আমি লেখার বিষয় সংকটে ভুগিনি : জাকির তালুকদার
এ বছর কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার। লেখালেখির শুরু থেকেই তিনি আলাদা এক পথ নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর লেখায় ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে পুরাণের সংমিশ্রণ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ‘কুরসিনামা’, ‘মুসলমানমঙ্গল’, ‘কবি ও কামিনী’, ‘ছায়াবাস্তব’, ‘কল্পনা চাকমা ও রাজার সেপাই’, ‘পিতৃগণ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বাংলা একাডেমি পুরস্কার ঘোষণা হওয়ার পরই তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ লেখক এহসান মাহমুদ। দুজনের আলাপে বেরিয়ে এসেছে জাকির তালুকদারের লেখক হওয়া থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যের নানা বিষয়। তা ছাড়া গত ২০ জানুয়ারি ছিল তাঁর জন্মদিন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৫ সালের ২০ জানুয়ারি। এই সাক্ষাৎকার লেখকের প্রতি জন্মদিনের একটু বিলম্বিত শুভেচ্ছাও বটে।
এহসান মাহমুদ : আমাদের আলোচনার শুরুতেই আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এ বছর বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার জন্য।
জাকির তালুকদার : ধন্যবাদ এহসান। পুরস্কার পাওয়াটা আমার ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। পুরস্কার না পেলেও আমি লিখতাম। আগে যে রকম লিখতাম, তেমনই লিখে যেতাম আমি। পুরস্কারপ্রাপ্তি জাকির তালুকদারের লেখালেখির ওপরে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে বলে আমি মনে করি না। আমি আগের মতোই আমার সেরাটা লিখে যাওয়ার চেষ্টা করব। তবে তার মানে এই নয় যে পুরস্কারের কোনো মূল্য নেই। তা কিন্তু নয়। পুরস্কারটি মূল্যবান আমার পরিবারের জন্য। এটি পরিবারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ লেখালেখির কারণে আমার পরিবারের জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি। পরিবার অনেক ঠকেছে। পরিবার অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। তাই আমার এই পুরস্কারটি তাদের এক ধরনের গর্বিত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। এটা একধরনের ক্ষতিপূরণ। তারা যদি একটু খুশি হয় তবে আমার ভবিষ্যতের লেখালেখির জন্য একটু ভালো।
মাহমুদ : আপনার সম্পর্কে যতটুকু জানি যে, ছাত্রজীবনের পুরোটা সময়ই ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু পরে আর সক্রিয় রাজনীতিতে এগোলেন না। সেখান থেকে লেখালেখিতে এলেন কেন?
তালুকদার : সক্রিয় রাজনীতিতে যাওয়ার যে পদ্ধতি বা প্রক্রিয়াগুলো রয়েছে সেগুলো আমার ভালো লাগেনি। আমি যখন ছাত্ররাজনীতি করতাম তখন যদি একটি পোস্টারও কোথাও লাগাতে যেতাম, ভাবতাম এটি গণমানুষের জন্য করা হচ্ছে। অথবা বিপ্লবের জন্য, মুক্তির জন্য করা হচ্ছে। পরে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর খুব কাছাকাছি গেলাম, তখন দেখলাম যে, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে নানা রাজনীতি, তাদের কর্মপদ্ধতির সাথে একাত্মতা জানানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তখন ভেবে দেখলাম যে আমার যা চিন্তা বা লক্ষ্য, রাজনীতি দিয়ে আমি মানুষের জন্য তার কতটুকু করতে পারব? মনে হলো আমি রাজনীতির চেয়ে লেখালেখির মাধ্যমে তার চেয়ে ভালো করতে পারব। তাই সক্রিয় রাজনীতি রেখে লেখালেখি করব বলে ঠিক করি। অনেক পেশায় অনেক লোক থাকেন। আমার মনে হয়েছে এখানে দলীয় যে রাজনীতি তার জন্য আমি আনফিট। তার চেয়ে লেখালেখি করাটা আমার জন্য ভালো হবে।
মাহমুদ : লেখালেখির শুরুর দিকটা জানতে চাইছি। শুরুটা কেমন ছিল?
তালুকদার : লেখালেখির শুরুটা বলতে হলে বলতে হয় ছাত্রজীবন থেকেই আমি লেখালেখি করতাম। তখন ছড়া লিখতাম। কবিতা লেখারও চেষ্টা করেছি। তবে ছড়াটাই বেশি ছিল। ছাত্রজীবনেই একটি ছড়ার বই বেরিয়েছিল। পরে আরো একটি ছড়ার বই প্রকাশ হয়। তখন দৈনিক কাগজগুলোতে আমার ছড়া প্রকাশ হতো। ছড়াকার হিসেবে তখনই আমাকে চিনত। মানে মোটামুটি একটা পরিচিতি পেয়েছিলাম ছড়াকার হিসেবে।
আমি যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করি, তখন একটি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে এনজিওতে চাকরি নিয়ে একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যাই। আমি যে গ্রামে গিয়েছিলাম, সেই গ্রামে হয় তো সপ্তাহে ছয় দিনই বিদ্যুৎ থাকত না। আমার যাঁরা সার্ভিস রিসিভার ছিল, তাঁরা ছিল একেবারেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তাঁদের জীবনযাপন দেখে আমার মনে হলো এদের যে জীবন সে জীবন ছড়া-কবিতায় তুলে আনা সম্ভব নয়। নাটকেও তা সম্ভব না। আর প্রবন্ধ লিখলে তা তো একটি বিবৃতির মতো হয়ে যায়। তাই এই জীবনকে তুলে আনার জন্য কথাসাহিত্য অর্থাৎ, ছোটগল্প, উপন্যাস বা মুক্তগদ্যই ভালো মাধ্যম বলে আমার কাছে মনে হয়। তারপর আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ সেদিকে নিবদ্ধ করলাম।
মাহমুদ : আপনার বিষয়ে আমি যতটুকু জানি যে, লেখালেখির শুরুর দিকে আপনি ১৩০০ গল্প পড়েছিলেন। সেটাকে কি আমরা আপনার গল্প লেখার প্রস্তুতি বলতে পারি?
তালুকদার : একই সাথে গল্প লেখা শুরু করি এবং পড়াও শুরু করি। গল্পগুলো পড়ার কতগুলো কারণ ছিল। একটি হলো যে আমি দেখতে চেয়েছিলাম বাংলা গল্প কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় এসে পৌঁছেছে। আরেকটি বিষয় হলো, কারা কারা এর মাঝে গল্প লিখেছেন, তা জানা। পাশাপাশি এতদিন যাঁরা গল্প লিখে এসেছেন তাঁদের মধ্যে বিশাল পার্থক্য গড়েছেন কে কে, তা জানা। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় ছিল, অনেকেই বলতেন যে এত এত গল্প লেখা হয়েছে, এখন নতুন করে আর কী লেখা হবে! তাই আমি গল্পগুলো পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম যে এত এত রথী-মহারথী লেখার পরেও গল্প লেখার আর কোনো পরিসর আছে কিনা? নতুন কোনো বিষয় বা আঙ্গিক রয়েছে কি না? তো পাঠ করার পরে দেখলাম যে আমি যদি আমার নিজস্ব একটি ভাষা তৈরি করতে পারি তবে আমার লেখার বিষয় বা আঙ্গিক নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। এবং এত বছর পরেও আমি কখনো আমি লেখার বিষয় সংকটে ভুগিনি। আমি প্রতিদিনই লিখি। এখনো আমার লেখার কাজ মনে মনে যতগুলো ঠিক করা আছে সেগুলো শেষ করতে হয়তো আরো দশ বছর লাগবে।
মাহমুদ : নিজের গল্প বিষয়ে আপনার বিবেচনা কী?
তালুকদার : নিজের গল্প বিষয়ে বিবেচনা হচ্ছে যে, আমাদের ভাষায় এত মহারথী গল্প লিখে গেছেন, এখনো লিখছেন। তারপরেও আমার কাজ করার মতো অনেক জায়গা আছে। কিংবা সুযোগ রয়েছে। আর আমার একটি মৌলিক সুবিধা আছে। আমার মানে এখানে আমাদের এই ভূখণ্ডের বাঙালি মুসলমানদের। সুবিধাটি হচ্ছে আমরা যাঁরা বাঙালি মুসলমান, তাঁদের সাংস্কৃতিক এবং মিথলজিক্যাল দিকটি বাঙালি হিন্দুদের চেয়ে বেশি। আমাদের অনেক সিনিয়র লেখকরা এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেননি। তাঁরা হয়তো জানতেন না। কিংবা তাঁরা এটি নিয়ে কাজ করেননি। কিন্তু আমি আমার জন্মগতভাবে পাওয়া এসব সংস্কৃতি ও মিথগুলোকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। আমি ধর্মীয় মিথগুলোকে নিজে রূপান্তর করে বাংলা ভাষায় কয়েকটি গল্প লিখেছি। এ ক্ষেত্রে বলা যায় আমিই পাইওনিয়ার।
মাহমুদ : আমরা এখানে সোলেমান পয়গম্বরের দেয়াল গল্পটির কথা বলতে পারি?
তালুকদার : হ্যাঁ, সোলেমান পয়গম্বরের দেয়াল। আরো বেশ কয়েকটি রয়েছে।
মাহমুদ : আপনার কি কোনো আদর্শ গল্পকার রয়েছে? আপনার প্রিয় গল্পকার কে?
তালুকদার : না। আমার কোনো আদর্শ গল্পকার নেই। যাঁকে দেখে, মানে যাঁর লেখা পড়ে মনে হয়নি তাঁর মতো লিখব। আমার মনে হয়েছে আদর্শ থাকলে আমি কপি করব। তবে এমন হয়েছে, এখনো হয়, কোনো লেখকের গল্প পড়ে আমি খুবই চমৎকৃত হই। কখনো বিস্মিত হয়েছি এই ভেবে যে এত সুন্দর গল্প লেখা যায়!
তবে এটা বলতে পারি, আমার কাছে বারবার পাঠ্য বলে মনে হয়েছে যাঁদের গল্প, তাঁদের কথা বলতে পারি। অমিয়ভূষণ মজুমদার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও হাসান অজিজুল হকের কিছু গল্প আমার কাছে বারবার পাঠ্য বলে মনে হয়। যেসব গল্প আমি বারবার পাঠ করি—তিন বন্দ্যোপাধ্যায় (তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক) তো অবশ্যই, পাশাপাশি কমলকুমার মজুমদারের গল্পও অনেক বেশি পড়ি। এ ছাড়া এমন অনেক লেখক রয়েছেন যাঁরা খুব বেশিদিন লেখেননি, তাঁদের গল্পও আমি পাঠ করি।
মাহমুদ : আপনার দ্বিতীয় উপন্যাস মুসলমানমঙ্গল। এর কাহিনীর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে ধর্মীয় ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক বাস্তবতা—এ দুটোকে মেশানোর পাশাপাশি ধর্মীয় পুরাণের নানা বিষয়ও এখানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এটির ব্যাখ্যা জানতে চাইছি। কিংবা কোন বিশেষ চিন্তা বা ধারণা থেকে উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেছিলেন?
তালুকদার : ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত, এটাকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত ধরা যায়। যখন আমাদের লেখকরা তাঁদের লেখায় সামাজিক, পারিবারিক বিষয়ের পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয় নিয়েও লিখতেন। তাঁরা ইসলামিক ফিলসফি নিয়ে ভাবতেন এবং তাঁদের লেখায় তা প্রকাশ পেত। কিন্তু ষাটের দশকের পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। ষাটের দশকের পরেই ইসলামী চিন্তাকে একধরনের একপাশে সরিয়ে রাখা হলো। ইসলাম বিষয়ে কোনো লেখাই আর দেখা যায়নি তাঁদের লেখায় এ পর্যন্ত। যেন অনেকটা ব্যাকডেটেট হয়ে গেছে, তাই একে নিয়ে আর কোনো আলোচনা বা লেখালেখি হয়নি। অথচ এটি অনেকটা বাতাসের মতো, যার মধ্যে আমরা ডুবে আছি। তাঁদের এই যে দূরে সরে যাওয়ার ফলে ইসলামটা চলে গেল কতগুলো মোল্লা এবং সুবিধাবাদীদের হাতে। এবং এর ফলে তাঁরা যে ব্যাখ্যাটা দেয় ইসলামের আমরা তার প্রতিবাদ করতে পারিনি। কারণ আমরা তার থেকে দূরে সরে আছি, আমরা ওই বিষয়ে জানি না। আমরা কোরআন ভালোভাবে পড়িনি, হাদিস পড়িনি, ফিকাহ শাস্ত্র পড়িনি তাই এসব আমরা জানিনি। সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইসলামের যে কতগুলো তত্ত্ব রয়েছে আমরা তা জানি না। এই অভাববোধটা মনে হয় আমার ভেতরে কাজ করছিল। তাই ভেবেছিলাম, অন্য কেউ করেননি, তাই আমি করি।
মাহমুদ : তার মানে ভেতরের তাগিদটা সব সময়ই ছিল?
তালুকদার : হ্যাঁ, তাগিদটা সব সময়ই ছিল। তাই লিখেছি। আর বিশ্বসাহিত্যে ফিকশনে ননফিকশন বলে একটা বিষয় চালু আছে, যা আমাদের এখানে প্রথমে অনেকেই মানতে চাননি। তাই আমি যখন মুসলমানমঙ্গল উপন্যাসটি লিখলাম, তখন অনেকে এটিকে উপন্যাস বলে মানতে চাননি। তখন আমি বলেছি, ঠিক আছে এটিকে আপনারা একটি গ্রন্থ হিসেবেই দেখেন। তবে এখনো আমি বিভিন্নজনের কাছ থেকে এই বইটির পাঠপ্রতিক্রিয়া পাই। নানা মন্তব্য শুনি।
মাহমুদ : আপনি তবে এটিকে কী হিসেবে লিখেছেন?
তালুকদার : এটি আমি উপন্যাস হিসেবেই লিখেছি। এটি উপন্যাস।
মাহমুদ : আপনার অধিকাংশ লেখাই, এখানে যদি ‘পিতৃগণ’ উপন্যাসটির কথা বলি। যেটির জন্য আপনি জেমকন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেটিও গড়ে উঠেছে ঐতিহ্য আর কিংবদন্তির গল্প নিয়ে। এই যে আপনার লেখায় ঐতিহ্য একটি বড় জায়গা করে নিয়েছে, এটি কি সচেতনভাবে করেছেন, না লিখতে লিখতে চলে এসেছে?
তালুকদার : সম্ভবত আমার মনটিই এভাবে তৈরি হয়ে আছে। এ রকম থাকে না যে- এভাবে নয় এভাবে করব। সে রকম আর কি! আমরা যেটি বলি যে আমাদের বাঙালিদের মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ-এর মধ্য দিয়ে। তবে আমি এখানেই দেখাতে চেয়েছি বাঙালিদের যে মুক্তির সংগ্রাম তা শুরু হয়েছে আরো অনেক আগে। প্রায় এক হাজার বছর আগে। পাল রাজাদের যে বাঙালি বলা, এমন অনেক ভুল ইতিহাস চালু আছে। মূলধারার ইতিহাস বইয়েও এই ভুলগুলো রয়েছে। কৈবর্ত্যরা বা ভূমিপুত্ররা যে পরাক্রমশালী রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়েছে, এটা বিশ্বের একমাত্র নজির। তখন থেকেই কিন্তু বাঙালি জয়ী জাতি। তখন অবশ্য বাঙালি ছিল না। পরবর্তীকালে অনেক রূপান্তরের পরে বাঙালি হয়েছে। তাই এর মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ আমার লেখার মধ্য দিয়ে আমি বারবার বলতে চাই, ঘোষণা দিতে চাই যে, বাঙালির যে মুক্তির আন্দোলন তা একাত্তরে শুরু হয়নি, সাতচল্লিশেও হয়নি। এটি শুরু হয়েছে অনেক অনেক আগে পাল রাজাদের আমলে। আমি এর মধ্য দিয়ে দেখাতে চেয়েছি বাঙালি কখনোই পরাধীনতাকে সহজে মেনে নিতে চায়নি। একজন বাঙালি হিসেবে এটি আমার জন্য গর্বের বিষয়। আমি গর্বিত।
মাহমুদ : আমরা জানি যে, শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে আপনি একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন। উপন্যাসটির অবস্থা জানতে চাইছি। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে উপন্যাস রচনা করাটা কতটা যৌক্তিক বলে আপনার মনে হয়? যৌক্তিক কথাটি এই কারণে বলছি যে, যখন বিষয়টির কোনো সমাপ্তি বা ফলাফল বা পরিণতি আমরা এখনো দেখিনি।
তালুকদার : সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখার দুটি দিক হতে পারে। এটি লেখা যেতেও পারে, নাও যেতে পারে। তবে একটি ঝুঁকি থেকে যায়। আর যেহেতু এটির এখনো কোনো পরিণতি আসেনি কিংবা ধরো যে ফলাফলও পাওয়া যায়নি, তাই এটি নিয়ে কাজ করাটা একটু ঝুঁকিরই। তবে শাহবাগ নিয়ে যখন লিখতে শুরু করেছি তখন এর পেছনের কথা, আন্দোলনের মাঝপথের কথা সব কিন্তু জানতে হব। সেই সাথে জানতে হবে শেষটাও। আমিও উপন্যাসটির কিছু অংশ লেখার পরে অসম্পূর্ণ রেখে দিয়েছি। তার মানে এই নয় যে, এটি একটি বাতিল প্রকল্প।
মাহমুদ : তবে কি এটিকে একটি স্থগিত প্রকল্প বলতে পারি?
তালুকদার : (হাসি) তা বলতে পারো। এখন এটি স্থগিত অবস্থাতেই আছে। তবে পুরোপুরি বাতিল নয়। আগামী এক-দু বছরে যে এটি লেখা শেষ হবে বা প্রকাশ পাবে এমনটাও বলতে পারব না।
মাহমুদ : এবার আমরা একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন শহিদুল জহির হচ্ছে ব্যর্থতার উদাহরণ। তিনি নিজের তৈরি বৃত্ত থেকে বের হতে পারেননি। বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করতেন।
তালুকদার : এই বিষয়টি এ রকম যে, আমি যখন কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে যাব, তখন ওই বিষয়টিই ঠিক করে দেবে আমার লেখার ভঙ্গিটি বা কথন পদ্ধতিটি কেমন হবে, লেখার শৈলীটি কেমন হবে- তা ওই লেখার বিষয়ের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। যেমন আমি যখন হাঁটতে থাকা মানুষের গান লিখি, তখন যে ভঙ্গিটি ব্যবহার করি, ‘পিতৃগণ’ লেখার সময়ে কিন্তু সেই ভঙ্গিটি ব্যবহার করি না। কিংবা যেই আমি ‘সোলেমান পয়গম্বরের দেয়াল’ লেখার সময় যে ভাষাটি ব্যবহার করি, ‘যোজনগন্ধা’ লেখার সময়ে আমি কিন্তু সেই একই ভাষাটি ব্যবহার করি না। শহীদুল জহির বলব যে খুব উচ্চমানের একটি ভাষাভঙ্গি এবং আঙ্গিক তিনি পেয়েছিলেন। তিনি নিজেকে হারানোর ভয়ে আর ওখান থেকে বেরিয়ে আসেননি। এরপর তিনি সব সময়ই আগে ভাষাভঙ্গিটি ঠিক করে পরে লেখার বিষয় ঠিক করতেন। তাঁর এভাবে একটি বৃত্ত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অনেকটা বৃত্তবন্দি অবস্থা বলা যেতে পারে। তিনি আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সাহস দেখাননি। তাঁর জীবদ্দশায় আমি তাঁকে বলেছি, হাসান আজিজুল হক বলেছেন, আরো অনেকে বলেছেন ওই বৃত্তটি থেকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু তিনি পারেননি। তিনি যে ভাষাটি আয়ত্ত করেছিলেন তা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমাবশ্যা এবং পুরান ঢাকার ভাষার একটি মিশেল ঘটিয়ে তা হয়েছিল। নিজের তৈরি ঘরবাড়ি ভেঙে যদি নতুন রাস্তায় না আসতে পারলেন, এটা একজন লেখকের জন্য জড়াবস্থা। যেহেতু শহীদুল জহির এখন বেঁচে নেই, তাঁর অকাল মৃত্যু না হলে তিনি এ থেকে বেরিয়ে আসতেন কিনা, তা আমরা জানি না। তবে তাঁর যে রচনা তিনি রেখে গেছেন, সে বিচারে এটিকে আমি তাঁর সীমাবদ্ধতা বলেই মনে করি।
মাহমুদ : বিষয়টি যদিও বলা বিব্রতকর তবুও আপনি নানা সময়ে স্পষ্ট মতামত দিয়ে থাকেন বলেই জানতে চাইছি। আমাদের বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে এখন জীবিতদের মধ্যে কার কার লেখা আপনার ভালো লাগে?
তালুকদার : হাসান আজিজুল হক স্যার এখন আর গল্প লিখছেন না। এটিও আমি বলব যে লেখকের একধরনের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা। যদিও তিনি এখন গল্প না লিখলেও আত্মজীবনী লিখে চলেছেন। প্রবন্ধ লিখছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন এখন আর তাঁকে দিয়ে গল্প হবে না। এটিও ভালো দিক। আর এখনকার চলমান লেখক যাঁরা এখনো লিখে চলেছেন তাঁদের মধ্যে মঈনুল আহসান সাবেরের লেখা আমি পড়ি। আমাদের এখানে একটি ধারণা আছে যে গ্রামীণ পটভূমি নিয়ে না লিখলে সে আবার লেখক কিসের! তবে সেটি মঈনুল আহসান সাবের ভেঙে দিয়েছেন।
মাহমুদ : হ্যাঁ, মঈনুল আহসান সাবের যেটি করেছেন—তাঁর লেখায় আমাদের শহুরে মধ্যবিত্তদের বেশ ভালোভাবে তুলে ধরেছেন। আমাদের নাগরিক জীবনের খুঁটিনাটি নানা বিষয় তাঁর লেখায় উঠে এসেছে।
তালুকদার : মঈনুল আহসান সাবের আমার কাছে এসব কারণেই একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। আর আমার সমসাময়িকদের মধ্যে ইমতিয়ার শামীমের কথা বলা যেতে পারে। তাঁর কিছু ভালো গল্প রয়েছে। তবে তাঁর এখনকার গল্পগুলোকে আমার কাছে দুর্বল বলে মনে হয়। আর অদিতি ফাল্গুনীর প্রথম বইয়ের কয়েকটি গল্প আমার খুবই প্রিয়। আমি একটি বিষয়ে খুব সচেতন থাকার চেষ্টা করি যে, আমার সমসাময়িকরা কেমন লিখল তা পড়ি। তাদের লেখা প্রকাশ হলেই পড়ি। সেলিম মোর্শেদের লেখা পড়ি। কাজল শাহনেওয়াজের গল্প পড়ি, প্রশান্ত মৃধার গল্প, আহমাদ মোস্তফা কামালের গল্প পড়ি, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের গল্প পড়ি। একেবারে নতুন জেনারেশনের বাকী বিল্লাহর গল্প পড়েছিলাম। ভালো লেগেছিল। আর আমাদের বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যে সত্যি সত্যি ভালো লিখছে বেশ কয়েকজন। শাহ্নাজ মুন্নী বেশ ভালো লিখছেন। তিনি আগে থেকেই লিখছেন। তাহমিনা শাম্মীও ভালো লেখেন।শাহনাজ নাসরিনের কিছু গল্প পড়ে ভালো লেগেছিল। মুনিরা কায়েস তো আমার কাছে খুবই শক্তিমান লেখক। তিনি অবশ্য লেখেন কম। আমাদের দেশের সকল নারী লেখকদের স্মরণ করেই বলছি, মুনিরা কায়েস সবার চেয়ে আলাদা। তাঁর মতো গদ্য আর কারো নয়। তাঁর চেয়ে ভালো গদ্যশিল্পী মহিলাদের মধ্যে বের হয়নি।
মাহমুদ : একটা বিষয়ে আলোচনা সবসময়ই শোনা যায় যে, মূলধারার লেখক এবং জনপ্রিয় ধারার লেখক। এই আলোচনাটিকে আপনি কতটা সমর্থন করেন? করলে আপনি নিজেকে কোন ধারার বলে মনে করেন?
তালুকদার : আমি কোনো ধারার না। আমি লেখালেখি করি, লেখালেখির ধারায় থাকতে চাই। তবে জনপ্রিয় ধারা বলে একটি আলোচনা শোনা যায়। আমাদের পাঠকদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এক ধরনের বই লেখা হয় যার একটি ফর্মুলা হয়তো আছে—যেখানে কতটুকু প্রেম থাকবে, কতটুকু বিরহ থাকবে, কতটুকু সেক্স থাকবে তা নির্ধারণ করা হয়। এমনকি কত পৃষ্ঠার মধ্যে শেষ করতে হবে এমন বিষয়ও হয়তো থাকে। তবে সেই ফর্মুলাটি আমার জানা নেই। আর জানার কথাও নয়। আমি আমার মতো লিখে যাই।
মাহমুদ : তার মানে নিজেকে কোনো ধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছেন না?
তালুকদার : না। আমার পাঠক ও সমালোচকরা ঠিক করবেন আমি কোন ধারার। আমার কাছে জানতে চাওয়া হলে বলব, আমি বাংলা ভাষার একজন লেখক।
মাহমুদ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য। আবারও অভিনন্দন।
তালুকদার : তোমাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ এহসান। ভালো থেকো।