গ্রন্থ আলোচনা
বিশ্বসাহিত্যের অনবদ্য সংকলন ‘তিন হাত ঘুরে’
ভিন্নভাষী একজনের ভাষিক রূপ অন্য ভাষায় প্রকাশ করা অত্যন্ত দুরূহ বিষয়। এ ক্ষেত্রে বক্তব্য অক্ষুণ্ণ রেখে বাচনভঙ্গি আলাদারূপে প্রকাশ করার মতো মেধা ও শ্রম-ব্যয়ের কাজটি করে যান অনুবাদক শিল্পীরা। সাহিত্যাঙ্গনে অন্যান্য কষ্টসাধ্য কাজের মধ্যে অনুবাদ উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে বলে এ মাধ্যমে খুব একটা মাড়াতে চান না সাহিত্যকর্মীরা। অনুবাদ রচনার ক্ষেত্রে কেবল ভাষা সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং শিল্প-বিচার করার মতো জ্ঞান থাকাও অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার প্রেক্ষাপটে অনুবাদকে বিচার করলে তার শীর্ণকায় কলেবর বিশেষ পরিলক্ষিত হয়। বলা যায়, এ বিষয়ের ওপর কাজ করার মতো ব্যক্তিত্বের ভয়বহ আকাল যাচ্ছে। যদিও বাজারে অনুবাদ বইয়ের কোনোরকম অভাব দেখা যায় না। প্রতিবছর হাজারো বই অনূদিত হচ্ছে। কাটতিও বেশ, নেই পাঠক-চাহিদার কোনো ঘাটতি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুবাদের নামে যা হচ্ছে, তা নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছু নয়।
দুর্বল ভাষাজ্ঞান, অপরিপক্ব বাক্য গঠনশৈলী, বোধের মারাত্মক অভাব, বানান সম্পর্কে অসতর্কতা বা অজ্ঞানতা ইত্যাদি প্রকট আকারে দেখা যায় সেই সব বইয়ের পাতায় পাতায়। আর তা ছাড়া যে অভিযোগটা প্রায়শ শোনা যায়, তা চরম অমার্জনীয়। অনেকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলায় অনুবাদিত লেখাগুলো একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে লিখে নিজের নামে প্রকাশ করে যাচ্ছে হরহামেশাই। নিজেদের অনুবাদকের তালিকায় নাম লেখানোর এমন ঘৃণ্য প্রয়াসের কারণে আজ অনুবাদ-শিল্পীরা চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান। তবে অসততার মাঝেও লড়াই করে সততার লাঠি। তেমনই একজন লাঠিয়াল কবি বেলাল চৌধুরী। এ দেশে যে কজন হাতে গোনা সাহিত্যশ্রমী সততার সঙ্গে অনুবাদ নিয়ে নিরলস কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে তিনি অন্যতম।
বছর চারেক আগে একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয় তাঁর বাংলা তরজমায় নানা মহাদেশের কবিতা ও গদ্যের সংকলন ‘তিন হাত ঘুরে’ বইটি। এটি লেখকের নানা সময়ে অনুবাদকৃত সংকলিত একটি বই। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নানা ভাষাভাষী কবিদের কবিতা ও গদ্য অনুবাদ করে আসছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। নিজে একজন প্রথম শ্রেণির কবি হওয়ার সুবাদে তাঁর আছে ভাষাগত সমৃদ্ধ ভাণ্ডার ও প্রগাঢ় বোধন চেতনা। এ বইটিতে তিনি বেয়াল্লিশজন কবি ও কথাসাহিত্যিকের উপস্থিতি ঘটিয়েছেন। বইটিতে আছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস-অংশ, সাক্ষাৎকার, নিবন্ধ। কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে গ্যেটের জলদস্যু; দান্নুৎসিওর কবিতা; পাবলো নেরুদার সুরাগীতি, প্রথমে বন্দনা করি ওয়াল্ট হুইটম্যানের, মানুষের প্রতিকৃতি, রুটি স্তব, বিষণ্ণতার গান, টমেটোর স্তবগাথা, নুনের গুণগান; উইলিয়াম মেরিডিথের ভাবলেখ, স্মৃতিকথা; হাইনরিশ হাইনের ফ্রিডরেকে; পল ক্লোদেল-এর ফ্রাঁসের প্রতিমাকল্প; পোলিশ লেখক চেশওয়া মিয়োশের দীর্ঘ কবিতা অরফিউস আর ইউরিডিসি; গুন্টার গ্রাসের আমি কী নিয়ে লিখি, ফোল্ডিং চেয়ার, মুক্ত হাওয়ায় ঐকতান, আবহাওয়া; হ্যারল্ড পিন্টারের গণতন্ত্র, ক্যানসারের জীবকোষ; লিওপোল্ড সেদার সেঙ্ঘরের ইতিহাস; রবার্ট লাওয়েলের যেখানে রামধনুর শেষ, আইজায়াহ, ‘মানসিক পীড়িতদের’ জন্য এটাই নিবাস, স্কাংক আওয়ার; আর্নেস্টো কার্দেনার সোমোজা স্টেডিয়ামে সোমোজা কর্তৃক সোমোজার মূর্তি উন্মোচন; ওলে সোয়িকার একটি কবিতা; জারোশ্লাভ সিফার্টের দীর্ঘ কবিতা; প্রখ্যাত আমেরিকান কবি উইলিয়াম স্ট্যাফোর্ডের মাটির বাসিন্দা, পনেরো, মাটি থেকে শব্দ, বাই-ফোকাল; আমেরিকান নিগ্রো কবি বব ক্যফম্যানের সাড়া এবং টেড জোয়ানসের জনতার মধ্যে কণ্ঠস্বর; সি পি কাবাফির ইথাকা; জুনিচারি শুনতারোর দুই টোকিও; ভিসওয়াভা শিম্বোরস্কার বাস্তবিক দাবি; ফিলিস্তিনি কবি ফাদেল আলীর জেরুজালেমের গান এবং রশীদ হুসেইনের একটি ঠিকানা; সিজারে পাভেসের কারাগার; শাঁতোব্রিয়েঁর কেমবুর্গের জীবন; পাবলো আন্তনিও কুয়াদ্রার দুটি জ্বলন্ত নক্ষত্রের হৃদয়, বিশিষ্ট স্থপতি লুই আই কানের কার্লো স্কার্পার কাজে; এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্রীপন্থী নেত্রী অং সান সুচির দুটি কবিতা শান্ত-নিথর দৃষ্টিতে, মুক্ত পাখিরা মুক্ত বার্মার দিকে।
আরো আছে হোর্হে লুইস বোর্হেসের কবিতা রক্ষাকবচ এবং প্রতীক্ষা, অনুপ্রবেশকারী, চাকতি নামে তিনটি ছোটগল্প; অক্টাভিও পাজ-এর সুদীর্ঘ কবিতা দুই উদ্যানের কাহিনি এবং গল্প তরঙ্গের সঙ্গে আমার জীবন। গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ফ্রানৎস্ কাফকা-এর রূপান্তর, আরবীয় সাহিত্যে তরুণ গল্পকার সালাহ হাসান-এর একটা কাচের বাক্স-য় ডিক এল জিনের শিশিরকণা সংগ্রহ; তরুণ আর্হেন্তেনীয় লেখক লিলিয়ানা গনজালেস দ্য লেডোর সেনর অগাস্টো; প্রতিভাবান সুইডিশ লেখক অ্যান্ডার্জ হার্নিংয়ের এক-মুখো খচ্চর; সাহিত্য-ঐতিহাসিক এবং সুইডেনের অন্যতম সমকালীন লেখক ডেন ডেনব্লাংকের এক স্যুটকেস ভর্তি পেরেক; জাপানি কথাসাহিত্যিক মাৎসুমোতোর অ্যানিম্যাল রোড উপন্যাসের কিয়দংশ; শিন ইচি হোশির প্রেমের কুঞ্জি; ইবুসে মাসুজির সালামান্দার; আধুনিক জাপানের একজন অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও আভাগার্দ নাট্যকার আবে কোবোর লাল রেশমগুটি; মিশিমা ইউকিওর যে ছেলেটি কবিতা লিখত; এলিয়াস কানেত্তির গল্প উটের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
ইন্দোনেশিয়ার প্রাক্তন পরলোকগত প্রেসিডেন্টের বিধবা পত্নী জাপানসুন্দরী রত্না শারি দেবী সুকর্নের সঙ্গে এন্টনি লোপেজের আলাপচারিতা ‘রাজনীতি, প্রেম, ব্যবসা, শ্যাম্পেন এবং স্মৃতি বিষয়ে’ শিরোনামে একটি দুর্লভ সাক্ষাৎকার এরই সঙ্গে সংকলিত হয়েছে। সবশেষে আছে জেন মাইয়ূরের গণিতবিষয়ক গদ্য গণিতবিদ কার্ল ফ্রিডরিক গাউস। অনুবাদকের দেওয়া তথ্যসূত্রে জানা যায়, এ তরজমাটি প্রকাশিত হয়েছিল শক্তিমান কথাকার কমলকুমার মজুমদার সম্পাদিত ‘অঙ্ক ভাবনা’ পত্রিকায় (প্রথম সংখ্যা, ১৯৬৫, কলকাতা)। বইটিতে অনুবাদক প্রায় প্রতিটি লেখার নিচে উক্ত লেখক সম্পর্কে ছোট পরিসরে জানা-অজানা নোট দিয়ে ভিন্নতা এনেছেন।
১৯২ পৃষ্ঠার বইটি শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল ২০১২ সালে। বইটির দাম রাখা হয় ৩২৫ টাকা।