প্রথম দিনেই সরগরম ঢাকা লিট ফেস্ট

Looks like you've blocked notifications!

প্রাণবন্ত এক সূচনা হলো ঢাকা লিট ফেস্টের ষষ্ঠ আসরের। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ সকাল থেকেই মেতে উঠেছিল শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক-সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায়। ছিলেন শিল্পবোদ্ধা, সাহিত্যপ্রেমীরা। সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আর আড্ডায়-আলোচনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে পুরো আসর।

লিট ফেস্টের প্রথম দিন উদ্বোধনের পর ২৩টি ভিন্নধর্মী আলোচনা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, বইয়ের গল্প, স্মৃতিচারণসহ নানা আয়োজনে জমে ওঠে উৎসব। বেলা ১১টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তন তথা প্রধান মঞ্চে এই আয়োজনের উদ্বোধন করেন নোবেলজয়ী লেখক ভি এস নাইপল ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ, আহসান আকবর ও সাদাফ সায্‌।

নোবেলজয়ী ব্রিটিশ সাহিত্যিক ভি এস নাইপল স্টেজে এসে ফিতা কেটে ঢাকা লিট ফিস্টের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

উদ্বোধন অনুষ্ঠানের শুরুতে সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার নির্দেশনায় রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে সুরের ধারা। এর পর শুরু হয় মূল পর্বের অনুষ্ঠান। শুরুতেই বক্তব্য রাখেন ঢাকা লিট ফেস্টের তিন পরিচালক যথাক্রমে কাজী আনিস আহমেদ, আহসান আকবর ও সাদাফ সায্‌। কাজী আনিস আহমেদ ধন্যবাদ জানান বিদেশি অতিথি ও উপস্থিত সবাইকে। পাশাপাশি লিট ফেস্টের আকর্ষণগুলো তুলে ধরেন তিনি।

আহসান আকবর তাঁর বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সাহিত্যকে তুলে ধরতে এ উৎসবের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। উৎসব পরিচালকদের মধ্যে সর্বশেষ বক্তৃতা দেন সাদাফ সায্‌। একই সঙ্গে উৎসবের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করা সাদাফ তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের দুই হাজার বছরের সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে উৎসবটিতে সেসব ঐতিহ্যবাহী লোকসাহিত্যের গানগুলো স্থান করে দেওয়ার কথা জানান।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবের কথা উল্লেখ করেন।

উদ্বোধনের পরপরই শুরু হয় অন্যান্য আলোচনা সেশন।

দুপুর ১টায় মূল মঞ্চে বিশ্বসাহিত্য নিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড ফিকশন : হিডেন রিয়েলিটি’ শীর্ষক আলোচনায় বসবেন ড্যানিয়েল হান, নিকোলাস, লেজার্ড ও আনজুম হাসান ও নায়েল এলতোখি। সাহিত্য শীর্ষক এই আলোচনায় সাহিত্যের ভাষান্তর নিয়ে কথা ওঠে। ভাষান্তরের এই বিষয়টিকে শুধু অনুবাদ বা বৈশ্বিক সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন, সে নিয়েই তর্ক করেন আলোচকরা।

দুই হাজার বছরের পুরোনো এক শহর। নাম হোমস। পাঁচ/ছয় বছর আগেও সে শহরে মানুষ জাগত স্বাভাবিকতার স্বাদ মুখে নিয়ে। সে শহর এখন শ্মশান। অন্নপূর্ণা আর আদিল—স্বপ্নালু এক যুগল। জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মে তারা আলাদা। প্রতিকূল পরিবার আর তৃতীয় বিশ্বের হাজারও দুঃসংবাদের ভিড়ে একটু সুসংবাদ হয়ে ওঠার আশায় পাড়ি জমায় সিরিয়ায়, হোমসে। হাজার মাইল দূরের অপরিচিত শহর হোমসের ট্র্যাজেডি অন্নপূর্ণার নিজের জীবনের ট্র্যাজেডি হয়ে ওঠে। এ নিয়েই ভালোবাসার শহরের গল্প। ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরীর এ ছবি নিয়ে গল্প করলেন সংগীতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও জয়া আহসান।

এ সময় আরেক মঞ্চে চলছিল ‘ইমাজিনিং হিস্ট্রি’। আলোচনায় অংশ নেন তিন স্বনামধন্য সাহিত্যিক সাজিয়া ওমর, বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী ও সাদ হোসেন। কে কে টি স্টেজে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা পর্ব সঞ্চালনা করেন সাদ হোসেন।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ফখরুল আলম অনূদিত ‘বিষাদসিন্ধু’ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন স্বয়ং অনুবাদক ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং ইএমকে সেন্টারের পরিচালক এম কে আরেফ। ফখরুল আলম জানান, পুঁথিভিত্তিক এই সাহিত্য কর্মটি অনুবাদ করতে তাঁর তিন বছর সময় লেগেছে।

আমেরিকার কবিতা ও আমেরিকা নিয়ে মঞ্চে রীতিমতো তর্কযুদ্ধ করেছেন পুলিৎজার বিজয়ী মার্কিন কবি বিজয়ী সেশাদ্রি, চীনা মার্কিন কবি জেফরি ইয়াং ও বাংলাদেশি কবি অধ্যাপক কায়সার হক। তিন কবি অবশ্য কবিতার চেয়ে সদ্য নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন।

সাম্প্রদায়িকতার এপার-ওপার নিয়ে মঞ্চে বসেছিলেন দুই বাংলার সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিকরা। আহমেদ রেজার সঞ্চালনায় এই সেশনে ছিলেন জহরসেন মজুমদার, সেমন্তি ঘোষ, মাসুদুল হক, মাসুদুজ্জামান। বক্তারা বলেন সাম্প্রদায়িকতার কোনো বিভেদ নেই।

‘ইমাজিনিং হিস্ট্রি’ শীর্ষক আলোচনায় স্বনামধন্য সাহিত্যিক সাজিয়া ওমর, বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী ও সাদ হোসেন সাহিত্যে কল্পনার উপস্থিতি নিয়ে সাহিত্য ও ইতিহাসের মিশ্রণ নিয়ে আলোচনা করেন। ইতিহাসের নায়ক ও শহীদদের স্বীকৃতি নিয়ে আলোকপাত করা হয় এ আলোচনায়। সাজিয়া ওমর বলেন, ‘আমাদের সাহিত্যে ইতিহাসের নায়কদের আরো বেশি উপস্থিত থাকা উচিত, যাতে করে আমাদের শিক্ষার্থীরা এদের ব্যাপারে আরো জানতে আগ্রহী হয়।’

সাহিত্য, স্থাপত্যবিদ্যা ও স্নায়ুবিজ্ঞান। কলা আর বিজ্ঞানের চিরকালের মনকষাকষি তো আছেই, বিষয়বস্তু থেকেও যে এদের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। অথচ বৃহস্পতিবার ঢাকা লিট ফেস্টের প্রথম দিন এই তিন শাস্ত্রের মধ্যেই কী চমৎকার মেলবন্ধন দেখালেন তিন বক্তা।

বাংলা একাডেমির নতুন ভবনের নিচতলাতেই কে কে স্টেজ। সেশনের নাম ‘অ্যান ইন্টিমেট আর্কিটেকচার : দ্য নিউরোসায়েন্স অব অ্যাসথেটিকস’। এমন কাঠখোট্টা নামের কারণেই বোধ হয় অন্যান্য সেশনের তুলনায় কিছুটা কম ছিল উপস্থিতের সংখ্যা। তবে দর্শনের যেসব মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে সহজ ভাষায় কথা হলো, বোধ করি স্কুলছাত্রেরও তা বুঝতে কষ্ট হতো না।

ঢাকা লিট ফেস্টে এবার দুই তানিয়ার গল্প নিয়ে এসেছেন কলকাতার লেখিকা অন্তরা গাঙ্গুলী। বৃহস্পতিবার উৎসবের প্রথম দিনে দুপুরবেলা টিভিব্যক্তিত্ব ইরেশ যাকেরের সঙ্গে এ বই নিয়ে বেশ স্বতঃস্ফূর্ত আলাপে মেতে উঠলেন লেখিকা।

বিকেল সাড়ে ৩টায় অনুষ্ঠিত হয় ‘গ্রানটা : ট্রুথ অ্যান্ড লাইস’। আলোচনা করেন ব্রিটিশ লেখিকা এ্যামি স্যাকভিলা, অ্যাংলো-অস্ট্রেলিয়ান লেখিকা ইভি ওয়েলড। কে কে টি স্টেজে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা পর্ব সঞ্চালনা করেন ভারতের কার্তিকা ভি কে। আলোচনায় সাহিত্যে সত্য-মিথ্যা এবং মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা হয়।

তিন দিনের এই আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ভি এস নাইপলের ওপর নির্মিত প্রামাণ্য। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক বিদ্যা সূর্যপ্রসাদ নাইপলের জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন বিবিসির পরিচালক অ্যাডাম লো। ‘আ স্ট্রেঞ্জ লাক অব ভি এস নাইপল’ নামক চলচ্চিত্রের নেপথ্যে রয়েছে নাইপলের লেখনী জীবন শুরু থেকে বর্তমানের আদ্যোপান্ত। ভাগ্য নিয়ে প্রশ্ন খোদ নাইপলের নিজেরই। ত্রিনিদাদের স্কলারশিপ, লেখালেখি করে অর্জিত নিবাসের ভাগ্য, সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার ভাগ্য সবকিছু মিলেই লেখা এই চলচ্চিত্র।

কে কে টি স্টেজে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যিক টিম কোপ, সাদিয়া দেলভি, সাইমন ব্রুটন ও শেরিং তাশি। অভিযাত্রিকদের শতবর্ষের অভিজ্ঞতা এবং ভ্রমণের মধ্য দিয়ে জীবনকে দেখা ও জীবনবোধ নিয়ে আলোচনা করেন আলোচকরা।

বারখা দত্ত ভারতের এনডিটিভির কনসাল্টিং এডিটর হিসেবে কর্মরত আছেন। ২২ বছরে সাংবাদিকতা শুরু করা বারখা সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয় হিসেবে পদ্মশ্রীতে ভূষিত হয়েছেন। সাংবাদিকতার কাজে ঘুরে বেড়িয়েছেন আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, মিসরসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। কাভার করেছেন সম্প্রতি হয়ে যাওয়া মার্কিন নির্বাচনও, কথা বলেছেন হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে। তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘দিস আনকোয়াইট ল্যান্ড’। তবে বই ছাড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতিই তাঁদের আলোচনার প্রধান উপজীব্য হয়ে ওঠে।

এর আগে বারখা দত্তের আরেকটি প্যানেল ছিল সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ, ভারতীয় লেখক শ্রীরাম কারি, মার্কিন সাংবাদিক জেফরি ইয়াং ও মার্কিন সাংবাদিক বেন জুডাহ। আমেরিকার আর ভিন্নতা নেই—এ নিয়েই শুরু হয়েছিল আলোচনাটি। তবে পুরো আলোচনার মধ্যমণি ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁকে নিয়ে জমে ওঠে আলোচনা।

উৎসবের সব শেষ আলোচনা ছিল প্রয়াত সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হককে স্মরণ। এতে উঠে আসে লেখকের ব্যক্তিজীবন থেকে সাহিত্যিক জীবনসহ সব ক্ষেত্র।

দিন শেষে ‘গুরুপদে না ডুবিলে জনম যাবে অকারণ’, ‘চরণ ছেড়ো না রে চরণ’-এর মতো বিখ্যাত বাউল সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে সরগরম হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমির বটতলার নজরুল মঞ্চ। ধূপের ধোঁয়া আর মোমবাতির আলো দিয়ে সাজানো বাউল পরিবেশে একে একে সংগীত পরিবেশ করলেন কুষ্টিয়ার বাউলশিল্পীরা। এ সময় মঞ্চে ছিলেন কুষ্টিয়ার বাউল গুরু দরবেশ হোসেন আলী শাহ। এ ছাড়া সংগীত পরিবেশন করেন জহুরা বেগম, শাহনাজ বেলি।