সমন্বয়বাদী নজরুল
নজরুলের সমন্বয়বাদী দর্শন নির্দেশ করে যে তিনি অসাম্প্রদায়িকতার চেয়েও বেশি কিছু ভাবতেন। তিনি সাম্প্রদায়িকতার ভেদাভেদ ভুলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধির জন্য তাঁর সাহিত্য ও গানকে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর কবিতা, গল্প-উপন্যাস, নাটক যেমন ‘গাহি সাম্যের গান / মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’ আদর্শেরই কল্পিত রূপ, তেমনি তাঁর প্রবন্ধ ও কথিকাগুলো এমনটি কথা বারবার বলে গেছে। তাঁর নিজের যাপিত জীবন ও সংসার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়ানোর একটি প্রবল প্রচেষ্টা। হিন্দু রমণী প্রমীলা দেবীকে তো ধর্মান্তিরত করা ছাড়া বিয়ে করেছিলেনই, উপরন্তু বড় ছেলে, যার শিশু বয়সে মৃত্যু হয়, তার নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ। নজরুলের সমন্বয়বাদী দর্শন আধুনিক বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য বিরাট পাথেয়।
তবে নজরুলের সমন্বয়বাদী দর্শনের কথা নিশ্চয় অনেকদিনের পুরোনো, কিন্তু কথাটি আমি প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি যখন সম্প্রতি প্রয়াত বিদেশি রাজনৈতিক-সাংবাদিক, গবেষক, এবং নজরুল বিশেষজ্ঞ পিটার কার্স্টাসের পিএচডি অভিসন্দর্ভটি পড়ার আমার সুযোগ হয়। তাতে তিনি নজরুলকে সিনক্রেটিক কবি বা সমন্বয়বাদী কবি হিসেবে প্রমাণ করেছেন।
কাস্টার্সের সমন্বয়বাদী ব্যাখ্যাকে আরেকটু সম্প্রসারিত করে আমরা নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক মানবতার বা ধর্মীয় সমন্বয়বাদিতার আরেকটা সংযোজনের কথা বলব। সেটাতে নজরুলের রাজনৈতিক দর্শন অনেকখানি এসে পড়বে। এ আলোচনায় নজরুলের দর্শন আমরা তিনটি পরষ্পর-নির্ভর পরিপ্রেক্ষিতে রেখে বিচার করব: ১) অসাম্প্রদায়িক নজরুল, ২) নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা, এবং ৩) বাংলাদেশে নজরুল কেন প্রাসঙ্গিক।
১. অসাম্প্রদায়িক নজরুল
ব্রিটিশদের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার পরম আকাঙ্ক্ষা নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার চরম প্রকাশ হলেও, তাঁর আরেকটি গভীরপ্রোথিত যুদ্ধ ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। কারণ দারিদ্র্যের একটি কারণ যদি ছিল ঔপনিবেশিক শাসন, তেমনি আরেকটি কারণ ছিল সাম্প্রদায়িকতা--যা ধর্ম, বর্ণ ও জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ তুলে দারিদ্র্যের রজ্জুগুলোকে মোটা ও শক্ত করে। ‘মানুষ’ কবিতায় শুরুতে ‘গাহি সাম্যের গান-- / মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’ বলার পর নজরুল বলছেন, ‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, / সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ তারপর ধর্মের নামে মানুষকে ইতরায়ন করার বিরুদ্ধে বলছেন, ‘মানুষেরে ঘৃণা করি’ / ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’।”
‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে সহজ একটি প্রতিতুলনা দিয়ে মানুষ বা মানবতা যে ধর্মীয় ভেদাভেদের চেয়ে শ্রেয়তর অবস্থানে আছে তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন :
“নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এটাই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু-তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি--আমারই মতো একজন মানুষকে।’”
এ চিরন্তন মানবতার পরিচয়টা তুলে ধরে তারপর তিনি সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘটছে, বা মানবতা কিভাবে সাম্প্রদায়িকতার কঠোর জঠরে পড়ে হারিয়ে গেছে বা উল্টে গেছে তার একটি চিত্রকল্পও তুলে ধরছেন :
“কিন্তু আজ দেখছি কী? ছোরা খেয়ে যখন খায়রু মিয়া পড়ল, আর তাকে যখন তুলতে গেল হালিম, তখন ভদ্র সম্প্রদায় হিন্দুরাই ছুটে , ‘মশাই করেন কী? মোচলমানকে তুলছেন! মরুক ব্যাটা!’ তারা ‘অজাতশ্মশ্রু’ হালিমকে দেখে চিনতে পারেনি যে সে মুসলমান। খায়রু মিয়ার দাড়ি ছিল। ছোরা খেয়ে যখন ভুজালি সিং পড়ল পথের ওপর তাকে তুলতে গিয়ে তুর্কিছাঁট-দাড়ি শশধরবাবুরও ওই অবস্থা!”
এই প্রবন্ধের শুরুটাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চরম উৎকর্ষ উক্তি দিয়ে : ‘একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন: দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে নজরুল ছিলেন ৩৮ বছরের ছোট। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার সময়টি ১৯২১ সাল যদি নজরুলের কবি হিসেবে উন্মেষকাল ধরি, তখনই রবীন্দ্রনাথ ষাট বছরে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রকাব্যবলয় থেকে বের হওয়ার প্রচেষ্টা যেমন কল্লোল যুগের কবিদের মধ্যে ছিল, সেটি নজরুলের মধ্যেও ছিল- কিন্তু সে প্রচেষ্টা কবিতার মাধ্যমে ছিল না। কারণ শুরু থেকেই নজরুল কখনো রবীন্দ্রনাথের মতো লিখেননি। তাঁর অবার তো ফার্সি-আরবি শব্দ মিশ্রিত কাব্যবচন সংস্কৃত-বাংলা শব্দের জন্য একটি আলাদা কাব্য-প্রকরণ তৈরি করে দেয়। তারপরও রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে নজরুলের জন্য একটি রক্ষণশীল বাতাবরণ তৈরি হয়, যেটি তাঁর বিদ্রোহী সত্তা অচিরেই আক্রমণ করতে প্রবৃত্ত হয়। এই রক্ষণশীলতা আপাতদৃষ্টিতে আবর্তিত হতে থাকে কবিতায় শব্দ ও শব্দের পরিভাষা নিয়ে, কিন্তু তলায় তলায় এর মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িকতা-বিভাজিত সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব।
এই জটিল সম্পর্কটা স্পষ্ট হবে যদি আমরা নজরুলের ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ শীর্ষক প্রবন্ধটির মূল বক্তব্য অনুসরণ করি। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক তাঁকে বসন্ত নাটিকাটি উৎসর্গ করার সুখস্মৃতিটি বর্ণনা করে নজরুল বলছেন : ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্টদেবতাকে পূজা করে।’ কিন্তু নজরুলের কানে এসেছে কবিগুরু না কি তাঁকে নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে তাঁর কাব্যচর্চায় আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার নিয়ে। নজরুল বিলক্ষণ বুঝতে পারলেন এ কাজটি আসলে করেছেন শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। তিনি কবিগুরুর মনকে চটিয়ে দিয়েছেন। নজরুলের আপত্তি এখানে যে কবিগুরু কেন শেষ পর্যন্ত ভীষ্ম হয়ে অভিমন্যু বধে সায় দিলেন। কিন্তু ‘মহাভারতের ভীষ্ম এই অন্যায় যুদ্ধে সায় দেননি, বৃহত্তর ভারতের ভীষ্ম সায় দিয়েছেন- এটাই এ যুগের পক্ষে সবচেয়ে পীড়াদায়ক।’
তারপর বিতর্কটা আসে ‘খুন’ শব্দটার রক্তের অর্থে ব্যবহার করা নিয়ে। তখন নজরুল বলেন, আরবি-ফার্সি শব্দের প্রয়োগ বাংলা ভাষায় ভারতচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখ করে গেছেন। নজরুলের মতে ‘খুন’সহ বিভিন্ন বিদেশি শব্দ বাংলা কাব্যলক্ষ্মীকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি আরো বলছেন, “বিশ্বকাব্যলক্ষ্মীর একটা মুসলমানি ঢং আছে।” বলছেন, “বাংলা কাব্য-লক্ষ্মীকে দু’টো ইরানি ‘জেওর‘ পরালে তার জাত যায় না, বরং তাঁকে আরো খুবসুরতই দেখায়।”
তাঁর একটি গান “উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার” প্রসঙ্গে নজরুল বলছেন কবিগুরুর আপত্তি সত্ত্বেও “খুন”-এর বদলে রক্ত ব্যবহার তিনি করেন নি কারণ তাতে কাব্যের আবেদন কমে যেত।
যুক্তিটা নজরুলের বয়ানে শোনা যাক :
“এই গানটি সেদিন কবি-গুরুকে দুর্ভাগ্যক্রমে শুনিয়ে ফেলেছিলাম এবং এতেই হয়তো তাঁর ও-কথার উল্লেখ। তিনি রক্তের পক্ষপাতী। অর্থাৎ ও লাইনটাকে- ‘উদিবে সে রবি মোদেরই রক্তে রাঙিয়া পুর্নবার’ও করা চল্তো। চল্তো কিন্তু ওতে ওর অর্ধেক ফোর্স কমে যেত। আমি যেখানে ‘খুন’ শব্দ ব্যবহার করেছি, সে ঐ রকম ন্যাশনাল সঙ্গীতে বা রুদ্ররসের কবিতায়। যেখানে ‘রক্তধারা’ লিখবার সেখানে জোর করে ‘খুনধারা’ লিখি নাই। তাই বলে ‘রক্ত-খারাবি’ও লিখি নাই, হয় ‘রক্তারক্তি’ না হয় ‘খুন-খারাবি’ লিখেছি।
“কবি-গুরু মনে করেন, রক্তের মানেটা আরো ব্যাপক। ওটা প্রেমের কবিতাতেও চলে। চলে, কিন্তু ওটাতে ‘রাগ’ মেশাতে হয়। প্রিয়ার গালে যেমন ‘খুন’ ফোটে না তেমনি ‘রক্ত’ও ফোটে না- নেহাৎ দাঁত না ফুটালে। প্রিয়ার সাথে ‘খুন-খুনী’ খেলি না, কিন্তু ’খুন-সুড়ি’ হয়তো করি।
‘কবিগুরু কেন, আজকালকার অনেক সাহিত্যিক ভুলে যান যে, বাংলা কাব্য-লক্ষ্মীর ভক্ত অর্ধেক মুসলমান। তারা তাঁদের কাছ থেকে টুপি আর চাপকান চায় না, চায় মাঝে মাঝে বেহালার সাথে সারেঙ্গীর সুর শুনতে, ফুলবনের কোকিলের গানের বিরতিতে বাগিচায় বুলবুলির সুর।
. . . “আরো মনে হয়, আমার শত্রু সাহিত্যিকগণের অনেক দিনের অনেক মিথ্যা অভিযোগ জমে ও’র [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের] মনকে বিষিয়ে তুলেছে। নৈলে আরবি-ফার্সি শব্দের মোহ তো আমার আজকের নয় এবং কবিগুরুর সাথে আমার বা আমার কবিতার পরিচয়ও আজকের নয়। কই, এতদিন তো কোনো কথা উঠল না এ নিয়ে!”
ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারি মূলত এসেছে বাংলায় খুনের অর্থ- হত্যা বা হত্যাকাণ্ড, এবং হিন্দীতে খুনের অর্থ রক্ত এই বিসংবাদ থেকে। প্রবন্ধের বাকি অংশটা উদ্ধৃত করা যেত, এতই শানিত যুক্তি তাঁর। বলাবাহুল্য বিদেশি শব্দ গ্রহণ-বর্জন, তাদের সংস্কৃতিগত পরিচয় নিয়ে কবিকুল ও লেখককুলের মধ্যে বিতর্ক একটি চলমান ব্যাপার। এখানে রবীন্দ্র-নজরুলের মধ্যে বিতর্কটি তাই বর্তমান সময়ে যে আরো নতুন নতুন পাখা গজাবে সেটি সত্য। জঙ্গম সমাজে গতিশীলতার একটি প্রধান উপাদান হলো বিতর্ক।
‘খুন’ বা এরকম কিছু মুসলমানী বিদেশি শব্দের পরিভাষা, যেমন ‘দস্তরখানা’, ‘দাওয়াৎ’, নিয়ে লেখক আবুল ফজলের সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ হয়েছিল, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বাংলা শব্দের শুদ্ধতা নিয়ে যৌক্তিক একটি অবস্থানে অবিচল ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়।
এখানে একটা ঘটনার উল্লেখ করলে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের প্রমাণ পাওয়া যাবে। ১৯৩৩ সালে রাউজানে এক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নজরুল আসেন, আরো ছিলেন কবি আব্দুল কাদির, মাহবুব-উল আলম, আবুল ফজল, কামালুদ্দীন আহমদ খান (বেগম সুফিয়া কামালের স্বামী) এবং কবি ওহীদুল আলম।
সেখানে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদক নজির আহমদ চৌধুরী তাঁর বক্তৃতায় কবি নজরুল ইসলাম ও সাহিত্যিক মাহবুব-উল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন যে ব্রিটিশকে মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য এ দুই সাহিত্যিক ৪৯ সংখ্যক বাঙালি রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে মহাযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।
প্রত্যুত্তরে নজরুল বললেন, “আপনারা শুনেছেন, আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, আমরা নাকি ব্রিটিশকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাহায্য করতে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমি বলতে চাই, আমরা যখন যুদ্ধে যাই, আমাদের মধ্যে ছিল দারুণ তারুণ্য। তারুণ্যের তাগিদ সহ্য করতে না পেরে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হচ্ছে, কে জিতবে, কে হারবে, এ সব তলিয়ে দেখার মন ও মেজাজ আমাদের ছিল না।” (ওহীদুল আলম, পৃথিবীর পথিক)
২. নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা
নজরুলের বিদ্রোহী ব্যক্তিত্ববাদ রূপ লাভ করেছিল প্রধানত পরাধীনতার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। শিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর এক শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র ঘটক তাঁকে “যুগান্তর” গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করান। তখন থেকে নজরুলের রাজনৈতিক চেতনায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দেবার স্বপ্ন প্রোথিত হয়। মুজাফ্ফর আহমদ সহ কতিপয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী ও নেতার সংষ্পর্শে এসে নজরুল তাঁর বিপ্লবী চেতনাকে আরো শানিত করতে সংক্ষম হন। নবযুগ পত্রিকায় ‘ম্যায় ভুঁখা হুঁ’ জাতীয় প্রবন্ধগুলো, এবং এর কিছু পরে তিনি ও মুজাফ্ফর আহমদের সম্পাদনায় প্রকাশিত ধূমকেতু পত্রিকায় তাঁর ‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না’ ধরনের সম্পাদকীয়গুলো এবং এরপর বামপন্থী পত্রিকা লাঙ্গল পত্রিকার ‘সাম্যবাদী’ গুচ্ছের কবিতাগুলো প্রমাণ করে যে নজরুলের ব্যক্তিত্ববাদ তাঁর বিদ্রোহী সত্তার সমষ্টিগত পরিচয়-রাজনৈতিক পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদী ধর্মপরায়ণতা, নারীর অবদমন ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে সামগ্রিক প্রতিবাদই গঠন করেছে তাঁর বিদ্রোহী সত্তাকে।
১৯২০ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অর্থানুকূল্যে নবযুগ সান্ধ্যদৈনিক প্রকাশিত হয় কাজী নজরুল ইসলাম এবং মুজাফ্ফর আহমদের যৌথ সম্পাদনায়। নজরুলের রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু হলো, এবং অচিরেই ‘ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ’ এবং ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে’ শীর্ষক দু’টি রচনা প্রকাশ করার দায়ে পত্রিকাটি সরকারের কোপানলে পড়ে। প্রথম রচনাটি প্রহসনমূলক যেখানে নজরুল বলছেন, জালিনওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মতো ‘বীরত্বসূচক’ কর্মের জন্য জেনারেল ডায়ারের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হওয়া উচিত। আর দ্বিতীয় রচনাটি ছিল যে-সকল মুসলমান স্বেচ্ছাসেবক গ্রিসের বিরুদ্ধে তুরষ্ককে সাহায্য করার জন্য আফগানিস্তান হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছিল, তাদের ওপর ব্রিটিশ সীমান্ত সৈন্যদের গুলি ছোঁড়ার বিষয়টি।
নবযুগ বন্ধ হয়ে গেলে নজরুল কিছুদিন মাওলানা আকরাম খান কর্তৃক প্রকাশিত সেবক পত্রিকায় চাকরি করেন। কিন্তু পত্রিকাটির সাম্প্রদায়িক চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে তিনি নিজেই ধূমকেতু নামক একটি অর্ধ-সাপ্তাহিকী প্রকাশ করেন। ১৯২২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পত্রিকাটিকে আবাহন জানালেন ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু / আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু’ চর্তুপদী কবিতাটি দিয়ে। ধূমকেতু পত্রিকাটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে নজরুলের বিদ্রোহকে সর্বাত্মক প্রকাশে সাহায্য করে। এর পঞ্চম সংখ্যায় ‘আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে তিনি বাংলার বিপ্লবী শহীদ যুবাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, কানাই লাল দত্ত, সত্যেন বসু, প্রফুল্ল চাকী এবং বাঘা যতীনসহ সবার ছবি ছাপিয়ে ধূমকেতু নিয়মিত বের হতো।
এই ধূমকেতুর ১২তম সংখ্যায় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২) প্রকাশিত হয় দূর্গা পূজা উপলক্ষ্যে তাঁর কবিতা “আনন্দময়ীর আগমনে” যেটি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করলেন শুধু নয়, কবিকে করলেন গ্রেপ্তার কুমিল্লা থেকে, যেখানে প্রেয়সী প্রমীলা দেবীর তাঁর দেখাশোনা হচ্ছে মাত্র। এ কবিতাটিতে তিনি ব্রিটিশ শাসকদের লক্ষ্য করে বললেন তারা ‘বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি’ আর তাদের অত্যাচারে ‘ভূ-ভারত আজ কসাইখানা’ হয়েছে। ইংরেজ বিচারক সুইনহো নজরুলকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অপরাধে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিলেন। কিন্তু নজরুল নিজের সমর্থনে একটি জবানবন্দী জমা দেন আদালতে, যেটি ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে বিখ্যাত, এবং যেটি তিনি রচনা করেন কারাবাসের সময়, ৭ জানুয়ারি ১৯২৩। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার গদ্যরূপ যেন এটি। কবি বললেন, ‘একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর জন সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড।’
আরো বললেন,
“আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রবেশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়-দ্রোহী নয়, সত্য-দ্রোহী নয়। সে-বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ সত্য-স্বরূপ।’
নজরুলের রাজনৈতিক লেখার ধরন হলো উৎকৃষ্ট প্রতিতুলনা তৈরি করে বক্তব্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। এই ‘জবানবন্দী’তেও তাই করলেন। বললেন,
‘আজ ভারত পরাধীন না হয়ে যদি ইংলন্ডই ভারতের অধীন হতো এবং নিরস্ত্রীকৃত উৎপীড়িত ইংলন্ড-অধিবাসীবৃন্দ স্বীয় জন্মভূমি উদ্ধার করবার জন্য বর্তমান ভারতবাসীর মতো অধীর হয়ে উঠত, আর ঠিক সেই সময় আমি হতুম এমনি বিচারক এবং আমার মতোই রাজদ্রোহ অপরাধে ধৃত হয়ে এই বিচারক আমার সম্মুখে বিচারার্থ নীত হতেন, তা হলে সে সময় এই বিচারক আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যা বলতেন, আমিও তাই এবং তেমন করে বলছি।’
নজরুল প্রথমে আলীপুর জেলে থাকলেও পরে তাঁকে হুগলিতে নেওয়া হয়। সেখানে নজরুল কয়েদিদেরকে মানবেতর পরিবেশে রাখার প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন, এবং অনশনরত অবস্থায় তাঁর স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হতে থাকে। ৩৯ দিন পর তাঁর কাকী শ্বাশুড়ি বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে নজরুল অনশন ভাঙেন, ২৯ মে ১৯২৩। উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথের প্রেরিত বিখ্যাত তারবার্তা ‘গিভ আপ হাঙার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটরেচার ক্লেইমস ইউ’ কারা কর্তৃপক্ষ নজরুলের কাছে পৌঁছাতে দেয়নি, অন্যদিকে নজরুলের নিজের মা জাহেদা খাতুন তাঁর অনশন ভাঙানোর জন্য কারা ফটকে এলেও নজরুল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে সম্মত হননি। কারাবাস শেষ করার পর নজরুল পরপর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। যদিও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা (১৯২২) কর্তৃপক্ষের রোষ এড়াতে সক্ষম হয়, কিন্তু পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলো যথাক্রমে বিষের বাঁশী (১৯২৪), ভাঙার গান (১৯২৪), প্রলয় শিখা (১৯৩০) ও চন্দ্রবিন্দু (১৯৩১) নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু সর্বহারা (১৯২৬), যেটাতে লাঙ্গল পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সাম্যবাদী জনপ্রিয় কবিতাগুলো সংকলিত হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পেরেছিল।
৩. বর্তমান বাংলাদেশে নজরুল কেন প্রাসঙ্গিক
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এর প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন অসুস্থ কবিকে নিয়ে এলেন তাঁর মনে এই চিন্তাটি কাজ করেছিল যে যে কবি নির্যাতিত ও শৃংখলিত মানুষের মুক্তি চেয়ে দুর্বার বিদ্রোহের অনল জ্বালিয়েছিলেন, যে কবি হিন্দু-মুসলমানকে একই বৃন্তের দুটি ফুল বলে সম্প্রীতির গান গেয়েছিলেন এবং সর্বোপরি যে কবি শোষণবিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখে ‘গাহি সাম্যের গান’ উচ্চারণ করেছিলেন, সে কবির আত্মার দেশ হতে পারে বাংলাদেশ। নজরুলের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ণ করেন বঙ্গবন্ধু। স্বপ্ন একটাই- শোষণহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা।
নজরুল সম্পর্কে আমার আগে এক ধরনের পড়াশোনা ছিল, ছিল এক ধরনের ধারণা। কিন্তু গত আড়াই বছর ধরে ত্রিশালে বাস করতে করতে আমি নজরুল সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্যভাবে ভাবতে শুরু করেছি। প্রথমে তাঁর জৈবিক জীবনটা আমার ভাবনাতে এসেছে। পুলিশ কর্মকর্তা কাজী রফিজউল্লাহর বাড়ি ছিল ত্রিশালের কাজীর শিমলা গ্রামে। আসানসোলে কর্মরত অবস্থায় তিনি একটি চায়ের দোকানে রুটি বেলার দায়িত্বে নিয়োজিত কিশোর নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম (কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃজন, ২০১২) এবং তরুণ নজরুল গবেষক রাশেদুল আনামের মতে (নজরুল জীবনের ত্রিশাল অধ্যায়, ২০০৬) রফিজউল্লাহর নিজের এক ভাইপোও তখন আসানসোলে ছিলেন, যে নজরুলের সমবয়সী ছিল এবং পড়ালেখায় ছিল উদাসীন। রফিজউল্লাহ ভাবলেন, নজরুলের সঙ্গে যদি তাঁর ভাইপোকেও দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন তাহলে এক গুলিতে দুই শিকার হয়। নজরুল দারিদ্র্যমুক্ত হয়ে পড়ালেখা করতে পারবেন আর নজরুলের সাহচর্যে তাঁর ভাইপোও পড়ালেখা করবে। কিন্তু প্রয়াত অধ্যাপক প্রীতিকুমার মিত্র, যিনি আমার বিবেচনায় নজরুল চর্চায় একান্ত কোণঠাসা গবেষক, তাঁর অত্যন্ত সুলিখিত গ্রন্থ দ্য ডিসেন্ট অব নজরুল ইসলাম : পোয়েট্রি অ্যান্ড হিস্ট্রি (২০০৭) গ্রন্থে বলছেন, নজরুলের ত্রিশালবাস সুখকর ছিল না। স্থানীয় লোকদের সঙ্গে তাঁর মিলমিশ হচ্ছিল না। এই আধুনিক যুগেও ত্রিশালের যোগাযোগ ব্যবস্থা বাংলাদেশের অপরাপর উপজেলার মতোই অপর্যাপ্ত ও কষ্টকর। সেখানে পাক্কা ১০০-২০০ বছর আগে অত্যন্ত শুষ্ক রাঢ় এলাকার একটি নবীন কিশোর ত্রিশালের মতো জলমগ্ন এলাকায় একটি বছর থাকবে সেটি একমাত্র সম্ভব হয়েছিল নজরুলের ওই কৈশোর বয়সেই দারিদ্র্যে উপনীত হওয়ার জন্য এবং কাজী সাহেবের দায়িত্বশীল অভিভাবকতায়।
১৯১৪ সালে নজরুল কাজীর শিমলা থেকে পাঁচ মাইল দূরে দরিরামপুর হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ভালো ছাত্র ছিলেন তিনি এবং স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি শীর্ষতম স্থান অধিকার করে সপ্তম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেই ১৯১৪ সালেই পালিয়ে রানিগঞ্জে ফিরে আসেন। এর ষোল বছর পরে রচিত ‘অগ্নিগিরি’ শীর্ষক ছোটগল্পে তাঁর ত্রিশাল বাসের কিছু উল্লেখ ধরা পড়ে। নজরুলের গানে ও কবিতায় প্রেম-বিরহের সংশ্লেষে বর্ষা ও গ্রীষ্মের প্রকৃতি বারবার ফিরে এলেও ঠিক রবীন্দ্রনাথের ঢংয়ে (‘নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি! / গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।‘) বা জীবনানন্দের মতো (‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এ বাংলার পারে / রয়ে যাব।’) বাংলাদেশের প্রকৃতির বন্দনা নেই। ঠিক বাংলাদেশ-প্রকৃতি সংলগ্ন উদ্ধৃতিযোগ্য কবিতা বা গান তাঁর খুব কম: ‘পদ্মার ঢেউ রে’ কিংবা ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী।’- জাতীয় কবিতা বা গান হাতে গোনা যায়। নজরুলে প্রকৃতি আছে, কাজল নদী আছে, চকোরী আছে, সমীর আছে, কিন্তু সেগুলো প্রকৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে, ঠিক বাংলাদেশের প্রকৃতির বিশিষ্টতা হিসেবে আসেনি।
কবির কৈশোর জীবনের ত্রিশালবাস নিশ্চয় ধানী জমির ভরভরা প্রকৃতি সম্পর্কে কবিকে অবচেতনভাবে হলেও উদ্বুদ্ধ করেছিল, কিন্তু কবি নজরুলের রচনায় ও গানে মরুর প্রকৃতি নিয়ে যে মোহাবিষ্টতা লক্ষ করা যায়, ত্রিশালের কোমল ঘন সবুজ প্রকৃতি তার কল্পনায় ছাপ ফেললেও তার প্রমাণ কম। যেকোনো বিচারে নজরুল বাংলা সাহিত্যে ও গানে সর্বশ্রেষ্ঠ বিরহী কবি, অভিমানী তো বটেই (‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে”), নজরুলের প্রেমিক হৃদয় রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে গোলাপ ফুলের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়েছে, তারপরও লক্ষ করলে বোঝা যায়, নজরুলের অভিব্যক্তি একান্তই ব্যক্তিগতভাবে সৃষ্ট চিত্রকল্প নির্ভর হলেও প্রকৃতি-অনুষঙ্গ নির্ভর নয়। হয়তো যে কবি ‘মহাবিদ্রোহী’ সত্তা নিয়ে চলাফেরা করতেন, তাঁর পক্ষে ‘শাওন রাতে . . . নয়নে বারি’ ঝরলেও রবীন্দ্রনাথের মতো শ্রাবণের আকাশে ‘মম জল-ছলোছলো আঁখি মেঘে মেঘে’ পেতে দেওয়া সম্ভব ছিল না। এ ছাড়া আরেকটি কারণ মনে হয় যে যদিও নজরুল ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ শীর্ষক ছোটগল্পটি ১৯১৯ সালে লিখেছিলেন, কিন্তু তা’তেও গল্পের ছলে আত্মকথনে বর্ধমানের রানিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে নায়কের আবার ফিরে ভর্তি হওয়ার কথা থাকলেও ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলের উল্লেখ নেই। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে বড় লেখকদের জীবনছায়ার সঙ্গে পরিচিত বলে নজরুলের রচনায় ত্রিশালবাস অনুল্লেখ থাকা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়।
উত্তর-ঐতিহাসিকতাতত্ত্বের গুরু স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাট তাঁর উইল ইন দ্য ওয়র্ল্ড (২০০৪) জীবনীগ্রন্থে শেক্সপিয়রের জীবনপ্রবাহের সঙ্গে সাহিত্যসৃজনের সংশ্লেষ এত অভ্রান্ত দালিলিকভাবে উপস্থাপন করেছেন যে শেক্সপিয়রের জীবনের ফাঁকা অংশগুলো তাতে বিশ্বাসযোগ্যভাবে ভরে উঠেছে। গ্রিনব্ল্যাটের প্রবল কল্পনাশক্তি নির্ভর সিদ্ধান্তগুলো এজন্য গ্রাহ্য করতে হয় যে তিনি সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন করে সেগুলোকে সমর্থন দিতে পেরেছেন। এ ধারণা থেকে আমার মনে হয় প্রীতিকুমার মিত্র স্থানীয় লোকদের যে উৎপাতের কারণে নজরুলের ত্রিশাল ত্যাগের কথা বলেছেন এবং এর সঙ্গে পরবর্তীতে নজরুলের ত্রিশালকে স্মরণে না আনার কথা যদি যোগ করি, কিংবা পরবর্তী জীবনে কখনো ত্রিশালে বেড়াতে না আসার বিষয়টি যদি ধরি, তা হলে আমার মনে হয় এ রকম একটি সিদ্ধান্তে আসা যায় যে ভিনদেশি অত্যন্ত সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান এবং প্রতিভাবান বালক নজরুল প্রায় চূড়ান্তভাবে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত একটি অনগ্রসর কৃষিসমাজে বাস করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে একটি কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন, যে কারণে হয়তো ত্রিশাল সম্পর্কে তাঁর বিরূপ মনোভাবই গড়ে ওঠে। কারণ ১৯৩০-এর দিকে নজরুলের খ্যাতি যখন তুঙ্গে তখন রফিজউল্লাহ্ কলকাতায় এসে নজরুলের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে দুটি ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সফল হননি। নজরুল কী একটা কাজে খুব ব্যস্ত ছিলেন বিধায় দেখা করেননি। পরে অবশ্য নজরুল রফিজউল্লাহর আসার কথা জানতে পেরে তাঁকে টেলিগ্রাম করে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এবং পুনরায় কলকাতা এলে দেখা করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সেটি আর হয়নি রফিজউল্লাহর মৃত্যুর কারণে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নজরুলের ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রাতঃস্মরণীয় ফিরোজা বেগমের একটি অনুযোগ মনে পড়ে। তিনি একবার বলেছিলেন নজরুলকে আমরা জাতীয় কবি করেছি ঠিক, কিন্তু তাঁর কোনো আদর্শকে আমরা ধারণ করি না (কালের কণ্ঠ, ২০ মে, ২০১০)। ফিরোজা বেগমের এই কথাটি আমাকে ভাবায়, তারপর একটি লেখায় (‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম : একটি প্রশ্নের অবতারণা ও একটি পাদটীকা’) আমি এর একটি বিশ্লেষণ তৈরি করে প্রকাশ করি। কথাটি হলো শ্রেণিভিত্তিক। রাষ্ট্রের অভিভাবক যাঁরা, সংস্কৃতির যাঁরা প্রতিপালক তাঁরা হচ্ছেন একান্তই মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত, যাঁরা নজরুল পাঠে এবং চর্চায় বিনোদন পাবেন, কিন্তু নজরুলের মৌলিক মানবিক চেতনাকে তাঁরা শ্রেণিগত চরিত্রের কারণেই ধারণ করতে অক্ষম। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবোধ ও অধ্যাত্মবাদ যতটা না মধ্যবিত্ত শ্রেণি-উত্থিত শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রুচির জন্য সহনশীল, নজরুলের অসাম্প্রদায়িক, শ্রেণিবিহীন, শোষণবিরহিত, ধনী-দরিদ্র ব্যবধান লোপকারী মানবিক চেতনা প্রকৃতই ধারণ করতে পারবে সেই রকম রাষ্ট্র-সমাজ ব্যবস্থা আমাদের নেই।
নজরুলের সাম্যবাদী কবিতাগুলো কর্তন করে, তাঁর নবযুগ এবং লাঙ্গলপর্বের অগ্নিঝরা গদ্যগুলো বাদ দিয়ে আমরা নজরুলকে পোষ মানানোর চেষ্টা করেছি, যেটি আমি ‘নজরুলকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার’ শীর্ষক আরেকটি রচনায় গ্রিনব্ল্যাটের ‘কন্টেইনমেন্ট’ তত্ত্ব বা পোষ মানানোর রীতির আলোকে আলোচনা করেছি। আমেরিকান গবেষক অধ্যাপক ড. রাচেল ফেল ম্যাকডারমটের এই যুক্তি খুবই গ্রহণযোগ্য যে নজরুলকে তাঁর সমগ্রতে গ্রহণ করার শক্তি আমাদের মধ্যবিত্তের নেই বলে আমরা সাম্প্রদায়িক নজরুলের চর্চা করে যাচ্ছি, পূর্ববঙ্গে নজরুলকে পরিণত করা হয়েছে হামদ নাতের কবি হিসেবে, আর পশ্চিমবঙ্গে শ্যামাসংগীতের কবি হিসেবে-যার কোনোটিই যৌক্তিক মূল্যায়ন নয়। (দ্রষ্টব্য : ‘নাইন্টি ইয়ারস অব রেবেলিয়ন?’ দ্য প্রেজেন্ট লিগাসিস অব ‘বিদ্রোহী’ ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ শীর্ষক প্রবন্ধ, যেটি তিনি ঢাকায় ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার রচনা ৯০ বছর পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পাঠ করেছিলেন।)
‘মানুষ’ কবিতায় নজরুলের ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ ; -গন্থ আনেনি মানুষ কোনো’ পংক্তিটি তাঁর অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের সারাৎসার। আমরা প্রায় সকলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষণে এবং রচনায় রবীন্দ্রনাথ-নজরুল এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আদর্শগত চিন্তার একটি ঐতিহাসিক-পরিব্রাজনশীল-ঐক্যের কথা বলি, সেটি আমরা রবীন্দ্রনাথ-বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে বলি এভাবে যে বাঙালি-সংস্কৃতি ও বাংলাভাষার মর্যাদা রবীন্দ্রনাথের অপার্থিব প্রতিভায় ভাস্বর হয়ে ওঠে এবং এ দুটির আর্ন্তজাতিক উদ্বোধন হয়েছে সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে ও রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়াতে। আবার নজরুল-বঙ্গবন্ধুর সমীকরণের সময় এভাবে বলি যে নজরুল ধর্মের শোষণ প্রক্রিয়ার বলয় থেকে মুক্ত হয়ে নির্যাতিত মানুষের মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটিই বঙ্গবন্ধু বাস্তবে রূপায়ণ করেন।
গ্রাহাম হোল্ডারনেস তাঁর শেক্সপিয়র : দ্য হিস্ট্রিজ (২০০০) গ্রন্থে ইতিহাসরীতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলছেন যে ইতিহাসের একটি উল্লম্বন পাঠ আছে, আর একটি আনুভূমিক পাঠ আছে। ইতিহাসের ধর্মীয় পাঠ হচ্ছে উলম্বন পাঠ, যেখানে ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত একটি মই আছে, যেখানে সবচেয়ে শীর্ষ ধাপে আছেন সৃষ্টিকর্তা, তারপর পার্থিব জগতের শাসকবর্গ, আর সবচেয়ে নিচে আছে প্রপীড়িত জনগণ। অর্থাৎ, রাজা শাসিত সামাজিক কাঠামোর যে পরিচিতি আমরা পাই। ইউরোপ-কেন্দ্রিক মধ্যযুগ ও রেনেসাঁর প্রারম্ভিক সময়ের এই ধাপবহুল সামাজিক কাঠামোকে অস্তিত্বের শৃঙ্খল বলেও আধুনিক যুগের অনেক ইতিহাসবিদ ব্যাখ্যা করেছেন এবং সেদিক থেকে নজরুলের আক্রমণের শিকার ইতিহাস পাঠের এই রীতিটিই। ‘মানুষ’ কবিতা থেকে আবার উদ্ধৃতি করা যাক : ‘কোথা চেঙ্গিস্, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়? / ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার! / খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? / সব দ্বার এর খোলা র’বে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা! / হায় রে ভজনালয়, / তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!”
উল্লম্বন সামাজিক কাঠামোয় নানা ছুতায়, বিশেষ করে ধর্মীয় বাহানায়, শোষণ করার যে প্রক্রিয়াগুলো খোলা থাকে, তার নিরসন হয় আনুভূমিক গণতান্ত্রিক কাঠামোতে, যেটির প্রণোদনা নজরুলের কবিতায় আছে এভাবে : ‘তুমি শুয়ে র’বে তেতালার’ পরে, আমরা রহিব নিচে, / অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে-ভরসা আজ মিছে!’ (‘কুলি-মজুর’)
নজরুলের দেহগত সক্ষমতা স্তব্ধ হয়ে যায় ১৯৪২ সালে, যখন বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে নবীন যুবক হিসেবে উত্থানরত। শহীদ সোহরাওয়ার্দির নেতৃত্বে তখন তিনি মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠনের ব্যাপারে সক্রিয়, যেটির প্রয়োজন ছিল আসন্ন পাকিস্তান ইস্যুর ওপর নির্বাচন সম্পন্ন করা (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ২০১২)। পাকিস্তান হওয়ার পর পরই আসলে নজরুলের সাম্যের গানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শোষণবিহীন বাংলাদেশ গঠন করার লক্ষ্য এক হয়ে যায়। নজরুলের আনুভূমিক গণতন্ত্রের যে কাব্যিক দর্শন ছিল, সেটি বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মীলনে খুঁজে পেলেন। গ্রন্থটির একেবারে শেষে ২৮৩ পৃষ্ঠায় ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়ের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসন ছাড়া আপোস করবে না।’ এ স্বায়ত্বশাসনের দাবি (৬ দফা) থেকে বাংলাদেশের সৃষ্টি। শুনেছি, বঙ্গবন্ধু কোনো এক জনসভায় যখন শোষণবিহীন সমাজের কথা বলছিলেন তখন তাঁর পাশে দাঁড়ানো ভুঁড়িসর্বস্ব একজন নেতার প্রতি হাস্যরসিকতার ছলে বলেছিলেন যে তাঁর পেটটিও কাটা যাবে। অর্থাৎ ভুঁড়ির চিত্রকল্প দিয়ে বৈষম্যপূর্ণ অর্থনীতির কথা তিনি বললেন, আর বললেন, আনুভূমিক গণতন্ত্রের মধ্যে সবাই অর্থনৈতিকভাবে সমান থাকবে। এদিক থেকে নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক চিন্তার মধ্যে যোগসূত্র পাওয়া যায়।