বিপিন পাল ও আমাদের পুতুলনাচ

পুতুলনাচ ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রচলিত একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। গ্রামীণ জনপদে আবালবৃদ্ধবনিতার, বিশেষ করে শিশুদের বিনোদনে পুতুলনাচ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে দীর্ঘদিন।
জনশ্রুতি রয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের বিপিন পাল প্রথম এই উপমহাদেশে পুতুলনাচের প্রবর্তন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার তিতাস নদীর কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা জনপদ কৃষ্ণনগর গ্রামে বিপিন পালের জন্ম। এই কৃষ্ণনগর গ্রামেই রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি জমিদারবাড়ি। বিপিন পাল শুরুতেই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিপিন পালের দলের নাম ছিল ‘গোবিন্দ পুতুলনাচ’। গোবিন্দ ছিল বিপিন পালের ছেলে। বিপিন পাল বিভিন্ন পূজা-পার্বণে পুতুলনাচের মাধ্যমে ধর্মীয় পালা পরিবেশন করতেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের কিছুদিন পর বিপিন পাল মারা গেলে তাঁর ছেলে গোবিন্দ পাল সপরিবারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্যাগ করে চলে যান ভারতে। তাঁদের অনুপস্থিতিতে দলটি মারাত্মক সংকটে পড়ে। এ সময় দলের হাল ধরেন গিরিশ আচার্য্য। পরবর্তী সময়ে তাঁর হাত ধরেই এ দেশে পুতুলনাচের একটি নতুন ধারা সৃষ্টি হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রখ্যাত পুতুল নাট্যশিল্পী ধন মিয়া এ দলের সদস্য হিসেবে পুতুলনাচ রপ্ত করেন।
১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে ধন মিয়া গিরিশ আচার্য্যের দলে কাজ শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যে গিরিশ আচার্য্য চলে যান ভারতে। দলের হাল ধরেন ডেঙ্গু মাঝি। ধন মিয়া কাজ করতে থাকেন ডেঙ্গু মাঝির সঙ্গে। এর পর গিরিশ আচার্য্যের দলের আরেক সদস্য তালশহর গ্রামের কালু মিয়া স্বতন্ত্র একটি দল গঠন করেন। কালু মিয়া ও ধন মিয়া পুতুলনাচের প্রথম পর্যায়ের মুসলমান শিল্পী।
ধন মিয়া হিন্দু বা পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে নিজস্ব ভঙ্গিমায় পুতুলনাচ করতেন। পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচে নতুনত্ব আনেন শহরের মেড্ডার ধন মিয়া। তিনি কৃষ্ণনগর গ্রামের গিরিশ আচার্য্যের দলে পুতুলনাচের তালে তালে গান করতেন। শেষ পর্যন্ত ধন মিয়া নিজেই পুতুলনাচের প্রদর্শনী করতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত পুতুলনাচের দল ‘রয়েল বীণা অপেরা’। ধন মিয়া পুতুলনাচের যে কাহিনীগুলো প্রদর্শন করতেন, তা হলো ‘বড়শি বাওয়া’,‘বাঘের কাঠুরিয়াকে ধরে নেওয়া’, ‘বৈরাগী-বৈরাগিণীর ঝগড়া’ প্রভৃতি। শুধু পৌরাণিক কাহিনী নয়, পুতুলনাচের মাধ্যমে দলগুলোর জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও পরিচালনা করেন তিনি।
প্রথম দিকে পুতুলনাচ পরিবেশিত হতো বিভিন্ন কাহিনীর ভিত্তিতে। অনেকটা পালাগানের মতো। এসবের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের লীলা, রাম-লক্ষ্মণের বনবাস, সীতাহরণ, জয় হনুমান, সতী সাবিত্রী, বেহুলা ভাসান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এর পর এই শিল্পে মুসলমান শিল্পীদের প্রাধান্য বিস্তারের ফলে পুতুলনাচের কাহিনী ও বিষয়বস্তুতে কিছুটা পরিবর্তন হয়। পৌরাণিক কাহিনীর স্থান দখল করে লোকায়ত বিষয় এবং কাহিনী। যেমন—বাঘ শিকার, মাছ ধরা, কুমির ও কাঠুরে, ময়ূরপঙ্খী নাও, রহিম বাদশা ও রূপবান কন্যা, পরীদের কাহিনী, রাজকন্যা ও রাজকুমার, বাউল গায়েন, কৃষককন্যা, কৃষক পরিবার, গ্রামীণ জীবনচিত্র (যেমন—কলসিতে পানি আনা, ধানকাটা ও সংগ্রহ, কৃষকের হালচাষ) প্রভৃতি কাহিনী অন্যতম। দেশীয় পালাগানের ঢঙে পরিবেশিত এসব কাহিনীর পুতুলনৃত্য বিমুগ্ধ করত দর্শককে। এ সময় যন্ত্রের ব্যবহারও ছিল কম। ছিল পাতার বাঁশি ও হারমোনিয়াম। সঙ্গে ছিল আরো কিছু দেশীয় বাদ্যযন্ত্র। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুতুলনাচের আঙ্গিক ও বৈশিষ্ট্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন বিষয় হিসেবে এসেছে এইডস, মাদক, হাত ধোয়া দিবস, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, এসিড প্রতিরোধ সম্পর্কে জনসচেতনতা প্রভৃতি।
অতীত বনাম বর্তমান। আগের পুতুলনাচের সঙ্গে এখনকার পুতুলনাচের বিস্তর ফারাক ঘটেছে। নানা ধরনের আর্ট ফর্ম এতে এসে মিশেছে। শুধু পুতুলনাচ ছাড়াও এখন পাপেট থিয়েটার, সিনেমাও হচ্ছে। নাটক বা সিনেমার ক্ষেত্রে প্রথমে গল্প বাছা হয়। চিত্রনাট্য লেখা হয়। চরিত্র বুঝে আঁকা হয় পুতুলের ছবি। সে অনুযায়ী কাঠ, থার্মোকল, ফোম, পেপার ম্যাস বা পাল্প দিয়ে বানানো হয় পুতুল। এতে রং, গয়না, কাপড় পরিয়ে সাজানো হয়। নাটকের ক্ষেত্রে এর পর সেই পুতুলগুলো দিয়ে মঞ্চে পারফর্ম করানো হয়। সিনেমার ক্ষেত্রে ক্যামেরা ব্যবহার করা হয় নানা লোকেশনে নিয়ে গিয়ে। শোয়ের সময় পুতুলের হয়ে কথা বলেন পাপেটিয়ার নিজে। অনেক সময় রেকর্ড বাজানো হয়। পুতুলনাচের জন্য আবহ, গান, এমনকি কোরিওগ্রাফ পর্যন্ত করা হয়। এ ছাড়া পাপেট শো তো এখন পড়াশোনার আঙিনায়ও ঢুকে পড়েছে। বিদেশে অনেক আগেই পাপেট শো কোর্স রয়েছে। জানা গেছে, সম্প্রতি অন্ধ্রপ্রদেশে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় পাপেট ব্যবহার করা হচ্ছে। কারণ, পাপেট শো ছোট-বড় সকলে এতটাই উপভোগ করে যে এর মাধ্যমে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায় সমাজের সর্বস্তরে। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী বা অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের শিক্ষাদানে খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখছে পাপেট্রি বা পুতুলনাচ। এ ছাড়া বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিক প্রচার-প্রচারণা থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন, সব ক্ষেত্রেই হচ্ছে এর হরদম ব্যবহার।
পাপেট্রি এক ধরনের অ্যানিমেশন। কার্টুনকে যেমন আঁকার পর ক্যামেরার সাহায্যে গতি দেওয়া হয়, এটাও অনেকটা তাই। তবে ক্যামেরার বদলে এখানে গতি দেয় মানুষ। বিপিন পাল, ধন মিয়া, মুস্তাফা মনোয়ার, শরীফুল ইসলাম মালদার, রাজু মিয়া, কালু মিয়া ও নাম জানা-অজানা অসংখ্য মানুষ নানাভাবে জড়িয়ে ছিলেন ও আছেন এই শিল্পের সঙ্গে।