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী কি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কেন তাঁহার কীর্তি হেলা করিয়াছেন আমি বলিতে পারিব না। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির চেষ্টাই শুদ্ধ সার হয় নাই, তিনি বাংলা ব্যাকরণের শ্রেষ্ঠ বাদীগণের অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও কিছু অংশে এই পক্ষে ধরিতে হইবে। আমাদের যুগে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আর মুহম্মদ এনামুল হকের মধ্যেও এই চেষ্টার নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে। সেই চেষ্টা পূর্ণাঙ্গ নহে, ইহা সত্য। কিন্তু বাংলা একাডেমী এই সকল ব্যাকরণ বা ভাষাতত্ত্ব আমল করিয়াছেন এমন প্রমাণও কোথাও পাইতেছি না।

১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমী হইতে পাঁচ জন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির দস্তখতে একটি আধা ব্যাকরণ জাতীয় বহি বাহির হইয়াছিল। নাম রাখা হইয়াছিল বড়ই কোমল— ‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’। পাঁচ ব্যক্তির মধ্যে যিনি সবার শেষে ছিলেন তাঁহার নাম আনিসুজ্জামান। আমরা পরে দেখিব বিশেষজ্ঞ কমিটির তিনি সভাপতি হইয়াছেন অর্থাৎ সবার আগে বসিয়াছেন। ইহা হইতেই অনুমান করি দুই পঞ্চায়েতের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটিও তিনিই করিতেছিলেন।

আরো দেখা যাইতেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে (২১-২৩ অক্টোবর) কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমীতে যে কর্মশিবির লইয়া বসেন তাঁহার এক নম্বর প্রবন্ধকর্তা প্রফেসর আনিসুজ্জামান। ১৯৯২ সালে ‘পাঠ্য বইয়ের বানান’ নামে যে পুঁথি ঐ বোর্ড ছাপাইয়াছিলেন তাহার প্রণেতাও ছিলেন প্রফেসর আনিসুজ্জামান। (পাঠ্য বইয়ের বানান, ১৯৯২)

‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ বইটি এখন আর সহজে পাওয়া যাইতেছে না। কিন্তু এই বইয়ের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র যাহাকে বলিয়াছিলেন ‘অতিশয় অন্যায়, গুরুতর, এবং ধর্ম্মবিরুদ্ধ বৈষম্য’ তাহার প্রমাণ পদে পদে পাওয়া যায়। আমি অনেক দিন অবাক হইয়া ভাবিয়াছি। এহেন কাণ্ডজ্ঞানহীন পুঁথি কেমন করিয়া বাংলা একাডেমীর নামে বাহির হয়? বাংলা ভাষার স্বভাব সম্বন্ধে যাঁহার ন্যূনতম, সামান্যতম ধারণাও আছে তিনি কি করিয়া এহেন অবমাননাকর বহির লেখক তালিকায় নিজের নাম যোগ করিতে সমর্থ হইলেন? আজও উত্তর পাই নাই। তিনি কি করিয়াই বা বানান কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হইলেন? বাংলাদেশে মনীষার কি এতই দুরবস্থা ঘটিয়াছে? বিশ্বাস করিতে শ্বাসকষ্ট হয়।

এই দেশে তোষামোদ ও অবিমৃষ্যকারিতার ভাষা কি পর্যায়ে উঠিয়া গিয়াছে তাহা দেখিতে বশীর আল্‌হেলাল একটি বাক্যই যথেষ্ট। মুহম্মদ এনামুল হক বাঁচিয়া আছেন তখনও। বশীর লিখিলেন, ‘ভাষা ও ব্যাকরণের তত্ত্ব যাঁদের আয়ত্ত তাঁরা একে একে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আর সংস্কার কাজের অধিকার যে প্রতিষ্ঠানের উপরই বর্তাক, ড. মুহম্মদ এনামুল হকের অধিনায়কতা ছাড়া তা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।’ (পৃ. ১৫)

পরলোকগত মোহিতলাল মজুমদার হইতে একটি কথা উদ্ধার করিয়া কাজে লাগাইয়াছিলেন মহাত্মা মুনীর চৌধুরী। ১৯৭০ সালের কথা। মুনীর চৌধুরী জানাইতেছেন, মোহিতলালের মতে, ‘ভাষার আদর্শ ক্ষুণ্ণ করার প্রয়োজন দুই কারণে হইতে পারে— প্রথম, ভাষার আদর্শ সম্বন্ধে অজ্ঞতা, বিশুদ্ধ বাক্যরচনার অক্ষমতা; দ্বিতীয়, ভাষাকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিয়াও লেখকের নিজের খেয়াল-খুশি চরিতার্থ করিবার আগ্রহ। কিন্তু অজ্ঞতা ও অক্ষমতার প্রমাণ এতই স্পষ্ট যে, দ্বিতীয় কারণটির উল্লেখ বা আলোচনা অনাবশ্যক মনে হইতে পারে।’(বাংলা গদ্যরীতি, পৃ. ২৭)

বাংলা একাডেমীর ‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’নামক ১০৬ পাতার পুঁথিতে অকপটে স্বীকার করা হইয়াছে, ‘বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত তৎসম শব্দের বানান এবং ব্যবহার জানার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মাবলী এখানে বর্ণিত হল।’ (পৃ. ১৩)

শুদ্ধ তৎসম শব্দের নিয়মাবলী কেন? বাংলা শব্দের কি নিয়ম নাই? পঞ্চায়েতের উত্তর এই রকম: ‘বানান এবং শব্দ ব্যবহারের সম্পূর্ণ ব্যাকরণ এখানে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। যে-ক্ষেত্রে ভুল হবার সম্ভাবনা বেশি সে-ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নিয়মই বিবৃত হয়েছে। এই নিয়মগুলি পাঠ করে একজন ভাষার নিয়ম-কানুন সম্বন্ধে যেমন অবহিত হবেন, তেমনি বানান-বিভ্রমের হাত থেকেও নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবেন।’(পৃ. ১৩; মোটা হরফ আমাদের)

সবিনয়ে জিজ্ঞাসিব, এই সর্বশেষ বাক্যটি কি বাংলা ভাষায় লিখিত? ইহা ইংরেজির কপট তর্জমা বৈ কি! যাঁহারা এই জাতীয় বাক্য লিখিতে সক্ষম তাঁহারাই ফতোয়া দিতেছেন ‘সক্ষম’ শব্দটিও ‘শুদ্ধ’ নহে। (পৃ. ৬৫) সেই ফতোয়া লোকে মানিবে কেন? কোন শক্তিতে তাহাকে মানাইবেন? যিনি এই বাক্যের অন্তত শরিকি লেখক তিনি কি করিয়া বাংলা বানানের বিধান নির্ধারণ করিবেন?

(চলবে)

(লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০১০ সালের ১৫ মে, নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত ‘নতুনধারা’ সাময়িকী পত্রিকার সপ্তম সংখ্যায়। এখানে ওইসময়কার বানানই অবিকৃত রাখা হয়েছে।—ফিচার সম্পাদক)