সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
পুরাটা বছর দেওভোগ গেরামের নানা জোনে বান-বাতাসের ডরে খালি কঁকাইছে। ডরাইয়া কেবল কাঁপাকাঁপি দিছে। কিন্তু গেরামের একজোনেরে কোনো ডর কোনোরকমে কাতর করে নাই। কোনো কিছু নিয়াই সেই একজোনের কোনো ডরডারি লাগে নাই। সেয় হইতাছে জুলেখার মায়।
আর তার কিয়ের ডর! দিনে-দোপোরে যার মাথায় ঠাটা পড়ে; যার আঞ্চল তেনে একমাত্র নিধি খোয়ানি যায়, দেহের ভিতর তেনে কইলজাখান নাই হইয়া যায়—সেয় কী আর জ্যাতা মানুষ থাকে? থাকে না। দশজোনের চক্ষে দেখতে তারে জ্যাতা দেহাইতে পারে, কিন্তুক আসোলে সেয় মরা। মরার আর কিয়ের ডর!
বান-বাতাসের আনাগোনার খবর শুইন্না জুলেখার মায়ে ডরায় নাই। ডরান তো দূর, তার পরান দেখো অই সংবাদে ছলকানি দিয়া উঠছে! ছলকানি দিয়া উঠছে আশায়! ওরে মাবুদ! এইবার তো তাইলে আমার হারানিধির সঠিক সংবাদ পাওনের একটা পোথ পাওয়া গেলো! এই একটা বছর জুলেখার মায়ে যতোবার যতোজোনের মোখে সেই আচানক মাতারির দর্শন পাওনের কথাখান শোনছে, লগে লগে সেয় লৌড়ানি দিয়া গেছে সেই দর্শন-দেওনের জায়গায়।
এট্টু যদি সেয় তার দর্শনখান পায়! যদি তার দেখা পায় ! একবার যুদি পাইতো! খালি একবার! তয় জুলেখার মায় লগে লগে সেই সাদা কাপোড় পিন্ধইন্না জোনের পাও দুইখান খপ কইরা ধরতো! তার পাও ধইরা পইড়া থাকতো জুলেখার মায়ে।
পাও ধইরা হত্যা দিয়াই কি খালি সেয় পইড়া থাকতো? না না! চক্ষের পানিতে সেই পাও দুইখানরে ধুইয়া, নিজের চুল দিয়া তরিজুত কইরা মোছাইতো ছার-কপালি জুলেখার মায়ে। তার বাদে নিজের গলায় নিজের আঞ্চলখান জড়ানি দিয়া জুলেখার মায়ে সেইজনরে জিগাইতো, সেয় নি তার পোড়াকপালি না-বুঝ মাইয়াটার কোনো সন্ধান জানে!
জিগাইতো, আর সেই সোনার পরতিমারে ফিরতি পাওনের কোনো রাস্তা নি আছে! কোনোরকমে নি তার কোলে ফিরত আইবো কোলের ছাও জুলেখায়! যদি মাইয়ার ভালাইয়ের লেইগা মায়েরে বুক চিরা রক্ত দেওন লাগে, তো দিবো মায়ে। অক্ষণ দিবো! খালি তার মাইয়ায় ফিরত আহুক ঘরে! বান-বাতাসে খালি তার জুলেখারে ফিরতি পাওনের রাস্তাখান বাতাইয়া দেউক জুলেখার মায়রে! এই দয়াখান করুক সেয়!
সেই কারণে গেরামের লোকে যখন বান-বাতাসের ডরে ধুঁকতে থাকছে, জুলেখার মায়ে তখন বনবনাইয়া ঘুরানি দিছে গেরামের এই মাথায় সেই মাথায়। সন্ধ্যা নাই দোপোর নাই সকাল নাই বিকাল নাই—সেয় খালি গিয়া হত্যা দিয়া পইড়া থাকছে গেরামের সগল নিরালা আপথ-আঘাটায়। যুদি তগবগা লাল-পাইড়ের সাদা কাপোড় পিন্ধইন্না জোনের লগে একবার দেখাটা হয়—খালি একবার! এই আশায় আশায় ছোটার সে কোনো কমতি রাখে নাই। ছোটছে আর খালি ডাক পাড়ছে, বান-বাতাস মাগো! আমারে একবার দেখা দেও! একটা বার খালি আমারে দেখা দেও মা!
কিন্তু কপালের ফের তার কাটে নাই। বান-বাতাসে তারে গেরাজ্জি করে নাই। সেই কারণেই গেরামের সগল মাতারিরে যেয় কিনা যখন তখন, যেইনে মন চায় সেইনে, দেখা দিয়া গেছে; সেয় একবারও জুলেখার মায়েরে দর্শন দেয় নাই! একটাবারও না।
তার সাক্ষাৎ পাওনের আশা নিয়া চক্ষের পানি মোছতে মোছতে, দিনে-রাইতে, এইদিগে-সেইদিগে কম তো ছোটে নাই জুলেখার মায়ে! এগো বাড়ির নামায়, তাগো বাড়ির ঘাটায় গিয়া না থির হইয়া বওয়া দিয়া থাকছে সেয় কতো কতো বার!
বইয়া থাইক্কা থাইক্কা, বার চাইয়া চাইয়া; এক সোম নৈরাশ হইয়া আবার কান্দতে কান্দতে বাড়ির দিগে মেলা দিছে। কিয়ের খাওয়া কিয়ের লওয়া কিয়ের কী! নিজের দিগে নজর দেওনের আর কোনো ইচ্ছা, এট্টু কোনো শক্তি—কিচ্ছুই আর নাই তার।
অখন বিয়ানে-সন্ধ্যায় জুলেখার মায়ে কোনোরকমে চুলাটারে ধরায়—খালি দুগা ভাত ফুটাইতে। শোক-তাপ, আগুন-পানি সব নিয়াও বাড়ির বেটাটারে তো কর্মে যাওন লাগে! যাওন লাগে তামানটা দিনের লেইগা। বিয়ানবেলা সেই মানুষটারে হুদা মোখে যাইতে দেয় কোন পরানে জুলেখার মায়ে! আর, খাটা-খাটনি কইরা তামানটা দিনের বাদে ঘরে আইয়া সেয় হুদা মোখে থাকেই বা কেমনে!
সংসারে আউজকা খালি অই বেটাটার পাতে ভাত দেওনের এই একটা ঠেকাই আছে জুলেখার মায়ের। তার নিজের আর খাওনই বা কী, আর উপাসই বা কী! দুনিয়ার কোনো কিছু নিয়া আর কোনো ঠেকা-টান্ডা-ধার-টান নাই তার। সব শেষ হইয়া গেছে! তার এই পোড়া-আংড়া জিন্দিগি বাঁচে তো বাঁচবো! নাইলে গেলে গা যাইবো। আর কী! কিছু না।
এইর মিদে আঁতকা শোনা যায় কোন কথা? না, ইমাম হুজুরে বোলে গেরাম বন্ধ করোনের কাম শুরু করছে! বান-বাতাসের আনা-যানা বন্ধের বেবস্থা নিতাছে বোলে সেয়! কথাখান শুইন্নাই দেওভোগের প্রায় সগল ঘরের সগলতের কইলজার ডর এক দমকে নাইম্মা যায়। তাগো মোনে হইতে থাকে যে, এইবার বাঁচলাম! আর ডর নাই!
কিন্তুক জুলেখার মায়ে সেই খবর পাইয়া খুশি হইবো কী, নিজের কপালরে থাবড়াইয়া কাইন্দা জারেজার হয়। কান্দতে কান্দতে সেয় মাটিতে উপুড় হইয়া পইড়া থাকে তামানটা দিন। এইটা কী করতাছে ইমাম হুজুরে! হায় আল্লা! সেয় ক্যান এমুন বৈরী হইলো জুলেখার মায়ের?
এইটা কিমুন দুশমনি গেরামের হগলতের! বান-বাতাসরে খেদাইলে জুলেখার সন্ধান পাওনের রাস্তা যে বন্ধ হইয়া যাইবো, সেই কথা বিচার করতাছে না ক্যান তারা! জুলেখার মায়ের অন্তর চিক্কুর পাড়তে পাড়তে কইতে থাকে, কী হইতো গেরামখানরে বন না করলে! যেয় দেখা দিতাছিলো, সেয় তো কেউর অমঙ্গল করতাছিলো না! যেমন আওয়া-যাওয়া করতাছিলো, করতো সেয়! কেউর লগে তো কোনো শত্রুতামি করে নাই বান-বাতাসে! তাইলে তারে খেদানের লেইগা ক্যান এতো কুত্তা-খাইয়া পাগল হইছে একেক জোনে!
বান-বাতাসে কী খালি আজাইরা কারোনে এমুন আনা-গোনা দিতাছে! না না! কেউ না বুঝুক, জুলেখার মায়ে ঠিকই বোঝতাছে, ক্যান আনাগোনা দিতাছে সেয়। মায়ের দিল খোনে খোনে কইতাছে, সেই মাতারিয়ে বিনা কারোনে দেওভোগে আইসা হাজির হয় নাই! বিনা বাতাসে গাঙ লড়ে না ! লড়ে না।
আজাইরা কামে আওয়ার হইলে আগেপিছে আর কোনো সোমে আহে নাই ক্যান! আইছে কোনসোম? আইছে ঠিক জুলেখায় হারানি যাওনের পর পর! যখন মাইয়াটার কোনো খোঁজ পাওনের আর কোনো রাস্তা মাইনষের সামোনে খোলা নাই, তখনই সেয় আইসা হাজির হইছে।
সেয় আইছে জুলেখার খবর লইয়া। সেয় জুলেখার বিষয়েই কোনো না কোনো সংবাদ দিতে আইছে! আহহারে! ক্যান সেয় জুলেখার মায়েরে দেখা না দিয়া, অন্য মানুষগো দেখা দিতাছিলো! সেয় কী জুলেখার মায়েরে তার সাক্ষাৎ পাওনের উপযুক্ত মোনে করে নাই!
এই দুক্ষু-জ্বালা নিয়া কয়দিন নিজে নিজে তড়পায় জুলেখার মায়ে; তার বাদে সেয় জুলেখার বাপেরে সগলকথা ভাইঙ্গা কয়। কইয়া, ইমাম হুজুরের কাছে যাওনের লেইগা তারে নানামতে মিন্নতি করতে থাকে।
তয় কারেই বা কী কয় জুলেখার মায়! মাইয়ায় নিরুদ্দিশের পর তেনে তার বাপে ঠেকা কামে লড়েচড়ে ঠিক; কিন্তুক করে কোনোরকমে। সেয় চলেফিরে য্যান পুরা বোবা, বয়রা-ধেন্ধা, নিশিয়ে-ধরা এক মনিষ্যি। দশ কথারও একখান জব পাওয়া যায় না আর তার মোখ তেনে। দশ ডাকেও একটা সাড়া দেয় না বেটাটায়।
সেই মানুষটারে জুলেখার মায়ে ভেগাভেগা কইরা মিন্নতি করতে থাকে। একবার মোখে করে, একবার তার পাও দুইটা ধইরা করে। জুলেখার মায়ে তারে মিন্নতি কইরা কয়, সেয় য্যান ইমাম হুজুরের কাছে একটাবার যায়।
গিয়া য্যান তারে কয়, এই গেরাম বন্ধ-করানির কামখান হুজুরে কয়দিন পরে করুক! আর কয়দিন পরে! আগে ইমাম হুজুরে সেই আঁতকা আঁতকা দেখা-দেওয়া মাতারির লগে এট্টু দেখা সাক্ষাৎটা সাইরা লউক! জাইন্না লউক, এই বান-বাতাসে জুলেখার কোন সংবাদ নি আনছে!
আরো জানোনের কাম যে, কোনো ভোগ কী সেয় চায় ? ভোগ পাইলে কী সেয় জুলেখারে ফিরত পাওনের রাস্তা দেখাইয়া দিবো? ইমাম হুজুরে আল্লার রাস্তার মানুষ। দোয়াকালাম জানা পরহেজগার লোক। সেয়ই খালি এই গেরামের একজোন, যেয় কিনা পষ্ট বোজবো, কী চায় অই মাতারি!
জুলেখার বাপে নিজের পরিবারের এইসগল কথার জব দেওয়া তো দূর, মিন্নতিখানরেও কানে নেয় নাই। জুলেখার মায়ে তাইলে আর কী করবো! নিজের কপালে মারোন ছাড়া তার আর কিছু করোনের নাই। নিজে গিয়া কেমনে সেয় ইমাম হুজুররে কথাটা কইবো! জিন্দিগি পুইড়া আংড়া হইয়া গেছে ঠিক, কিন্তু জুলেখার মায়ের চক্ষের তেনে শরম-হায়া তো ঘোচে নাই!
হুজুরে একলা পাওয়া গেলেও নাইলে কোনোমতে কথাটা কওন যাইতো! কিন্তু তারে একলা পাওনের কোনো পোথ অখন জানা নাই জুলেখার মায়ের! অখন তো ইমাম হুজুরে আর তাগো বাড়িতে একটা পাড়াও দেয় না যে, সেয় হুজুরের কাছে কথাখান তোলোনের একটা ফুরসত পাইবো!
আর, কইলেই নি সেয় হোনবো একটা মাতারির কথা! পুরুষপোলার মোখ তেনে কথাখান গেলে—সেইটা যেমুন ওজনদার হইবো, জুলেখার মায়ের কথা কী তেমুন ওজনদার শোনাইবো! শোনাইবো না।
এমনে এমনে ক্রমে একদিগে, ইমাম হুজুরে পোলাপাইনটিরে লইয়া দিনের পর দিন গেরাম-বান্ধানি দিতে থাকে; আরেকদিগে, অন্তরের কান্দন চক্ষে নিয়া নিয়া গেরামের এই ঘাটায় সেই ঘাটায় লৌড়-ছুট দিতে থাকে জুলেখার মায়।
লৌড়-ঝাঁপ দিতে থাকে সেয় সেই অশৈলী বান-বাতাসের লগে এট্টু সাক্ষাৎ করোনের আশায়! কোনোমতে যুদি একটাবার, খালি একটাবার তার সাক্ষাৎ মিলে! এট্টু যুদি হের লগে দেখা হইয়া যায়! এট্টু যুদি মাইয়াটার কথাটা তারে জিগানের সুযোগটা পায় মায়ে!
এই যে গেরামের এক বাড়ির পর্দা-পুশিদাঅলা একজোনে, আঁতকা এক আচুইক্কা কাম করা শুরু করছে; এই যে সেয় দিনের পর দিন কেমুন বেতালা হইয়া কই কই যাইতাছে, কই কই গিয়া বইয়া থাকতাছে, বিষয়টা কি গেরামের দশজোনের নজরে আহে নাই? বিষয়টা তাগো নজরে আসছে।
এই যে একটা গিরস্থ ঘরের বউ, যেয় কিনা নিজেগো বাড়ির ঘাটায় তরি লাম্বা ঘোমটা না দিয়া যায় নাই কোনোকালে, সেয় যে অখন এমুন আউল্লা-পাতাইল্লা ছুট দিয়া গেরামের ঘাটা-আঘাটায় যাওয়া ধরছে—এই যে অখন, কই থাকতাছে তার মাথার কাপড়, কই থাকতাছে তার কাপোড়ের আঞ্চল—এইটা কি ইমাম হুজুরের গোচরে আহে নাই?
এই যে সেই গিরস্থবাড়ির বউ ক্ষেত-পাতর কিছু খেয়াল করতাছে না, খালি ছোটতাছে। ছুইট্টা গিয়া এর বাড়ির ছিটালের কিনারে, তার বাড়ির নামার জিক্কা গাছের তলে গিয়া বইয়া থাকতাছে তো থাকতাছেই—বিষয়খান কি ইমাম হুজুরের নজরে আহে নাই? আইছে।
ইমাম হুজুরে অই বিষয়টারে নিয়া ভিতরে ভিতরে ভাবনাচিন্তাও কিছু কম করে নাই। অনেক করছে। কইরা, সেয় যেই ফায়সালাখান পাইছে, সেইটা ভালা কিছু না। ইমাম হুজুরে পরিষ্কার বুঝছে যে, আরেক সব্বনাশ হইছে! এইটা আর কিছু না! এইটা হইতাছে জুলেখার মাওয়ের মাথা-খরাপ হওনের লক্ষণ!
আহারে! সন্তানশোকে মাও-টার মাথায় দোষ পইড়া গেছে! একে খোয়াইছে সেয় তার একমাত্র নিধিরে! আবার এদিগে দেহো তার মাথায়ও কিনা দোষ পইড়া গেলো! অখন জুলেখার মায়ের সংসারই বা কে দেখে! আর, এই মাতা-খরাপ মাতারিরেই বা কে দেখে! কাটা ঘাওয়ের উপরে আর কতো নুনের ছিটা দিবা রে বিধি!
জুলেখার মায়ের মাথা-খরাপের লক্ষণখান নজরে আসার পরে ইমাম হুজুরের অন্তরে খোনে খোনে কিসের জানি কামড়ানি পড়তে থাকে! ইয়া মাবুদ! কেমুন গরদিশের তলে পড়ছে এই মা-বাপ দুইটায়! ইয়া পাক পরোয়ারদিগার!
একবার হুজুরের মোনে লয় যে, যাই; গিয়া দুক্ষে ফাতাফাতা মাও-বাপটারে এট্টু বুঝ দিয়া আহি! আবার লগে লগেই তার অন্তর বেদনায়-শরমে কুঁকড়াইয়া যায় কোন মোখে সেয় বুঝ দিতে যাইবো অই পোড়া-দগ্ধা মানুষ দুইটারে!
মাইয়াটার সন্ধান পাওনের কোনো বেবস্থা তো ইমাম হুজুরে করতে পারে নাই! পারছে সেয় কোনো উপায় বাইর করতে? কিছুই পারে নাই। এমনে এমনে দুনিয়ার রাস্তা দিয়া তো পারে নাইই; গায়েবি-বাতেনি পথ দিয়াও পারে নাই! অখন তাগো সামোনে গিয়া সেয় কী কইবো!
কোনো কিছু দিয়াই নি আর তাগো কইলজার কান্দন ঘোচানের কোনো উপায় আর কোনো মানুষের হাতে আছে! নাই, নাই! তাইলে আর কী! থাকুক হেরা দোনোজোনে, যেমনে পারে থাকুক নিজেগো মতোন। আল্লায় তাগো দিলের জ্বালা দূর করুক! মাইনষে আর কী করবো! আল্লার দরবারে দোয়াটুক করা ছাড়া তাগো আর করোনের কিছু নাই। হুজুরে দোয়া করে, আল্লাপাক য্যান অই দাগা-খাওয়া পরানরে শান্তি দেয়!
জুলেখার সন্ধানের কামে বিফল হইয়া কষ্টে-শরমে আর অই বাপ-মাওয়ের সামোনে গিয়া খাড়া হওনের মোখ পায় নাই ইমাম হুজুরে! নিজের মোনে কতো কথা লড়ছে-চড়ছে তার। এক মোনে হইছে—যাই। এক মোনে হইছে—কোন মোখে যামু!
এমনে এমনে নানা কথা মোনে কইরা কইরা নিজে নিজেই খালি বাউলি কাটছে হুজুরে। কিন্তু কোনো মতেই সেয় একটা দিনও যাইতে পারে নাই অই বাড়িতে! যায় নাই ঠিকই, কিন্তু তার নিজের ভিতরের পরান-দগ্ধানিরে সেয় নিভানি দিতে পারছে? পারে নাই।
ঘুঁষঘুষাইয়া দগ্ধাইয়া চলছে হুজুরের অন্তর, সকল সময়। খালি তার মোনে হইতে থাকছে, এমনে এমনে একলা ধুঁকতে থাকবো গেরামের একটা ঘরের দুইটা নিরাছারা, উপায়ছাড়া মানুষ! চক্ষের উপরে এমুন ধুঁকতে থাকবো! আর তারা সগলতে দেইক্ষাও দেখবো না! এইটা নি মাইনষের কাম! এমুন কেমনে চলতে পারে!
চিন্তাভাবনা কইরা কইরা শেষ নাগাদ য্যান একটা পোথের লাগাল পায় ইমাম হুজুরে। তার মোনে হয়, যে, ইসুফ মিয়ার বাপ-মায়ের লগে গিয়া এই বিষয়খান নিয়া শল্লা করলে একটা উপায় বাইর হইবোই হইবো! শেষে একদিন, বিত্তান্তটা নিয়া কথা কইতে ইসুফ মিয়াগো বাড়িতে যায় ইমাম হুজুরে।
সেয় গিয়া শোনে যে, বড়ো ভালা একখান ঘটনা ঘটছে! আইজ-কাইল কয়দিন হয়—ইসুফ মিয়ার মায়ে নিত্যি যাইতাছে জুলেখার মায়ের কাছে! অই বাড়িতে অখন কোনো একটা দিনও সেয় যাওয়া বন রাখতাছে না!
জুলেখাগো বাড়িতে যাওনের তাগিদাটা আরো আগেই আইছে ইসুফ মিয়ার মায়ের অন্তরে; কিন্তুক বিমারী পুতটারে ভালামতোন খাড়া না কইরা মায়ে কোনোদিগে এক পাওও দিতে চায় নাই! তখন অন্তরের তাগাদা অন্তরে থুইয়া পুতেরে যতন করছে মায়। কোনোদিগে লড়ে নাই!
অখন তো খোদার মরজি ইসুফ মিয়ায় টেমাইয়া-টোমাইয়া হইলেও চলাফিরা শুরু করছে! ইসুফ মিয়ার মায়ে আর তাইলে দেরি করবো কোন কারোনে! তগ-নগদ সেয় গিয়া জুলেখার মাওয়ের ভালা-বুরার তদারকি দিতাছে!
মোখে একটা আওয়াজও না কইরা ইমাম হুজুরে এই সগল কথা শোনে। আর অন্তরে অন্তরে বারেবারে কইতে থাকে; আল্লা শুক্কুর! শুক্কুর তোমার দরবারে মাবুদ! তোমার দুনিয়ায় মাইনষের দিলে অখনও মাইনষের লেইগা মায়া-দর্দখান আছে খোদা ! কেয়ামত দূরে আছে তাইলে অখনও ! ছোবহানাল্লা!
এইমতে জুলেখার হারানি যাওনের পরে এক বছর যায়, দুই বছর যায়, তিন বছরও যায়। দেওভোগ গেরামে লোকে আবার দিন পার করতে থাকে শায়-শান্তি হালে।
জুলেখার নিরুদ্দিশ হওনের পরে পরে গেরামের মাইনষের অন্তরে যে ডর ঢুকছিলো, দিনে দিনে ক্রমে ক্রমে সেই ডর সগলতের অন্তর তেনে ফিঁকা হইয়া যায়! এমুনই দুনিয়ার নিয়ম! ঝড়-তুফান, বালা-মুসিবত আইসা পুরা মিসমার কইরা দিতে চায় লোকের জিন্দিগি-বিরিক্ষিরে। কিন্তু সেই বিরিক্ষির তাগদ দেখো! সে মচকায়, কিন্তু ভাঙ্গে না। টুন্ডা, নেড়া, ভাঙ্গা গাছের ঠাইল্লায় ঠাইল্লায় আবার ফুঁচকি দেয় নয়া পুখরী। রইদে-মেঘে ভিজতে ভিজতে সেই পুখরী তরতাজা হয়। হাসে খেলে, ঝরতে থাকে। আবার নয়া পুখরী মোখ তোলে!
একটা বাড়ির দুই জোন মনিষ্যির জীবন ছাড়া, দেওভোগ গেরামের আর সকল লোকের জিন্দিগির নয়া পুখরীই দিনে দিনে, সুখে-দুক্ষে ডগমগ হইতে থাকে। গেরামরে বান্ধন-দেওনের পরে আর কোনো বান-বাতাসের আনা-যানাও কেউর নজরে আসে না। গেরাম-বান্ধনের পরে, আর একবারও কোনোজনে কোনো অশৈলী কারবার ঘটতে দেখে না গেরামে।
অখন, জুলেখার মোখখানও আর তেমুন পষ্ট কইরা লোকের স্মরণে আসে না। কিন্তু তার হারানি-যাওনের কথাখান সগলের মোনের ভিতরে গাইত্থা থাকে। সেই কথাখানা পরস্তাবের মতোন সগলতের মোখে মোখে ফিরতে থাকে।
এমনে চলতে চলতে তিন বছর গিয়া দেওভোগ গেরামে আসে চতুর্থ বছর।
(চলবে)
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)