ফুটবল, রূপকথা ও বাস্তবতা
সাংবাদিক, লেখক ও ঔপন্যাসিক এদোয়ার্দো গালিয়ানোর জন্ম উরুগুয়েতে, ১৯৪০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। লেখালেখির মাধ্যমে আজীবন তিনি লাতিন আমেরিকার অতীত ও ঐতিহ্যকে খুঁজে বেরিয়েছেন। তাঁর বইগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘মেমরিজ অব ফায়ার’, ‘ডেইজ অ্যান্ড নাইটস অব লাভ অ্যান্ড ওয়ার’। ফুটবল নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বই ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’। এদোয়ার্দো গালিয়ানোর আরেকটি বিখ্যাত কাজ ‘ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা’। ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল ৭৪ বছর বয়সে উরুগুয়েতে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান গালিয়ানো।
লেখাটি ‘প্লে দ্য গেম’ নামে খেলাধুলাভিত্তিক ড্যানিশ একটি এনজিও সংস্থার অনলাইন পোর্টাল থেকে নেওয়া। মূল লেখাটি ১৯৯৭ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটি অনুবাদ করেছেন হাসনাত শোয়েব।
১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে লিমায় কমান্ডোরা জোরপূর্বক জাপানিজ রেসিডেন্সে ঢুকে ফুটবল খেলারত দখলদার গেরিলাদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। গেরিলাদের নেতা নেস্তর চেরপা কার্তোলিনি, যিনি কি না প্রিয় ক্লাব অলিয়েঞ্জের জার্সি পরিহিত অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন।
ঠিক একই সময়ে মন্টেভিডিওতে ১৫০ জন আবর্জনা সংগ্রহকারী পদে নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়। বরাবর ২৬ হাজার ৭৭৮ জন ওই পদে আবেদন করেন। এত বড় ভিড় সামলানোর জন্য শহরের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম সেন্তেনারিওতে লটারির ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে ১৯৩০ সালে উরুগুয়ে প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিল। পুরোনো দিনের আনন্দময় স্মৃতিকাতর মাঠটি সেদিন বেকার যুবকদের দীর্ঘশ্বাসে ভরে উঠছিল। ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে ভেসে উঠছিল সেসব সৌভাগ্যবানের নাম, যাঁদের নির্বাচন করা হয়ছিল।
লাতিন আমেরিকায় এমন কিছু ঘটে না, যা কোনো না কোনোভাবে ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত নয়। এটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রাখে এবং এ সময়ে সবচেয়ে বেশি স্থানও। আর মতাদর্শকে অস্বীকার করা সত্ত্বেও যাঁরা মানবতা ভালোবাসেন, কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন না।। ডানপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মতে, ফুটবল প্রমাণ করেছে সেসব মানুষ পা দিয়েই চিন্তা করে। এবং বামপন্থীরা মনে করে এটাই কারণ, কেন মানুষ একেবারেই কোনো কিছু চিন্তা করে না।
কিন্তু এ রকম অপমানও রক্তমাংসের মানুষের ওপর কোনো প্রভাব রাখতে পারে না। যখন সমষ্টিগত আবেগ পৃথিবীতে শক্তিশালী হয় এবং সফলতা নিয়ে আসে, তারা তখন যেকোনো উৎসব অথবা বিপর্যয়কে ভাগাভাগি করে নিতে পারে। সেইসঙ্গে তারা কোনোরকম আত্মসমালোচনা এবং কৈফিয়ত দেওয়া ছাড়াই টিকে থাকে। পছন্দ হোক বা না হোক, ভালো কিংবা খারাপ যে কারণেই হোক; এই সন্দেহ এবং উত্তেজনার সময়ে এসে অনেক লাতিন আমেরিকান জন্য ফুটবল ক্লাবগুলোর ওপরই সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখছে। বিজয় উদযাপন এবং চরম দুঃখের এটাই অন্যতম উৎস।
‘গতিময়তা হচ্ছে প্রকাশ অযোগ্য আবেগ’—এমনটাই পড়েছিলাম বুয়েন্স আয়ার্সের দেয়ালে। রিও ডি জেনেরিওর দেয়ালে ফ্লুমিনেসের ভক্তরা লিখেছিল, ‘আমার ভালোবাসার বিষ।’ মন্টেভিডিওর দেয়ালে কিছু হাত ক্রোধান্বিত হয়ে লিখে দেখেছিল, ‘প্রিয় পেনারল, তোমাকে এইডসের মতো আমি রক্তে বহন করি।’
সেসব পড়ে আমি তব্দা মেরে যাই। জার্সির জন্য প্রেম কি নারীর জন্য প্রেমের মতোই ভয়ংকর? যেখানে এমনকি ট্যাঙ্গোর মতো উৎসবও সেখানে কোনো আলো ফেলতে পারে না। যেকোনো ক্ষেত্রে ভালোবাসায় পূর্ণ একজন ভক্তকে তাঁর বিয়ের সময়ের আবেগের চেয়েও অনেক বেশি সিরিয়াস দেখায়, কারণ ক্লাবের প্রতি আনুগত্য যেকোনো কিছু করিয়ে নিতে সক্ষম। এবং এটি যে শুধু লাতিন আমেরিকায় ঘটে, তা নয়।
অ্যাঞ্জেল ভাস্কোস ডি লা ক্রুজ নামে এক বন্ধু আমাকে লিখেছিল, ‘আমি সব সময় সেল্টা ভিগোর সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু এখন আমি আছি তাদের চিরশত্রু দেপার্তিভো লা কারুনার সঙ্গে। সবাই জানে তুমি শহর, নারী, কাজ অথবা রাজনৈতিক পছন্দ বদলাতে পারো, এমনকি সম্ভবত উচিতও... কিন্তু তুমি কখনোই দল বদলাতে পারো না। আমি জানি, আমি একজন বিশ্বাসঘাতক। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই, বিশ্বাস করো, আমি এটা করেছি আমার সন্তানের জন্য। সেই আমাকে বুঝিয়েছে। সম্ভবত আমি একজন বিশ্বাসঘাতক কিন্তু আমি একজন মহান পিতা।
স্টেডিয়াম হচ্ছে পৃথিবীর আয়না
ফ্যানাটিক হলো সেইসব ফ্যান, যারা আজন্ম স্নায়বিক বৈকল্যে ভোগে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশের মধ্যে যারা নিজেদের ভালোবাসাকে প্রকাশ করে। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড় রাগিরি যখন বোকা জুনিয়র্স ছেড়ে শত্রুপক্ষ রিভারপ্লেটে যোগ দেন, উগ্র সমর্থকরা তাঁর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তাঁর বাবা-মা, যাঁরা ওই সময় বাড়িতে অবস্থান করছিলেন, তাঁরা আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন।
গত মার্চে হল্যান্ডের শান্ত শহর আমস্টারডামে আয়াক্স ও ফেয়েনোর্দের চারশ উগ্র সমর্থক মিলিত হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রক্তাক্ত সেই আনুষ্ঠানিক সংঘর্ষে একজন নিহত ও অনেকেই আহত হন। আর্জেন্টাইন রিপোর্টার এজকুয়েল ফার্ন্দানেজ মোরেস মন্তব্য করেছিলেন, ‘তারা এটা ঠিক করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কিন্তু লাঠিসোটাসহ এটি রূপ নেয় মধ্যযুগীয় বর্বরতায়।’
হিংস্রতা ফুটবলকে সেভাবে কলঙ্কিত করেছে, যেভাবে এটি পৃথিবীর অন্য সবকিছুকে কলঙ্কিত করেছে। ইতিহাসবিদ এরিক হবসবমের মতে, ‘হত্যা, নির্যাতন এবং গণনির্বাসন এখন দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যা এখন আর কাউকে অবাক করে না।’
গণমাধ্যম কি ফুটবলের খারাপ প্রভাব সম্পর্কে নিজেদের জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে না? এই খেলাটা কি একপাল গৃহপালিত ভেড়ার রক্তখেকো নেকড়েতে পরিণত হওয়ার কারণ?
উত্তর খুব সহজ, যদি কেউ দেখেও না দেখার ভান না করে। স্টেডিয়ামের দর্শক মাঝেমধ্যে পুঞ্জীভূত হতাশা এবং নিঃসঙ্গতা থেকে কুৎসিত রূপ ধারণ করে, যা এই শতকের শেষ থেকে পুরো বিশ্বের চরিত্রকে চিহ্নিত করে আসছে। এবং এ ধরনের উদ্বেগ স্টেডিয়ামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, যেটা আমরা অন্যান্য ক্ষেত্রে যে সহিংস আচরণ করি তার চেয়ে কম না।
গ্রিসে পেরিক্লিসের সময়ে তিন ধরনের আদালত ছিল, যার একটিতে বিচারকরা বস্তুকে তথা ছুরিকে শাস্তি দিত। উদাহরণস্বরূপ অপরাধকালীন যে ছুরি ব্যবহার করা হয়েছে তাকে টুকরো টুকরো করে অথবা সমুদ্রে ছুড়ে দিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। আজকের দিনে যদি একইভাবে বলকে শাস্তি দেওয়া হয়, সেটি কি ন্যায্য হবে? ফুটবলের নামে যে অপরাধ হয়, তার জন্য কি ফুটবল দায়ী?
যারা ফুটবলকে পিশাচায়িত করে এবং চূড়ান্ত অর্থে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করে, তারাও ফুটবল ফ্যানাটিকদের মতোই যুক্তিহীন ও উগ্র। তারাও উগ্র ফুটবল সমর্থকদের মতো একই ভুল করে, যারা বিশ্বাস করে ফুটবল হচ্ছে জনগণের জন্য আফিম। ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদদের জন্য ভালো ব্যবসা। তারা সবাই খেলার মাঠকে মনে করে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ এবং তারা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়, তারাও সেই একই পৃথিবীর মানুষ। আসলে এমন কোনো প্যাশনের কথা আদৌ বলা যাবে, যা পৃথিবীব্যাপী কর্তৃত্বময় শক্তি দ্বারা ব্যবহার এবং পরিচালিত করা হয় না?
আত্মপরিচয়ের খোঁজে
বাস্তবতা আমাদের জানায়, অন্য সবকিছুর চেয়ে ফুটবল মাঠে অনেক বেশি হিংস্রতা দেখা যায় অথবা এটি অর্থ, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং সমষ্টিগত উন্মাদনার অন্যতম উৎসও বটে। এ ছাড়া খেলার মাঠ দক্ষতা প্রদর্শনের স্থানও, যেখানে জারি থাকে সুন্দরের লড়াই এবং নানাবিধ যোগাযোগও এর মাধ্যমে হয়ে থাকে। এটি খুব কমসংখ্যক স্থানের মধ্যে একটি, যেখানে শুধু একটি মুহূর্তের জন্য গরহাজিররা নিজেদের হাজির করে। যদিও এই কৃতিত্ব দেখানো গরিব মানুষ এবং গরিব দেশের পক্ষে সম্ভব না।
হেলেনীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের রীতি আমাদের জোয়ান আন্তোনিও সামারাঞ্জের সময় থেকে আড়াই হাজার বছর আগের অলিম্পিককে স্মরণ করিয়ে দেয়। সে সময়, যখন অ্যাথলেটরা নগ্ন হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিত এবং তাদের শরীরে কোনো বাণিজ্যিক ট্যাটু থাকত না। গ্রিক সভ্যতা নিজস্ব আইন এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাজারো শহরের জন্য বিধান তৈরি করে।
অলিম্পিয়ার স্টেডিয়ামগুলোতে অনুষ্ঠিত খেলাগুলো ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মতো, যা তাদের জাতীয় পরিচয়কে পুনর্গঠিত করত। যেভাবে সেখানকার বৈচিত্র্যময় মানুষগুলো তাদের অন্তর্গত দ্বন্দ্বের মিশ্রণে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকত। তারা বলত, আমাদের বানানো হয়েছে খেলার জন্য, যা মূলত ইলিয়াড এবং অথবা ওডিসি থেকে আবৃত্তি করার মতো। এগুলো সেই কবিতা, যার ওপর জাতিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
সম্ভবত অন্য যেকোনো খেলার চেয়ে বেশ উচ্চমাত্রায় বর্তমান সময়ে ফুটবল আমাদের জীবনে একই কাজটাই করছে। ফুটবলের এই শিল্পায়ন খেলাটিকে টেলিভিশনের পর্দায় সবচেয়ে সফল সর্বজনীন অনুষ্ঠানে পরিণত করেছে, যা খেলাটিকে একটা অভিন্ন শৈলী দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে এবং এর অনেক চরিত্রকে মুছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও।
কিন্তু ফুটবলের বৈচিত্র্য দারুণভাবে ও দৈবক্রমে টিকে থাকে এবং আমাদের অবাক করতে থাকে। তুমি পছন্দ করো বা না করো, বিশ্বাস করো বা না করো ফুটবল সমষ্টিগত সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিব্যক্তি। বাধ্যতামূলক বিশ্বায়ন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই পৃথিবীর মিথ্যা অবশেষসমূহ যা পৃথিবী বিপুল পরিমাণে ধারণ করে রেখেছে।
দক্ষিণের দেশগুলোয় এমন কোনো স্থানিক প্রাচুর্যতা নেই, যা তার আত্মপরিচয়কে নিশ্চিত করতে পারে। তাদের এই বলে নিন্দা করা হয় যে, সর্বজনীনভাবে জোরপূর্বক ব্যয় চাপিয়ে দেওয়ার ফলে জীবনাচরণে তারা অনুকরণ প্রিয় হয়ে ওঠে। জাতীয় শিল্প চাপে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বশাসিত উন্নয়নের যে পরিকল্পনা তা-ও ভণ্ডুল হয়ে যায়। ফলত, রাষ্ট্র ক্রমশ ভেঙে পড়তে থাকে। সার্বভৌমত্বের যে চিহ্ন তা-ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সেসব দেশ, যারা বিশ্বের বিশাল বস্তিতে পরিণত হয়েছে, তাদের অল্পই সুযোগ থাকে নিজেদের অস্তিত্বের অহংকার এবং অধিকার যাচাই করার জন্য।
তাদের উচিত অধিকারের সপক্ষে আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজন কর্তৃক নির্ধারিত দাসত্বের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করা এবং সেইসঙ্গে মিডিয়ার সে অংশের বিরুদ্ধেও যারা, তাদের খেলতে বাধ্য করে।
আমরা সব সময় পড়ে এসেছি, শুনে এসেছি এবং দেখে এসেছি কলম্বিয়া একটি সহিংস দেশ। কিন্তু আসলেই কি কলম্বিয়া সহিংস দেশ? এটা কি প্রকৃতিগতভাবে এবং ভাগ্যগুণেই সহিংসতার জন্য দায়ী? কলম্বিয়ানরা কি জিনগতভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে জন্মায়? অথবা দেশটি কি একজন বন্দির জন্য ভয়াবহ মৃত্যুপুরী, যা দায়মুক্তিকে জ্বালানি হিসেবে এবং অপরাধের অজুহাত হিসেবে অদৃষ্টবাদকে দাঁড়া করায়? কিন্তু বিষয়টা আসলে কি আরো অনেক বেশি জটিল এবং স্ববিরোধী না, প্রথমবার দেখাতে যতটা মনে হয় তার চেয়ে?
আমার এই উপদেশ যে সহিংসতা বিশেষজ্ঞ হয়ে ফতোয়া দেওয়ার আগে তাদের কিছু কলম্বিয়ান মিউজিক শোনা উচিত। উদাহরণস্বরূপ বিখ্যাত ভ্যাল্লেনাতোস বাদক আলজেও দুর্নের কথা বলা যায় এবং সেইসঙ্গে কলম্বিয়ান জাতীয় দলের ফুটবল খেলা দেখা যেতে পারে, যা তারা মানুষের আনন্দের জন্য হৃদয় দিয়ে খেলে।
আমি বিশেষভাবে সুপারিশ করব, ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়েম্বলিতে অনুষ্ঠিত কলম্বিয়ান গোলরকক্ষক রেনে হিগুইতার গোল বাঁচানোর বিখ্যাত সেই ছবিটা নিয়ে একটু যেন তারা গবেষণা করে। এই রকম সেইভ, এর আগে কোথাও দেখা যায়নি। যখন তার শরীর মাটি ও বায়ুর সমান্তরালে হাওয়ায় ভাসতে থাকে এবং বলটি কলম্বিয়ান গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছিল। এরপর আচমকা সে তার বুটের পেছনের অংশ দিয়ে বলটিকে এমনভাবে আটকে দেয়, যেভাবে বিচ্চু তার লেজ বাঁকিয়ে কামড়ে দেয়। কিন্তু বাক্যবাগীশরা এর কোনো কৃতিত্ব হিগুইতাকে না দিয়ে এমনভাবে কানাকানি করতে লাগলো যেন সে অমার্জনীয় কোনো অপরাধ করে ফেলছে।
ফুটবলই বিশের দশকে উরুগুয়েকে পরিচিত করে তোলে। এই ছোট দেশটির জনসংখ্যা পার্শ্ববর্তী দেশের শহর বুয়েন্স আয়ার্স অথবা মেক্সিকো সিটির একটির বস্তির চেয়েও কম। এরাই ফুটবলকে বেছে নিয়েছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের প্রকাশ করার জন্য এবং নিজেদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য। যদিও এখন এটি বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি নস্টালজিয়ায় টিকে আছে।
যদিও আমরা যেভাবে খেলি, সেটা দিয়েই আমাদের অনুমান করে নেওয়া হয়। আমরা উরুগুইয়ানরা বারবার খেলার মাঠে নিজেদের অসহায়ত্ব দেখে হতাশ হয়ে পড়েছি। আমাদের ফুটবল বেড়ে উঠছে বিরক্তিকর এবং নোংরামির মধ্যে দিয়ে, যেভাবে অবক্ষয়ের ফলে রাষ্ট্র ক্রমশ নিচের দিকে নেমেছে। ফলে জনশিক্ষা ও স্বাস্থ্য শিক্ষার মতো জায়গাগুলোও কমতে কমতে এখন প্রায় নাই হয়ে গেছে।
আমাদের সেরা খেলোয়াড়রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। খুব কমসংখ্যক বাচ্চা এখন খেলার জন্য মাঠে আসছে এবং খেলার প্রতি আগ্রহ পোষণ করছে।
খেলোয়াড় রপ্তানির বিষয়টা এমন যে, যখন একজন যোগ্য খেলোয়াড়ের উত্থান হয়, তাকে উচ্চ বেতনে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অথচ স্থানীয় চ্যাম্পিয়নশিপগুলো ক্রমশ দারিদ্র্য, দৈন্য এবং দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছে। তবুও এখনো বিশ্বাস অটুট আছে। ফুটবল আজো এখানে জাতীয় ধর্ম এবং প্রতি রোববার আমরা মিরাকলের জন্য অপেক্ষা করি। এখনো সবাই মিলে আশ্রয় গ্রহণ করে শেষবার ১৯৫০ সালে যখন মারাকানায় ব্রাজিলকে হারিয়ে উরুগুয়ের বিশ্বকাপ জিতেছিল, সেই স্মৃতির প্রতি। এই কৃতিত্বের ৫০ বছর হতে চলল, কিন্তু প্রতিটি ঘটনা আমরা এমনভাবে স্মরণ করি যেন এটি গত সপ্তাহে ঘটেছে এবং এর পুনরুজ্জীবনের আশায় আমরা আমাদের বিশ্বাসকে আরো শক্তিশালী করে তুলি।
অর্থ সত্ত্বেও ফুটবল সর্বজনীন প্যাশন
যদি ফুটবলকে সেসব দেশের মধ্যে সীমিত করে দেওয়া হয়, যারা এর জন্য সবচেয়ে বেশি খরচ করে, তবে এটি তেমন কোনো উদ্দীপনা তৈরি করতে পারবে না। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো যারা সবচেয়ে কম খরচ করে, খেলোয়াড়দের বাইরে পাঠানোর জন্য যাদের নিন্দামন্দ করা হয়। অথচ এই দেশগুলো আন্তর্জাতিক এবং ক্লাব পর্যায়ে একের পর এক শিরোপা জিতে চলেছে। এখানে ইউরোপ কত খরচ করেছে, সেটা কোনো বিষয়ই না।
পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র হচ্ছে আফ্রিকান ফুটবল। তারাই এখন বিনয় এবং উৎসব নিয়ে দৃশ্যপটে হাজির হচ্ছে এবং কোনো কিছুই তাদের আটকাতে পারবে না।
পেশাদার ফুটবল, যা এখন সবচেয়ে লাভজনক প্রদর্শনী শিল্প। যার সব কাজ কেবল অর্থলাভের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তবুও এটা এখনো সর্বজনীন আবেগের বিষয়। কারণ, কোনো এক দৈব বলে এটা আমাদের চমক দেখিয়েই যাচ্ছে। চমকে দেওয়ার এই যে ক্ষমতা তা লালিত হয় মূলত বিস্মৃত পৃথিবীর দ্বারা।
সমস্ত প্রতিকূলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ১৯৯৬ সালের অলিম্পিক জিতে নেয় নাইজেরিয়া। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় রোনালদো নামের বর্ণসংকর এক যুবক। রিওর আশপাশে দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে যার বেড়ে ওঠা। ১৪ বছর বয়সে যে কি না ফ্ল্যামিংগোর হয়ে খেলতে পারেনি বাস ভাড়া না থাকার কারণে।
কিছু অপ্রত্যাশিত ব্যতিক্রম ছাড়া সুযোগের অসমতাই ছিল এই শতকের শেষ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য চরিত্র, যা শুরু বিভিন্ন দেশের অপুষ্টিজনিত অপূর্ণতায় ভোগা খেলোয়াড়দের সবকিছু শুষে নেয়। ১৯৯৪ সালের বাছাইপর্বের ম্যাচে ইরিত্রিয়ান ফুটবলাদের খেলার জন্য কেবল বল ছিল, কিন্তু কোনো বুট ছিল না। আর ডেনমার্কের সঙ্গে ম্যাচ শেষে জার্সি বদলের পর আলবেনিয়ার খেলোয়াড়দের কাছে আর পরবর্তী ম্যাচের কোনো জার্সি ছিল না।
সমৃদ্ধি ও দারিদ্র্য সব সময় পরস্পরবিরোধী থাকে, যাদের কখনো একই সমতলে দেখা যায় না। সেটা ফুটবল হোক কিংবা অন্য কোথাও। তা সে যত বড় গণতান্ত্রিক দুনিয়া হোক না কেন। যদি সত্যি বলতে হয়, পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণে একটি মাত্র জায়গা আছে, যেখানে সমতা বিধান সম্পন্ন হয়েছে। সেটা হলো ব্রাজিলের অ্যামাজানের তীর ঘেঁষে ফাজেনদিনহা শহরের একটা মাঠ। নিরক্ষরেখা বরাবর এই মাঠ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। যার ফলে প্রতিনি দল একার্ধে দক্ষিণ গোলার্ধের হয়ে পরের অর্ধে খেলে উত্তর গোলার্ধের হয়ে।
কিন্তু এটা সত্য। সবকিছুর পরও ফুটবল হলো সর্বজনীন আবেগের বিষয়। পায়ের এই শিল্প একটা সাধারণ ভাষায় পৃথিবীর সব দেশে এবং উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম সব সংস্কৃতিতে বলটিকে হাসাতে অথবা কাঁদাতে পারে। মার্কিন দেশে ফুটবল সবেমাত্র মানুষকে বিনোদিত করতে শুরু করেছে, সেখানে ফুটবল এখনো তেমন জনপ্রিয় প্যাশন নয়। কিন্তু এর একটা বাণিজ্যিক আবেদন নিশ্চয় আছে, যার সম্পর্কে বেশ কিছু বড় কোম্পানি যথেষ্ট সচেতন।
ফুটবলের ব্যবসা
অনেক বছর ধরে কোকা-কোলা আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত। নাইকির ৪০০ মিলিয়ন ডলারে বিশ্বের সেরা দলটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ইতিহাসও খুব বেশিদিন আগের না। ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশন কেবল সুন্দর পোশাক দেওয়ার জন্য নাইকিকে একচেটিয়া অধিকার দেয়নি, এটি ব্রাজিলের ফুটবলকেও বিক্রি করছে। এ বছর প্রীতি ম্যাচে ব্রাজিল যখন মেক্সিকোকে ৪-০ গোলে হারাল নাইকি প্রমাণ করেছে, এখানে কোচের চেয়ে মাথায় মোড়ানো তাদের নাম লেখা কাপড়টির অবদান বেশি। ব্রাজিল কোচ জাগালো রোমারিওকে শুরু একাদশে নিতে চাননি; কিন্তু কোম্পানির কারণে তাকে দলে রাখতে হয়। যার ফলেই রোমারিও ও রোনালদো মিলে এই শাইনিং ড্রিম টিমের বিধ্বংসী জুটি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
ওই সময় মিডিয়াগুলোতে বার্সেলোনার তারকা রোনালদোর রোমের ক্লাব লাজ্জিওতে যাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছিল। নব্বই মিলিয়ন ডলারে এই তার এই দলবদল হচ্ছে—এমন গালগল্পও শোনা গিয়েছিল এবং সে সময় নাইকির সঙ্গে রোনালদোর ১৭ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। যখন লাজ্জিওর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিল উমব্রু, যা আবার সব খেলোয়াড়ের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল।
নাইকি লাতিন আমেরিকার স্পোর্টস ফুটওয়্যারের মার্কেটের বিশাল একটা অংশ দখল করে রেখেছে। যার মধ্যে বাজারমূল্য প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার এবং এটি প্রতি অর্থবছরে ২০ শতাংশ করে বাড়তে থাকে। ক্রীড়াসামগ্রী এবং বলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। জার্মান কোম্পানি এডিডাস ও পুমা যার মালিকানা ছিল ডেসলার ব্রাদার্সের কন্যার, খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যাকে এই ব্যবসার রানী বলা হতো। তারা নাইকির কাছে রাজত্ব হারায় এবং সেইসঙ্গে সেসব দেশীয় উদ্যোক্তাও, যারা ফুটবল নিয়ে কিছুটা ভাবত।
দেশের উৎপাদনকারী? অথবা গ্লোবালাইজেশনের দয়ায় একটি দেশের উৎপাদনকারী সংস্থা, যারা বিভিন্ন দেশে উৎপাদন করে? নাইকি হচ্ছে এমন একটি কোম্পানি, যাদের প্রায়ই শিশু শ্রমের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে নাইকি এবং অন্যান্য বহুজাগতিক কোম্পানিগুলো ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের কাছে শপথ নিয়ে বলে তারা পাকিস্তানে কিংবা অন্য কোথাও দাসের মতো হিসেবে শিশুদের ব্যবহার করবে না। অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও তাদের এই ঘোষণা স্বীকারোক্তিতে পরিণত হয়। এটা একটা সাধারণ জ্ঞানের বিষয়।
লোকে বলে, ‘ফুটবল একটা ব্যবসা।’ সাধারণ জ্ঞানে দেখলে, তারা সঠিক। এটা অনেকটা ‘রাজনীতি হচ্ছে ব্যবসা’ এ রকম বলার মতোই। কিন্তু কেউ একজন জিজ্ঞেস করতেই পারে, আজকের দিনে এমন কী আছে, যা ব্যবসা না? যৌনতা কি ব্যবসা নয়, এটি কি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্ররোচিত করার সবচেয়ে পছন্দের বিষয় নয়? এবং যে কেউ যে উপসংহারে পৌঁছবে, তার মানে কি হবে যৌনতা লাভজনক নয়? সে অনুযায়ী জানামতে, এটা একটি মহাআনন্দের বিষয় হিসেবে অব্যাহত থাকে।
যদি সে পদ্ধতি, যাকে পুঁজিবাদ নামে ডাকা হয়, যেটি এখন চালিত হয় বাজার অর্থনীতির অধীনে। সে তার সবচেয়ে খারাপ শত্রু, যেমন—চে গেভারা কিংবা ম্যালকম এক্সের স্মৃতিকে ব্যবহার করে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং গণভোগের জন্য তাদের পণ্যে রূপান্তরিত করে। তাহলে স্পোর্টস কীভাবে লাভজনক সেবা হওয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে পুঁজিবাদ থেকে বাঁচাতে পারে?
মোটের ওপর, এ মূল্যই যে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে তা স্পষ্ট বোঝা যায় যে কোনো রাষ্ট্রের ভ্রমণকর্তাদের কথায় যারা বিশ্বের প্রতিটি দরজায় গিয়ে সেলসম্যানদের মতো, প্রথমে বিনিয়োগের কথা বলে, দ্বিতীয়ত বলে বাণিজ্য সম্পর্কে, তার পর বলে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কের কথা, যা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। এই শেষ কথাটি এ জন্য বলা হয়, কারণ দোষ স্বীকারের এই গুণ ন্যূনতম একটা ছোট্ট পুণ্যও বটে এবং বিনয়ও কখনো কখনো লাভজনক হয়ে উঠতে পারে।
হ্যাঁ, ফুটবল একটা ব্যবসা, এ বিষয়ে সন্দেহের কিছু আছে কি? কোনো কোনো দেশে এটা বেশ লাভজনক। যেমন—ইংল্যান্ডে যেখানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও টটেনহাম হটস্পার স্টক মার্কেটে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে এবং নিউক্যাসল ও লিভারপুলের মতো দলগুলো সেই পদাঙ্ক অনুসরণের পরিকল্পনা করে। এবং এটা সেসব দেশেও ব্যবসা, যেখানে কেবল শুরুর পর্যায়ে আছে, যেমন—ডমিনিকান রিপাবলিক। যেখানে ১৯৯৬ সালের চ্যাম্পিয়নশিপের নাম রাখা হয়েছিল ‘ব্যান ক্রেডিট কার্ড’, কেবল বেনকো ডি ক্রেডিটোকে প্রমোট করার জন্য।
এমনকি ফুটবল যখন লাভজনক না, তখনো লাভজনক। জনপ্রিয় রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের উৎস হিসেবেও ফুটবল ভালো কাজ করে। যেভাবে এটি সাহায্য করেছে ইতালির প্রেসিডেন্ট সিলভিও বেরলুসানিকে অথবা ফার্ন্দান্দো কলরকে, যিনি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ‘সেন্ত্রাও ডেপার্তিভো আলেঞ্জো ক্লাবে’র প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন।
ফুটবল সম্পদ এবং জনপ্রিয়তা অর্জনের ক্ষেত্রেও একইভাবে কাজ করে। কদাচিৎই এমন সময় থাকে, যখন ফুটবল আদৌ কোনো কাজ করে না। এটা খুব স্বাভাবিক নিয়ম যে, সবচেয়ে শক্তিশালী পেশাদার ক্লাবটাও তাদের ব্যালান্স শিটে ভুল তথ্য দেয়, শ্রম আইন মেনে চলতে পারে না অথবা লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রেও দুর্নীতি করে। সেইসঙ্গে নিজেদের প্রতিপক্ষে এবং রেফারিকে কিনে নেওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের বিশেষ প্রবণতা দেখা যায়।
১৯৯৭ সালের মে মাসে ‘লাতিন ট্রেড’ নামক ব্যবসায়িক এক ম্যাগাজিন অভিযোগ করে বলে, লাতিন আমেরিকায় ফুটবল এখন পণ্যের চেয়ে অনেক বেশি বিনোদন। তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘যদি এটাকে বোতল ভর্তি করতে পারে, যে কেউ মিলনিয়ার হয়ে পারে। তারা সেখানে বোকা জুনিয়র্সের কথা উল্লেখ করে যারা সম্প্রচারস্বত্ব থেকে ১২০ হাজার ডলার আয় করে। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডালাস কাওবয়স নামে দলটি পেয়েছিল আড়াই মিলিয়ন ডলার। ডালাসের এই দল আমেরিকান ফুটবল খেলত, যাকে হোরিকো টোবিও এভাবে সংজ্ঞায়িত করেন, সামরিক চর্চার মাধ্যমে বিশেষ অঞ্চলে সহিংস বিজয় লাভ করা; কিন্তু এটা খেলা হতো হাত দিয়ে।’ আমেরিকান ফুটবল-উত্তর আমেরিকায় বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে, যেখানে এটা বিশাল জনপ্রিয়তা ভোগ করে।
এই ম্যাগাজিন পড়ার আগে, আমি বুয়েন্স আয়ার্সে বোকা জুনিয়র্স বনাম রিবারের একটি ধ্রুপদি ম্যাচ দেখতে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে যেন ‘কুইলেমস’ নামের বিয়ার কোম্পানিটি খেলছিল একই নামের আরেকটি বিয়ার কোম্পানির বিপক্ষে। ‘কুইলেমস’ এক মিলিয়ন ৮০০ হাজার ডলার দিয়েছিল রিভারপ্লেটের খেলোয়াড়দের বুকে নিজেদের নাম দেখানোর জন্য। ম্যাচটি ছিল আর্জেন্টাইন চ্যাম্পিয়নশিপের, যাকে ডাকা হচ্ছিল পেপসি-কোলা নামে।
ফুটবলার : সবই কর্তব্য, কোনো অধিকার নেই
হতে পারে লাতিন ট্রেড ম্যাগটি সত্য বলছে। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকা উত্তরকে অনুকরণ করেই সব করছে। যদিও এখনো উত্তরের অর্জনের চেয়ে এর অবস্থা অনেক দূরে। বর্তমান পৃথিবীতে যা কিছু চলমান এবং যা নয়, সবকিছু কিছু না কিছু বাণিজ্যিক বার্তা দেয়। প্রত্যেক খেলোয়াড়ই মূলত একেকজন সচল বিজ্ঞাপন। জনগণকে ভোগের ব্যাপারে উৎসাহিত করে। কিন্তু অন্যদিকে ফিফা খেলোয়াড়দের সংহতির সপক্ষে বার্তা প্রদানে অনুমতি দেয় না; বরং উল্টো এটাকে স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
আর্জেন্টাইন ফুটবলের প্রেসিডেন্ট হুলিও গ্রন্দোনা সম্প্রতি এই নিষেধাজ্ঞা আবার মনে করিয়ে দেন, যখন কয়েকজন খেলোয়াড় খেলার মাঠে দাঁড়িয়ে বেতন-ভাতা নিয়ে আন্দোলনররত শিক্ষকদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। এপ্রিলে ফিফা ইংলিশ ফুটবলার রবি ফ্লাওয়ারকে জরিমানা করেছিল শার্টে আন্দোলনরত ডকওয়ার্কারদের পক্ষে স্লোগান লেখার অপরাধে।
১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরের এডিশনে ব্রাজিলীয় ম্যাগাজিন ‘প্লাকার’ ফিফার ক্ষমতাধর দ্বিতীয় ব্যক্তি এবং ফুটবল ব্যবসার রাজপ্রতিনিধি জোসেফ ব্লাটারের (যিনি পরে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন) এক সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। যেখানে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের সংগঠিত হয়ে ইউনিয়ন গঠনের ব্যাপারে মত জানতে চেয়ে বলেন, ‘ফিফা খেলোয়াড়দের কথা বলে না।’ তখন ব্লাটার উত্তর দেন, ‘খেলোয়াড়রা ক্লাবের নিযুক্ত কর্মী।’
এর কয়েক মাস পর ১৯৯৬-এর অক্টোবর মাসে ইউনিয়নের কাছে একটি চিঠি আসে পেলের কাছ থেকে, যিনি একসময় শৈল্পিক ফুটবলের রাজা ছিলেন। ম্যারাডোনার সঙ্গে কুখ্যাত বাজে দ্বৈরথের পরও যিনি ইউনিয়নের জননেতা ছিলেন। পেলে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, 'চলো, সর্বকালের সেরা দলটি তৈরি করা যাক, যেটা হবে মুক্ত খেলোয়াড়দের দল।'
যারা এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা এমন আচরণ করে যেন খেলোয়াড়দের কোনো অস্তিত্বই নেই। তারা কখনো খেলোয়াড়দের কথা শোনে না। প্রদর্শনীর মূল চরিত্র হচ্ছে দর্শক। ব্যবসায়ী এবং আমলারাই সিদ্ধান্ত দেয় কে খেলবে, কততে খেলবে, কখন, কোথায় এবং কীভাবে খেলবে। দুর্বোধ্য ডিজাইন, গোপন অ্যাকাউন্ট সম্পর্কেও। ফিফা ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই নিয়ম পরিবর্তন করেছে অথবা সন্দেহজনক কোনো এক কারণে। যার মধ্যে গোলমুখ বড় করার মতো বিকারগ্রস্ত পরিবর্তনও ছিল। কিন্তু খেলোয়াড়রা কিছুই বলতে পারেনি।
খেলোয়াড়দের প্রাণ জীবনঘাতী গতির মধ্যে সব কাজ করতে হয়, যা আমাকে উইনস্টন চার্চিলের কথা মনে করিয়ে দেয়। যখন তার কাছে দীর্ঘ জীবন এবং ভালো স্বাস্থ্যের সিক্রেট জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কখনো খেলিনি।’
পেশাদার ফুটবলে দায়িত্বের শেষ নাই : আনুগত্য, সামরিক শৃঙ্খলা, কঠোর ট্রেনিং, দিনের পর দিন ম্যাচ খেলা, অধিক পরিমাণে উৎপাদনের বাধ্যবাধকতা, বেপরোয়া ওষুধ সেবন যা জীবনী শক্তি ধ্বংস করে দেয়; কিন্তু তা তোমাকে ইনজুরি এবং অবসাদ সত্ত্বেও খেলতে অনুমতি দেয়... বিপরীতে অধিকার বরাবরই অনুপস্থিত থেকে যায়।
কিন্তু অভিযোগ কেন? ফুটবলাররা কি আয়ের দিক থেকে যথেষ্ট সুপ্রসন্ন না? এটা তো সত্য যে, তারা অল্প কয়েকজন, যারা এই কাজের জন্য নির্বাচিত। কিন্তু এটা খুব আহামরি তাও না : ১৯৯৬ সালের ফোর্বসের সবচেয়ে বেশি আয় করা খেলোয়াড়দের মধ্যে কোনো ফুটবলারের নাম নেই। ক্লাবের ব্যালান্স শিটে এখনো খেলোয়াড়দের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও কয়েক বছর ধরে সামন্ততান্ত্রিক দাসত্বের বন্ধন কিছুটা লাঘব হয়েছে। ১৯৯৫ সালে ইউরোপে এটি ভেঙে পড়েছিল।
এটা খুব ভালো সংবাদ ছিল খেলোয়াড়দের জন্য এবং তাদের জন্যও যারা শ্রম স্বাধীনতা ও মানবাধিকারে বিশ্বাস করত। ইউরোপিয়ান কমিউনিটির সর্বোচ্চ বিচারিক কর্তৃপক্ষ লুক্সেমবার্গের উচ্চ আদালত বেলজিয়ান ফুটবলার জিয়ান মার্ক বোসম্যানের আনা একটি কেইসকে সমর্থন করে রায় দিয়েছিল যে, চুক্তি শেষ হওয়ার পর খেলোয়াড়রা ক্লাব ছেড়ে যেতে পারবে। খেলোয়াড়দের ইউনিয়ন এই বিজয়কে বাকি পৃথিবীতেও ছড়িয়ে দেওয়ার আশা ব্যক্ত করেছিল।
আন্তর্জাতিক পেশাদার ফুটবলার অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে বার্সেলোনায় বর্ণবাদ এবং বৈষম্যবিষয়ক এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। এটা ছিল মূলত দীক্ষার আলোকে ফুটবলের প্রকৃত রূপকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। ফুটবলের অন্যতম সেরা তারকাদেরও কালো কিংবা মিশ্রবর্ণের হওয়ার কারণে বর্ণবাদের শিকার হতে হয়েছিল কিংবা দরিদ্র হওয়ার কারণে নানা বৈষম্য মেনে নিতে হয়েছিল। আবার অনেক ক্ষেত্রে একই সঙ্গে চামড়ার রং এবং দরিদ্র হওয়ার কারণে একই সময়ে দুটো অপমানই সহ্য করতে হয়েছে। পরিসংখ্যানগত গড় অনুযায়ী তাদের যেভাবে দোষী করা হয়েছিল, মাঠে গিয়ে তারা এর একটা বিকল্প খুঁজে পেয়েছিল।
ব্রাজিলের সাম্প্রতিক এক জরিপে জানা গেছে, প্রতি তিনজন পেশাদার ফুটবলারের দুজনই প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেননি এবং অর্ধেকের বেশি হচ্ছে কালো চামড়ার। সাম্প্রতিক সময়ে মাঠে মধ্যবিত্তের আক্রমণ সত্ত্বেও ব্রাজিলের ফুটবল পেলে গারিঞ্চাদের সময়ের চেয়ে খুব বেশিদূর আগাতে পারেনি। পেলে যে কি না শৈশবে রেলস্টেশনে বাদাম চুরি করত এবং গারিঞ্চা যে কি না পুলিশের কাছ থেকে বাঁচতে গিয়ে ড্রিবলিং শিখেছিল।
কারো কারো ভেতর জনতা খেলা করে
কোনো কোনো ফুটবলারের ভেতর অনেক মানুষ খেলা করে। অপরিমেয় জনতাকে তারা নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারে। যাদের ভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য দুটোই নির্ভর করত খেলোয়াড়ের পায়ের ওপর। যখন বৈষম্য, ঘৃণা, অনন্ত ব্যর্থতার দোষে তারাই তাদের চিহ্নিত করে একজন নিঃসঙ্গ সফল নায়ক হিসেবে, জয়ের মুহূর্তে তাদের কাছে যূথবদ্ধ আশার অনুভূতিগুলো এমনই। যদিও সে তা চাই না, যদিও সে তা জানে না তবুও তার কৃতিত্ব প্রতীকী মূল্য পায়। এবং এর মধ্যে দিয়ে অনেকের মর্যাদা পদদলিত হয়, যেন এটা কখনোই পরাজিত হওয়ার ছিল না।
উদাহরণস্বরূপ জর্জ উইয়ার কথা বলা যায়। অনেক মানুষের জন্য তিনি বিশেষ কিছু। শুধু লাইবেরিয়ার সেসব মানুষের জন্য নয়, যারা মনরোভিয়ার বন্দরে যেখানে তিনি বড় হয়েছেন, সেখানে তীর্থযাত্রীদের জন্য জলকূপ করে দিয়েছে বরং আফ্রিকানদের জন্য। জর্জ উইয়া ১৯৯৫ সালে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়, যিনি জন্মেছিলেন টিনের খুপড়ি ও কার্ডবোর্ডের ঘরে এবং বারো বছর বয়সে গাঁজা খাওয়া এবং পেশাদার চোরের কাজ শুরু করেছিলেন। এটা যে কেবল ফুটবলের সঙ্গে ঘটে তা নয়। মার্কিন দেশের নাগরিক অধিকারকর্মীরা জ্যাকি রবিনসনকে দেবতা হিসেবে চিহ্নিত করে। চল্লিশের শেষ দিকে সাদাদের বেসবল খেলায় রবিনসন ছিলেন প্রথম কালো তারকা। ওই সময়ে কালোরা সাদাদের সঙ্গে কোনো কিছুই ভাগাভাগি করতে পারত না। এমনকি কবরও না। তার দিকে চিনাবাদাম ছুড়ে দেওয়া, থুতু মারা কিংবা মৃত্যুর হুমকি দেওয়ার মতো ঘটনার পরও রবিনসন অসাধারণ অ্যাথলেটিক দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
গুয়েতেমালার অবেহেলিত সংখ্যাগুরু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে এটা উল্লেখযোগ্য প্রতীক যে, খেলাধুলার মহত্তম জাতীয় চরিত্রটি একজন একটি ‘কীশ ভারতীয়’। তিনি একজন দূরপাল্লার দৌড়বিদ, যিনি ম্যারাথনে অপরাজিত ছিলেন এবং আজ তিনি গলফ কোর্সে বল কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
সে জন্মেছিল ডরোটিও গুয়াদামাচ নামে, কিন্তু বর্ণবাদ তাকে বাধ্য করেছে তার মায়ান নাম বাদ দিতে এবং মাথিও ফ্লোরেস নামে নিতে। তার কৃতিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ গুয়েতেমালার একটি মাঠের নামকরণ করা হয় মাথিও ফ্লোরেসের নামে। যেখানে আকস্মিক আতঙ্কের কারণে হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে ৯০ জন লোক মৃত্যুবরণ করেন। সম্ভবত কোনো একদিন যখন পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। যদি আসলেই কোনো দিন হয়, সেদিন তার আদি নামেই নিশ্চয় স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হবে, যা তিনি আজীবন চেয়েছিলেন।
এটা অনিবার্য বলে মনে হয় যে, আমি ফুটবলের আবেগ, ব্যবসা এবং সাধারণভাবে স্পোর্টস নিয়ে লেখা সংক্ষিপ্ত এই নোটটির উপসংহারে কিছু কথা বলব ডিয়াগো আরামান্দো ম্যারাডোনাকে নিয়ে। কিছু কথা এবং কিছু প্রশ্নও।
প্রায়ই এমনটা ঘটে কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর কেবল আরো কিছু প্রশ্ন দিয়ে দেওয়া যেতে পারে : সেইসব জনপ্রিয় তারকা, যাঁরা নিজেদের মধ্যে অন্য অনেক মানুষকে ধারণ করেন এবং সেই একজন যিনি নিজের মধ্যে বহন করেন লক্ষ জনকে, তারা কি সবার চেয়ে নিঃসঙ্গ? সবার সঙ্গে থাকার পরও কি ম্যারাডোনা আসলে একা? কী থেকে তিনি পালিয়ে বেড়ান? তিনি যে বারবার গলা ফাটিয়ে নিজেকে খ্যাতির কুকুর বলে ডাকেন, এ জন্য কি? তিনি কি খ্যাতি দ্বারা তাড়িত হয়ে খ্যাতির পেছনে ছুটেছেন? এর দ্বারাই কি তিনি ক্লান্ত ও শ্বাসরুদ্ধ হয়েছেন এবং এটিই কারণ যে তিনি এখন আর নেই? তিনি কি এটা ছাড়া থাকতে পারবেন? যে খ্যাতি তার দারিদ্র্যকে দূর করেছে এবং তাকে সমস্ত অবজ্ঞা থেকে উদ্ধার করেছে?
ম্যারাডোনা কি কোকেনের প্রতি আসক্ত নাকি খ্যাতির প্রতি? এমন কোনো ক্লিনিক কি কোথাও আছে যা এ রকম ক্ষতিগ্রস্তদের সারিয়ে তুলতে পারে? ম্যারাডোনা কি এ জন্য অবসর নিতে চাননি, কারণ তিনি মরতে চাননি? তিনি কি খেলা দেখতে পারবেন না, খেলায় অংশ নেওয়ার পরিবর্তে?
সেই ভিড় থেকে ফিরে আসা কি অসম্ভব, যেখান থেকে তিনি এসেছেন? এটা কি তিনি মেনে নিতে পারছেন না যে, সেই দিন আর নেই যখন প্রতিপক্ষ জানতো না তাকে মার্ক করবে নাকি তার কাছ থেকে অটোগ্রাফ চাইবে?
তিনি কি তার সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারের এমন সাবলীল সমাপ্তি মানতে পারছেন না?
তিনি কি পারেন না চিরতরে কথা বলা বন্ধ করতে, যেভাবে তিনি মুখ দিয়েও গোল দেওয়ার চেষ্টা করেন? তিনি কি পারেন না, সেসব কাজ বন্ধ করতে যেন তিনি স্টেডিয়ামের ঈশ্বর? ঈশ্বরের মতো আদর্শদের কি নিজেদের আগুনেই পুড়ে যাওয়ার শাস্তি দেওয়া হয়? প্রাচীন অ্যাজটেকদের বল খেলার নিয়ম অনুসারে বিজয়ীকে জনতার প্রস্তাব অনুযায়ী অবধারিতভাবে দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হতো। জনতা যাকে ভালোবাসে, দাবি করে এবং তারাই তাকে খেয়ে ফেলে? যে বিদ্রোহী ফুটবলার তার মর্যাদা রক্ষার জন্য এবং আমাদের নান্দনিক ক্রীড়াশৈলী উপহার দেওয়ার জন্য কঠিন লড়াই করেছেন, আমরা সবাই কি পারি না তাকে কিছুটা বুঝতে এবং পাওনা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে?