পর্ব-২
আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

দুষ্টুমির আরো একটি নজির আছে। একবার বড়দা সুধাংশুকুমারের পিঠে চেপে আলমারির ওপর থেকে ঘরে থাকা ইঁদুরের বাচ্চা ধরতে গিয়ে ভারী আলমারির চাপায় পড়েছিলাম আমি। ব্যথা পেয়েছিলাম খুব, কিন্তু তাও যেন গা সওয়া হয়ে যায়। আমার এমন সহ্যশক্তি দেখে বাড়ির সবাই তো বটেই, পাড়াপড়শি পর্যন্ত অবাক না হয়ে পারত না। এ ছাড়া লাল কাঁকড়া ধরতে গিয়ে কাদায় ডুবে গিয়েছিলাম একবার। সে সময় কেউ একজন এসে আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। ১৯৩৯ সালের জুন মাসে লেখা আমার স্মৃতিকথামূলক রচনা ‘শৈশব-স্মৃতি যাচাই করার গল্প’-এ ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেছি আমি :
‘স্মৃতিটা এই। নদী (হলদি নদী) থেকে শখানেক গজ তফাতে পাশাপাশি দুটি খাল কাটা আছে। একটিতে লক আছে, জল তার লোনা কিন্তু পরিষ্কার এবং নদীর জোয়ার-ভাটাকে অগ্রাহ্য করে ক্যানালে জল সব সময়েই ভর্তি থাকে। অন্যটিতে লক নেই, জেয়ারের সময় ভরে যায় লাল কর্দমাক্ত জলে, ভাটার সময় মাঝখানে আধহাত জল থাকে কি না সন্দেহ। দুপাশে লাল এঁটেল মাটির স্তর—পাঁকের মতো। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য লাল লাল কাঁকড়া। কাঁকড়া ধরে ধরে একটা কাচের বয়ামে ভরে রাখতে গিয়ে আমি কোমর পর্যন্ত নরম পাঁকে ডুবে গিয়েছি। না পারি এদিকে সরতে, না পারি ওদিকে সরতে। আশপাশে কেউ কোথাও নেই। তিন-চার হাত লম্বা একটা বাঁশ আমি প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে আছি। তারপর? তারপর আর কিছু মনে নেই। কিন্তু কী ঘটেছিল? কে আমায় আঠার মতো নরম এঁটেল মাটির সমাধি থেকে রক্ষা করেছিল? কেঁদেছিলাম কি না, আর্তনাদ করেছিলাম কি না মনে পড়ে না; কিন্তু যন্ত্রণা যে অনুভব করেছিলাম বীভৎস, তা স্পষ্ট মনে আছে। আজও আমার সেই অসহায় অবস্থার অকথ্য মানসিক কষ্টভোগের কথা মনে করলে বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে থাকে।’ তবে এ ঘটনা নিয়ে আমার মনে ছিল অনেক প্রশ্ন। মাত্র চার বছর বয়সের এই ঘটনা কি আসলেই আমার জীবনে ঘটেছিল, নাকি এটা নেহাতই ছিল আমার কল্পনা—তা নিয়ে মনে ছিল ব্যাপক সংশয়। তাই তো মনের ভেতরকার সংশয় দূর করতে ঘটনার ২০ বছর পর আবার সেই জায়গা গিয়েও দেখেছি, স্মৃতিতে জমা ওই ঘটনার সঙ্গে বাস্তবতার মিল আছে কি নেই। এমনকি সেই খালের পাড়ের কাদায় ডুবে পরখ করতেও দ্বিধা করিনি। দেখা যাক, ছেলেবেলায় আটকে যাওয়ার পরের ঘটনাটি, অর্থাৎ আমাকে উদ্ধার করার কথাটি মনে পড়ে কি না।
স্মৃতিকথায় লিখলাম, ‘ঘটনাটি কি আমার কল্পনা? বড় হয়ে বাড়ির সকলকে প্রশ্ন করেছি, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। অপর খালটিতে আমি জলে ডুবে মরতে বসেছিলাম, তার একটা গল্প এরা আমাকে শোনান; কিন্তু এদিকের খালে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে আমি কোনো দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম বলে তাঁরা শোনেননি। ...আমি কি নিজেই কোনোরকমে শেষ পর্যন্ত নিজেকে উদ্ধার করেছিলাম এবং মার ও বকুনির ভয়ে কথাটা কারো কাছে প্রকাশ করিনি? কিন্তু কাচের বয়ামে লাল কাঁকড়া ধরতে গিয়ে কোমর পর্যন্ত এঁটেল কাদায় ডুবে যাওয়া, একখণ্ড বাঁশ আঁকড়ে ধরা—এসব কথা যদি স্পষ্ট মনে থাকে আমার, পরে কী হলো আবছাভাবেও তা মনে নেই কেন?’
এ রকম কত প্রশ্ন যে আমি নিজেকে করেছি, তার সংখ্যা হয় না। কত দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ সমস্যার কথা ভেবেই কাটিয়ে দিয়েছি। মানুষের জীবনে কত বড় বড় সমস্যা থাকে, কত বিরাট রহস্য কত রূপে দেখা দেয়, দুদিন পরে মানুষ সব ভুলে যায়, আর ওসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু আমার ভাবতে ভাবতে এমন হয়েছিল যে আমার শৈশবের এই ঘটনা সত্য অথবা কল্পনা, সত্য হলে কী এর পরিণতি আর কল্পনা হলে কেন এ কল্পনা আমার মনে এমনভাবে দাগ কেটে স্থায়ী হয়ে রইল, জানার জন্য আমি মাঝেমধ্যে একরকম ছটফট করতাম। ...বড় হয়ে হলদি নদীর ধারে গ্রামটিতে যখন গেলাম, মনে মনে আমি কতখানি আগ্রহ পোষণ করছি! জায়গাটির যেসব ছবি মনে ছিল, তার অনেকগুলোই মিলে গেল। তবে এরই মধ্যে প্রায় কুড়ি বছর সময় কেটে গেছে, স্থানটিতে যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। ক্যানালের পাশে মাঠের মধ্যে বড় একটা বটগাছ ছিল, সেটা খুঁজে পেলাম। কে যেন গোড়াটা পাকা বাঁধিয়ে দিয়েছে। ক্যানালের তীরেই একটা পুরোনো মরচে ধরা ট্যাঙ্ক পড়ে থাকত, যার মধ্যে ঢুকে ঢুকে অনেক খেলা করেছি, সেটা খুঁজে পেলাম না।
নদী নাকি অনেকটা এদিকে সরে এসেছে। ক্যানেল অথবা খালের কী পরিবর্তন ও সংস্কার সাধিত হয়েছে, বলতে পারব না। চার বছর বয়সের স্মৃতি অত নিখুঁতও নয়, ব্যাপকও নয়। তবে একটা বিষয় লক্ষ করলাম যে, এ পাশের খালটিকে আমি অবাধ বলে জানতাম, আসলে তা নয়। একটি ক্যানেলে লক বসানো আছে নদীর খুব কাছে এবং এই লকের মারফত ক্যানাল ও নদীর মধ্যে নৌকা চলাচল করতে পারে। অপর ক্যানেলে আরো খানিকটা ভেতরের দিকে স্থায়ী লক বসানো—বাঁধই বলা যায়, শুধু চাষের জন্য জল আটকে রাখবার উদ্দেশ্যে। বাঁধ আর নদীর মধ্যে আলের যেটুকু অংশ, তাতে নদী জোয়ার-ভাটাতে যাতায়াত করে। এবং ভাটার সময় তেমনি এঁটেল লাল মাটির কাদায় অসংখ্য লাল কাঁকড়া দেখা দেয়।
দুটি খালের মাঝখানে ভূখণ্ডের যে বাড়িটিতে আমরা থাকতাম, আজও সে বাড়িটা আছে, যদিও আমার কল্পনার সঙ্গে বাড়িটার আজ অনেক অমিল। বাড়ির সঙ্গে কোনাকুনি রেখা টেনে, যেখানে পাঁকে ডুবে গিয়েছিলাম কি না যাচাই করতে এসেছি খালের সেইখানে, খালের ধারে একটা অজানা গাছের নিচের কাঠের একটা গুঁড়িতে বসে প্রায় সারাটা দিন কাটিয়ে দিলাম। আমি নৌকায় এসেছি, নৌকা বাঁধা আছে অপর ক্যানালটিতে। মাঝখানে একবার কেবল নৌকায় গিয়ে স্নানাহার সেরে এসেছি, তারপর আর এই খালের তীর ছেড়ে নড়িনি।
অল্প দূরে ছোট একটি টিনের চালা আর দরমার বেড়ার বাড়ি। বাড়ির ছেলেবুড়ো যে আমাকে বিশেষ কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করছে, আমি তা অনেকবার অনুভব করেছি। ছেঁড়া বিবর্ণ সবুজ রঙের একটা কোট গায়ে দিয়ে ষাট বছরের এক বৃদ্ধ আমাকে দু-একটি প্রশ্নও করে গেছে। আমল দিলে লোকটি হয়তো আরো অনেক কথা জিজ্ঞাসা করত, অনেক কথার জবাব দিত খুশি হয়ে। কিন্তু আমার তখন মানুষের সঙ্গ ভালো লাগছিল না।
আমার বুঝতে বাকি থাকেনি, শৈশব-স্মৃতির যে রহস্য আমাকে এতকাল পীড়ন করে এসেছে, কোনোদিন আমি তার মর্মকথা আবিষ্কার করতে পারব না। তবু খালের ধার থেকে সরে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। হলদি নদীর এক সংকীর্ণ কাদা-ভরা কাঁকড়া-বহুল খাল আমাকে যেন কী এক জাদুমন্ত্রে মোহাচ্ছন্ন করে তার তীরে জোর করে সারাটা দিন বসিয়ে রাখল। কত চিন্তা মনে এলো, কত বিচিত্র অনুভূতি, চেতন ও অচেতনের সীমারেখার এপারে-ওপারে আনাগোনা করল—সন্ধ্যায় মনে হলো সারা দিন যেন জেগে স্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্ন নয়, একটা দুঃসহ ভার মনের মধ্যে চেপে রয়েছে।
চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো; নিশ্বাস ফেলে একরকম জোর করে নৌকায় ফিরে গেলাম। ঠিক ছিল সন্ধ্যার আগেই নৌকা ছাড়া হবে; কিন্তু খালের ধার থেকে চলে এলেও একেবারে স্থান ত্যাগ করে চলে যেতে ইচ্ছা হলো না। ভাবলাম, আজ রাত্রিটা যাক, কাল দিনের বেলা একটু খোঁজখবর করে ফিরে যাব।
শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম খুবই, কিন্তু শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলাম—ঘুম এলো না। হঠাৎ আমার মনে হলো, সমস্যার সমাধানে একটা উপায় তো আমি অবলম্বন করে দেখিনি! খালের কাদায় কোমর পর্যন্ত ডুবিয়ে সেই রকম অবস্থা সৃষ্টি করে তো দেখিনি, সেবার শেষের দিকে কী ঘটেছিল যে কথা মনে পড়ে কি না! অনুরূপ অবস্থা বা আবেষ্টনী অনেক সময় অনেক ভুলে যাওয়া কথা মনে পড়িয়ে দেয় বটে, কিন্তু এ-ক্ষেত্রে উপায়টা যে আমার বিশেষ কাজে লাগবে না, এ আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কেরই একটা কল্পনা মাত্র, আমি তা সঙ্গে সঙ্গেই টের পেলাম। তবু পরদিন সকালে পরীক্ষাটা করে দেখব স্থির করামাত্র আমার সমস্ত ছটফটানি যেন কমে গেল, অল্পক্ষণের মধ্যে শান্ত হয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
(চলবে)