শিক্ষকতা ও সাহিত্য সমালোচনা

সৈয়দ আকরম হোসেনের দুই উৎসারণ

Looks like you've blocked notifications!

আকরম স্যারের নাম শুনেছিলাম আশির দশকের গোড়ার দিকে তাঁর ছাত্র হওয়ার কয়েক বছর আগে আমার আরেক শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত সাম্প্রতিক ধারার প্রবন্ধ নামের বইয়ের সূত্রে। আমি তখন ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের স্নাতক পর্বের ছাত্র। ‘কথামালা : পূর্ব-বাঙলার কবিতা’ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছিল সে বইয়ে। সেই প্রবন্ধ ভালোমতো বুঝে উঠবার সামর্থ্য তখনো হয়নি আমার। তবে চিন্তার সূক্ষ্মতায় ও ভাষার সামর্থ্যে প্রবন্ধটি সে সময়ের সাহিত্য-রসিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল তা টের পেয়েছিলাম। তা ছাড়া তাঁর পিএইচডি থিসিসের গ্রন্থরূপ রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস : চেতনালোক ও শিল্পরূপ সম্পর্কে শুনতে পেয়েছিলাম অনেকেরই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, বিশেষ করে মনে পড়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের কথা। কোনো এক পত্রিকায় তিনি বইটি সম্পর্কে প্রশংসাসূচক সমালোচনা লিখেছিলেন। মোটকথা, সমালোচক-গবেষক হিসেবে তাঁর গুরুত্ব তত দিনে আমি কিছুটা অনুধাবন করতেও সক্ষম হয়েছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অগ্রজপ্রতিম কিংবা সমবয়সী ছাত্রদের কাছে তাঁর ক্লাস সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। কেউ একজন এমনও বলেছিলেন যে, বাংলায় বিএ অনার্স পাস করতে হলে ক্লাস তেমন না করলেও চলে। তবে তিনি আকরম স্যারের ক্লাসে উপস্থিত থাকেন আনন্দের জন্য। এসব সূত্রেই তাঁর সম্পর্কে বেশ কৌতূহল জন্মেছিল আমার মনে। ঢাকা কলেজের ছাত্রত্বের সুবাদে ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্র হওয়ার একটা সম্ভাবনাও তখন ছিল। কারণ, যেসব কলেজে স্নাতকোত্তর খোলা হয়নি, সেসব কলেজের ছাত্ররা যদি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে চায়, তাহলে তাদের জন্য অন্যতম উপায় তখনো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনাতন পদ্ধতির এই স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হওয়া। স্বাভাবিক কারণেই বিভিন্ন কলেজের সীমিত সুযোগে লেখাপড়া করে আসা এ ধরনের কোর্সে ভালো ছাত্রের সংখ্যা খুব বেশি থাকত না। সুতরাং এই স্মৃতিমূলক লেখা যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা অনুমান করতে পারবেন যে আমিও সেই অমেধাবী ছাত্রগোষ্ঠীর পেছনের সারিরই একজন। এ রকমের হীনমন্যতা নিয়েই আমি সেই কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম এই ভেবে যে, অন্তত গৌরবময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে আমিও সেই গৌরবের অংশীদার হতে পারব!

আমার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সেশন ছিল ১৯৮৪। কিন্তু স্বৈরাচারী জিয়া-এরশাদের সামরিক ও ছদ্মবেশী সামরিক শাসনের যুগে বারবার রাজনীতির নানা চালের খড়্গ-কৃপাণ নেমে আসায় সেশনজটের কারণে পিছিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের ক্লাস শুরু হতে হতে ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাস এসে গিয়েছিল। রুটিন পেয়ে দেখলাম, অন্যান্য শিক্ষক ৫০ মিনিটের ক্লাস নেবেন। আর আকরম স্যার প্রতিটি ক্লাস নেবেন এক ঘণ্টা ৫০ মিনিটের। তাঁর ক্লাস হবে বিকেলের দিকে। প্রতি সোম ও মঙ্গলবার বিকেল ২টা ৩০ থেকে ৪টা ২০ মিনিট পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে তাঁর ক্লাসের সময়।

আমি ছাত্র হিসেবে ভালো না হলে কী হবে, ক্লাসে উপস্থিত থাকার ব্যাপারে ছিলাম উৎসাহী। ফলে পরীক্ষায় কেমন করেছি, তা না জানা শিক্ষকরা হয়তো কেউ কেউ আমাকে ক্লাস-ফাঁকি-না-দেওয়া ভালো ছাত্র বলেই জানতেন। যা হোক, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। স্যার ক্লাস নিতেন কলাভবনের দোতলায়, ২০১৭ ও ২০৬৮ নম্বর কক্ষে। প্রথম যেদিন তাঁকে দেখলাম, সেদিন তাঁর পরনে ছিল ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি ও সাদা ঢিলে পাজামা। পুরোনো বাংলা সিনেমার রোমান্টিক নায়কোচিত সৌম্যদর্শন চেহারা তখন স্যারের। এর পরে ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও স্যার এখনো প্রায় একই রকম সুদর্শন এবং দৃশ্যত তরুণতর। আমরা যখন তাঁর ছাত্র, তখন তিনি সবে ৪০ পেরিয়েছেন। তখনো তাঁকে বয়সের তুলনায় তরুণতরই মনে হতো।

প্রথম দিনের কথা। ক্লাসে এসেই সব ফ্যানের সুইচ অফ করে দিতে বললেন। বললেন দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতে। যদিও তখন জানুয়ারি মাস, মনে হচ্ছিল ঘরভর্তি এত মানুষের উত্তাপে অস্বস্তি লাগবে। মুখে হাসি থাকলেও এক ধরনের গাম্ভীর্যও লক্ষ করেছিলাম তাঁর মধ্যে।

যে নোটখাতা নিয়ে ক্লাসে যেতাম, সেটা খুঁজে পেয়েছি। দেখছি, স্যারের সঙ্গে প্রথম ক্লাসের তারিখ ৮.০১.৮৬। কিছু পরে, ১৩. ০১. ৮৬ তারিখের নিচে দেখছি লেখা আছে উপস্থিতি—রেজিস্টারে তখন পর্যন্ত আমার নাম ওঠেনি। স্যার তাঁর দীর্ঘ ক্লাস নেওয়ার সূত্র ধরিয়ে দিলেন। বিষয়ের গভীরে যেতে হলে সময় দরকার, দরকার মনঃসংযোগ। কারণ, শ-দুয়েক ছাত্রছাত্রীর রোলকল করতেই চলে যায় অনেকটা সময়। তাই দুটি ক্লাসের সময়কে একসঙ্গে যোগ করে নিয়েছেন তিনি। এতে ১০ মিনিটের বাড়তি সময়ও পাওয়া যায়। প্রথম দিনের ক্লাসেই স্যার জানালেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস যোগাযোগ ও প্রবন্ধের বই সংকলন পড়াবেন। এমএ ক্লাসে আমাদের পাঠ্য ছিল রবীন্দ্রসাহিত্য। স্যার রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ও প্রবন্ধ আলোচনা করে আমাদের রবীন্দ্র অনুধাবনের পথ দেখিয়ে দেবেন। প্রথম দিনে তিনি তাঁর পড়াবার ধরন সম্পর্কে বললেন। বললেন, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীর মনঃসংযোগের গুরুত্ব সম্পর্কে। ফ্যানের বাতাসের শব্দ সকলের মনঃসংযোগ নষ্ট করে বলে সুইচ অফ রাখেন তিনি। প্রথম ক্লাসে আলোচ্য বিষয়ে আর কী বলেছিলেন, তা লিখে রাখিনি। কারণ, স্যার সম্ভবত বলছিলেন, মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনতে। সেই ক্লাসেই পড়ানোর নীতিমালা সম্পর্কে আমাদের ধারণা দিয়েছিলেন তিনি।

দ্বিতীয় ক্লাস ছিল ১৫.০১.৮৬ তারিখে। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস বিবেচনা করতে হলে আগে উপন্যাস বিবেচনার গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলো জানতে ও বুঝতে হবে। স্পষ্ট মনে পড়ছে যে তিনি বলেছিলেন, উপন্যাস বিবেচনার প্রথম শর্ত ‘চেতনালোক’ বিশ্লেষণ। দ্বিতীয়ত দেখতে হবে ‘প্রকরণ’। প্রকরণের মূল দিকগুলো হচ্ছে—১. দৃষ্টিকোণ, ২. ঘটনাবিন্যাস, ৩. চরিত্রায়ণ, ৪. ভাষারীতি। দৃষ্টিকোণকে আবার তিনটি বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করেছিলেন—১. ঔপন্যাসিকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ, ২. কেন্দ্রীয় চরিত্রের দৃষ্টিকোণ, ৩. প্রান্তিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ। পরে দেখতে হবে পরিচর্যারীতি। পরিচর্যারীতিকে আবার সাতটি ভাগে ভাগ করেছেন—১. চিত্রাত্মক, ২. গীতময়, ৩. নাট্যিক, ৪. বিশ্লেষণাত্মক, ৫. বর্ণণাত্মক, ৬. প্রতীকী-চিত্রকল্পময় ও ৭. দৃশ্যানুগ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস পড়াতে গিয়ে এই শর্তগুলো নিয়ে স্যার আলোচনা করেছেন। ক্লাসের নোটখাতায় এ কথাগুলো টোকা ছিল বলে হুবহু উদ্ধৃত করতে পারলাম। কিন্তু এ ছাড়া স্যারের ক্লাসে কয়েকটি অনুষঙ্গ আমাদের বিশ্লেষণী সত্তাকে জাগিয়ে দিয়েছিল। সাহিত্য বিচারে ইতিহাসের বিবেচনাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ মনে করতেন তিনি। একজন লেখকের প্রখর কালজ্ঞান যে তাঁর সৃষ্টিশীলতারও অন্যতম উৎস, তা আমি খানিকটা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম স্যারের ওই ক্লাসগুলো করবার কারণে। এ কথা ঠিক যে, আমাদের পড়াবার আগেই তাঁর সাহিত্যচিন্তা সুস্পষ্ট অবয়ব লাভ করে ফেলেছিল এবং তার প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর রচিত প্রবন্ধসংরূপের আধারে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, স্যারের নিজস্ব ভাষা রূপবন্ধ অনুসরণ করে গভীরে পৌঁছবার মতো পাঠকসত্তা আমার তখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে পত্রিকার পাতায় তাঁর সেসব বিষয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধাবলি পাঠ করেও আমার পক্ষে অনুধাবনস্তরের তলদেশে যাওয়া সম্ভব হতো না।

তখন তো এখনকার মতো কোর্স পদ্ধতি ছিল না। যদ্দূর মনে পড়ে, স্নাতকোত্তরের জন্য ছিল চারটি পত্র। রবীন্দ্র উপন্যাসের পাশাপাশি আকরম স্যার আমাদের পড়াবেন ‘তিরিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্য’। এই শিরোনামের আওতায় তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করবেন। প্রথমেই বুঝেছিলাম, স্যারের ব্যক্তিত্বে যুগপৎ গাম্ভীর্য, বৈদগ্ধ্য ও সরসতার সমাহৃতি ঘটেছে। সম্ভবত এ গুণই আমাকে আকৃষ্ট করেছিল বেশি। এর একটা কারণ হয়তো এটা হতে পারে যে, আমার আরেক শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য। আমার এ দুই শিক্ষক বিদগ্ধ হয়েও আনন্দের অফুরন্ত আধার। সায়ীদ স্যারের ব্যক্তিত্বে যেমন কৌতুকময়তার মাত্রা বেশি অনুভব করেছি, তেমনি আকরম স্যারের মধ্যে অনুভব করেছি বৈদগ্ধ্যের মাত্রা। গাম্ভীর্য, বৈদগ্ধ্য ও সরসতা—এই তিনের সমাহারের ঐক্যের কথা আমার কাছে শুনে প্রবীণদের কেউ কেউ আমাকে বলেছিলেন যে এর উৎস তাঁদের উভয়েরই শিক্ষক মুনীর চৌধুরী। দুজনেই ছাত্রজীবনে ছিলেন মুনীর চৌধুরীর অনুসারী।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নিয়মিত ক্লাস করায় উৎসাহী হওয়ার ব্যাপারে আকরম স্যার ছিলেন আমার কাছে অন্যতম আকর্ষণ। স্যারের ক্লাস আমাকে এতটাই আকৃষ্ট করল যে আমি তখন রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, মানিক ও ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসগুলো গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। এমনকি অন্যান্য পত্রের পাঠ্যবস্তুকে উপেক্ষা করে কেবল এই চার লেখকের উপন্যাসগুলো পড়তে পড়তেই আমার সময় শেষ হতে লাগল। কারণ, আমি বুঝতে পারলাম যে তা না হলে ‘বৈদগ্ধ্য’ ও ‘সরসতা’ আমি ঠিকভাবে অনুধাবন তো করতেই পারব না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার আনন্দই সম্পূর্ণ মাঠে মারা যাবে। আমি আকরম স্যারের ক্লাসের প্রতি এতটাই উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলাম যে সে সময় অন্য শিক্ষকদের ক্লাসেও প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়ার কথা প্রায়ই ভুলে যেতাম। কারণ, স্যারের ক্লাস আমার যতটা না জ্ঞান অর্জনের, তার চেয়ে বেশি হয়ে উঠেছিল আনন্দের। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে কেবল স্যারের বক্তব্য শোনার আনন্দের চেয়ে তাঁর বক্তব্য অনুধাবন করে তার প্রয়োগ ঘটিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়!

আকরম স্যার ক্লাসে যে কেবল উপন্যাস প্রসঙ্গেই কথা বলতেন তা নয়। এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক দর্শন ও শিল্পকলার নানা তত্ত্ব সম্পর্কেও প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলতেন। স্যার ছিলেন মার্কসীয় দর্শনের অনুসারী। তবে ওই ধারার কোনো গোঁড়ামিতে তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন না। কেবল মার্কসীয় দর্শনই নয়, আরো বিচিত্র দার্শনিক প্রত্যয়গুলোও তাঁর কল্যাণে আমার পক্ষে অনুধাবন সম্ভব হয়ে উঠেছিল। কথায় কথায় ক্লাসে একদিন চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ উঠল। লেখকের গঠন-প্রকৌশল বোঝাতে মাঝেমধ্যেই পরিচিত চলচ্চিত্রের দৃশ্যকল্প চলে আসত তাঁর আলোচনায়। তাঁর এ রকম দু-একটি বক্তব্যের সূত্রে আমি সাড়া দিলে তিনি তা গ্রহণ করলেন এবং আমার আগ্রহ-পরিধির বিস্তারকে স্বাগত জানালেন। একদিন উপন্যাসে লেখকের পরিচর্যা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কথা উঠল চলচ্চিত্রের কিছু ডিটেল সম্পর্কে। প্রসঙ্গত, ‘ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ’ শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করে বসলাম। স্যার আমার এই অংশগ্রহণকে সেদিন পাকামো মনে না করে আন্তরিকভাবে স্বাগত তো জানালেনই, পরের ক্লাসগুলোতেও এসে আমার খোঁজ করতে লাগলেন। ধারাবাহিকভাবে তিনি আমার কৌতূহল ও প্রয়াসকে প্রশ্রয় দিয়ে উপন্যাসের পাঠ বিশ্লেষণে আমার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করতে লাগলেন।

আগেই বলেছিলাম, আমাদের ‘সনাতন’ পাঠক্রমে ভালো ছাত্রদের সংখ্যা খুবই কম হওয়ার কথা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি পড়াতেন খুবই গুরুত্বসহকারে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রচুর কথা বলতেন। আমি স্যারের এতটাই অনুরাগী হয়ে পড়লাম যে নানা অছিলায় তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারের বাসভবনেও মাঝেমধ্যে যেতে শুরু করলাম। সেখানে স্যারের সহৃদয়তার সঙ্গে আমার বাড়তি পাওনা হতো স্যারের স্ত্রীর আপ্যায়ন আর আন্তরিক স্নেহময়তার পরশ।

বিভূতিভূষণের উপন্যাস নিয়ে আলোচনার আগে তিনি আমাদের বললেন তাঁর জীবনী সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। একই কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি পড়াবার সময়। সত্যি বলতে কি, সংক্ষেপে হলেও রবীন্দ্রনাথের জীবনকে পূর্ণাঙ্গভাবে জানতে চেষ্টা করেছিলাম তখন। স্যার রবীন্দ্রনাথের জীবনী সম্পর্কে সূত্রাকারে তখনকার সামাজিক ও ঐতিহাসিক পটভূমিও বলেছিলেন। পরের একটি ক্লাস থেকে বুঝেছিলাম ‘সাহিত্য শিল্পীর জীবনেরই প্রতিবিম্ব’—এ তত্ত্বের আলোকে তিনি রবীন্দ্রনাথ কিংবা বিভূতিভূষণকে বিশ্লেষণ করা সংগত মনে করেছেন! বিভূতিভূষণের ক্ষেত্রে মনে করেছেন আবেগ, সংস্কার আর মেধার সমন্বয়ে বিভূতিভূষণের শিল্পসত্তা এক জ্যোতির্ময় চেতনা স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে যেন জন্ম-জন্মান্তরের ‘পথিক আত্মা’র ধ্বনি শোনা গেছে। আরো বললেন ১৮৮৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাল পরিসরের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক, সাহিত্যিক উল্লেখপঞ্জি প্রস্তুত করতে। বিভূতিভূষণের জীবনদৃষ্টি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন, তিনি মানুষকে দেখেছেন অখণ্ড দৃষ্টিতে আর জীবনকে দেখতে চেয়েছেন প্রবহমান দৃষ্টিতে। আরো দু-একটি সূত্র তিনি তুলে ধরেছিলেন, যা পরেও বিভূতিভূষণের শিল্পীসত্তাকে বুঝতে সহায়ক হয়েছে আমার।

স্যার বলেছিলেন, বিভূতিভূষণের উপন্যাসে দুঃখ এসেছে মানুষের জীবনের বড় সম্পদ হয়ে। তিনি পুরো ব্যাপারটাকে সূত্রবদ্ধ করেছিলেন এইভাবে, শিল্পিত দুঃখই বেদনা; মানুষের সিনসিয়ার দুঃখের কোনো ব্যর্থতা নেই! মানুষের এই সিনসিয়ার দুঃখের কথাই তুলে ধরেছেন বিভূতিভূষণ তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে; উপন্যাসের মধ্য দিয়ে দিয়েছেন মানুষকে প্রকৃতিচেতনার শুশ্রূষা। এই দিকটিও বিভূতি-উপন্যাসের বড় একটি দিক।

‘বল্লালী বালাই’, ‘আম আঁটির ভেঁপু’ ও ‘অক্রূর সংবাদ’—পথের পাঁচালী উপন্যাসের এই তিনটি পর্বের বিভাজনে যে ইতিহাস-পুরাণের রূপক ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা হয়তো কোনোদিনই বোঝা হতো না যদি আকরম স্যারের ক্লাস না করতাম। চলমানতাই জীবন—এটাই বিভূতিভূষণের জীবনদৃষ্টি। জ্যোতির্ময় চেতনালোকে উপনীত হওয়া ইন্দির ঠাকরুণের দৃষ্টিকোণের মাধ্যমে নিশ্চিন্দিপুরের চলমানতাকে রূপকায়িত করেছেন আর এর মধ্য দিয়েই অপুর জীবনের পরিপ্রেক্ষিতকে নির্মাণ করেছেন বিভূতিভূষণ। পথের পাঁচালী উপন্যাসের পৌরাণিক রূপকের গভীর তাৎপর্য এত সহজে আমি কোত্থেকে জানতাম, আকরম স্যারের ক্লাস না করলে!

শ্রেণিকক্ষে পথের পাঁচালী-অপরাজিত উপন্যাসের আলোচনায় আমাদের বুঝিয়েছিলেন, পথের পাঁচালী উপন্যাসের তিনটি পর্বের কোনোটিই অবান্তর নয়। তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অপু চরিত্রের সামগ্র্যের স্বার্থেই ‘বল্লালী-বালাই’ এবং ‘অক্রূর সংবাদ’ অংশ পথের পাঁচালী উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত। শ্রেণিকক্ষে স্যার আমাদের বুঝিয়েছিলেন :

ধাবমান সময় রূপান্তরিত করে চলেছে নিশ্চিন্দিপুরকে, নিশ্চিন্দিপুরের নিসর্গলোককে, মানবসমাজকে। ইন্দির ঠাকরুণ তো চলমান অমোঘ কালের নখরে বিক্ষতজীর্ণ, নিঃসঙ্গ পরিস্থিতির অপসৃয়মাণ প্রতিনিধি। সময়ের এই হিংস্র-মধুর প্রবহমান স্থানকালের মাঝে বিভূতিভূষণ অতি সতর্কভাবে বিন্যাস করেছেন তাঁর অপুকে। ‘বল্লালী-বালাই’ অংশের ছয়টি পরিচ্ছেদের অধিকাংশ ঘটনা, পুরাবৃত্ত, বর্ণনা, চিত্রকল্প কুণ্ডলীভূত কালশাসিত নয়, বিসর্পিল সময়চালিত। যে মহাকালপ্রবাহ নিঃশেষ করেছে বীরু রায়ের দম্ভ, ব্রজ চক্রবর্তীর ঐশ্বর্য এবং ব্রজকাকার ছেলে নিবারণের অস্তিত্ব। এমনকি সময়ের নখরচিহ্ন বহন করেছে নিশ্চিন্দিপুরের নিসর্গ।

স্যারের মতে, ‘আম আঁটির ভেঁপু’ অংশও ধাবমান কালবিষয়ক বিভূতিভূষণের একই শৈল্পিক মোটিফ ও টোনের সামগ্রিক প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত। এই অংশের উন্মোচন ঘটেছে শীতের এক অপরাহ্নে অপু-হরিহরের চলতি পথে। উপন্যাসের নামকরণের তাৎপর্যের ইঙ্গিত স্পষ্টতা পেয়েছে এখানে। পথের পাঁচালীতে মূর্ত জীবনদৃষ্টির প্রতীকায়নকে স্যার আমাদের কাছে প্রাঞ্জল করে দিলেন। পরে আমি যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশিত আম আঁটির ভেঁপুর জন্য ভূমিকা লিখি, তখন এর তাৎপর্য আরো গভীরভাবে অনুভব করেছিলাম। তবে ছোটদের জন্য বিভূতিভূষণ পথের পাঁচালীর কেবল ‘আম আঁটির ভেঁপু’ অংশটিই রেখেছিলেন, গোটা পথের পাঁচালী উপন্যাসটিকে সংক্ষিপ্ত করে বা ছোটদের জন্য আলাদা রূপান্তর করে দেননি। কারণ, ছোটদের মধ্যে কাহিনীর অখণ্ডতাকে সংরক্ষণ করাই ভেবেছেন যথার্থ। অর্থাৎ আম আঁটির ভেঁপুকে ছোটদের উপযোগী একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস হিসেবেই রেখেছেন বিভূতিভূষণ। একটি ত্রয়ী-উপন্যাসের একখণ্ড হিসেবে ভাবতে বা ভাবাতে চাননি। এমনকি এর কোনোরকম পরিমার্জনা বা পুনর্কথন করেননি। রেখে দিয়েছেন অবিকল।

আর ‘অক্রূর-সংবাদ’ অংশ সম্পর্কে আকরম স্যারের ভাষ্য হলো :

গঠনশৈলীর অনুন্মোচিত স্তরের key-note, এখানেই বিভূতিভূষণের প্রকাশ-প্রকরণের সংকেত-উৎস নিহিত। তিনি মিথ কাহিনীর প্যাটার্নে পথের পাঁচালী-অপরাজিত উপন্যাসের শিল্পপ্রমূর্তি নির্মাণ করেছেন, প্রকাশ করেছেন অপুর জাগরচৈতন্যের বিকশিত অভিজ্ঞান, অস্তিত্বের দায়ভার। দ্বন্দ্বরিবৃত নিঃসঙ্গ অপু মানসক্রিয়ায় সংগ্রামশীল, বিশ্বাসে-আদর্শে সত্য-অভিপ্রায়মুখী, সমকালীন সর্বপ্রকার পঙ্কযাত্রা-বিমুখ এবং অবশেষে এক অপরাজিত চেতনাস্তরে উত্তীর্ণ।

এখানে আমি স্যারের বই থেকে উদ্ধৃতি দিলাম। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে স্যার এত অল্প কথা ব্যয় করেননি। তাঁর ব্যক্তিত্বের সামগ্রিকতা দিয়ে, অর্থাৎ প্রসন্ন স্মিতহাস্য সহযোগে সংযত অথচ ইঙ্গিতময় অঙ্গভঙ্গি দিয়ে বলেছেন আরো অনেক না বলা কথা। আমাদের ক্লাসে স্যার যখন পথের পাঁচালী-অপরাজিত পড়াতেন, তার আগেই সম্ভবত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা’ বা বাংলা বিভাগের ‘সাহিত্য পত্রিকায়’ উপর্যুক্ত প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়ে গেছে। আমি তখন জোগাড় করে প্রবন্ধটি পড়েও ছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে কি, বোধগম্য পাঠ আমি পেয়েছিলাম শ্রেণিকক্ষেই! কারণ তখনো আমার পাঠকসত্তা পরিণত হয়ে ওঠেনি। আকরম স্যারের শিক্ষকতার এটাই বৈশিষ্ট্য। আমার ধারণা, স্যারের সাহিত্য-সমালোচক সত্তা সাহিত্যিক মহলে যতটা মূল্যায়িত হওয়া উচিত ছিল, ততটা হয়নি পরিণত সাহিত্য-পাঠকের অভাবে। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের মধ্যে তিনি যে সাহিত্য বোধের সঞ্চার ঘটিয়ে দিতেন, ছাত্ররা পরবর্তী জীবনে তার অনুশীলন না করলে এর দায় তো আর তাঁর ওপর বর্তায় না!

ক্লাসে আমাদের তিনি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস যোগাযোগ পড়াবার সময় এর বিষয়বস্তু নিরূপণ করে দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি বুঝিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু অপসৃয়মাণ সামন্ত শ্রেণির সঙ্গে উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণির দ্বন্দ্ব। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মানদীর মাঝি বা পুতুল নাচের ইতিকথার শিল্পশৈলী ও বিষয়বস্তুর আধুনিকতা, ব্যক্তিমানুষের অনুভবলোককে অনুধাবনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসে কীভাবে পরিচর্যা করেন, ঔপন্যাসিক শিল্পপ্রয়াসের মধ্য দিয়ে পাঠকদের অন্তরকে কীভাবে শুশ্রূষা করেন তার পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। পরে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু-চাঁদের অমাবস্যা-কাঁদো নদী কাঁদোর শিল্পপ্রকরণে প্রতীকের ভূমিকা এত সুন্দরভাবে আমাদের বুঝিয়েছেন যে বাকি জীবন ধরে উপন্যাস পাঠের সময় তাঁর প্রদর্শিত রূপরেখা আমাদের পথ দেখাবে।

আকরম স্যার সাহিত্যের অধ্যাপক ও সমালোচক। শ্রেণিকক্ষে স্যারের পাঠদান নিয়ে লিখতে গিয়ে অনুভব করলাম যে, তাঁর এই দুই সত্তা একটি অপরটির পরিপূরক। যদিও আমার অনুভবে লেখক সত্তার তুলনায় শ্রেণিকক্ষে সাহিত্যের অধ্যাপক-সত্তায়ই তিনি এগিয়ে থাকেন। কারণ, শ্রেণিকক্ষে তিনি তাঁর চৈতন্য ও ব্যক্তিত্বের অন্য অনুষঙ্গের পুরোটা নিয়েই হাজির থাকতে পারেন। তখন তাঁর কণ্ঠস্বরের প্রক্ষেপণ স্টাইল, ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকানোর সহাস্য ভঙ্গি, বক্তব্য উপস্থাপনে প্রাসঙ্গিক নাটকীয়তা, মোক্ষম শব্দচয়ন ও ক্ষেত্রবিশেষে শব্দের আভিধানিক ব্যাখ্যা, প্রতিটি উচ্চারিত শব্দের পরিশীলিত ও প্রমিত রূপ এবং মোটকথা তাঁর ব্যক্তিত্বের সামগ্রিক সজীবতা হাজির থাকে। সব মিলিয়ে শ্রেণিকক্ষে তিনি হয়ে ওঠেন বৈদগ্ধ্যসম্পন্ন রসস্রষ্টা পরিবেশনশিল্পী (Performer)। লেখক হিসেবে তিনি যখন ভাষ্য প্রস্তুত করেন, তখন পরিশীলনের সর্বশেষ স্তরে পৌঁছতে চান। এতে তাঁর বক্তব্যের ভাববস্তু এত ঘনবদ্ধ হয়ে ওঠে যে এর ফলে বক্তব্যের প্রাণরস পাঠসীমায় কম আসতে পারে। তা ছাড়া লেখার সময় স্যার তাঁর ব্যক্তিত্বের অন্যান্য ক্ষমতার সহযোগ প্রয়োগ-সামর্থ্য থেকে বঞ্চিত হন। ফলে সাহিত্য-সমালোচনার লেখক হিসেবে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় সত্যিকারের সাহিত্যাগ্রহী মনস্বী পাঠকের জন্য। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এমন একটি যুগের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি, যেখানে সাহিত্যের গভীরতর বোধসম্পন্ন মানুষের অভাবই ক্রমে বড় হয়ে উঠছে। ফলে সৈয়দ আকরম হোসেনদের মতো মানুষকে সামর্থ্য উপলব্ধি করার মানুষের ঘাটতিও বেড়েই চলেছে কেবল।

রচনাটি শুরুর লগ্নে আমার অভিপ্রায় ছিল শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও সাহিত্য-সমালোচক হিসেবে স্যারের অবদানের বিশিষ্টতাকে সমান্তরালে রেখে আলোচনা করার। কিন্তু লিখতে গিয়ে অনুভব করলাম, এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ পরিসর ও আরো অনেকটা সময়। এর জন্য তাঁর সব রচনার গভীর পুনর্পাঠ যেমন দরকার, তেমনি প্রয়োজন স্মৃতিকে আরো ভালোভাবে ঝালিয়ে নেওয়া। সময়াভাবে এই রচনায় কেবল আমার অভিপ্রায়ের কথাই হয়তো খানিকটা ব্যক্ত করবার প্রয়াস পাওয়া গেল। বর্তমান রচনারূপটির জন্যও আরো সম্পাদনা জরুরি! স্যারের লেখা সকল রচনা অবলম্বনে তাঁর সাহিত্য-সমালোচক সত্তার সম্পন্ন পরিচয় তুলে ধরবার চেষ্টা আমার অব্যাহত থাকবে এমন আকাঙ্ক্ষা জাগরূক রেখে স্যারের প্রতি আমার এই অসম্পন্ন শ্রদ্ধাঞ্জলির আপাতত যতি টানছি।