স্মরণ
আধুনিক কবি শামসুর রাহমান
আমার ব্যক্তিগত মেমোরিতে কয়েকটি নাম ও তাঁর বানান খুব ভালোভাবে গেঁছে আছে। এর অন্যতম কারণ সে নামগুলোর ব্যতিক্রম ধর্মিতা। রেহমান সোবহান, প্রমথ চৌধুরী, শামসুর রাহমান প্রমুখ। সাধারণভাবে আবিদুর রহমান, আতিকুর রহমান, মাহবুবুর রহমান- এ ধরনের নামের সঙ্গে ‘রহমান’ শব্দটি সংযুক্ত থাকবে সেটাই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু নামের শেষে ‘রেহমান’ বা ‘রাহমান’ সংযুক্ত থাকবে সেটা একটু অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রম। আর সে কারণেই কবি শামসুর রাহমানের নামের শেষে ‘রহমান’ না হয়ে ‘রাহমান’- সেটা অনেকেই হয়তো এখনো অনবধাবশত না-ই জানতে পারেন। এটি বেশি ভুল হয় যখন বাচ্চাদের ক্লাসের পাঠ্য কবিতা পড়ানো হয়।
তবে বিশেষত যাঁরা আগেই বানানটি ধরতে পারেন, তাঁরা হয়তো অতিসতর্কতার অংশ হিসেবে তাদের বলে দেন যে রাহমান বানানের সঙ্গে ‘আ’-কার সংযুক্ত আছে। আমি আমার নিজের বাচ্চাদের পড়ানোর সময়ও একই সূত্র ব্যবহার করে থাকি। অপরদিকে ‘প্রমথ চৌধুরী’ যে ‘প্রথম চৌধুরী’ না, তা আমি নিজেও আবিষ্কার করলাম জীবনের অনেক ক্লাস ডিঙানোর পরে। আর এটি অনেকের জীবনেই ঘটেছে বলেই সদ্য প্রয়াত কবি রফিক আজাদ এটি নিয়ে একটি রম্য রচনা লিখেছিলেন। যা হোক, এসব ভুলও সাহিত্যে অনেক হাস্য-রসাত্মকের জন্ম দিয়েছে। আজকে আমার আলোচনায় স্মরণ করব বাংলাদেশের, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের দশম মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে। তাঁর জন্ম ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে, তাঁর নানাবাড়িতে। বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্ম নেওয়া ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে কবি ছিলেন চতুর্থ। কিন্তু তাঁর শেকড়ের মূল ছিল ঢাকার অদূরে নরসিংদীর রায়পুরে। মাত্র ২০ বছর বয়সে সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায় ১৯৪৯ সালে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। একসময় তিনিই বলেছিলেন যে, কখনো কবিতার মধ্যে রাজনীতি আনবেন না। কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর তিনি আর তাঁর আগে কথায় স্থির থাকতে পারেননি। কারণ তাঁর চেতনাবাদী মন তাঁকে রাজনীতিকে কবিতার বাইরে রাখতে পারেনি।
‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ যা ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর কবিতায় সব সময় স্থান পেয়েছিল জীবনবোধ, শৃঙ্খলমুক্ত জীবনাচার, স্বাধীনচেতা মন। সে কারণেই বারবার তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা, আটান্নর আইয়ুববিরোধী কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিন বছর, পঁচাত্তরের নির্মম ঘটনা, পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, আশির দশকের সামরিক স্বৈরশাসন ইত্যাদি। ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘অভিশাপ দিচ্ছি’, ‘সফেদ পাঞ্জাবি’, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘ইলেকট্রার গান’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, ‘ধন্য সেই পুরুষ’, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, ‘গর্জে ওঠো স্বাধীনতা’ ইত্যাদিই প্রধান। তবে তার মধ্যে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ ও ‘স্বাধীনতা তুমি’- এ দুটি কবিতা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে স্বাধীনচেতা বাঙালি পাঠকসমাজে।
কর্মজীবনে তিনি ১৯৫৭ সালে সাংবাদিক হিসেবে ‘দ্য ডেইলি মর্নিং নিউজ’-এ কাজ শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে ‘দৈনিক বাংলা’ ও ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র সম্পাদক নিযুক্ত হন তিনি। পরে স্বৈরাচারের সঙ্গে আপস করতে না পেরে তিনি ১৯৮৭ সালে এখান থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো- বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক ইত্যাদি। এর পাশাপাশি তিনি ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হতে কবিকে সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি উপাধি দিয়েছেন।
৬৬টি কাব্যগ্রন্থ, চারটি উপন্যাস, অনেক প্রবন্ধ, ছড়াসহ তাঁর শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে নয়, তাঁর রচনাসমগ্র গুণেমানেও অনন্য। এসব রচনার জন্য বাংলাদেশে সর্বপ্রথম তিনিই ঢাকার কল্যাণপুরে তাঁর নিজ বাসায় সস্ত্রীক জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন। পরে দুজনেরই সাহসী প্রতিরোধে সেদিন তাঁরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। কারণ তিনি তাঁর লেখনীর দ্বারা সর্বদাই জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদবিরোধী ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এ কবি ২০০৬ সালের ১৭ আগস্টে জাতির এ শোকাবহ মাসে সকল ভক্তকুলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ৭৬ বছর বয়সে এক প্রকার অকালপ্রয়াণে যান।
জীবদ্দশায় প্রতিটি জন্মদিন পালনে মৃদৃভাষী বক্তব্য দিতেন তিনি সবার জন্য। তবে কবির স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য নরসিংদীর রায়পুরে তাঁর পৈতৃক পরিত্যক্ত পাড়াতলির বাড়িটিতে যে একটি স্মৃতি পাঠাগার ও সংরক্ষণাগার তৈরি করা হয়েছে, সেটা লোকবলের অভাবে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে বলে এলাকাবাসী এবং কবির ভক্তকুলের অভিযোগ রয়েছে। সে জন্য এ বিষয়ে বর্তমান সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটু সুদৃষ্টিই এর জন্য যথেষ্ট বলে মনে করেন অনেকে। কারণ তিনি এতদিন বেঁচে থাকলে এখন দেশের জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কলম নিয়ে আবারও সোচ্চার হতেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। সে জন্যই আজ তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের জন্য। আর সেটি করতে পারলেই প্রগতির পথে দেশ আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।