স্মরণ

নজরুল চেতনায় বিষধর

Looks like you've blocked notifications!

ত্রিপুত্র-ধারী রুদ্রের রোষ-বহ্নিতে জনমিয়া

ভয়াল জ্যোতির্জাগশিশু-সম আসিলাম বাহিরিয়া।

আমার ফণার মণি করিলাম উল্কাপিণ্ড তুলি

মহাকাল-করে জ্বালাময় বিষ-কেতন উঠিনু দুলি।

সেদিন আমারে প্রণতি জানাতে এলো কত নর-নারী,

বন্দিয়াছিল আমারে ভাবিয়া সাগ্নিক নভোচারি।

[‘মৃত তারা’/ কাজী নজরুল ইসলাম]

ভারতীয় জীবনদর্শনে বিষ ও অমৃত নামের দুটি বিপরীতমুখী চেতনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। পুরাণে অমৃত সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় মনে হয় এটি এমন একটি পানীয় যা একদা বৈদিক দেবতার উদ্দেশ্যে হোমে অর্পণ করা হতো এবং পরবর্তীকালে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী নিজেরাই ব্যবহার করতে শুরু করে। কৃষি-অর্থনীতির পূর্বে গো-পালন ছিল সামাজিক শক্তির কেন্দ্র ও দুগ্ধজাত দ্রব্যেই তৈরি হতো অমৃত বা জীবনীশক্তি কিন্তু ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে অর্থনৈতিক বিকাশ রুদ্ধ ও বিপন্ন হলে তৈরি হয় উদ্ধারের রূপকার্থ সমুদ্র-মন্থনের কাহিনী। হারিয়ে-ফেলা শক্তি বা অমৃত পুনরুদ্ধার হলেও সঙ্গে উঠে আসে কালকূট অর্থাৎ বিষ। অবশ্য এই মন্থথনকার্যে জনগণের প্রতীকার্থে নাগরাজ বাসুকিকে ব্যববহার করা হয়েছিল মন্থন-রজ্জু হিসেবে এবং তার ধারণ করা ক্ষতিকর শক্তি তথা বিষ সম্পর্কে কারো মনে কোনো প্রশ্ন জাগেনি। আদিতে সম্ভবত নাগেরাই ছিল ফণী কিন্তু বিষধর নয় অর্থাৎ স্বতন্ত্র ক্ষমতাকেন্দ্র ও পুঞ্জীভূত সম্পদের অধিকারী। স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসেবে নাগেরা পরাজিত হয় আর্য-আধিপত্যের নিকট, তাদের ঠেলে দেওয়া হয় প্রান্তের দিকে; আর্য মনস্তত্ত্বে তারা পরিণত হয় মনুষ্যেতর ও প্রান্তরূপ পাতালবাসী প্রাণীতে। এ সময় সর্পদের সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই, এতে ধারণা করা যায় সর্পরা আর্য-আধিপত্যের কালে সুবিধাপ্রাপ্ত একটি জনগোষ্ঠী যাদের ভাবা হয়েছে গতিশীল অথচ কুটিলতাপূর্ণ। এরা গতিমান অথচ বুকে হাঁটে অর্থাৎ মেরুদণ্ড থাকা সত্ত্বেও অবনত, কখনো দংশনের কালে মাথা উঁচু করে- এরাও সম্পদ ধারণ করেছে কিন্তু এবার একটি নতুন ঢেউয়ে আর্য-বিপরীত মনস্তত্ত্বে এরা নেতিবাচক চরিত্ররূপে চিহ্নিত হয়। নজরুল ইসলাম তাঁর কালের সম্পদ, তার বণ্টন ও সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে আদি-পৌরাণিক কাহিনীর নাগ-সর্প, সমুদ্র-মন্থন, দেবাসুরের বিরোধকে নবমূল্যায়নে গ্রহণ করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা ও দ্বন্দ্বময় শ্রেণিসম্পর্কের একটি পরিচয় লুকিয়ে আছে দেবাসুর ও নাগ-সর্পদের কাহিনীর ভেতর। অমৃতরূপ জীবন মাত্র নয়, বিষয়-সম্পদ ও ক্ষমতা লাভকারী আর্য-মনস্তত্ত্ব সুবিধামতো প্রান্তের মানুষদের প্রতি দোষারোপের রাজনীতি বা প্রপাগাণ্ডা চালাতে থাকে। নিজেরা বিষয় লাভ করেও বিষয়-বিষের সঞ্চয়কারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বাসুকি-গোষ্ঠীকে। বলা হয় এরা অনেকটা কুবেরের মতোই, পাহারা দেয় কিন্তু ভোগ করতে পারে না! পুরাণে আট প্রকার নাগের উল্লেখ আছে; অনন্ত, বাসুকি, পদ্ম, মহাপদ্ম, তক্ষক, কুলীর, কর্কট ও শঙ্খ। আট দিকের রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে এদের সংযোগ আছে অর্থাৎ এরা দিকের রক্ষাকর্তা। শব্দার্থে অনুমান করা যায় নাগেরা পর্বতের অধিবাসী হওয়ার কথা, বাঙালির কীর্তিত শিবও তাই ছিলেন প্রান্তিক সত্তা হিসেবে। অবশ্য পুরাণ মতে নাগ কদ্রুর গর্ভজাত কশ্যপের সন্তান। এরা সংখ্যাধিক্যে ও ক্ষমতার কার্যকারণে ক্রূরাচারী হয়ে ওঠে। এরাই একদা বিশ্ব অর্থাৎ বিশ্বের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং তাদের বিষয়বিষের প্রভাবে বিশ্ব ধ্বংসের প্রান্তে উপনীত হয়েছে। প্রজারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে ব্রহ্মার অভিশাপে নাগেরা পাতালবাসী হলো। মূলত সমাজবিকাশ ও সম্পদ সংগ্রহের বৈশিষ্ট্যে নাগেরা কুটিল ও বিষধর হিসাবে কল্পিত। এরাই সম্ভবত আদি নগর ও পুঁজি সংগ্রহের কারিগর এবং প্রজার প্রতিরোধে নয়, আর্য-আধিপত্যের কারণে সম্পদসহ আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে সর্পদের সঙ্গে সমাজের ক্ষমতা বা সর অর্থাৎ স্নেহরূপ সারাংশ ভোগদখলের ব্যাপার ছিল। নাগদের স্থলাভিষিক্ত নতুন শক্তি নিশ্চয়ই তা কোনো প্রান্তিক জনশক্তি নয়, এখানে কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিরোধেরও প্রশ্ন আসে না বরং ক্ষমতায় এসেছিল আধিপত্যধর্মী আর্যেরা। তবে এটা সত্য, সমাজে বিষ ও অমৃতের রূপকার্থে যেভাবে সর্পদের সম্পর্ক তৈরি হয় তাতে বোঝা যায় সম্পদের অনাচারের সঙ্গে এদের যোগ আছে। পাতালে রক্ষিত থাকে অমৃত এবং তাকে পেতে হলে বিষ-ভাণ্ড অতিক্রম ও বিষধরের সাহায্যের প্রযোজন হয়।

বাংলায় প্রবাদ আছে বিষ নাই সাপের কুলোপনা চক্কর- এইসব প্রান্তিকজনের বহু কষ্টের ঠাট্টা! ফণা ধরে যে তার নাম ফণাধর বা ফণীধর বা ফণী অর্থাৎ সাপ। অষ্টনাগের একজন পদ্ম অর্থাৎ দল-মণ্ডলীর কেন্দ্র; নাভীপদ্মে যেমন স্রষ্টারূপে প্রভু বসেন তেমনি! সবই ক্ষমতার কারসাজি-  ফণী, চক্রের মস্তিষ্কে তার বসবাস, আক্রমণাত্মক ক্ষমতার নিদর্শন। ফণী শব্দটি এখন প্রায় অপ্রচলিতই, তবু নজরুল ইসলাম ব্যবহার করেছেন। কেন? নাগদের অর্জিত জ্ঞান বা সম্পদই কি ফণা? ফণা তো মস্তিষ্কেই থাকে! কিন্তু সংগ্রহবৃত্তির আগ্রাসী অনাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহার সাধারণের মনস্তত্ত্বে প্রতিশোধের স্পৃহা তৈরি করে, এ কারণেই হয়ত ফণী বললে এখন সাপকেই বোঝায়। সুযোগসন্ধানী, ধূর্ত, ভোগী মনোবৃত্তির সামাজিক বর্গের পরিচয় পাওয়া যায় বিত্ত সংগ্রহের ধারাক্রমে; যা ব্যক্তির অর্জিত নয় কিন্তু বংশানুক্রমে ব্যবহারের সুযোগ থাকে, তাতে যে অনাচার বা অপব্যয়, তাকেই সমাজ মনস্তত্ত্ব নেতিবাচকভাবে সাপ হিসেবে বিবেচনা করেছে। এরাই সমাজের বিষধর শ্রেণি। ফণীর সঙ্গে যুক্ত একটি প্রাসঙ্গিক শব্দ ‘ফণীমনসা’। কেমন হয় ফণীমনসা? সৌন্দর্যে ও ক্রূরতার দৃশ্যকল্পে দ্বৈতাভাসী- কাঁটাযুক্ত ফুলের সৌন্দর্য, এজন্যই এমন নাম? তবে এর চরিত্র পৌরাণিক নয়, কবির রোমান্টিক মনের অতলে এর বীজ লুকিয়ে আছে। কিন্তু মনসা জনমানুষের পৌরাণিক চরিত্র- সর্পমন্ত্রাধিষ্ঠাত্রী দেবী। কশ্যপ এঁকে সৃষ্টি করেন মন দ্বারা এবং একারণে নাম হয় মনসা। তাঁর প্রিয় বৃক্ষ স্নুহী বা সিজ অর্থাৎ ফণীমনসা। তিনি কশ্যপের মানসী, মহাদেবের শিষ্যা, বিষ্ণুর ভক্ত ও জরৎকারু মুনির স্ত্রী। মূলত শারীরিক সৌন্দর্যে, জ্ঞানে, ভক্তিতে অপূর্ব এক মননশীল প্রাণের নাম মনসা। তিনি সর্পদের বিষহরণের মাধ্যমে বিষহরী অভিধা লাভ করেন কিন্তু নাগদের রক্ষার মাধ্যমে পান নাগেশ্বরী নাম। আমাদের পরিচিত মনসামঙ্গল বা মনসাপূজার বৃত্তান্তে চাঁদ সওদাগরের সাক্ষাৎ লাভ করি এবং তার সঙ্গে মনসার যে বিরোধ তা ক্ষমতার ভিত্তিতে সামাজিক অর্থনৈতিক কার্যকারণকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। মনসা কি সর্পদের ক্ষমতা ও সম্পদ হরণ করেনি? এদেরই শ্রেণিচরিত্র কি চাঁদ সওদাগরের মধ্যে নেই?

মনসা হন বিষহরী এবং বিষ একটি নেতিবাচক শব্দ। আদিতে ‘বিশ’ শব্দটির দ্বারাই বিচ্ছুরণ বোঝাত এবং অন্য একটি সত্তার ভেতর এর প্রভাব ইতিবাচক হলে ‘বিশ’ অর্থে সেই বিচ্ছুরিত শক্তি কাঙ্ক্ষিত হত কিন্তু এর প্রভাব নেতিবাচক হলে শক্তিটিকে অবনমনের দ্বারা বলা হয়েছে ‘বিষ’। বিষ প্রাণের বিরুদ্ধ শক্তি, যা প্রচল বা গতিশীল বাস্তবতাকে ধ্বংস করে। ক্ষমতা বা সম্পদ জনমানুষের বিরুদ্ধ শক্তি হলে বিষবৎ হতে পারে, এখনও এর সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। এগুলো হলাহল, গরল বা কালকূট! বিষ ধারণ করে থাকা বিরুদ্ধ শক্তির নাম বিষধর, আজকের বিবেচনায় সর্প-  হয়ত এরাই একদা সমাজের সর ভক্ষণ করেছিল। কিন্তু বিষ ধারণ করলেই বিষধর হয় না, বিষ ধারণ করেই মহাদেব হয়েছেন শিব, নীলকণ্ঠের একমাত্র কারণ মহৎ উদ্দেশের ভেতর লুকিয়ে আছে। অমৃতের ভাগ নেবার লোকের অভাব হয় না, বিষের ভাগ একাই নিতে হয়- এ হচ্ছে নেতৃত্বের দায়। বিষ্ণু তো পরামর্শ দিলেন নবতর উৎপাদনের জন্য কিন্তু এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার দায় গ্রহণ করতে হয়েছে শিবকেই। এতে সমাজ বেঁচে গেল, অমৃত কিন্তু গেল বিশেষ একটি শ্রেণির হাতে! এজন্যই হয়ত দশমহাবিদ্যার বাইরে নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেন ‘মনসা-বন্দনা’: ‘জয় শঙ্কর-শিষ্যা, কশ্যপ-দুহিতা মনসা।/ জয় নাগেশ্বরী জয় অনন্ত নাগ-গণ পূজিতা মনসা॥’ আশা ছিল বৈষম্যের বিষ থেকে মুক্তি লাভ করবে সমাজ।

নাগ ও সর্পে পার্থক্য বিদ্যমান। নাগ-চেতনায় আছে ক্ষমতা হারানো এক জনগোষ্ঠীর কথা, এরা রাজ্য হারিয়ে কিছু সম্পদসহ আত্মগোপন করেছিল। এরা বিষ ধারণ করলেও হারানোর বেদনাযুক্ত এবং একদা অমৃতরূপ জীবন-প্রতিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্যকারী। কিন্তু সর্প যথার্থই বিষধর, সামাজিক সুবিধাভোগী বিষয়-বিষে আক্রমণাত্মক। এই দুই সূত্রের সঙ্গে বিষ ও অমৃত উদ্ধারের সমুদ্র-মন্থন কাহিনীর রূপকার্থও নজরুল ইসলাম পৌরাণিক প্রসঙ্গে লাভ করেছিলেন কিন্তু তাদের ব্যবহার করেছেন কাল, সমাজধর্ম ও রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতায়। সেমেটীয় ঐতিহ্য থেকেও তিনি সাপ সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছেন মুসলিম-মানস সূত্রে। ক্ষমতা, সম্পদ আহরণ ও রক্ষা, যৌনতা ও কূটকৌশলের বিপরীতমুখী প্রবণতার সংমিশ্রণে সাধারণভাবে সর্পদের সম্পর্কে যে তৈরি ধারণা পাওয়া যায় তাতে কিছু সংযোজন-বিয়োজনের দ্বারা নজরুল ইসলাম তার বিষধর প্রতীকটির প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছেন। আলোচনা শুরু করা যায় সাপের প্রবল ভূমিকা আছে এমন একটি গল্প ‘পদ্ম-গোখরো’ দিয়ে। এমনিতে সরল ও রূপকথাধর্মী, আমাদের স্মৃতিতে থাকা কথামালার সাযুজ্য নিয়েই কাহিনী সংগঠন অথচ পরিণামে বা বয়নের নকশায় ভারতবর্ষীয় সমাজ ও ব্যক্তির অবচেতন সত্যকে উন্মোচন করে গল্পটি। রসুলপুরের মীর পরিবার, বর্তমানে ক্ষয়প্রাপ্ত সামন্ত- তাদের অর্জিত সম্পদ নষ্ট হয়েছে উত্তরাধিকারীর ভোগ-বিলাসে। এই পরিবারের সন্তান আরিফের সঙ্গে বিয়ে হল সম্পদ নয় বংশগৌরবে ধন্য সৈয়দ বংশের কন্যা জোহরার। সৈয়দেরা পীর, মীরেরা ছিলেন জমিদার; দুই পরিবারেরই সামাজিক গুরুত্ব প্রথমে ছিল অর্থ-সম্পদের কারণে কিন্তু বর্তমানে সম্পদ হারিয়ে কেবল বংশগৌরবের ওপর নির্ভরশীল। জোহরা রূপবতী, আরিফ রূপবান এবং উভয়ের মিলন হল ইতিবাচক। জোহরার আগমনের পর অসুস্থ শাশুড়ি সুস্থ হলেন এবং এরপর পেলেন পদ্ম-গোখরো প্রহরারত ‘একটি নাতিবৃহৎ পিতলের কলসি বাদশাহী আশরাফীতে পূর্ণ’ অর্থাৎ গুপ্তধন। দুটি সাপ কিছুতেই কলসির কর্তৃত্ব হারাতে রাজি ছিল না, জোহরার স্নেহ ও দুধের লোভ দেখিয়ে তা সম্ভব হল। সেই সোনার মোহর গলিয়ে পাওয়া টাকায় মীর পরিবার সচ্ছলতা ফিরে পেল কিন্তু অর্থ তার গতিশীলতার ধর্ম বজায় রাখে ব্যবসায়ে; নজরুল ইসলাম লেখেন :

‘... বধূর “পয়” দেখিয়াই বোধ হয়- আরিফ তাহারই কিছু টাকা লইয়া কলিকাতায় আসিয়া কয়লার ব্যবসা আরম্ভ করিয়া দিল। ব্যবসায় আশার অতিরিক্ত লাভ করিতে লাগিল।

বৎসর দুয়েকের মধ্যে মীর-বাড়ির পুরাতন প্রাসাদের পরিপূর্ণ রূপে সংস্কার হইল। বাড়ি-ঘর আবার চাকর-দাসীতে ভরিয়া উঠিল।

পরে কর্পোরেশনের কন্ট্রাকটরী হস্তগত করিয়া আরিফ বিপুল অর্থ উপার্জন করিতে লাগিল।

কোন কিছুরই অভাব থাকিল না, কিন্তু জোহরাকে লইয়া তাহারা অত্যন্ত বিপদে পড়িল।’

সম্পদের সঙ্গে বিপদ আসে কি? আপাতভাবে বিপদ না হলেও সম্পদের পিছুটান বা সংকট থাকতে পারে কিংবা গভীরতর অর্থে আন্তরিক দায়। যে সাপের কবল থেকে উদ্ধার হল সম্পদ তারাই স্নেহাসক্ত হল জোহরার। সাপ দুটি কিছুতেই জোহরা সঙ্গ ছাড়ে না; সাপের ভয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি ভীত; আরিফ-জোহরার শয্যার মাঝে স্থান নিতে চায় তারা। গভীর রাতে স্ত্রীর পরিবর্তে আরিফ পায় সাপের হিমস্পর্শ, আর দেখতে পায় ‘তাহারই শয্যাপার্শ্বে পদ্ম-গোখরোদ্বয় তাহার বধূর বক্ষে আশ্রয় খুঁজিতেছে।’ সর্প তো সর বা সারাংশরূপ স্নেহ ধারণকারী, দুগ্ধলোভী! একারণেই কিনা নজরুল দুটি প্রসঙ্গ আনেন একাধারে। প্রথমত জোহরার যমজ সন্তান হারানোর প্রসঙ্গ, ‘স্নেহ-বুভুক্ষু তরুণী মাতার হৃদয় মন’ অর্থাৎ জন্মান্তর-ভাবনা এবং সর্পশিশুদের আদরযত্ন। দ্বিতীয়ত, ‘স্বামী অসহায় ক্রোধে ফুলিতে থাকে, কিন্তু কোন উপায়ও নাই। তাহার ও তাহার প্রাণের অধিক প্রিয় বধূর মধ্যে এই উদ্যত-ফণা ব্যবধান সে লঙ্ঘন করিতে পারে না। নিষ্ফল আক্রোশে অন্তরে পুড়িয়া মরে।’ ইঙ্গিতে অবদমিত কাম-প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন নজরুল ইসলাম, আরিফের উক্তিতেও এর প্রমাণ : ‘তোমায় দংশন করে না ওরা, কিন্তু ওদের বিষের জ্বালায় আমি পুড়ে মলুম! আমার কি ক্ষতি যে ওরা করেছে, তা তুমি বুঝবে না!’ সমাধান হল সাপের সঙ্গে জোহরার বিচ্ছেদ; মীর পরিবারে পরামর্শে জোহরাকে পিতৃগৃহে পাঠানো হল। দরিদ্র পিতার ঘরে এল ধনীর পত্নী, বসনে-ভূষণে দীপ্তি বিচ্ছুরিত জোহরা। সাপ রইল শ্বশুরবাড়ি, পিতার ঘরে সম্পদের ঔজ্জ্বল্য! মন ভালো নেই জোহরার, সন্তানতুল্য সাপের কথা মনে পড়ে। জোহরা অসুস্থ হয়ে পড়লে শ্বশুরের পরামর্শে স্থির হয় তারা রসুলপুরেই ফিরে যাবে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার পূর্বরাতে প্রায় বিশ হাজার টাকার স্বর্ণালঙ্কার চুরি করে জোহরার পিতা-মাতা এবং এই দৃশ্য দেখতেও পায় আরিফ, তার মনে হয় ‘এত কুৎসিত এ পৃথিবী।’ এর প্রেক্ষাপট পাওয়া যায় :

‘আরিফ জানিত, কিছুদিন ধরিয়া তাহার শ্বশুরের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হইয়া পড়িয়াছিল। দেশেও প্রায় দুর্ভিক্ষ উপস্থিত। মাঝে মাঝে তাহার শ্বশুর ঘটি বাটি বাঁধা দিয়া অন্নের সংস্থান করিতেছিলেন, ইহারও সে আভাস পাইয়াছিল। ইহা বুঝিয়াই সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া অর্থ সাহায্য করিতে চাহিয়াছিল কিন্তু তাহার শ্বশুর স্বীকৃত হন নাই। জোহরার হাত দিয়াও দেখিয়াছে, তাঁহার জামাতার নিকট হইতে অর্থ সাহায্য লইতে নারাজ।’

আভিজাত্যের অহংকার, দারিদ্র্য ও লোভের কার্যকারণে চুরি, সম্পর্ক বিনষ্টি ও হত্যাচেষ্টার মতো ঘটনা ঘটেছে। কিংবা বলা যায়, হঠাৎ পাওয়া ধন-সম্পদই সংকটের উৎস। চুরির ঘটনার সঙ্গে জোহরা সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত আরিফ করতেই পারে, কেননা সম্পদ এখন বিপদের নাম। এরই কার্যকারণে আরিফকে প্রয়োগ করা হয় বিষ, জোহরা তা জানতে পেরে মাকে বলে ‘রাক্ষুসী’। আরিফ বেঁচে যায় দৈবক্রমে এক ডাক্তারের চিকিৎসায়; তিনদিন জলস্পর্শহীন জোহরাও পিতৃগৃহ থেকে ফিরে আসে শ্বশুর বাড়ি। আরিফ বাড়ি ফিরলে পিতামাতা প্রশ্ন করেছিল ‘একি, এমন নীল হয়ে গেছিস কেন?’ কলেরার অজুহাত দিয়েছিল আরিফ। অবশ্য আরিফ-জোহরার মিলন ছিল প্রেমময়, দাম্পত্যে এই ঘটনার আপাত শান্তিময় পরিসমাপ্তিই ঘটল। কিন্তু সর্পদ্বয়ের বিচ্ছেদ ও পিতৃগৃহে স্বামীকে বিষ প্রয়োগের ঘটনা যৌথভাবে তৈরি করে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা :

‘এই নীরব অন্তর্দাহের বিষ-জ্বালা তাহাকে আজ মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত ঠেলিয়া আনিয়াছে। সে সর্বদা মনে করে, সে বেদেনি, সে সাপুড়ের মেয়ে। সে ঘুমে জাগরণে শুধু সর্পের স্বপ্ন দেখে। সে কল্পনা করে, তাহার স্বামী নাগলোকের অধীশ্বর, সে নাগমাতা, নাগ-নাগেশ্বরী।’

এবার মতিচ্ছন্ন জোহরা সর্পদ্বয়কে আপন সন্তান জ্ঞান করে। আপন মৃতসন্তানের শিয়রে পুনরায় ফিরে আসে সর্পদ্বয়, মীর পরিবারও তাদের উৎপাত মেনে নেয়। কিন্তু গল্পের পরিণামে দেখা যায় রাত্রিকালে গোপনে দেখা করতে আসা পিতার প্রহারে মারা যায় সাপ দুটি, আর সাপের দংশনে মারা যায় জোহরার পিতা। গল্পে আরিফ ও জোহরার সংলাপ :

‘তোমার মা মারা গেছেন কলেরা হয়ে। ওঁরা মক্কা যাচ্ছিলেন। তোমার মা রাস্তায় মারা গেলে, তোমার বাবা অনুতপ্ত হয়ে তোমায় শেষ দেখা দেখতে আসেন লুকিয়ে। লুকিয়েই হয়ত চলে যেতেন। এমন সময় চাকরানী দেখতে পেয়ে ভূত বলে চিৎকার করে! ঠিক সেই সময় তোমার পদ্ম-গোখরো তাঁকে তাড়া করে!”

জোহরা হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “বেশ হয়েছে, জাহান্নামে গেছে ওরা! যাক। আমার পদ্ম-গোখরো- আমার খোকারা কোথায় বল!”

আরিফ বলিল, “তোমার বাবা তাদের মেরে ফেলেছেন!”

জোহরা, “এ্যাঁ খোকারা নাই?” বলিয়াই অজ্ঞান হইয়া পড়িল।

ভোর হইতে না হইতে গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া গেল, মীর সাহেবদের সোনার বউ এক জোড়া মরা সর্প প্রসব করিয়া মারা গিয়াছে।’         

এই গল্পের মর্মে নাগ-সর্প-বিষ ও জীবন-সম্পর্কে অমৃত প্রাপ্তির রূপকার্থ আছে এবং তা আমরা রচনার প্রারম্ভিক আলোচনা অনুসরণের দ্বারা অনুধাবন করতে পারব। গল্পের নামেই পদ্মের ব্যবহার বিদ্যমান, অষ্টনাগের একজন এই পদ্ম; ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে জনমণ্ডলীর কেন্দ্র দখলের প্রতীকতা আছে এতে। মীর বা সৈয়দ বংশের কর্তৃত্ব বিত্তনির্ধারিত, বিত্ত দ্বারাই দ্বারা জনমণ্ডলে প্রভাব বলয় তৈরি করে। অথচ বিত্ত যখন সৃষ্টিশীল থাকে না অর্থাৎ গতিশীলতার ধর্মে ব্যবসায়ে, সুদ-লভ্যাংশে বা পুঁজিতে রূপ লাভ করে না, কেবল ভোগে ব্যবহৃত হয়, তখন সূচনা হয় অবক্ষয়ের। মোহর প্রাপ্তির পর মীর পরিবার পুনরায় অর্জন করে সামাজিক কর্তৃত্ব, তারা ব্যবসায়ে অর্থও বিনিয়োগ করে। এই আকস্মিক উত্থান, সম্পদের সঙ্গে বিপদ, বিষয়ের সঙ্গে বিষের আগমনের মতোই ঘটেছে পরিণামে। গল্পে বিষ বা বিষধরের প্রভাব দু’ভাবে ব্যবহার করেন নজরুল ইসলাম; প্রথমত, সর্প তৈরি করে দাম্পত্য তথা যৌনতায় বিরোধ, দ্বিতীয়ত, জোহরার পিতৃগৃহ সৈয়দ বংশে জাগিয়ে তোলে লোভ ও সম্পর্কের বিভাজন রেখা। গল্পটিতে সাপের যৌন-প্রতীকতা লাভের ক্ষেত্রে অবাধ হতে পারেননি নজরুল ইসলাম, মাতৃত্বের দ্বারা অনেকখানি সীমাবদ্ধ করেছেন। যৌন-উর্বরতার ধারণা অস্বীকার করেন না তিনি, তাকে দুধ-কলা দিয়ে পোষ মানিয়ে স্নেহের অধিভুক্ত করতে চান। জোহারার পিতার হাতে জোহরার সন্তানতুল্য সাপ দুটির মৃত্যু কোনো কূটাভাস তৈরি করে কীনা তা স্পষ্ট নয়। তবে কল্যাণী বধূর সর্পের প্রতি আকর্ষণ, সচেতনতা হারিয়ে ফেলে তাদের সন্তান হিসেবে লালন-পালন এবং জনশ্রুতিতে তার একজোড়া মৃত সাপের মাতায় পরিণত হওয়ার মধ্যে বহু সূত্র হারিয়ে-ফেলা রহস্য যেন জটিল হতে থাকে। আমাদের সৃষ্টি-সম্পদ হারানোর স্মৃতি আমাদেরই পাহারা দিতে হয়, সাপ নয়, নাগ সেখানে রাজ্য হারানোর কষ্টনীল বেদনারও ধারক যেন। আর বস্তুনির্ভরতায় বিষয়-বিষের সংকটে পড়ে কিছু মাত্রায় মীর পরিবার, আরিফ ও জোহরার দাম্পত্য এবং সৈয়দ পরিবার অনেকাংশে। সর্প সংরক্ষণ করে সম্পদ অথচ ভাগ্যবানের হাতে পড়লেই প্রকাশ পায় তার কল্যাণী রূপ। এখানে অমৃতের উৎস কোথায়? অমৃত প্রকৃতপক্ষে ইতিবাচক প্রেমময় সম্পর্কের ভেতর নিহিত থাকে; নজরুল ইসলাম তা প্রমাণ করতে চেয়েছেন জোহরা-আরিফের দাম্পত্যে, জোহরার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্কের ভেতর। কিন্তু বিষের উদগীরণ ঘটেছে জোহরার সঙ্গে পিতা-মাতার সম্পর্ক থেকে এবং এর উৎস সম্পদ। জীবনে সম্পদ ও বিষ- দুটিকেই স্বীকার করেছেন নজরুল ইসলাম। সম্পদ কল্যাণের জন্য, আর যদি সম্পদে বিষ থাকে তবে বিষে বিষ-ক্ষয় নীতি গ্রহণ করেন তিনি। সাপ ও জোহরার পিতার পরস্পরকে আঘাত এবং পরিণামে উভয়ের মৃত্যু যেন সেই ইঙ্গিতও দেয়।     

গল্প-কাহিনীতে চরিত্রের বিস্তৃতির সুযোগ নিলেও কবিতায় নজরুল ইসলাম বিষধর প্রসঙ্গে সংহত ও প্রতীকী আবহে স্থিত। কালের অমৃতের সন্ধানে বেরিয়ে প্রায়শ কালকূটের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি এবং ভাঙা-গড়ার দ্বৈততার মতোই অমৃত ও গরলকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রেও তাঁর সহায় একই পৌরাণিক নায়ক শিব। সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে দেবাসুরের সমুদ্র-মন্থনের রূপকার্থই দেখতে পান তিনি। শিবের পৃথিবী বা সৃষ্টি রক্ষার তাগিদে সমুদ্র-মন্থনে উত্থিত গরল পানের দৃষ্টান্ত প্রকৃতপক্ষে মহত্ব ও ক্ষমতার প্রমাণ। নজরুলের শিবের প্রাসঙ্গিকতা মূলত কল্যাণের ভাবনা দ্বারা পরিশোধিত। তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখেছেন : ‘আমি কৃষ্ণ-কণ্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধির।’ নীল অর্থে এখানে ‘কৃষ্ণ’ শব্দ ব্যবহৃত হল, ভারতীয় সংস্কৃতিকে দেবতা কৃষ্ণ নীল রঙেই অভিব্যঞ্জিত হয়। ‘কৃষ্ণ-কণ্ঠ’ প্রকৃতপক্ষে নীলকণ্ঠ, তা অশুভকে ধারণ ও বেদনার প্রতীকার্থ প্রকাশ করে। আত্মপরিচয় দানের বিশেষ এক ভঙ্গির দ্বারা নজরুল ইসলাম আমিত্ব কীর্তন করেন; এর একদিকে রক্ষা সেবা কল্যাণের বার্তা প্রকাশ পায় অন্যদিকে আগ্রাসী সত্তা, আক্রমণ করে যাবতীয় ক্ষতিকর ও নেতিবাচক শক্তিকে। অবশ্য দুই প্রবণতা আবেগবশত প্রায়শ মিলেমিশে যায় : ‘ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’,/ ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’!’ আপাত স্বতন্ত্র প্রকাশও আছে নেতিরূপে : ‘আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,/ আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী।’

‘পদ্ম-গোখরো’ গল্পেও আমরা লক্ষ করেছি প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বিষের ইতিবাচক ব্যবহার। যে সম্পদ আমরা রক্ষা করতে চাই বা করেছি তার হরণ সহজে মানা যায় না, প্রতিশোধ নিতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মঙ্গলকারী দেবতারূপে শিব আক্রমণাত্মক নয়। এর ভূমিকা সৃষ্টি, পালন ও সেবায়; কিন্তু শিব যখন দৃশ্যমান থাকে না অর্থাৎ রক্ষার কোনো দৃষ্টান্তই উপস্থাপিত হয় না তখন নজরুল ইসলাম আক্রমণাত্মক পন্থার পক্ষপাতী। এটি আসলে সমাজ-রাজনৈতিক প্রসঙ্গে জাগরণ ইচ্ছার প্রতিফলন : ‘ভাঙো মা ভোলার ভাঙ-নেশা,/ পিয়াও এবার অ-শিব গরল/ নীলের সঙ্গে লাল মেশা।’ [‘রক্তাম্বরধারিণী মা’/ অগ্নি-বীণা]। শিবের অ-শিব চরিত্র তা-বে প্রকাশ পায় অথচ পরিণামে তা শিবত্বই, কেননা জীর্ণতার ধ্বংস ব্যতীত নতুনের আবির্ভাব ঘটে না। নীল রঙে নীলকণ্ঠের পৌরাণিক যে স্মৃতি তার কালের বিপ্লবী ধর্ম লাল যুক্ত করে দিয়ে উদ্দীপনা তৈরি করতে চাচ্ছেন। প্রতিশোধের বিষ মেশানো পথেই তৈরি হবে বিপ্লবের সম্ভাবনা, এজন্য মন্থন অর্থে আলোড়িত সংগ্রাম অনিবার্য। অমৃতের সন্ধানে বেরিয়ে গরলের ভয়ে পিছিয়ে গেলে অমৃত কখনোই হাতে আসবে না। কালকূট ধারণে সক্ষম নেতৃত্বই এনে দেবে বিজয়; নজরুল তাই স্বীকার করেন :

‘ওকি বিজয়-ধ্বনি সিন্ধু গরজে কল-কল্ কল কল-কল্!

     ওঠে কোলাহল

     কূট হলাহল

     ছোটে মন্থনে পুন রক্ত-উদধি

           ফেনা-বিষ ক্ষরে গলগল্!’ [‘আগমনী’/ অগ্নি-বীণা]

সর্পের বিষধর ও নেতিবাচক চরিত্র তৈরি হয়েছে সমাজতাত্ত্বিক কারণে কিন্তু বিষধর হওয়া সত্ত্বেও তেমন হয়নি নাগেদের ক্ষেত্রে। নাগেরা আপন রাজ্য ও সম্পদ হারানোর প্রেক্ষাপটে প্রতিরোধ, প্রতিশোধ ও বেদনার প্রতিমূর্তি লাভ করে। নাগরাজ বাসুকি, পৌরাণিক নায়কের মর্যাদা লাভ করে সে কিন্তু সর্পরাজ তক্ষক, তার কোনো গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক পরিচয় নেই। নজরুল ইসলামের চেতনায় সর্প ও নাগের এই বিপরীতার্থক তথ্য ধারণ করা আছে বলেই নাগেদের ধ্বংসকারী ক্ষমতার সঙ্গে আপন স্বভাব, অগ্নির ধর্ম মিলিয়ে দেন। ধূমকেতুর ধ্বংসকারী ক্ষমতার বর্ণনায় নজরুল ইসলাম লিখেছেন : ‘পুচ্ছে আমার নাগ-শিশু উদ্গারে বিষ-ফুৎকার’। [‘ধূমকেতু’/ অগ্নি-বীণা]। কেন্দ্রীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে এই প্রান্তিক নাগদের সংগ্রাম পৌরাণিক আবহই নয়, সার্বজনীন মুক্তিসংগ্রামেরও ইঙ্গিত বহন করে। এরা ছিল অন্তর্দেশবাসী, প্রান্তিক অথচ একতাবদ্ধ। অগ্নি প্রজ্বলনের দ্বারাই পাণ্ডব বাহিনী একদা তাদের বাইরে বের করেছিল ধ্বংসের জন্য। সেই অসম যুদ্ধের স্মৃতি ও ক্ষোভ নিয়ে নজরুল ইসলাম যেন এগিয়ে এসেছেন। শক্তিসাধনা ও প্রতিরোধের প্রেক্ষাপটে নজরুলের কাব্যের নামকরণের ধারার মধ্যেও বিকাশমান বিষ-চেতনা লক্ষ করা যায়। অগ্নি-বীণায় যে রুদ্র-পুরুষ তারই প্রেম দোলন-চাঁপায় এবং নজরুলের ভাষায় এই ক্ষুদ্রপ্রেম অতিক্রম করে পুনরায় তিনি বিষের বাঁশী হাতে নেমে পড়েছেন স্বভাবত বিদ্রোহী কর্মে। পৌরুষ তাঁর আকাঙ্ক্ষিত, উদ্দেশ্য বিদ্যমান পুরাতন জীর্ণতার ধ্বংস। কিছু ক্ষেত্রে তা সফল হয় না, বিশেষত সমাজের বিচিত্র ঘোরপ্যাচে সত্যবাণী তল পায় না, একারণেই সম্ভবত আরো আক্রমণাত্মক বা আত্মবিষের ক্ষরণ ঘটান। বিষের বাঁশী কাব্যের ‘কৈফিয়ত’ দিয়েছেন : ‘এ “বিষের বাঁশী”র বিষ জুগিয়েছেন আমার নিপীড়িতা দেশ-মাতা, আর আমার ওপর বিধাতার সকল রকম আঘাতের অত্যাচার।’ দ্রোহেরই সহোদর কাব্যপ্রয়াশ এখানে, মানুষের আত্মপরিচয় থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পর্যন্ত এর গতিপরিধি। এজন্য পূর্ববর্তী পুরাণ ও শব্দের অনুষঙ্গ এবং সম্ভাবনার খতিয়ান পুনরায় খুলে বসতে হয়েছে তাঁকে। এছাড়া নজরুলের উপায়ও নেই, কেননা স্বভাবত তিনি এর বাইরে যেতে পারেন না। বিষের জ্বালা তাঁর অন্তরে, শব্দে তাঁর ছোবল, তাঁর বাণীর সীমা টানে এমন ওঝা সমকালে নেই। তাঁর এই সুরে আহ্বান আছে; তা দলগত চেতনার ঐক্যে ফলপ্রসূ হবে, এমনই আস্থা রাখেন তিনি। অবশ্য যথার্থ নেতার অনিবার্যতাও মানেন; এর চেয়ে বেশি মানেন অন্তরে দেশরূপ মাতৃপ্রেমের উপস্থিতি। বিষের বাঁশী কাব্য উৎসর্গ করেছেন ‘বাঙলার অগ্নি-নাগিনী মেয়ে মুসলিম-মহিলা-কুল-গৌরব’ মিসেস এম. রহমানের উদ্দেশে। নজরুল এর কারণ ব্যাখ্যাস্বরূপ লিখেছেন :

সহসা থমকি দাঁড়ানু আমার সর্পিল-পথ-বাঁকে,

ওগো নাগ-মাতা, বিষ-জর্জর তব গরজন-ডাকে!

কোথা সে অন্ধ অতল পাতাল-বন্ধ গুহার তলে,

নির্জীত তব ফণা-নিঙ্ড়ানো গরলের ধারা গলে;

পাতাল-প্রাচীর চিরিয়া তোমার জ্বালা-ক্রন্দন চুর

আলোর জগতে এসে বাজে যেন বিষ-মদ-চিক্কুর!

আঁধার-পীড়িত রোষ-দোদুল্ সে তব ফণা-ছায়া-দোল

হানিছে গৃহীরে অশুভ শঙ্কা, কাঁপে ভয়ে সুখ-কোল্

ধূমকেতু-ধ্বজ বিপ্লব-রথ সম্ভ্রমে অচপল,

নোয়াই শির শ্রদ্ধা-প্রণত রথের অশ্বদল!

ধূমকেতু-ধূম-গহ্বরে যত সাগ্নিক শিশু-ফণী

উল্লাসে “জয় জয় নাগমাতা” হাকিল জয়-ধ্বনি!

বন্দিল, উর নাগ-নন্দিনী ভেদিয়া পাতাল-তল!

দুলিল গগনে অশুভ-অগ্নি-পতাকা জ্বালা-উজল!

এখানে নজরুল ইসলাম নাগশিশুরূপে কল্পনা করেছেন নিজেকে, নাগমাতা-  দেশমাতারই স্বরূপচিহ্নিত ব্যক্তিত্ব। বন্দিত্ব বা আত্মবদ্ধতার প্রসঙ্গের সূত্রে প্রকাশ পায় জাতির পরাধীনতার তথ্য। অথচ আমাদের সম্পদ বা সম্ভবনা অলীক নয়, ফণার আলোই আমাদের পথ দেখাতে পারে এবং আছে কর্মীরূপ লক্ষ লক্ষ নাগশিশু বা জনগণ। হারানো দেশ উদ্ধারে বা বন্দিত্ব মুক্তির জন্য পাতাল ভেদ করার বিকল্প নেই- মূলত আত্মমুক্তির প্রবণতার ওপর বেশি গুরুত্ব দেন নজরুল ইসলাম। প্রতিশোধ স্পৃহা না থাকলে নেতা হওয়া যায় না, চালিত করা যায় না নাগশিশুদের এবং সম্পদ উদ্ধারও সম্ভব হয় না। এই সক্ষমতা তিনি অবলোকন করেছিলেন মিসেস এম. রহমানের ব্যক্তিত্বে, দেশপ্রেমের প্রকাশে। তিনি তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছেন মাতৃরূপ ও বন্দিত্ব ছিন্নকারী সত্তার রূপকল্প। নজরুল ইসলাম আপন বন্দিত্ব ও নাগদের পাতালবাসের রূপকার্থ তৈরির দ্বারা সমকালীন রাজনৈতিক দ্রোহ ও কর্মপ্রণালি বিন্যস্ত করেছেন :

এরই মাঝে তুমি এলে নাগ-মাতা পাতাল-বন্ধ টুটি’

অচেতন মম ক্ষত তনু পড়ে তব ফণা-তলে লুটি’!

তোমার মমতা-মানিক আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা,

তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্ব-জননী! তোমার আঁচল পাতা

নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তরে; বিষ শুধু তোমা দহে,

ফণা তব মাগো পীড়িত নিখিল ধরণীর ভার বহে!

প্রকৃতপক্ষে নজরুলের বিষ-জ্বালা স্বভাব উপনিবেশক বিরোধী শক্তিরূপে অনন্য। বয়সোচিত প্রেমের ধর্ম তিনি স্বীকার করেছেন কিন্তু তাতে আবদ্ধ হতে চাননি। পুরুষ-প্রবল তিক্ততা দিয়ে আক্রমণ করতে চেয়েছেন সামাজিক শত্রুকে; এজন্যই যেন স্বভাব পাল্টাতেও ভয় পেয়েছেন : ‘গাইবি আবার কণ্ঠ-ছেঁড়া বিষ-অভিশাপ-সিক্ত গান।’ শিব হচ্ছেন নীলকণ্ঠ, নজরুল ইসলাম হতে চান বিষ-কণ্ঠ- এতে পরোক্ষে ও প্রকাশ্যে কল্যাণের অভিন্নতাই ঘোষিত। যে বিষধর ছিল শিবের মাথায় জড়ানো, সেই বিষধর হাতে জড়িয়ে এগিয়ে আসতে চান নজরুল :

আয় রে আমার বাঁদন-ভাঙার তীব্র সুখ

জড়িয়ে হাতে কাল-কেউটে গোখরো নাগের

                     পীত চাবুক!

হাতের সুখে জ্বালিয়ে দে তোর সুখের বাসা ফুল-বাগান!’

                     আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!

[‘আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ’/ বিষের বাঁশী]

নজরুল ইসলাম আপন স্বভাবকে মেনেছেন ‘অগ্নি-ফণী’রূপে, এই বিষ মাখানো জিহ্বার চুম্বনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় অটল সামাজিক বিন্যাস। নিশ্চয়ই নজরুল ইসলাম এতে তাঁর উপনিবেশ ও কুসংস্কার বিরোধী বাণীর কথা জানাচ্ছেন যাতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে বিরোধী পক্ষ- ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ও বিদ্যমান সনাতন সমাজ। অনড় সমাজের মূলে আঘাত লাগলে ক্ষমতাবানেরা ক্ষিপ্ত হয়, এরই বিবরণ তিনি দিচ্ছেন। তিনি স্বতন্ত্র, সমাজ-সংসার প্রেম-পরিণয় তাঁর নয়; নিজের প্রতিই জানান দিচ্ছেন : ‘সাপ ধরে তুই চাপ্বি বুকে/ সইবে না তোর ফুলের ঘা’। তিনি ফিরে এলেন মানবপ্রেম ও পাতালবাস ছিন্ন করা সংগ্রামের কণ্টকিত পথে : ‘ফণী-মন্সার কাঁটার পুরে/ আয় ফিরে তুই কাল্-ফণী,/ বিষের বাঁশী বাজিয়ে ডাকে নাগ-মাতা-/ “আয় নীলমণি!”

সময় পাল্টালেও যুদ্ধের রূপ পাল্টায়নি; এখনও শত্রুর হাতে মৃত্যুবরণ করছে মানুষ। কালের আক্রমণ বিষরূপে আসে- এই প্রবণতা ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করেছেন নজরুল ইসলাম, কেননা কালের আক্রমণের দ্বারাই জাগ্রত হবে অবরুদ্ধ-প্রাণ মানুষ। নাগবিষে বিশ্ব ধ্বংস হবে না, জাগিয়ে তোলবার আহ্বান আছে : ‘হানে কাল-বিষ বিশ্বে রে মহাকাল-নাগ’ [‘জাগৃহি’/ বিষের বাঁশী]। এই নাগ প্রকৃতপক্ষে বাসুকি, এর অপর নাম শেষ নাগ বা অনন্ত নাগ; এই অনন্তকে নজরুল কল্পনা করছেন মহাকালরূপে, কালের উদ্দীপিত আহ্বানই শুনিয়ে জাতি বা জনমানুষকে জাগ্রত করতে চান নজরুল ইসলাম। অন্যদিকে বিষরূপ সময়কে আত্মস্থ বা ধারণের ক্ষমতা কেবল শিবের অর্থাৎ যথার্থ নেতৃত্বেরই আছে, তারই আরাধনা করছেন নজরুল ইসলাম। শিবরূপে একাধারে রুদ্র, অগ্নি, নটরাজ ও সুন্দরকে আকাক্সক্ষা করেন কবি। জাতি যখন বিপর্যস্ত, তাঁর ভাষায় ‘রক্ত-মদের বিষ পান করি’/ আর্ত মানব’- তাদের কোনো সক্ষমতা নেই অথচ কালের অনিবার্য গতি পরিবর্তনের দিকে, প্রলয় সন্নিকট; তখন নতুনতর নেতৃত্ব আকাঙ্ক্ষা করেন কবি- ‘কোলাহল-ঘাঁটা হলাহল-রাশি/ কে নীলকণ্ঠ গ্রাসিবে রে আজ দেবতার মাঝে দেবতা সে আসি’? [‘তূর্য নিনাদ’/ বিষের বাঁশী]। নজরুল সমকালে লক্ষ করেছেন নেতৃত্বের ব্যর্থতা, স্বরাজের দাবিও তাঁরা ব্যক্তিত্ব ও শক্তিমত্তার সঙ্গে করতে পারেননি। এজন্য তরুণদের প্রতি তাঁর আগ্রহ; ‘জোয়ানরা হাল ধর্‌বে তার/ কর্‌বে তরী তুফান পার!’ তিনি মনে করেন কেবল নৈতিকতার দ্বারা স্বাধীনতা বা স্বরাজ অর্জন সম্ভব নয়; ‘ধর্ম-কথা প্রেমের বাণী জানি মহান উচ্চ খুব,/ কিন্তু সাপের দাঁত না ভেঙে মন্ত্র ঝাড়ে যে বেকুব!’ [‘বিদ্রোহী বাণী’/ বিষের বাঁশী]। এখানে সাপ নিশ্চিতভাবেই নেতিবাচক ও ঔপনিবেশিক শাসকশক্তি।  

নজরুল ইসলাম শক্তির উপাসক; তাঁর শক্তিধর নায়কেরা আছেন পুরাণে- তাঁরা পরীক্ষিত ঘটনা-পরম্পরায় ও সমাজ মনস্তত্ত্বে; তিনি শক্তি অনুভব করেন কিছু প্রাকৃতিক উপাদানে, যেমন ঝড়, সমুদ্র। এগুলো মূলত নজরুলেরই ব্যক্তিত্বের পক্ষের শক্তি বা অনুষঙ্গ। শিব বা নটরাজ, রুদ্র বা অগ্নি, রক্ত বা ঝড় সবই নজরুলের চেতনার সঙ্গী। প্রতিশোধপরায়ণ আক্রমণাত্মক শক্তিরূপে নাগও সেই প্রসঙ্গের অন্তর্গত। ঝড়ের আত্মপরিচয় উদ্ঘাটনকল্পে নজরুল ইসলাম নাগরাজের পৌরাণিক প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন এবং তা সমুদ্র, ঢেউ ও বাতাসের তীব্র গতির প্রাসঙ্গিকতায় :

নাহি জানি কোন্ ফণী-মনসার হলাহল-লোকে -

কোন বিষ-দীপ-জ্বালা সবুজ আলোকে -

নাগ-মাতা, কদ্রু-গর্ভে জন্মেছি সহস্র-ফণা নাগ,

ভীষণ তক্ষক-শিশু! কোথা হয় নাগ-নাশী জন্মেজয় যাগ -

উচ্চারিছে আকর্ষণ মন্ত্র কোন গুণী -

জন্মান্তর পার হতে ছুটে চলি আমি সেই মৃত্যু-ডাক শুনি’। [‘ঝড়’/ বিষের বাঁশী]

ঝড়কে নজরুল ইসলাম শক্তিরূপে অবলোকন করেছেন- এতে ধ্বংস হবে জীর্ণ পুরাতন এবং আবির্ভাব হবে নবীনের। পরিণামে সর্পের বিষ-জর্জরতার মাঝেও ইতিবাচক সূত্র আবিষ্কার করে নেন কবি : ‘ছুটে চলি মহা-নাগ, রক্তে মোর শুনি আকর্ষণী,/ মমতা-জননী/ দাহে মোর পড়িল মুরছি;/ আমি চলি প্রলয়-পথিক- দিকে দিকে মারি-মরু রচি।’ এর মধ্যে শিবময় রাজনীতির সূত্র বা দৃষ্টান্ত আছে। নজরুল এমনি কারণে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে ভেবেছেন একরূপে নীলকণ্ঠ, অন্যরূপে যুবসম্প্রদায়ের চেতনার অগ্নিপুরুষ : ‘আজি দিকে দিকে বিপ্লব-অহিদল খুঁজে ফেরে ডেরা,/ তুমি ছিলে এই নাগ-শিশুদের ফণী-মনসার বেড়া!’ [‘ইন্দ্র-পতন’/ চিত্ত-নামা]। নারীমুক্তির বাণী প্রকাশের ক্ষেত্রেও সামাজিক বা ধর্মীয় রুদ্ধতাকে পৌরাণিক নাগ-গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিয়ে প্রতীক তৈরিতে সচেষ্ট নজরুল ইসলাম : ‘ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মত আয় না পাতাল ফুঁড়ি’!/ আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি!’ [‘নারী’/ সাম্যবাদী]। আর যদি ক্ষমতা বা সম্পদের পাহাড় জমা হয় এবং বিপরীতে চলতে শোষণ ও অনাচার তাকেও ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে। সম্পদকে মাথার ফণী বিবেচনা করে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী যখন শনি হয়ে ওঠে তখন বিকল্প ফণার কথা বলেন তিনি। জনমানুষের ঐক্যবদ্ধ রাজনীতির মধ্যেই আছে পরিবর্তনের নিদর্শন; নজরুল ইসলামের আহ্বানও থাকে :

এবার ফণীমনসার নাগ-নাগিনী

     আয় রে গর্জে মার্‌ ছোবল!

     ধর্‌ হাতুড়ি, তোল্ কাঁধে শাবল॥’ [‘শ্রমিকের গান’/ সর্বহারা]

নজরুল ইসলামের কাব্যের নাম ফণীমনসা [১৩৩৪]। এর দ্বারা তিক্ত, কণ্টকিত ও আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। এর আগে নজরুল ইসলামের কবিতায় ‘ফণীমনসা’ শব্দবন্ধ কয়েকবারই ব্যবহৃত হয়েছে এবং তাতে হসন্ত আছে কিন্তু কাব্যগ্রন্থের নামের বানানে তিনি হসন্ত ব্যবহার করেননি। কণ্টকিত গুল্মের সৌন্দর্যময় ফুলের দৃষ্টান্ত এতে আছে যা নজরুল-স্বভাবের অন্তর্গত অথবা সর্প ও মনসার দ্বৈরথের ইঙ্গিত দিতে পারে। মনসাকে ক্রুদ্ধ-কোপন স্বভাব ও সর্প ধ্বংসের প্রতীকী চরিত্ররূপে ফণীমনসা কাব্যের পরিকল্পনার অংশভুক্ত করতে পারেন নজরুল ইসলাম, তাতে বিস্তৃত সামাজিক অর্থ-গভীরতার পাওয়া যায়। অন্যদিকে, সমকালীন রাজনীতির ঘূর্ণাবর্ত বা পরস্পর বিপরীত শক্তির সংঘাতময় মন্থনে অমৃতের চেয়ে বিষের উত্থানই বেশি লক্ষ করেছেন কবি। পরাধীন জাতির সমাজ-জীবনে যে ঐক্য থাকা উচিত বা আকাক্সিক্ষত তার ব্যতিক্রমের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিশানা। দোলাচলের প্রেক্ষাপটে অশ্বিনীকুমারের উদ্দেশ্যে ইতিবাচক দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন নজরুল ইসলাম :

সপ্তকোটি তিক্ত জিহ্বা বিষ-রসায়ন

উদগারিছে বঙ্গে নিতি, দগ্ধ হল ভূমি!

বঙ্গে আজ পুষ্প নাই, বিষ লহ তুমি! [‘অশ্বিনীকুমার’/ ফণীমনসা]

জনগণ বিভক্ত, আত্মপরিচয়ের অভাবে বিপর্যস্ত অথচ দলাদলি ও পরস্পরকে আক্রমণে মুখে বিষ উঠে আসে। এই পর্যায়ে অশ্বিনীকুমার আবির্ভূত হবেন অনেকটাই দেবাসুরের সমুদ্র মন্থনকালে উত্থিত গরল ধারণ করা নীলকণ্ঠের মতো। নেতৃত্ব নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন নজরুল ইসলাম, সত্য-নেতার ভূমিকা নিয়ে জানিয়েছেন, ‘চারদিকে এই গুণ্ডা এবং বদ্মায়েসির আখড়া দিয়ে/ রে অগ্রদূত, চলতে কি তুই পারবি আপন প্রাণ বাঁচিয়ে?’ আর এর মাঝেই আছে সুবিধাভোগীরা :

জাতির পরান-সিন্ধু মথি’ স্বার্থ-লোভী পিশাচ যারা

সুধার পাত্র লক্ষ্মীলাভের করতেছে ভাগ-বাঁটোয়ারা,

বিষ যখন আজ উঠল শেষে তখন কারুর পাইনে দিশা,

বিষের জ্বালায় বিশ্ব পুড়ে, স্বর্গে তাঁরা মেটান তৃষা! [‘পথের দিশা’/ ফণীমনসা]

এই কালেই প্রয়োজন যথার্থ নবীন নেতৃত্ব। একটি কবিতায় লিখেছেন : ‘তরুণ তাপস! নব শক্তিরে জাগায়ে তোল্।/ করুণার নয়- ভয়ঙ্করীর দুয়ার খোল্।/ নাগিনী-দশনা রণরঙ্গিনী শস্ত্রকর/ তোর দেশ-মাতা, তাহারি পতাকা তুলিয়া র্ধ।’ [‘অগ্রপথিক’/ জিঞ্জির]। নজরুলের ভাষায় যৌবনের ধর্মে তারুণ্য নটরাজ শিব সমার্থক, ভাঙার মন্ত্রে উদ্দীপিত হয়ে যারা এগিয়ে আসবে। কিন্তু সেই শিবের সাক্ষাৎ এখন পাওয়া যাচ্ছে না, নজরুলের মতে, সম্ভবত তিনি ভাঙের নেশায় চোখ বুজে আছেন। কিন্তু আশা তিনি ত্যাগ করেননি এবং মিসেস এম. রহমানকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো একটি কবিতায় তারই উল্লেখ আছে :

কাঁটার কুঞ্জে ছিলে নাগমাতা সদা উদ্যত-ফণা

আঘাত করিতে আসিয়া ‘আঘাত’ করিয়াছে বন্দনা!

তোমার বিষের নীহারিকা-লোকে নিতি নব নব গ্রহ

জন্ম লভিয়া নিষেধ-জগতে জাগায়েছে বিদ্রোহ!

জহরের তেজ পান ক’রে মাগো তব নাগ-শিশু যত

নিয়ন্ত্রিতের শিরে গাড়িয়াছে ধ্বজা বিজয়োদ্ধত!

মানেনি ক’ ত’রা শাসন-ত্রাসন বাধা-নিষেধের বেড়া -

মানুষ থাকে না খেঁয়াড়ে বন্ধ, থাকে বটে গরু-ভেড়া! [‘মিসেস্ এম. রহমান’/ জিঞ্জীর]

নজরুলের আশাবাদ অনেকখানি সফল হয়নি, এজন্য তিনি হাহাকার করেছেন সমুদ্রের রূপকার্থে। দস্যু সুরাসুর সমুদ্রকে লুণ্ঠন করেছে, হরণ করেছে তার উচ্চেঃশ্রবা, লক্ষ্মী ও শশী-প্রিয়া- এরা সুখে আছে স্বর্গে গিয়ে। লুণ্ঠিত অমৃতের গুণে স্বর্গবাসীরা আজ অমর অথচ সমুদ্র অসীম শূন্যতার ভেতর বসবাস করে। এই শূন্যতার মাঝে নজরুল ইসলাম যেন আত্মরূপ খুঁজে পান। সব-হারানো উদ্বেগ বা বেদনা থেকে নজরুল ইসলাম বিষময় ধ্বংসের উপাদান বা মানসিকতা অর্জন করেন। এই ধ্বংসের প্রতীক বা উদ্দীপনায় রাজনীতি আছে, এতে সঙ্গ দেয় মানব-সমাজ মনস্তত্ত্ব-উত্থিত পৌরাণিক সৈনিক, প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সর্বত্র শক্তি সাধনাই তাঁর উদ্দেশ্য। নটরাজ তাঁর তাণ্ডব নৃত্যের দ্বারা প্রলয়ের সূচনা ঘটায়, তখন তাঁর ললাট থেকে অগ্নি বিচ্ছুরিত হয়। এর তুলনা বাসুকির সঙ্গে : ‘সহস্র-ফণা বাসুকির সম বহ্নি সে/ শ্বসিয়া ফিরিছে, জ্বরজ্বর ধরা সেই বিষে।’ [‘প্রলয় শিখা’/ প্রলয় শিখা]। এখানে ধ্বংস অনিবার্য, নতুন সৃষ্টিরও সূচনা। এ কারণে বিষের ধর্ম এখানে নেতিবাচক নয়। আবার সমাজ যখন প্রতিবাদে আগ্রহী থাকে না, কেবল সুবিধা খোঁজে এবং তোষামোদ নামের প্রভু-পূজায় কার্যসিদ্ধিতে আগ্রহী হয়, নজরুল মনে করেন এতে স্বাধীনতা আসবে না। লক্ষ্মী ও অমৃতভাণ্ড পেতে হলে সংঘ, প্রতিরোধ-প্রতিবাদ ও ত্যাগের বিকল্প নেই। শিবের জবানিতে দেবী দুর্গার প্রাসঙ্গিকতায় নজরুল ব্যর্থতার কার্যকারণ ও চিত্র উপস্থাপন করছেন :

অমৃত চাহিছে, ওরা ত চাহে না

     মোর কণ্ঠের বিষের ভাগ,

ওদেরি মরুতে জঙ্গলে চরে

     তোমার বাহন সিংহ-বাঘ! [‘পূজা-অভিনয়’/ প্রলয় শিখা]

বিষধারণের সক্ষমতাই আজকের শক্তির প্রমাণ! মূলত স্বার্থত্যাগ ও দায় গ্রহণের ভেতর থেকেই মুক্তির বীজ শিকড়ায়িত হবে। কালের প্রেক্ষাপটে শিবরূপ নেতৃত্বই নীলকণ্ঠ। এই নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে নতুনতর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও কাজ করেছে, তাঁর মতে ‘শূদ্রের মাঝে জাগিছে রুদ্র’ [প্রলয় শিখা]। প্রান্তিক জননেতাই মুক্তির যথার্থ দূত, তিনি থাকেন জনমানুষের মাঝে এবং ধনিক শ্রেণির নাগপাশ থেকে মুক্তির ওপরই নির্ভর করবে মানুষের মুক্তি যেমন রুদ্ররূপী মহাকালের নাগ-বন্ধন মুক্তি ঘটেছিল। রাজনৈতিক আলোড়নের কালে নেতৃত্ব প্রসঙ্গে বারবার সমুদ্রমন্থনের দৃশ্যকল্প ব্যবহার করেছেন নজরুল ইসলাম; তাঁর মতে এই রাজনৈতিক আলোড়নে এমন কিছু সংকট তৈরি হবে যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব। এখানে সংকটরূপে আসে বিষ :

মন্থনে শুধু উঠে হলাহল,

শিব নাই, পান করে কে গরল,

অমৃত-ভাণ্ড লয়ে আয় মা গো

           জ্বলিয়া মরি বিষের জ্বালায়॥ [‘৫২’/ সুর-সাকী]

মাতা এখন লক্ষ্মী; এরদ্বারা অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যেমন, তেমনি বর্গী তাড়ানোর তাড়নাও প্রকাশ পাচ্ছে। লক্ষ্মীকে উদ্দেশ্য করে একটি গানে লিখেছেন : ‘কোন্ দুখে তুই রইলি ভুলে বাপের বাড়ি অতল-তলে,/ ব্যথার সিন্ধু মন্থন শেষ, ভর্‌ল যে দেশ হলাহলে,/ অমৃত এনে সন্তানে বাঁচা’। [‘৬৭’/ সুর-সাকী]। শৈব পুরাণের বাইরে কৃষ্ণেরও আছে বিষধর ধ্বংসের কর্মকা-। লোকমানসের প্রেমিক কৃষ্ণ ত্রাতারূপে একদা গতিশীল জলের নদী অর্থে জীবনকে সর্প ও বিষমুক্ত করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। জীবনের শুরুতে কৃষ্ণকে রক্ষার জন্য নন্দগৃহে পাঠিয়ে দিতে হয়, সেখানে শেষনাগ পথপ্রদর্শকরূকে কাজ করে। পুতনা রাক্ষসীর বিষস্তন্য পান করিয়ে কংস অনেক শিশুকে হত্যা করে অথচ কৃষ্ণের কঠোর স্তন্যপানের কারণে পুতনা রাক্ষসীই মৃত্যুবরণ করে। কৃষ্ণ কালীয়নাগকে দমন করে কালিন্দীর জলকে বিষমুক্ত করেন। এই পৌরাণিক প্রেক্ষাপট স্মৃতিতে রেখে নজরুল ইসলাম রাধার প্রেমাকুল বেদনার চিত্র অঙ্কন করেন :

সাপুরিয়া রে! বাজাও কোথায়

           সাপ খেলানোর বাঁশি!

কালিদহে ঘোর উঠিল তরঙ্গ

           কালনাগিনী নাচে বাহিরে আসি’! [‘৭৬’/ বুলবুল : দ্বিতীয় খণ্ড]

রাধার মনের বাসনা গোখরো কেউটের দংশনের মতোই পরিবর্ধিত হচ্ছে অথচ কৃষ্ণের সাক্ষাৎ নেই!- ‘অঙ্গ জরজর বিষে,/ বাঁচাও বিষহরি এসে,/ একি বাঁশি বাজালো কালা/ সর্বনাশী॥’ মনে চেপে-বসা দুর্বিপাককে নজরুল ইসলাম অজগরের আগ্রাসী আক্রমণের সাথে তুলনা করেছেন কয়েকটি ক্ষেত্রে। শেষ সওগাত কাব্যের ‘কচুরিপানা’ কবিতায় কচুরিপানাকে বিষবৎ বিবেচনা করে এর পাতাকে সাপের ফণার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই ফরমায়েসি রচনা ব্যতীত সর্বত্রই নজরুল দুটি ক্ষেত্রে সর্প ও সর্ববিষের প্রসঙ্গ ব্যবহার করেছেন- সমাজ ও প্রেমিক হৃদয়। রাজনৈতিক কেবল নয়,  সামাজিক অসঙ্গতির কার্যকারণ ব্যাখ্যার জন্য সমুদ্র মন্থন ও বিষের প্রসঙ্গ এনেছেন : ‘বিশ্বে ভোগের মন্থনে আজ উঠিয়াছে হলাহল।/ অসুর-শক্তি শ্রান্ত হইয়া আজিকে আপন বিষে/ ‌ঊর্ধ্বে চাহিছে দেবতার পানে, জ্বালা জুড়াইবে কিসে!’ [‘অমৃতের সন্তান’/ শেষ সওগাত]

নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় প্রেমের ধারণায় কখনো কখনো নিয়ে আসেন শৈব ভাব। আমিত্ব-ধারণা প্রেমিক ব্যক্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে থাকে এবং তা অনেকাংশে বেদনায় নীলকণ্ঠ। ভালোবাসার আবেগ তাঁর দুনির্বার, প্রাথমিকভাবে এখানে প্রাপ্তিই সারকথা; এজন্যই যেন তিনি প্রেমিক পুরুষের মনস্তত্ত্বে শক্তির ভাব আনেন। তার আহ্বান ‘ধ্বংস র্ক এই মিথ্যাপুরী।/ রক্ত-সুধা-বিষ আন্ ধর্‌ টিপে টুটি!’ প্রেমের প্রসঙ্গে এসব খাপ খায় না তা নজরুল জানেন, তাই পুনরায় নিম্নকণ্ঠে বলেন : ‘কণ্ঠে আজ এত বিষ, এত জ্বালা,/ তবু বালা!/ থেকে থেকে মনে পড়ে-/ যতদিন বাসিনি তোমারে আমি ভালো,/ যতদিন দেখিনি তোমার বুক-ঢাকা রাগ-রাঙা আলো,/ তুমি ততদিন-ই/ যেচেছিলে প্রেম মোর, ততদিনদিনই ছিলে ভিখারিণী।’ [‘পূজারিণী’/ দোলন চাঁপা]। এই বিষ-জ্বালা অপ্রাপ্তির, কামনাজাত। দেবাসুরের অমৃতের সন্ধানে সমুদ্র মন্থন ও গরল উদগীরিত হওয়ার রূপকার্থও তৈরি হয় এতে। ভারতীয় মনস্তত্ত্বে প্রেম যদি অমৃত, কাম একধনের গরলের ছোঁয়া আনে। বেদনার অশ্রু দ্বারা প্রেমাস্পদের কামনা অবসিত হয়; মিলন অসম্ভব জেনেই হয়ত প্রেমিককে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে প্রেমিকা সান্ত্বনা পায় : ‘আমার চোখের একটি বিন্দু অশ্রুজল,/ নিব্বে তাতেই তোমার বুকের অগ্নি-সিন্ধু নীল গরল’। নজরুল ইসলাম কেতকী ও কেয়ার বন এবং সাপের যুগলবন্দীতে দৃশ্যকল্প রচনা করেছেন অনেক ক্ষেত্রে। কেতকী গাছের গঠন, অবস্থান, পরিবেশ ইত্যাদির কারণে সাপের আবাসস্থল হওয়া অসম্ভব নয়। প্রেমের বৈপরীত্যময় কণ্টকিত অনুভব এতে রূপ দেবার চেষ্টা আছে; বাসনা ও আঘাত প্রেমকে ব্যাহত নয় গতিশীলও করে। বিশেষত ফণীর আর্কেটাইপ নজরুলের পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। সাপের মাথায় মণি থাকার যে বিশ্বাস তা প্রাপ্তির পরিণামী তীর্থরূপ, সকল বিষের জ্বালা বা বিষের ভয়কে অতিক্রমের দ্বারা মণি আয়ত্ত করতে হয়। প্রেমের ক্ষেত্রে এর রূপকার্থ কেবল বিরহে নয়, যথাকর্তব্য বিচিত্র সামাজিক দায় অতিক্রমের প্রসঙ্গেও যুক্ত থাকে। প্রেম তাই ফণীর ফণায় মণিস্বরূপ। একটি গানে এই প্রসঙ্গ আছে :

ফণীর ফণায় জ্বলে মণি

     কে নিবি তাহারে আয়

মণি নিতে ডরে না কে

     ফণীর বিষ-জ্বালায়॥ [মহুয়ার গান]

মনের বেদনার কার্যকারণে প্রকৃতির সৌন্দর্য বিষবৎ মনে হতে পারে। সংবেদনশীল মানুষের বিশেষত প্রেমাস্পদের বিরহজনিত মানসিক সংকটকালে কবির বর্ণনা ‘পাহাড়তলীর শাল্বনায়/ বিষের মত নীল ঘনায়!’ [‘চৈত্রী হাওয়া’/ ছায়ানট]- বেদনার গভীরতায় চমৎকৃত করে। প্রেমাস্পদের বিদায়কালে বেদনার রূপকল্প তৈরি হয়েছে : ‘বিদায়-দিগন্ত ছানি’ নীল হলাহল/ আকণ্ঠ লইনু পিয়া, তরল গরল’। [পুবের হাওয়া/ ছায়ানট]। প্রেমে এই গরল পানের ধরাবাহিকতা রক্ষা করেছেন যেহেতু তিনি অমৃত লাভ করতে চান এবং এই দ্বৈততার ভেতর দিয়েই নজরুল ইসলাম শেষ পর্যন্ত নীলকণ্ঠ।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে নজরুল ইসলাম অমৃত হারানো এক পরাধীন জাতির ক্ষুব্ধ প্রতিনিধি। সমকালের ঔপনিবেশিক শাসন, রুদ্ধ সমাজ, সাম্প্রদায়িক বিভেদ এবং আরো বিচিত্র অনাচারের বাধ্যতামূলক দংশন ও বিষ-জ্বালার ভেতর তাঁকে বসবাস করতে হয়েছে। উদ্ধারের জন্য তাঁকে শক্তি-প্রতীক সংগ্রহ করতে হয়েছে, তাতে সম্পৃক্ত হয়েছে প্রধানত দেবাসুরের সমুদ্র-মন্থনের কাহিনী। বিষ ও অমৃত উদ্ধারের যাবতীয় জটিলতা নিয়েই নজরুল ইসলাম স্বভাবত স্বীকার করেছেন বিষধরের সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা।