স্মরণ

সিনেমা ছাড়া জীবনকে শূন্য ভাবতেন কুরোসাওয়া

Looks like you've blocked notifications!

সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রনির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার আজ মৃত্যুদিবস। ১৯৯৮ সালের এই দিনেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পরের দিন, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র বিশ্লেষক রজার এবার্ট তাঁকে স্মরণ করেছিলেন একটি লেখার মাধ্যমে। রজার এবার্টের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত সেই লেখাটিই পাঠকদের জন্য ভাবানুবাদ করা হয়েছে।

গেল রোববার চলে গেলেন আকিরা কুরোসাওয়া, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের একজন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮। তাঁর জীবনের শেষটুকু কেটেছে প্রায় অন্ধত্বের সঙ্গে, তাও তিনি কাজ করে গেছেন, চোখের ইঞ্চিখানেক কাছে কাগজ পেন্সিল নিয়ে স্কেচ করেছেন। তাঁর শেষ ছবিটা মোটে বছর পাঁচেক আগে বানানো। যুদ্ধ পরবর্তীকালে যে বাঘা বাঘা লোক সিনেমার আর্টটাকে নতুন করে রূপ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এক সুইডেনের ইঙ্গমার বেরিমান বাদে কে আর কুরোসাওয়ার মতো এত মাস্টারপিস বানিয়েছেন? আর এই টাইটেলগুলোও শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেয় বারেবারে— ‘স্ট্রে ডগ’, ‘রশোমন’, ‘ইকিরু’, দ্য সেভেন সামুরাই’, ‘থ্রোন অব ব্লাড’, ‘দ্য হিডেন ফোরট্রেস’, ‘দ্য ইডিয়ট’, ‘ইয়োজিম্বো’, ‘হাই অ্যান্ড লো’, ‘রেড বেয়ার্ড’, ‘দেরসু উযালা’, ‘কাগেমুশা’, ‘র‍্যান’ এবং আরো অনেক নাম।

এমন দুটো গুণাগুণের সমন্বয় আকিরা কুরোসাওয়া ঘটিয়েছিলেন যা সচরাচর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে দেখা যায় না— তিনি ছিলেন একজন নান্দনিক চিত্রনির্মাতা এবং একই সঙ্গে একজন চিন্তাশীল মানবতাবাদী একজন মানুষ। তাঁর চলচ্চিত্রে ছিল বেপরোয়া আর দুর্দান্ত স্বাধীনতা, আর সেই সঙ্গে মনুষ্যত্বের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো টান। তাঁর ছবির মূল চরিত্রদের লক্ষ্য স্রেফ জেতা ছিল না, বরং ছিল সঠিক নৈতিক প্রয়োজনীয়তাকে বেছে নেওয়া।

আকিরা কুরোসাওয়ার চলচ্চিত্রকে বিষয়ানুগ তিনটি প্রকরণে ভাগ করা যায় : সামুরাই কাহিনী, যা জাপানি ইতিহাসের সঙ্গে একাকার, যেমন ‘দ্য সেভেন সামুরাই’ (হলিউডে যা ‘দ্য ম্যাগনিফিশিয়েন্ট সেভেন’ নামে নির্মিত হয়েছে পরে) এবং ‘দ্য হিডেন ফোরট্রেস’ (যে ছবি থেকে ‘স্টার ওয়ারস’ ছবি ‘আর২ডি২’ এবং ‘সি৩পিও’ চরিত্র দুটি অনুপ্রাণিত হয়েছে)। সাহিত্য থেকে অনুপ্রেরণাও নেওয়া হয়েছে, সেখানে শেক্সপিয়র আর দস্তয়েভস্কি যেমন রয়েছেন তেমনি মার্কিন ক্রাইম থ্রিলার লেখকরাও রয়েছেন। আর তৃতীয়টি হলো- সব গল্পই ছিল সমসাময়িক আখ্যান, নৈতিক সংশয়ের মুখোমুখি সাধারণ মানুষের কথা।

এড ম্যাকবেইনের ক্রাইম স্টোরিগুলো অ্যাডাপ্ট করার চিন্তা হয়তো কয়েকজন জাপানি নির্মাতা করেছিলেন। তবে কুরোসাওয়া কিন্তু ‘কিংস র‍্যানসম’ পড়ে তাঁর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছবি ‘হাই অ্যান্ড লো’ (১৯৬২) তৈরি করার রসদ পেয়েছিলেন। এ ছবিতে ধনাঢ্য এক ব্যক্তিকে জানানো হয় যে তাঁর পুত্রকে অপহরণ করা হয়েছে। মুক্তিপণের জন্য তাঁকে নিজের সব সম্পত্তি বিক্রি করতে হবে। এরপর এটা আবিষ্কৃত হয় যে অপহরণহারী ভুল করে ওই ব্যক্তির পুত্রের বদলে ওই ব্যক্তির গাড়িচালকের পুত্রকে অপহরণ করেছে। এখন এই ছেলেটির মুক্তিপণও কি একই হবে? যখন ওই কর্মচারী আর ধনাঢ্য ব্যক্তির চোখাচোখি হয় এক দুর্দান্ত শক্তিশালী শটে, কুরোসাওয়া তখনই মুখোমুখি করিয়ে দিয়েছেন সবাইকে এক কঠিন প্রশ্নের সামনে। সব জীবনের মূল্য কি সমান হয়?

একই প্রশ্ন খানিকটা ভিন্ন পথে উঠে এসেছে ‘কাগেমুশা’ (১৯৮০) ছবিতে। এই ছবির কাহিনী এক চোরকে নিয়ে যার চেহারা কি না সদ্য মারা যাওয়া এক যুদ্ধদেবতার অনুরূপ। এই মৃত্যুকে গোপন রাখার জন্য এই চোরকে বসানো হয় এই যুদ্ধদেবতার জায়গায়। সেই ক্ষমতা, সেই অবস্থান, সেই পোশাক আর সেই প্রাচুর্য সব হলেও চোরটি কিন্তু সেই যুদ্ধদেবতা হয়ে উঠতে পারে না। আর সেটাই হয়ে ওঠে সেই চোর বা ছায়া যুদ্ধদেবতার টানাপড়েন।

‘ইকিরু’ (১৯৫২) ছবিটিতে দেখা যায়, এক বৃদ্ধ মনে করেন চাকরি করা অর্থহীন। যদিও তিনি চাকরি জীবনে বেশ সফল। তিনি একটি শহরাঞ্চলের ব্যুরোর প্রধান। সুইসাইডাল ডিপ্রেশন আর মদ্যপানে ডুবে থেকে তিনি জীবন থেকে মুক্তি চান। তবে এর আগে তিনি জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বশেষ কাজ করতে চান—তা হলো শিশুদের জন্য একটি খেলার মাঠ তৈরি। আর এই কাজই তাঁর জীবনে প্রকৃত অর্থ এনে দেয়।

আসলে একটি মানুষের জীবনের মানেটা কী? ১৯৭০ সালে কুরোসাওয়া নিজেই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, যখন তাঁর ছবি ‘রেড বেয়ার্ড’ (১৯৬৫) এবং ‘দোদেস-কা-দেন’ (১৯৭০) ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়। তখন তিনি পরবর্তী ছবি বানানোর জন্য কোনো টাকাপয়সা পাচ্ছিলেন না। ১৯৭৫ সালে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এরপর ওই বছরেই, অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে নিজের একমাত্র অ-জাপানি চলচ্চিত্র ‘দেরসু উযালা’ নির্মাণের জন্য অর্থ পান রুশ এক অর্থ তহবিল থেকে। এই ছবি ছিল এক বিখ্যাত অভিযাত্রী আর তার সামান্য গাইডের মধ্যকার বন্ধুত্ব নিয়ে। সেরা বিদেশি ছবির ক্যাটাগরিতে এটি অস্কার জিতে নেয় (এটি দ্বিতীয়, প্রথম অস্কার পান ‘রশোমন’ ছবির জন্য)। এর পরও তিনি জাপানে কাজ করার জন্য অর্থ পাচ্ছিলেন না। কারণ তাঁকে অনেক বয়স্ক আর বাণিজ্য-বিমুখ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছিল। অবশেষে, ১৯৮০ সালে মার্কিন পরিচালক—  যারা তাঁকে সমীহ করতেন— তাঁদের সহায়তায় কুরোসাওয়া নির্মাণ করেন ‘কাগেমুশা’। ১৯৮৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘র‍্যান', ছবিটি ছিল শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়ার’ থেকে নির্মিত অনুপ্রাণিত ছবি, সেই ছবিটিও কান চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ পুরস্কারে সম্মানিত হয়।

পরবর্তীকালে এই দুই মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে সেগুলোর চমৎকার দৃশ্যায়নের জন্য। যেমন আলাদা দৃশ্যের কথা যদি বলা যায়—  সৈন্যরা ফ্লাইটের সিঁড়ি এমন করে নামিয়ে ধরছে যেন পানির উপরিতল মাপছে, অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে একটি ঘোড়ার মৃত্যু হচ্ছে, কিংবা নুয়ে পড়া বৃদ্ধ রাজার চারপাশে ঘিরে রাখা উজ্জ্বল পতাকা— সবকিছুই পুরো গল্পের আমেজ আর অনুভূতি সংক্ষেপে বলে দেয়।

ক্যারিয়ারের পুরোটাজুড়েই জাপানে কুরোসাওয়া সমালোচিত ছিলেন ‘অতি পশ্চিমা’ হিসেবে। তিনি প্রায়ই ওয়েস্টার্ন গল্প আর সংগীত ব্যবহার করেছেন। সমালোচক ডোনাল্ড রিচির মতে কুরোসাওয়ার সমালোচিত হওয়ার কারণ ছিল যে তাঁর ছবিগুলো কোনো ব্যক্তিবিশেষের আখ্যান বা বক্তব্য। তাঁর সামুরাই ছবিগুলো কোনো ব্যক্তির সিদ্ধান্ত বা পছন্দের বিষয়গুলো নিয়েই চিত্রায়িত করা, সেখানে দায়িত্বশীল কার্যক্রমের প্রভাব ছিল না।  কুরোসাওয়া জন্মেছিলেন ১৯১০ সালে, আর যখন তিনি স্কুলে ওয়েস্টার্ন আর্ট নিয়ে পড়ালেখা করেছেন— তখনই তাঁর রুচিটা তৈরি হয়েছিল ওভাবেই। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে কুরোসাওয়া একজন চিত্রপরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন। প্রথমদিকে করেছেন আমেরিকান অকুপেশন অথরিটির কিছু বাঁধাধরা কাজ, তারপর ‘স্ট্রে ডগ’ (১৯৪৯) আর ‘রশোমন’ (১৯৫০) ছিল পুরোই তাঁর নিজের। অভিনেতা তোশিরো মিফুনে (রশোমন, দ্য সেভেন সামুরাই, থ্রোন অব ব্লাড, ইয়োজিম্বো এবং রেড বেয়ার্ড) এবং তাকাশি শিমুরার (ইকিরু) সঙ্গে তাঁর ছিল দীর্ঘদিনের পরিচয় ও বন্ধুত্ব।

কুরোসাওয়ার শেষদিকের ছবিগুলো অনেকটাই ছিল শান্তিতে আচ্ছন্ন একজন প্রবীণ ব্যক্তির ধ্যানের মতো।

এগুলোর মধ্যে ছিল ‘আকিরা কুরোসাওয়াস ড্রিমস’ (১৯৯০), যা ছিল আটটি ছোট গল্পের সমন্বয়। আরেকটি ছিল ‘র‍্যাপ্সডি ইন অগাস্ট’ (১৯৯১), যার কাহিনী ছিল বোমা নিয়ে বোঝাপড়া। এই ছবিতে কুরোসাওয়া একজন জাপানি-মার্কিন চরিত্রের আবির্ভাব ঘটান, যার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে যুদ্ধ আসলে সরকার বনাম সরকার হয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের হয় না। তাঁর শেষ ছবি ‘মাদাদাইয়ো’ (১৯৯৩)। এটি কখনোই যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারের জন্য পরিবেশন করা হয়নি, তবে মার্চ মাসে শিকাগোয় ‘ফ্যাসেটস সিনেমাথেক’-এ প্রদর্শিত হয়। এই ছবির গল্প এক বৃদ্ধ অধ্যাপককে নিয়ে, যার প্রিয় ছাত্ররা প্রতি বছর একবার করে মিলিত হয় তাঁর জন্মদিনে। তিনি সেই পার্টিতে একটি বিশেষ বিয়ারের গ্লাসে বিয়ার খান এবং বলেন—‘এখনো নয়’! এর কারণ, তিনি এখনো মারা যাননি!

‘আমার থেকে সিনেমাকে বিয়োগ করো, ফলাফল হবে শূন্য’ কুরোসাওয়া একবার এমনটাই বলেছিলেন। ১৯৯৩ সালে ‘মাদাদাইয়ো’ ছবির পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি যতজন এই ছবিটা দেখেছেন, তাঁদের সবাই সিনেমা হল ছেড়ে বেরুবার সময় নির্ভার একটা মন আর মুখে চওড়া একটা হাসি নিয়ে বের হবেন।’

এটাই কুরোসাওয়ার এপিটাফ হতে পারত।