পর্ব ১
আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে জীবনের প্রথম গল্প লেখেন তিনি। সেই গল্প প্রকাশিতও হয় সে সময়ের বিখ্যাত ‘বিচিত্রা’ পত্রিকাতে। পাঠকমহলে হয় প্রশংসিত। তার পরেরটুকু কেবলই ইতিহাস। আর থামেনি কলম। বন্ধুর বাজিতে জিত হয় তাঁর, পাশাপাশি জয় করেন অগুনতি পাঠকের হৃদয়। তবে এই মানুষটিই একসময় বাজি ধরেন তাঁর নিজের জীবনের ওপর। কারো অধীনে চাকরবৃত্তি করে নয়; বরং নিজের মেধা ও কলমের জোরে একক হতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই বিচ্ছিন্নভাবে দু-একবার নিশ্চিত আয়ের লক্ষ্যে কর্মক্ষেত্রে পা রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু সেখানে আপস করে টিকতে পারেননি বেশিদিন। দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আর অদম্য জেদের বশেই কেবল লেখালেখিকে সম্বল করে তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন। তবে দুই ‘অ’, মানে ‘অসুখ’ ও ‘অভাব’ সেই বাজিতে বারবার নাজেহাল করে তাঁকে। মৃগী রোগ ও চরম দারিদ্র্য তাঁকে বহন করতে হয়েছে আমৃত্যু।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে হঠাৎ রাস্তায় অধ্যাপক দেবীপদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। ‘যুগান্তর’ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় গল্প দিতে যাচ্ছিলেন তিনি। তাঁকে দেখে খুব কষ্ট হয় দেবীপদের। তাঁর শীর্ণ দেহ, নিকেলের চশমা, মলিন বেশ-বাস, ঘর্মাক্ত চেহারা—সব মিলিয়ে সেদিন খুব বেদনা বোধ করেন দেবীপদ। তাই রাস্তা থেকেই একরকম ধরে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে। ক্লান্ত মানুষটিকে কিছু খেতে দিলেন দেবীপদের মা। বড় তৃপ্তির সঙ্গে খেলেন তিনি। হঠাৎ দেবীপদকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাঙলা দেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’
হ্যাঁ, আমি প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই বলছি, যাঁকে আমরা সবাই চিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামে। সাহিত্যের এ অম্লান মানিক ছিলেন রবীন্দ্র ও শরৎ-পরবর্তী অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক। নিজের জীবনকে তো বটেই; মানুষের জীবনকেও তিনি প্রথমে দেখেছে ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্বে, পরে মার্কসীয় দর্শনে। কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত সাহিত্যকর্ম মানিকের শ্রেষ্ঠ, তা বিতর্কসাপেক্ষ বিষয় হয়ে আছে এখনো। মানিকের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে লেখা হয়েছে এই লেখা, তবে সেটা গতানুগতিক রীতিতে নয়। মানিকের মুখ থেকেই শুনিয়েছি তাঁর যাবতীয় কথাবার্তা।
জীবদ্দশায় মানিক বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতিকথা ছাড়া কোনো জীবনীগ্রন্থ রচনা করে যাননি। তা ছাড়া পৃথিবীর কোনো লেখকের পক্ষে সম্ভব নয় তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনার বর্ণনা করা। আমি কেবল একটি আঙ্গিক তৈরি করতে চেয়েছি। এই সময়ের এসে দাঁড়িয়ে মানিক যেভাবে বয়ান করতেন তাঁর জীবন থেকে মৃত্যু অবধি যাবতীয় কথা, আমি সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। কতটুকু সফল হয়েছি, তা বিজ্ঞ পাঠকই ভালো বলতে পারবেন। —লেখক
নিতান্ত সাদামাটা একটি দিনে জন্ম হয় আমার। সময়টা ১৯০৮ সালের ১৯ মে। সে সময় খ্রিস্টাব্দের হিসাবে নয়, বরং বঙ্গদেশে সবকিছুর হিসাব রাখা হতো বঙ্গাব্দ অনুসারে। বাংলা সন অনুযায়ী তাই আমার জন্মসাল ১৩১৫ সনের ৬ জ্যৈষ্ঠ, মঙ্গলবার। তবে মধ্যবিত্ত ঘরের এক বাঙালি ব্রাহ্মণকুলের সন্তান হলেও বাংলার কোনো অঞ্চলে ভূমিষ্ঠ হইনি আমি। ভারতের বিহার রাজ্যের সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহর, বর্তমানে যা ঝাড়খন্ড রাজ্যে অবস্থিত, সেটাই আমার জন্মস্থান। সেই জায়গাটি ছিল আমার বাবা শ্রী হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাকরিসূত্রে কর্মস্থল। সেখানেই চার ভাইবোনের পর জন্ম হলো আমার। জন্মের সময় ফুটফুটে কালো সুন্দর ছিলাম আমি। তাই আঁতুড়ঘরেই আমার নাম রাখা হয় ‘কালো মানিক’।
ব্রাহ্মণ-সন্তানের জন্মঠিকুজি হবে না, তা তো হয় না। রীতিমতো গণক ডেকে আমার জন্মের তিথি-ক্ষণ বিচার করে নক্ষত্রের অবস্থান এবং রাহু-কেতু-শনি-মঙ্গলের দশা নির্ণয় করে করা হয় ঠিকুজি। শীর্ণকায় কাগজ পরপর জোড়া দিয়ে দীর্ঘকায় করা হয়। তার ওপর কষা হয় হিসাব-নিকাশ। ঠিকুজিতে আমার নাম রাখা হয় অধরচন্দ্র। যদিও এই নামে কেউ ডাকত না আমায়। এমনকি বাড়ির মানুষও পর্যন্ত একসময় ভুলে যায় আমার এই ঠিকুজি-নামটি। বাবা সাধ করে আমার নাম রাখেন প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ওই যে বললাম, গায়ের রং কালো ছিল আমার, তাই বাড়ির সবার কাছে আমি ছিলাম ‘কালো মানিক’। একসময় নামের আগে স্বাভাবিকভাবেই ঝরে যায় ‘কালো’ শব্দটি। অবশেষে নাম গিয়ে দাঁড়ায় কেবল ‘মানিক’। এভাবেই আমার ডাকনাম একটা সময় হয় ‘মানিক’। এ ক্ষেত্রে একটি কথা বলে রাখি। আমার পোশাকি নাম যে প্রবোধকুমার, তা বহু বছর সাধারণ মানুষের কাছে ছিল অজানা। আমার এই অনেকাংশে অজানা নামটি আমি প্রথম জনসমক্ষে প্রকাশ করি কলকাতার ‘আকাশবাণী’ বেতারের এক অনুষ্ঠানে। আমার এ ঘটনাটির কথা উঠে আসে প্রাবন্ধিক ও গবেষক হায়াৎ মামুদের ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা : যাপিত জীবন’ নামে প্রবন্ধেও। সেই রচনার এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেন, “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল পিতৃদত্ত নাম যে প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তা আমরা জানতে পারি তাঁরই জবানিতে। তবে, সে অনেক পরে; তত দিনে তাঁর নিদেনপক্ষে ১৩টি উপন্যাস ও আটটি ছোটগল্পগ্রন্থ বেরিয়ে গেছে। কলকাতার ‘আকাশবাণী’ বেতার কেন্দ্রে সম্প্রচারিত একটি কথিকায় ও সংকলিত লেখকের কথা প্রবন্ধগ্রন্থে ‘গল্প লেখার গল্প’ রচনাটিতে তিনি এ-তথ্য জানিয়েছেন। দর্পণ উপন্যাস প্রকাশের (১৯৪৫ সাল) সমসাময়িক এ-ঘটনা। তাঁর বয়স তখন ৩৭ বৎসর।”
১৯৪৫ সালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে কী বলেছিলাম আমি, তা না হয় জানা যাক এবার। আমার প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘অতসীমামী’ গল্পের পটভূমি উল্লেখ করে আমি অনেক অজানা কথা তুলে ধরেছিলাম পাঠকের কাছে। ‘আমার গল্প লেখা’ আলাপচারিতায় আমি সেদিন বলেছিলাম, “ভাবলাম এই উচ্ছ্বাসময় গল্প [অতসীমামী] নিছক পাঠকের মনভুলানো গল্প, এতে নিজের নাম দেব না। পরে যখন নিজের নামে ভালো লেখা লিখব, তখন এই গল্পের কথা তুলে লোকে নিন্দে করবে। এই ভেবে বন্ধু কজনকে জানিয়ে গল্পে নাম দিলাম ডাকনাম মানিক।”
আমার বাবার আদিনিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মালপদিয়া গ্রামে। আমার মা নীরদাসুন্দরী দেবীর বাড়িও একসময় ছিল সেই বিক্রমপুরেরই গাওদিয়া গ্রামে। এটি পূর্ব বিক্রমপুরের একটি গ্রাম। বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানায় পড়েছে সেটি। পদ্মার একেবারে কোল-ঘেঁষা এ গ্রামটি এখনো আছে। পদ্মার ভাঙনে অনেক গ্রাম বিলীন হয়ে গেলেও এই গাওদিয়া গ্রামটি টিকে আছে তার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে। এ ক্ষেত্রে একটি তথ্য বলে রাখা ভালো, সত্যিকার অর্থে বিক্রমপুর নামে এখন আর কোনো অঞ্চল নেই। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, একসময় ঢাকা জেলার অন্তর্গত মুন্সীগঞ্জ মহকুমায় ছিল বিক্রমপুর। মুন্সীগঞ্জ এখন জেলা হয়ে গেছে। সেইসঙ্গে সরকারি নথি থেকে পদ্মার ভাঙনের মতো করে বিলীন হয়ে গেছে বিক্রমপুর নামটিও। উপমহাদেশের এ বিখ্যাত অঞ্চলটি এখন কেবল এক কিংবদন্তি হয়ে বেঁচে আছে, মানুষের মুখে মুখে। বিক্রমপুরের সন্তান কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন তাঁর ‘গাওদিয়া’ শিরোনামের প্রবন্ধে অনেকটা আক্ষেপ করেই তাই বলেছেন, ‘যে বিক্রমপুর ছিল বিখ্যাত মানুষদের জন্মের অহংকারে অহংকারী, সেই নামটিই এখন নেই।’ সেই প্রবন্ধের সূত্রে আরো জানা যায়, এই বিক্রমপুরের ‘মালখান নগরে’ ছিল প্রখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব বসুর বাড়ি। আর তাঁর স্ত্রী, কথাসাহিত্যিক প্রতিভা বসুর গ্রামের বাড়ি ছিল ‘ষোলঘর’। কথাশিল্পী সমরেশ বসুর বাড়ি ছিল ‘রাজানগর’ আর সুবোধ ঘোষের ছিল ‘বহর’। এ ছাড়া সত্যেন সেনের ‘সোনারঙ’, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ও হুমায়ুন আজাদের ছিল ‘রাড়িখাল’। চিত্তরঞ্জন দাশের আদিনিবাস ‘তেলিরবাগ’, অতীশ দীপঙ্করের ‘বজ্রযোগিনী’। ব্রজেন দাশ, সরোজিনী নাইডু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়—এমন অনেক বিখ্যাত মানুষও ছিলেন বিক্রমপুরের। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের লেখা ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’ বইটিতে বিক্রমপুরের গ্রামগুলো সম্পর্কে চমৎকার তথ্য পাওয়া যায়। যেমনটি তিনি লিখেছেন, “সং-দ্বীপ মূল অর্থ দুইদিকে জলবেষ্টিত ভূমি। চারদিকে জলবেষ্টিত হইলেও দ্বীপ। পাশের ভূমি হইতে উচ্চ হইলেও দ্বীপ, এই প্রকার দ্বীপকে হিন্দিতে টিকা বা টিলা বলে। বিক্রমপুরের ‘দী’ ও ‘দীয়া’ শব্দার্থক গ্রামসমূহই ওই সকল দ্বীপের অস্তিত্ব প্রদান করিতেছে। যথা : হলদীয়া, রাজদীয়া, গাড়িদীয়া, কাঠাদীয়া, মালাদীয়া।” ইমদাদুল হক মিলন তাঁর ওই প্রবন্ধের এক জায়গায় বিস্ময় প্রকাশ করেন, “আশ্চর্য, এই বইটিতে (বিক্রমপুরের ইতিহাস) ‘গাওদিয়া’র উল্লেখ নেই। অথচ গাওদিয়া ছিল বিশাল গ্রাম। পাঁচ সাতগ্রাম মিলে এক ইউনিয়ন, গাওদিয়া একাই ছিল একটি ইউনিয়নের সমান। এখন বারো আনাই ভেঙে গেছে পদ্মায়। দক্ষিণ থেকে ভাঙতে ভাঙতে উত্তর আর পুবে পশ্চিমে কিছুটা আছে গাওদিয়া।”
সে যাই হোক, আবার নিজের কথায় ফিরে আসি। আমাদের ছিল মস্ত বড় পরিবার। বাবা-মা আর আমরা আট ভাই, ছয় বোন মিলে ছিলাম মোট ষোলোজন সদস্য। বাবা পড়াশোনা করছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতক পাস করেছেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। এরপর তিনি চাকরিজীবন শুরু করেন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের কর্মচারী হিসেবে। পরে অবশ্য সাব-ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হন। বাবার ছিল বদলির চাকরি। তাই এ বছর এখানে, তো অন্য বছর অন্যখানে ছুটতে হতো তাঁকে মস্ত পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে। সেই সুবাদে আমার শৈশব-কৈশোর ও স্কুলজীবন পার হয়েছে অখণ্ড বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন অঞ্চলে—প্রধানত দুমকা, আড়া, সাসারাম, মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন অংশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কলকাতা, বারাসত, টাঙ্গাইল ইত্যাদি নাম উল্লেখ করতে পারি। তা ছাড়া বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম প্রভৃতি জায়গায়ও কাটে আমার বেশ কিছু সময়।
ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম অত্যন্ত চঞ্চল ও অসম্ভব সাহসী। চঞ্চলতা ও সাহসিকতার অনেক ঘটনা আছে আমার জীবনে। একদিন বাড়িতে মাছ কাটার বঁটি দিয়ে নিজের নাভির এপাশ-ওপাশ কেটে দু-ফাঁক করে ফেলি আমি। এই দৃশ্য দেখে সবাই তো ভয়ে কুঁকড়ে যায়, কিন্তু শরীরের যন্ত্রণাকে তোয়াক্কা না করে আমি থাকি নির্বিকার। এমনকি পেটকাটা অবস্থায় আমাকে হাসপাতলে নেওয়া হলেও আমি রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ শুরু করতে থাকি। ডাক্তারের নিষেধ মানার ছেলেই ছিলাম না। আমার স্মৃতিকথায় এসব ঘটনার বর্ণনাও আছে। সেই স্মৃতিকথার ঘটনাগুলো বিচিত্র মনে হতে পারে, তবে তার সবটুকুই ছিল সত্য। যেমন বলি, প্রচণ্ড আঘাত পেলে আমি কান্নার বদলে গান গাইতাম। ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে ‘আমার কান্না’ লেখাটিতে আমি যা লিখেছি, তাই না হয় তুলে ধরি, “ছেলেবেলা থেকেই আমি একটু অতি মাত্রায় দুরন্ত। হাঁটতে শিখেই প্রথমে মাছ কাটার মস্ত বঁটিতে নিজের পেটটা দু-ফাঁক করি—আজও সেলাইয়ের চিহ্ন আছে। এমনি আরো অনেক দুরন্তপনার চিহ্নই সর্বাঙ্গে চিরস্থায়ী হয়ে আছে। শোনা যায়, আমার নাকি একটা উদ্ভট স্বভাব ছিল, দারুণ ব্যথা পেলেও কিছুতে কাঁদতাম না। সুর করে (কালোয়াতি নয়!) গান (আবোল-তাবোল) ধরতাম, ব্যথা বাড়লে সুর চড়ত আর দু-চোখ দিয়ে জল পড়ত ধারা স্রোতে। মারে বাপরে বলে, হাউমাউ করে, শুধু চেঁচিয়ে, ভ্যাঁ করে প্রভৃতি যে নানা পদ্ধতি আছে সাধারণ কান্নার, তার একটাও নাকি আমি শিখিনি। এদিকে আবার যখন-তখন আপন মনে নিজের খাপছাড়া সুরে যেকোনো কথা বা শব্দ নিয়ে গানও আমি গাইতাম—সব সময় তাই বোঝা কঠিন ছিল আমি কাঁদছি না গাইছি!”
এই আমিই একদিন রান্নাঘরের চুলা থেকে চিমটা দিয়ে জ্বলন্ত কয়লা তুলে খেলতে গিয়ে নিজের পায়ের মাংসও পুড়িয়ে ফেলেছিলাম। ওই স্মৃতিকথায় সেই কথাটিও আছে, “একদিন দুপুরে মা ও বড়দি বারান্দায় খেতে বসে শুনছেন রান্নাঘরে আমি গান ধরেছি। খানিক পরে সুরটা কেমন কেমন ঠেকায় আর পোড়া মাংসের গন্ধ পাওয়ায় তাঁরা উঠে এসে দ্যাখেন, উনানের সামনে বসে গান করছি মুখখানা বিকৃত করে, চোখে জলে মুখ বুক ভেসে যাচ্ছে। কী হয়েছে বুঝতে তাঁদের মিনিটখানেক সময় লেগেছিল। তারপর চোখ পড়ল, আমার বাঁ পায়ের গোড়ালির খানিক ওপরে মস্ত একখণ্ড জ্বলন্ত কয়লা পুড়ছে, বেশ খানিকটা গর্ত হয়েছে! কাঠের উনান, চিমটে দিয়ে গনগনে কয়লাগুলো নিয়ে খেলতে গিয়ে এই বিপদ! ...প্রায় এক ইঞ্চি পোড়া দাগ এখনো আছে। পরে অনেকবার ভেবেছি, সত্যি, এমন বোকা কী করে হলাম সেদিন? বয়স বাড়লে বুঝেছি, ও রকম তীব্র যন্ত্রণা হতে থাকলে সব ছোট ছেলেই বোকা-হাবা গাধা হয়ে যায়—সাময়িকভাবে।”
দুরন্তপনার কেচ্ছা-কাহিনীর এখানেই শেষ না। একবার গরম কড়াই থেকে চুরি করে সদ্য নামানো রসগোল্লা তুলে মুখে ভরে নিই আমি। সেই রসগোল্লায় আমার সারা মুখ পুড়ে গিয়েছিল ঠিকই, তবুও হার মানার পাত্র আমি ছিলাম না; গরম রসগোল্লাই গিলেছিলাম কষ্ট করে। ওই ঘটনাটির কথাও আছে আমার সেই স্মৃতিকথায়, “মা রসগোল্লার কড়াই নামিয়ে অন্য কাজে মন দিয়েছেন, আমি সুযোগের প্রতীক্ষা করছি। আমার ভাগ্য ভালো যে রান্নাঘরেই অন্য কাজে মার বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল, নয়তো রসগোল্লার কড়াই নামিয়েই কোনো কাজে মা বাইরে গেলে হয়তো সারা জীবন আমাকে হাত পোড়া আর মুখ পোড়া হয়ে থাকতে হতো! সুযোগ যখন পেলাম কড়াইয়ের রসটা তখন আর ফোস্কা পড়াবার অবস্থায় নেই, তবে মজা টের পাইয়ে দেবার মতো গরম আছে। খাবলা দিয়ে কতকগুলো রসগোল্লা তুলেই মুখে পুরে দিয়ে সেটা টের পেলাম। সেই মুহূর্তে মা আর মেজদা (সন্তোষকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়) ঘরে ঢুকলেন। মা উঠলেন চেঁচিয়ে, মেজদা তিন লাফে এগিয়ে এসে কড়ায়ে আঙুল ডুবিয়ে দেখে নিলেন রসটা গরম কত। ...যন্ত্রণায় কান্না আসছিল। আমার কচি চামড়া, মেজদা বোধ হয় সেটা হিসাব করেননি যে তার গরম বোধের চেয়ে আমার গরম বোধটা কত বেশি, তা হলে হয়তো মায়া হতো। হঠাৎ ওরা এসে হাজির না হলে মুখের রসগোল্লা ফেলে আমি নিশ্চয়ই একটু কাঁদতাম। কিন্তু আর তো রসগোল্লা ফেলাও যায় না, কাঁদাও যায় না। এতক্ষণে দিদিরাও এসে পড়েছে, মেজদার কথা শুনে ওদের মুখে কৌতুকের হাসি! চিবিয়ে চিবিয়ে রসগোল্লা গিলে ফেললাম। ...সকলের মুখে ধীরে ধীরে চোখ বুলিয়ে নিলাম। কড়াই থেকে আরো কয়েকটা—আগের বারের চেয়ে সংখ্যায় কম মুখে পুরলাম। হাত-মুখ আগেই জ্বলছিল, এবার যেন পুড়ে গেল। মা এতক্ষণ কেমন এক দ্বিধাগ্রস্ত ভাব নিয়ে আমায় দেখছিলেন, এবার এসে আমায় কোলে তুলে নিলেন। মেজদাকে ভর্ৎসনা করে বললেন, তুই কী রে সন্তোষ! মেজদাই আমার হাতে আর মুখে গাওয়া ঘি মাখিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এটা কোন দেশি ছেলে? আমি ভাবলাম, বেশি গরম লাগলে কাঁদবে, কাঁদছে না দেখে…।”
একবার দুমকায় থাকতে, আমার ছোট ভাই লালু কুয়ায় ঝুঁকে ব্যাঙ দেখতে গিয়ে তার ভেতর পড়ে গিয়েছিল। বাড়ির সকলের ধারণা ছিল, আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে লালুকে কুয়াতে ফেলে দিয়েছে। তবে সে সময় আমার উপস্থিত বুদ্ধি এবং বড়দের চেষ্টায় সেই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায় আমার এই ভাইটি। সেই ঘটনাটিও না-হয় শোনা যাক, “বাড়ির পিছনে বেশ বড় একটা বাগান ছিল, কপি, বেগুন আর নানারকম তরকারিও হতো বাগানে। জল দেবার জন্য বড় একটা কাঁচা কুয়ো ছিল বাগানে, পরিধি খুব বড় কিন্তু বেশি গভীর নয়। কুয়োর মুখটা বাঁধানো তো ছিলই না, বাঁশ বা কাঠের কোনো বেড়া পর্যন্ত ছিল না মুখের চারিপাশে। বর্ষাকালে বেশি বৃষ্টি হয়ে লাল ঘোলাটে জলে কুয়ো ভরে উপচে পড়ত, শীতকালে সামান্য তলানি যেটুকু জল থাকত একবার বাগানে দিতেই তা ফুরিয়ে যেত। এই কুয়োর একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল আমার কাছে। কুয়োর মধ্যে বড় বড় ব্যাঙ বাস করত অনেকগুলো। দুপুরবেলা সকলে বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত থাকার সময় চুপি চুপি কোনো দিন একা, কোনো দিন ছোটভাইকে সঙ্গে নিয়ে কুয়োর ধারে গিয়ে উবু হয়ে ঝুঁকে ব্যাঙ দেখতাম, ঢিল ছুড়ে চেষ্টা করতাম ব্যাঙ শিকারের। বাগান তখন একান্ত নির্জন থাকত, ধারেকাছেও কেউ আসত না। শরৎকালে কুয়োটার জল তখন মাঝামাঝি নেমেছে। ভাইকে সঙ্গে করে একদিন ব্যাঙ দেখতে গিয়েছি। ভাইটি আমার বেশি ঝুঁকতে গিয়ে ঝুপ করে কুয়োর মধ্যে পড়ে গেল! আমি বাড়ির দিকে ছুটলাম। ঘরের মধ্যে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে বসে মা আর দিদিরা কথা বলছে পাড়ার এক বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে, পাশের ঘরে শুয়ে আছে বড় জামাইবাবু আর মেজদাদা। দরজার কাছে থমকে দাঁড়ালাম। কেমন একটা ভয় হলো মনে। সবাই যদি ভাবে আমি ঠেলা দিয়ে ফেলে দিয়েছি ভাইকে কুয়োর মধ্যে, মেজদা যদি শাসন করে! বাড়ির মধ্যে একমাত্র মেজদাকেই ভয় করতাম, তার শাসন ছিল বড় কড়া। এমনকি আমাদের বেশি শাসন করার জন্য বাবা পর্যন্ত তাকে মাঝেমধ্যে শাসন করে দিতেন। ভয় হয়, কিন্তু ওদিকে ভাইটা কুয়োর পড়ে গেছে। সবদিক বাঁচিয়ে তাই মায়ের কাছে গিয়ে চুপিচুপি কানে কানে বললাম, মা, লালু কুয়োয় পড়ে গেছে। মা ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন, কুয়োয় পড়ে গেছে! কোন কুয়ো?
[আমি বললাম] বাগানে।
মা চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকতে ডাকতে ছুটলেন। তার পেছনে ছুটলেন বড়দি। অন্য সবাই ছুটল কয়েক হাত পেছনে। লালুর জামাটা তখনো ভাসছিল, ভিজে জামায় বাতাস আটকে ভাসিয়ে না রাখলে ততক্ষণে সে তলিয়ে যেত। মা দেখেই কুয়োর মধ্যে ঝাঁপ দিলেন। দিদিও দ্বিধামাত্র না করে মাকে অনুসরণ করল। তারপর দড়ি বালতি এলো, বাঁশ এলো, মই এলো। লালু উঠল, মা উঠলেন। আধঘণ্টার মধ্যেই লালু আবার খেলে বেড়াতে লাগল। মাঝেমধ্যে কঠোর সমালোচনা আর কড়া ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকানো ছাড়া আমার দিকে এতক্ষণে কেউ বিশেষ মনোযোগ দেয়নি, এবার মেজদা গম্ভীর মুখে এসে আমার কান ধরে বললেন, চল, তোকে চুবিয়ে আনি কুয়ো থেকে। দড়ি বেঁধে তোকে দু-ঘণ্টা কুয়োর মধ্যে ফেলে রাখলে—
জামাইবাবু কাছে ছিলেন, বললেন, আরে আরে! কী করছ? মেজদাকে ঠেলে সরিয়ে আমাকে বুকে চেপে ধরে বললেন, ওকে কোথায় মাথায় তুলে আদর করবে, তার বদলে শাস্তি দিচ্ছ?
সকলে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। জামাইবাবু আবার বললেন, ওর জন্যই তো লালু আজ বাঁচল। এইটুকু ছেলে, ওর তো ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা। চুপ করেও থাকতে পারত। ও যে সঙ্গে সঙ্গে এসে খবর দিয়েছে এ জন্য ওকে পুরস্কার দেওয়া উচিত। আমি ওকে আজ রসগোল্লা খাওয়াব, যত খেতে পারে।
আবহাওয়া বদলে গেল। চাকরকে জামাইবাবু সঙ্গে সঙ্গে রসগোল্লা আনতে পাঠিয়ে দিলেন। চাকর ফিরলে বড় এক জামবাটি ভরা রসগোল্লা আমার সামনে রাখা হলো। চারদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে সকলে হাসিমুখে সস্নেহ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল। মেজদা কোমল সুরে বললেন, খা মানিক, খা। নয় একদিন একটু অসুখ হবে। তাতে কী? বিকেলে তোকে সাইকেলে চাপিয়ে বেড়িয়ে আনব।
চারিদিকে তাকিয়ে আমি—
আমি হু হু করে কেঁদে ফেললাম!”
(চলবে)