ঈদের আয়োজন

আনিফ রুবেদের ১০ কবিতা

Looks like you've blocked notifications!

কবরে শুয়ে মানুষ কী গান গায়

নিজের আত্মার ওপর আমি (জুতো পায়ে দিয়েই) হাঁটতে হাঁটতে আত্মার লাশের ওপর বসে পড়ি, ঘাসের মতো জোছনা বিছিয়ে, মাটির পা নিয়ে। দুর্দান্ত আমি, মৃত্যুর গায়ে হলুদের ছোপ রেখে দিই।

মিথ্যামৃত্যুর মায়ায় পড়ে গিয়ে ভুলে গেছি, কবরের ভেতর একা একজন মানুষ শুয়ে শুয়ে কোন গানটি গেয়ে চলে ঘুম ভেঙ্গে গেলে, মৃত্যু ভেঙ্গে গেলে।

আর একটু হেঁটে গেলেই গভীরের দিকে, সত্যমৃত্যু ধরা দেবে বুকে অথচ ক্লান্তির দোহাই দিয়ে বসেই থাকি শরীর কাটা ঘরের ভেতর, আত্মাকাটা ঘরের ভেতর।

পরাস্ত পাখির শেষ গান

পরাস্ত পাখির শেষ গান বিঁধে থেকে গেল অস্ত যাওয়া আর এক পাখির ঠোঁটে। পাখিনীর পাখার গভীর ছায়া দীর্ঘশ্বাসের মায়া আর মায়াহীন যন্ত্রণার শামিল।

‘মানুষে মানুষ গাঁথা’ লালন কথা পুড়ে পুড়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। পাঁজরের তলার মৌময় কাদার ভেতর অন্ধকারের মতো মানুষ হেঁটে চলে গেল। বসে থাকা না বুঝে থেমে থাকা না বুঝে চলে যাওয়া না বুঝে।

কান্নার গয়না, বিবেকের আয়না দেখা যায় না নদীর সুখের ডানা। আর দেখ ঘুড়ি ওড়ানোর সুতোয় বসে আছে সজীব ছত্রাক, নাটাইয়ের বাঁশে কাঠে ঘুন ঘুন আগুন। আমরা আমাদের ছেলেবেলা পুড়িয়ে ফেলেছি। অতীত কাল।

মৃত্যুসংক্রান্ত কারণে ঘুম

ওদিন তোমারা বনভোজনে যাবে। পাখিরা তাদের আহার বন্ধ রেখে তোমাদের আহারের দিকে চেয়ে থাকবে আর বিস্মিত হবে।

ওদিন আমি তোমাদের সাথে যেতে পারব না। মৃত্যু সংক্রান্ত কারণে প্রচুর ঘুমাতে হবে আমার।

মৃত্যুর মুখের ভেতর

মৃত্যুর মুখের ভেতর পা ঢুকিয়ে বসে আছি। আমার পা মৃত্যুর হৃদপিণ্ড ছুঁয়ে গেছে আর দেখ মৃত্যুর আহাজারি আর দেখ তুমি আমার বুকের ভেতর ব্যথা হয়েছ।

আমি ঈশ্বরের মুখের ভেতর অন্য এক পা ঢুকিয়ে দিয়েছি। ঈশ্বর আর কথা বলতে পারে না। গোঁ গোঁ করে মৃত্যুর পা ধরতে চায় হাত দিয়ে। আর দেখ ঈশ্বরের কামড়ে আমার পাও টনটান করে ওঠে না আর। তুমি চড়ে আছ বিশ্বাসহীনতার এক রঙিন ঘুড়ির পিঠে। আমার এক হাতে ছিঁড়ছি গোলাপের পাঁপড়ি আর হাতে সমুদ্রে ওঠাচ্ছি বিক্ষুব্ধ ঢেউ।

আমি আমার চারপাশ থেকে সরে যাচ্ছি। আমি আমার মাংস থেকে সরে যাচ্ছি। আমি আমার মৃত্যু থেকে সরে যাচ্ছি আমি আমার ঈশ্বর থেকে সরে যাচ্ছি।

শরীর জাদুঘর

তুমি আমার বুকের ভেতর বসে আছ, হাতে ধারাল ছুরি। রক্তের লাগাম ছুটে গেছে, রক্তঘোড়া বাঁধ মানে না। তুমি জোছনার বিষাক্ত হেমলক হয়ে থাক রক্তের লালায়। একটা ছোট গোলাপের দাম একটা শরীরের সমান।

আমার বড়ই সন্দেহ, এ দেহ সত্যি সত্যি কোনো গান গাইতে পারে কি না, কোনো জলে ডুবে যেতে পারে কি না। আমার বিষাক্ত কামড় পড়ে আমারই শরীরের জাদুঘরে। শরীরের জাদুঘরে পুরো পৃথিবী সাজানো আছে বলতে বলতে একলোক আমার শরীরের পাশ দিয়ে যায়। আমি তার কথার সাথে একমত হওয়ার আগে আরো বৃষ্টির অপেক্ষা করি, পোশাকের বোতামের ঘাট উপেক্ষা করে। এ পৃথিবী একটা প্রাকৃতিক ঘড়ির মাদুর, এ পৃথিবী একটা বাঘ তাড়ানো ঘোড়া।

হৃথিবী রথের যাত্রী-২১

পৃথিবীর পকেট হাতড়ে হাতড়ে কয়েকটা ধাতব মুদ্রা বের করে নিয়ে আসলে বাজাতে বাজাতে দু’হাতের ভেতর। বললে- ‘চল এবার ঘর বাঁধি পৃথিবীর সমস্ত মানুষের সাথে। সাদা গোলাপ সাদা গোলাপ, লাল গোলাপ লাল গোলাপ, কালো গোলাপ কালো গোলাপই থাকবে। আমাদের পৃথিবীর ঘরে শান্তির ঘুম আর জেগে থাকা।’ গিরিবালা, তুমি ধাতব মুদ্রাকে ভেবেছ শান্তির চমৎকার দীপ জ্বালানোর তেল। পৃথিবীর অজস্র পকেট হাতড়ে হাতড়ে যদি শান্তিমুদ্রা বের করতে পারতে কিছু হতো হয়তো।

তুমি সূর্যের দিকে তাকাও আর মাটির দিকে তাকাও। এইসব গ্রীষ্মকালে বুঝতে পারবে রোদপুরুষ কেমন শুকিয়ে দেয় মাটির ঠোঁট চুষে চুষে আর ঘাসগুলো জ্বলছে আমাদেরই চুলার ভেতর। আগুনকে কখনো কাঁদতে দেখেছ? আগুন কখনো কাঁদে না কারণ আগুন কাঁদলে সে নিজেই নিভে যাবে যে নিজের অশ্রুতে।

হৃথিবী রথের যাত্রী-২২

ঋতু বিষয়ে তোমার গভীর জ্ঞান আছে এ কথাকে কে অস্বীকার করে। বললে- ‘আর দেখ শীত আর বর্ষাকাল, কেমন রোদকন্যারা এসে ওমের মাদুরই বিছিয়ে দেয় আমাদের শরীরে।’

আমি নির্ভেজাল মানুষ হতে চাই। তুমি নির্ভেজাল মানুষ হতে চাও। ঘর বাঁধতে চাও পৃথিবীর সব মানুষের সাথে। গিরিবালা প্রাণ আমার, শান্তির মুদ্রা তুমিই আনতে পারবে পৃথিবীর সবকটা পকেট হাতড়ে। ক্ষয়ে যাক না কেন তোমার হাত, তবুও কাজে লেগে যাও তোমার শান্তি অন্ত প্রাণ নিয়ে। আমি ছাতা ধরে আছি পুরো পৃথিবীতে, রাত নামতে দেব না। তুমি আলো জ্বালো।

হৃথিবী রথের যাত্রী-২৩

গিরিবালা, যে হত্যা করেছিল একটা মানুষ তার বিচার চেয়ে বসলে আর যে লোকগুলো বিচারকেই হত্যা করল তার বিচার চাওয়ার বুদ্ধিতো তোমার খুলল না। হত্যা হওয়া বিচারের জন্য কোনো অশ্রুও জমা নেই তোমার অশ্রুথলিতে? গিরিবালা, তোমাকে মনে পড়লেই তোমার চুলের গন্ধ পাই।

ঘুমন্ত পাখিকে ভোর হলে ঘুম থেকে ডেকে তোলে কে? মানুষকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে পাখি। পাখির ডাকে মানুষেরা জেগে ওঠে, হাতে বন্দুক নেয় আর পাখির মাংস নিয়ে ফিরে আসে প্রতিদিন।

তুমি গিরিবালা, তুমি প্রিয়বালা। প্রাণবিক ইতিহাস তুমি রচনা কর। ঘুম চুমে যায় সব চোখগুলোকে। ঘুম পান করে প্রাণীদের চোখ, চোখ পান করে স্বপ্ন্, ব্যাভিচারী স্বপ্ন অবিচার করে ধ্বসিয়ে দেয় জীবনের দেয়াল। মাটির ঢেলা ভেঙে ফেল

হৃথিবী রথের যাত্রী-২৪

‘আমাদের দেশ, নদী প্রধান দেশ’ এ কথা লেখা আছে বইতে। ‘আমাদের দেশ দুঃখপ্রধান দেশ’ এ কথা লেখা আছে আমার খাতায়। নির্বুঝ মানুষ তুমি পরের দিনই স্যারকে গিয়ে কথা দুটি বলে, জিজ্ঞাসা করলে- ‘কোনটি ঠিক বলে দেবেন স্যার?’ তোমার শ্লেট তোমার চুলের মতো আমি ভেঙে ফেলব, তোমাকে আর স্কুলে যেতে হবে না। তোমার চক তোমার আঙুলের মতো আমি ভেঙে ফেলব, তুমি আর স্কুলে যেতে পারবে না।

আজব যুগ চলছে এই যুগটাতে। তোমার ভাগ্য তোমার হৃদয়ে লেখা নেই। তোমার ভাগ্য তোমার মগজে লেখা নেই। তোমার ভাগ্য তোমার বিদ্যালয়ের শ্লেটে আর বইতে লেখা আছে, তোমার ভাগ্য তোমার হস্তকব্জিপেশিতে লেখা আছে, তোমার ভাগ্য লেখা আছে আকাশবাণীর অক্ষরে। মন খারাপ হতেই পান খাও, এ অভ্যাস ছাড়তে হবে।

হৃথিবী রথের যাত্রী-২৫

প্রকৃত পৃথিবী কাকে বলে? পৃথিবী যদি প্রকৃতই পৃথিবী হয়ে ওঠে, মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলে- ‘এই দেখ আমি পৃথিবী, তোমাদের প্রকৃত পৃথিবী।’ তাহলে কী হতো? কেমন হতো?

বৃক্ষের ভেতরে- জীবন্ত বৃক্ষের ভেতরে যে বৃক্ষরস বয়ে যাচ্ছে তা তো কেবল আমাদের পূর্ব পুরুষদের আত্মা। সেখানে হাঁসের আত্মা, পায়রার আত্মা, উদ্বিড়ালের আত্মাও আছে গান গেয়ে গেয়ে। এসব বৃক্ষরস খেয়ে বেঁচে আছি।

কত দূর গেলে একজন মানুষ তার পথকে ঈশ্বর ভাবতে পারবে? কত দূর পথ হাঁটা হলে পথ তার পথিককে প্রিয় বান্দা বলে ধরে নেবে? আর সব আশীর্বাদ, আশীর্বাদ দেবে তার পা ছুঁয়ে? মানুষদের কল্যাণ করে মানুষ এ কথাও ঠিক আবার মানুষদের কল্যাণ করে আমগাছ বা খরগোশ বা সিংহরা এ কথাও ঠিক।

 

কবি পরিচিত

আনিফ রুবেদ। জন্ম ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮০ সাল। চামাগ্রাম, বারঘরিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। প্রকাশিত গ্রন্থ ৩টি- পৃথিবীর মৃত্যুদণ্ডপত্র (কাব্যগ্রন্থ, অন্যন্যা ২০১১), মন ও শরীরের গন্ধ (গল্পগ্রন্থ, ঐতিহ্য ২০১৪), এসো মহাকালের মাদুরে শুয়ে পড়ি (কাব্যগ্রন্থ, ঐতিহ্য ২০১৫)। মন ও শরীরের গন্ধ গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপির জন্য জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং মুক্তগদ্য লিখে যাচ্ছেন।