প্রকৃতি
চাঁপা নামের যত ফুল
আমাদের দেশে চাঁপা নামে যতগুলো ফুল আছে, তার খ্যাতি মূলত সুগন্ধের জন্য। আর ওদের বর্ণবৈচিত্র্য হচ্ছে আমাদের বাড়তি পাওনা। শুধু এখানেই নয়, চাঁপার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। নেই নেই করেও আমাদের দেশে চাঁপা ফুলের সংখ্যা একেবারে কম নয়। তবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে চাঁপা নামের সব ফুলই কিন্তু চাঁপা নয়। প্রচলিত নাম চাঁপা হলেও মূল চাঁপা ফুলের সঙ্গে বৈশিষ্টগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। প্রকৃত চাঁপার ইংরেজি নাম ম্যাগনোলিয়া। প্রকৃত চাঁপাফুল এবং শুধু নামেই চাঁপা, আমাদের দেশের এমন কয়েকটি ফুল নিয়ে এই আয়োজন।
জহুরিচাঁপা
অনেক দিন ধরে ফুলটির আধফোটা কুঁড়িতেই সন্তুষ্ট থেকেছি। অনেক খুঁজেও পরিপূর্ণ ফুল পাইনি। কয়েক বছর আগে শেষ জৈষ্ঠ্যে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ধোয়ামোছা উজ্জ্বল রমনাকে দেখতে গিয়েছিলাম। পার্কের মাঝামাঝি অবস্থানে পরিণত মহুয়াকে পাশ কাটিয়ে গাছটির কাছাকাছি চলে গেলাম। একই দৃশ্য, চারপাশে কতগুলো আধফোটা কলি। কিন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই মধুর সুবাস লাগল নাকে। তাতে সন্দেহ বাড়ে। দু-একটা ফুল ফুটতেও পারে। পাতার বুননে গাছ এতই নিশ্ছিদ্র যে ভেতরে চোখ গলানো যায় না। অগত্যা নিচের কাণ্ডে খুঁজে দেখার জন্য বসে পড়ি, আর তখনই আবিষ্কার করি পরম কাঙ্ক্ষিত ফুলটি। মুক্ত পাপড়িতে হাসছে যেন। গাছটি প্রথম দেখি নাটোরের দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ির ইতালিয়ান গার্ডেনে। মালিরা বলেন এগ্ প্ল্যান্ট। রমনা পার্কের গাছটির সন্ধান জানান পার্কের তত্ত্বাবধায়ক জিয়াউল হাসান পাখি। জহুরিচাঁপা (magnolia pumila) মূলত জাভা দ্বীপপুঞ্জের গাছ। প্রায় দুই মিটার উঁচু চিরসবুজ ঝোপাল গাছ। পাতা ভল্লাকার, ৭-১২ সেন্টিমিটার লম্বা, খসখসে। গ্রীষ্ম-বর্ষায় বেশি ফুল ফোটে, পাতার গোড়া থেকে একেকটি ফোটে সন্ধ্যার আগে আগে। হলদেটে-সাদা, সুগন্ধি, প্রায় তিন সেন্টিমিটার চওড়া, সবুজ বৃত্তাংশে আংশিক ঢাকা থাকে, বাটিবৎ, পাপড়ি ছয় থেকে নয়টি। কলমে চাষ।
কাঁঠালিচাঁপা
গাছ যতটা সহজলভ্য, ফুল ততটা নয়। এর কারণ একাধিক। গাছ পত্রঘন, তার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে ফুল। তা ছাড়া প্রস্ফুটনকালও সংক্ষিপ্ত। বছরের বাকি সময় পাতার সৌন্দর্য কিংবা কোনো উদ্যানকর্মীর শৈল্পিক আদলে গড়া ভিন্ন কোনো অবয়ব দেখেই আমাদের কাটাতে হয়। কিন্তু ব্যাংককের রাজপথে ফুলকে দৃশ্যমান রাখার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোটা লোহার আর্চের ওপর মাত্র দু-একটি লতা তুলে দেওয়া হয়েছে, তাতে ফুলগুলো মাথার ওপর ঝুলে থাকে। প্রায় প্রতিদিন দু-এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় সংখ্যায়ও বেশি। আমাদের দেশে কাঁঠালিচাঁপার (artobotrys odoratissimus) অতটা যত্নআত্তি হয় না, তবে সব বাগানেই চোখে পড়ে। কাষ্ঠল-লতা, বড় ঝাড়, ছেঁটে দিলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, বড় হলে নুয়ে পড়ে। ছোট ছোট ডাল কাঁটায় রূপান্তরিত। পাতা উজ্জ্বল সবুজ, আয়ত-ভল্লাকার। ফুল ফোটে গ্রীষ্ম ও বর্ষায়, অন্যান্য সময়েও হঠাৎ দু-একটির দেখা মেলে। পরিণত হলে পাকা কাঁঠালের গন্ধ ছড়ায়। এই সূত্র ধরেই অনেকে ফুল শনাক্ত করেন। রং হলদেটে বা সোনালি হলুদ, কাক্ষিক, পাপড়িসংখ্যা ৬, খোলা। ফুলের বোঁটা বাঁকা, আঁকশির গড়ন। গুচ্ছবদ্ধ ফল গোলাকার, পাখিদের প্রিয়। আদি আবাস ইন্দো-মালয়।
স্বর্ণচাঁপা
একসময় আমাদের নিসর্গ সজ্জায় গাছটি চরম উপেক্ষিত ছিল। আজকাল পার্ক-উদ্যান ও পথপাশে কিছুটা সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। ফুলটির প্রতি আমাদের কিঞ্চিৎ পক্ষপাতও আছে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে তার অবস্থান। মৈমনসিংহ গীতিকায় আছে- ‘চাইর কোনা পুষ্কুনির পারে চাম্পা নাগেশ্বর/ ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর।’ চাঁপা ফুলকে আঞ্চলিক ভাষায় চাম্পা ফুল বলা হয়। প্রাচীন লোককথায়ও চাম্পা নামটিই এসেছে বারবার।
জানামতে, ঢাকার শাহবাগে গণগ্রন্থাগারের প্রবেশপথের বাঁ-পাশে কয়েকটি সুউচ্চ গাছ চোখে পড়ে। জাতীয় জাদুঘরের ভাস্কর নভেরা হল লাগোয়া পুকুরপাড়ে আছে বেশ কয়েকটি। এ ছাড়া নীলক্ষেত পুলিশফাঁড়ি, হলিক্রস স্কুল, সড়ক ভবন, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, শিশু একাডেমি এবং সিলেট ও চট্টগ্রামের পথপাশে দেখা যায়।
ফুলের ক্ষেত্রে চাঁপা নামটি আমাদের অতি সুপরিচিত। তবে সব চাঁপাই চাঁপা নয়। প্রসঙ্গত, কনকচাঁপার কথা বলা যেতে পারে। নাম চাঁপা হলেও আদতে চাঁপা পরিবারের সদস্য নয়। একটির সঙ্গে অন্যটির দুস্তর ফারাক। আলোচ্য চাঁপা সুষমা ও সুগন্ধের জন্য কাব্য, কলা, উপহার, অর্চনা সর্বত্রই ব্যবহৃত। এর স্নিগ্ধ বর্ণ ও উজ্জ্বল সৌরভ পবিত্রতার প্রতীক। বৃদ্ধি দ্রুত, জীবন দীর্ঘ, চাষ সহজ এবং প্রস্ফুটন অফুরান। হিন্দু ও বৌদ্ধদের কাছে গাছ অত্যন্ত পবিত্র। শ্রীলঙ্কায় বুদ্ধমূর্তি তৈরিতে এই কাঠ বহুল ব্যবহার্য।
স্বর্ণচাঁপা মূলত পাহাড়ি প্রজাতি। সমতলেও বৃদ্ধি স্বাভাবিক। বৈজ্ঞানিক নাম- michelia champaca. গাছের কাণ্ড সরল, উন্নত, মসৃণ এবং ধূসর। পাতা চ্যাপ্টা, উজ্জ্বল-সবুজ, একান্তরে ঘনবব্ধ। ফুল একক, কাক্ষিক এবং ম্লান-হলুদ, রক্তিম কিংবা প্রায় সাদা। পাপড়িসংখা প্রায় ১৫। আমাদের দেশে সাদা রঙের ফুল চোখে পড়ে না। ফুলের বর্ণগত বিচিত্রতায় বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। মাটি, আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এমনকি তাজা ও বাসি ফুলের ক্ষেত্রেও রঙের তারতম্য হতে পারে। পরিপূর্ণ প্রস্ফুটিত চাঁপা তীব্র সুগন্ধি। গ্রীষ্মের প্রথম ভাগ থেকে বর্ষা-শরৎ অবধি ফুল থাকে। ফুল শেষ হলে গুচ্ছবদ্ধ ফল ধরে। দেখতে অনেকটা আঙুরের মতো। কাক ও শালিকের প্রিয় খাদ্য। চাঁপা ভেষজগুণেও অনন্য। বাকল ও ফুল বাতরোগের ওষুধ। ফুলের আরক চক্ষুরোগে ব্যবহার্য। বীজ পায়ের ক্ষতে উপকারী। কাঠ দারুমূল্যযুক্ত।
গুলঞ্চচাঁপা/কাঠগোলাপ
সুদূর মেক্সিকো থেকে আসা এই ফুলটি এখন আমাদের দেশে দারুণ জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তার কারণে তার নামও অনেক- যেমন গুলাচি, গোলাইচ, গোলকচাঁপা, চালতাগোলাপ, গরুড়চাঁপা ইত্যাদি। অবশ্য সবার প্রিয় ফুল হওয়ার একাধিক কারণও আছে। তন্মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে বর্ষব্যাপ্ত বিচিত্র রঙের প্রস্ফুটন। শুধু তাই নয়, কাঠগোলাপ (plumeria spp) দারুণ সুগন্ধিও। শীতের শেষ দিকে এই গাছের সব পাতা ঝরে পড়ে। তখন নিষ্পত্র গুলাচিকে একটি সুন্দর ভাস্কর্যের মতো মনে হয়। বসন্তের শেষ ভাগে পাতাহীন ডালপালার মাথায় দু-এক থোকা করে ফুল ফুটতে শুরু করে। ফুল ও পাতার পরিপূর্ণতা আসে গ্রীষ্মকালে। তখন দূর থেকে মনে হয় গাছটি যেন প্রকৃতির বিশাল এক পুষ্পস্তবক। তারপর শীত অবধি পর্যায়ক্রমে ফুল ফুটতে থাকে। বর্ণে গন্ধে প্রাচুর্যে এবং অক্লান্ত প্রস্ফুটনে এমন পুষ্পতরু সত্যিই বিরল। এই গাছটি ৮-১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পুরনো কাণ্ড রুক্ষ, অমসৃণ ও খসে পড়া বাকলের চিহ্নে ধূসর। ডালপালাগুলো নরম ও দুধকষভরা। প্রজাতিভেদে পাতার গড়ন নানা রকম। কোনো কোনোটির গোড়া ও আগার দিক সরু, কোনোটির আগার দিকটা বড় ও মাথা গোল। বিচিত্র গড়ন ও বর্ণবৈচিত্র্য এই ফুলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোনো কোনো ফুল একেবারে দুধের মতো সাদা, কোনোটিতে সাদা পাপড়ির কেন্দ্রে স্পষ্ট হলুদ দাগ, আবার কোনোটি লালচে গোলাপি রঙের। আবার সাদা রঙের কিছু ফুল দীর্ঘ মঞ্জরিদণ্ডের আগায় ঝুলে থাকে। ঢাকায় রমনা উদ্যান, ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও ঢাকা ক্লাব প্রাঙ্গণে কাঠগোলাপের সুদৃশ্য বীথি চোখে পড়ে।
হিমচাঁপা/উদয় পদ্ম
এই ফুলটিকে কেউ কেউ উদয় পদ্ম নামে নাও চিনতে পারেন। কারণ পোশাকি নাম ম্যাগনোলিয়া। এই গণে পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য প্রজাতি ছড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিকদের মতে, ম্যাগনোলিয়া হিমালয় অঞ্চলের আদি উদ্ভিদ প্রজাতি। বর্তমান ফুলটি অবশ্য সুদীর্ঘ সময়ের বিবর্তিত রূপ। আলোচ্য প্রজাতিটি মূলত আমেরিকার ফ্লোরিডা ও টেক্সাসের প্রজাতি। আমাদের দেশে এই ফুল সংখ্যায় কম। তা ছাড়া উচ্চতার দিক থেকেও ততটা উঁচু হয় না। কিন্তু ঠান্ডাপ্রবণ অঞ্চলে কিংবা জন্মস্থানে গাছ বেশ উঁচু হতে দেখা যায়। ম্যাগনোলিয়া ফুলকে উদয় পদ্ম নাম দিয়ে আপন করে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তা ছাড়া হিমচাঁপা নামেও পরিচিত। এরা অবশ্য আমাদের দেশি ম্যাগনোলিয়া নয়, আমাদের একমাত্র দেশি ম্যাগনোলিয়ার নাম দুলিচাঁপা। জন্মে সিলেটের পাহাড়ে। আলোচ্য উদয় পদ্ম সারা দেশেই বিক্ষিপ্তভাবে চোখে পড়ে। ঢাকায় বলধা গার্ডেনের সিবিলি অংশে প্রবেশপথের দুই পাশে বেশ দীর্ঘ বীথি চোখে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল প্রাঙ্গণ, রমনা পার্ক ও বোটানিক গার্ডেনে বেশ কয়েকটি গাছ চোখে পড়ে। বৃদ্ধি মন্থর হওয়ায় ফুলের জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়।
গাছ ১৫-২০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। কাণ্ড শক্ত ও কালচে রঙের। কুঁড়ির রং বাদামি ও রোমশ। পাতা ঊর্ধ্বমুখী, দেখতে অনেকটা কাঁঠাল পাতার মতো। তবে কাঁঠাল পাতার মতো আগা সরু নয়, আয়তকার। পিঠের রং খয়েরি ও বুকের দিকটা সবুজ রঙের। এমন বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্যান্য গাছ থেকে উদয় পদ্মকে (magnolia grandiflora) খুব সহজেই আলাদা করা যায়। সাদা, সুগন্ধি ও বড় আকারের ফুলগুলো ফোটে বসন্তের শেষ ভাগে, ১৫-২০ সেমি চওড়া, পাপড়ি ৬-১২টি। পরিপূর্ণ মৌসুম গ্রীষ্মকাল। একদিনের ব্যবধানেই বাসি হয়ে ঝরে পড়ে। ফুল থেকে কাঁঠালের আঁটির মতো মুঠো সমান বীজ হয়। এই গাছ রোদ পছন্দ করে। তবে চারা তৈরি করতে হয় ছায়ায়। বংশবৃদ্ধি গুটিকলমে।
কনকচাঁপা
কনকচাঁপা আমাদের অতি পুরনো ও দুষ্প্রাপ্য ফুল। দুর্লভ হওয়ার কারণে ফুলটি আমাদের কাছে নামে যতটা পরিচিত, অবয়বে ঠিক ততটা নয়। প্রাচীন মৈমনসিংহ গীতিকায়ও এ ফুলের উল্লেখ আছে :
‘হাঁট্যা না যাইতে কন্যার পায়ে পড়ে চুল মুখেতে ফুট্টা উঠে কনকচাম্পার ফুল।’
এই ফুলটি আমাদের অতি প্রিয়। তবে কনকচাঁপা কোনো চাঁপা নয়, উদ্ভিদবিজ্ঞানের মাপকাঠিতে এ দুইয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। ঢাকায় আছে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি। বলধা গার্ডেন, শিশু একাডেমির বাগান ও রমনা পার্কে বসন্তে এদের দুর্লভ প্রস্ফুটন চোখে পড়ে। বলধা গার্ডেনের গাছটির কন্যা শিশু একাডেমির গাছটি, চারাটি এনে লাগিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক ও নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া। রমনা পার্কে এই গাছটির চারা নিয়ে লাগিয়েছেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। এভাবেই আমাদের চারপাশে কিছু কনকচাঁপা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এরা সংখ্যায় খুব বেশি না। অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থে একসময়ের হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের (বর্তমানে শেরাটন বা রূপসী বাংলা হোটেল) ফটকের কাছাকাছি যে গাছটির সন্ধান দিয়েছেন বর্তমানে তা আর নেই। সোনালু বা সোনাইলের ফুল হলুদ রঙের কিন্তু গন্ধহীন। পেল্টোফরামের রং অবিকল কনকচাঁপার মতো, কিন্তু গন্ধ অত্যুগ্র। কনকচাঁপা অবশ্য এসব ত্রুটিমুক্ত। বর্ণে, গন্ধে সে অনুপম, অনন্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
কনকচাঁপা ছোটখাটো ধরনের গাছ। এর কাণ্ড মসৃণ ও বাকল ধূসর রঙের। মাথার দিকে ডালপালাগুলো কিছুটা ছড়ানো ধরনের। শীতের শেষে সব পাতা ঝরে পড়ে। আবার বসন্তের একটু ছোঁয়া পেলেই যেন প্রাণ ফিরে আসে। তখন তামাটে রঙের কচি পাতাগুলো হাওয়ায় দোল খায়। তার পরপরই হলুদ সোনালি রঙের সুগন্ধি ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। পরাগ রেণুর প্রলোভনে ছুটে আসে ভ্রমরার দল। এদের মঞ্জরি ছোট হলেও সংখ্যায় অজস্র। হলুদ পরাগচক্রে বহু কেশরের সমাহার। কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতেই নিঃশেষ হয়ে আসে ফুল। গাছতলায় তখন শুধুই ঝরাফুলের রোদন। ফুল ঝরে পড়ার পর লালচে ঢাকনার ভেতর গোল গোল ফল হয়। এই গাছের শিকড় দীর্ঘ ও আঁকাবাঁকা। সাঁওতালরা এই শিকড় সর্প দংশনের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করে। ছালের রস হজমিকারক। কাঠ শক্ত এবং লাঠি, খুঁটি ইত্যাদির উপযুক্ত। কনকচাঁপার আদিনিবাস আমাদের দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ। বৈজ্ঞানিক নামের প্রথম অংশ ওকনা গ্রিক শব্দ, অর্থ হলো নাশপাতি। ওর কোনো কোনো প্রজাতির সঙ্গে নাশপাতির পাতার সাদৃশ্য থেকেই এই নামকরণ। শেষ অংশ স্কোয়ারোজা লাতিন শব্দ, অর্থ হলো রুক্ষ। বৈজ্ঞানিক নাম Ochna squarrosa.
নাগেশ্বর
আমরা এখন যে ফুলটির সৌন্দর্য উপভোগ করছি তার নাম নাগেশ্বর। নাগেশ্বর এই অঞ্চলের অনেক পুরনো ফুল। হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল থেকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারতের অনেক স্থানেই নাগেশ্বর সহজলভ্য। তবে আমাদের দেশে সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় তুলনামূলকভাবে একটু বেশি দেখা যায়। পূর্ব-শ্রীহট্টের লোকগীতিতে নাগেশ্বরকে নিয়ে কয়েকটি পঙ্ক্তি আছে-
‘নাচেন ভালা সুন্দরী লো
বাঁধেন ভালা চুল,
যেন হেলিয়া দুলিয়া পড়ে
নাগকেশরের ফুল।’
দৃঢ়তা, গঠনসৌষ্ঠব, দীর্ঘ জীবন, ফুল ও পাতার সৌন্দর্য এই গাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নাগেশ্বর দীর্ঘাকৃতির বৃক্ষ। কাণ্ড গোল, সরল, মসৃণ ও ধূসর রঙের। এই গাছটি দেখতে অনেকটা পিরামিড আকৃতির। সারা বছর নতুন নতুন পাতা গজানো এই গাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নতুন পাতার রং উজ্জ্বল তামাটে রঙের। পাতা সরু ও মসৃণ, আগা তীক্ষ্ণ। পাতার বিন্যাস এতই ঘনবদ্ধ যে এই গাছ সব সময় ছায়া-সুনিবিড় থাকে। নাগেশ্বর (mesua nagassarium) ফোটার প্রধান মৌসুম হচ্ছে বসন্ত। তবে বছরের অন্যান্য সময়েও ফুল থাকে। পাপড়ির রং দুধ-সাদা। মাঝখানে আছে এক থোকা সোনালি রঙের পরাগ কেশর। সব মিলিয়ে এই ফুল বর্ণে-গন্ধে অনন্য। গৃহসজ্জা ও পূজার উপকরণেও এ ফুল কাজে লাগে। ফলের রং প্রথমে তামাটে, পরে ধীরে ধীরে বাদামি রং ধারণ করে। বীজ তেল জ্বালানি ও বাতের মালিশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফুল থেকে তৈরি আতরও উৎকৃষ্ট মানের। এই গাছের কাঠ উৎকৃষ্ট মানের। ইদানীং ঢাকার বিভিন্ন পার্ক ও পথপাশে বেশ কিছু নাগেশ্বর চোখে পড়ে।
ডুলিচাঁপা
২০০৭ সালের ১৪ জুলাই ডুলিচাঁপার একটি চারা রোপণ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক গার্ডেনে। বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়েই চারাটি রোপণ করা হয়। অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা মৌলভীবাজার জেলার পাথারিয়া পাহাড় থেকে ডুলিচাঁপার দুটি চারা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন ঢাকায়। আরেকটি রোপণ করা হয় রমনা পার্কে।
মাত্র চার বছরের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছটিতে প্রথম ফুল ফুটেছে ২০১০ সালের গ্রীষ্মে। পরের বছরও একই নিয়মে ফুল ফুটেছে। খবরটি নিঃসন্দেহে আনন্দদায়ক। শেষ পর্যন্ত আমাদের বুনো ম্যাগনোলিয়ার অভিষেক ঘটল নগর উদ্যানে। তবে আমাদের দেশে বহুল পরিচিত ম্যাগনোলিয়া হচ্ছে উদয় পদ্ম, যা হিমালয় অঞ্চলের আদি ফুল।
ডুলিচাঁপা (magnolia pterocarpa) বেশ বড় এবং চিরসবুজ গাছ। মাথা গোলাকার, পাতা বড়, ২০ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার লম্বা, মাথার দিক চওড়া, বোঁটার দিকে ক্রমান্বয়ে সরু, চার্ম ও মসৃণ, আগা ভোঁতা, বোঁটা খাটো। ডালের আগায় পুরুষ্টু বোঁটায় একক ফুল ফোটে। ফুল বড়, ১০ সেন্টিমিটার চওড়া, সাদা ও সুগন্ধি। পাপড়িসংখ্যা ৬, ডিম্বাকৃতি ও পুরুষ্টু। ফলগুচ্ছ ১২ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার লম্বা, চার থেকে ছয় সেন্টিমিটার চওড়া। ছোট আকৃতির এই ফলগুলোর আগা সামান্য লম্বা ও চোখা। বীজ কমলা রঙের। সিলেট ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বনেও থাকতে পারে। এরা Magnoliaceae পরিবারের সদস্য। চারা কিংবা কলমের মাধ্যমে এই গাছটি আমাদের চারপাশে ব্যাপক পরিমাণে রোপণ করা প্রয়োজন। এমনকি ডুলিচাঁপার একটি এভিন্যুও তৈরি করা যেতে পারে। যদি তা করা সম্ভব হয় তাহলে নিঃসন্দেহে একটি বড় কাজ হবে। কারণ অন্তত আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে আমাদেরও একটি ম্যাগনোলিয়া আছে। সৌন্দর্য ও সুগন্ধের জন্য ম্যাগনোলিয়া সারা বিশ্বেই ব্যাপক সমাদৃত।
সুলতানচাঁপা/কন্ন্যাল
উপকূলীয় জেলাগুলোতে সহজলভ্য। সুলতানচাঁপা (Calophyllum inophyllum) চিরসবুজ গাছ, লম্বাটে গড়ন, ১২ মিটার উঁচু হতে পারে। পাতা ঝলমলে সবুজ, আগা গোল। স্থানানুসারে গ্রীষ্মের শেষ থেকে শীত অবধি সুগন্ধি ফুল ফোটে। শাখায়িত মঞ্জরিতে ছোট ছোট সুগন্ধি সাদা ফুল দুই ধরনের। চার-গুচ্ছের পুংকেশর হলুদ রঙের। হয়তো বা প্রাচীন সুলতানদের মন জয় করেছিল এই ফুল। সে কারণেই এমন নামকরণ।
দোলনচাঁপা
দোলনচাঁপা (hedychium coronerium) কন্দজ, বর্ষজীবী গাছ। ৬০-৮০ সেমি উঁচু, কাণ্ডের পাশে কয়েকটি লম্বা লম্বা পাতা থাকে। আগায় সাদা ফুলের থোকা, সুগন্ধি, প্রজাপতির গড়ন, দুটি বড় পাপড়ি। বর্ষার ফুল, ফোটে সন্ধ্যায়। ছায়া ও ভেজা মাটি পছন্দ।
ভুঁইচাঁপা
ভুঁইচাঁপাও (kaempferia rotunda) বর্ষজীবী। ইদানীং খুব বেশি দেখা যায় না। অন্যান্য নাম ইন্ডিয়ান ক্রকাস, পিকক জিন্জার ইত্যাদি। দু-এক পশলা বৃষ্টি হলে মাটি ফুঁড়ে পাতাগুলো বেরিয়ে আসে। পাতা চ্যাপ্টা, শিরা স্পষ্ট। পাপড়ি বিক্ষিপ্ত, কেন্দ্রে বেগুনি রঙের ছোপ। দূর থেকে দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো।