সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
‘কী! কী কস এটি!’ গলা যদ্দুর নামানি দেওয়া যায়, দিয়া; ঝামটা মাইরা ওঠে ইসুফ মিয়ার মায়ে। ‘অখন নি তামশা করোনের হাউস হইলো তর জুলেখার মা! আমি তর মশকারির মানুষ?’
‘না গো ভাউজ! মশকারি করোনের কিসমত তো আল্লায় আমারে দেয় নাই! আমার কপালে আল্লায় সতিন দিছে! আইতাছে সেই সতিনে। জুলেখার বাপে হাছাই বিয়া করবো।’ জুলেখার মায় কথা কয়, না য্যান ফিসফিসায়! ঠান্ডা হিম গলার সেই ফিসফিসানি ইসুফ মিয়ার মায়ের অন্তরাত্মায় গিয়া বাড়ি দেয়। শইল্লে ঠকঠকানি ওঠে তার!
কী কয় এটি জুলেখার মায়ে! অর মাথায় দোষ পইড়া যায় নাইক্কা তো এই কয়দিনে! এই বাড়িতে, এই যে, এত্তাবড়ো একখান খোয়ানির ঘটনা ঘটছে; তার পোড়ানিই ত্তো কমে নাই অখনও! সেই পোড়া-দগ্ধ সংসারে বিয়ার বাদ্যি বাজবো অখন! এইটা হয়? কতখোন বেতোবা চক্ষে জুলেখার মায়ের দিগে চাইয়া থাকে ইসুফ মিয়ার মায়। তার বাদে সেয় জুলেখার মায়েরে একটা জোরতে একটা ঠেলা দিয়া কয়, ‘কী বিত্তান্ত ভাইঙ্গা ক! আমার কইলাম আউল্লা-পাতাইল্লা লাগতাছে জুলেখার মা!’
বিত্তান্ত আর কী! কুড়ি-পঁচিশ দিন আগের এক বিয়ানের কালে এই ঘটনার শুরু। বিয়ান বেলা। কর্মে যাইবো জুলেখার বাপে। রোজকার লাহান সেই দিনও তারে তরিজুত কইরা খাওন বাইরা দিছে জুলেখার মায়। অম্মা! জুলেখার বাপে সেই দিন করে কী, পাতের খাওন একনলা মোখে দিয়াই খেঁজি-ভেটকি দিতে থাকে। কুঁদানি দিতে দিতে কয়, ‘এটি কি রানছস? কী লো? হাতে কাম ওটে না তর?’
খাওন লইয়া এমুন তো সেয় জিন্দিগিতেও কোনোদিন করে নাই! আর, যা-ই রান্ধুক জুলেখার মায়ে, সেই রান্ধনরে খরাপ তো কেউ কোনোদিন কইতে পারে নাই! আউজকা হেয় এইটা কী কয়! শরমে হরদিশা হইয়া জুলেখার মায়ে বোবা মোখে জুলেখার বাপের দিগে চাইয়া থাকে। কোনো জব দিতে পারে না। তখন বেটায় করে কী—পাতের খাওন আধা খাইয়া, আধা ফালা-ছড়া কইরা উইট্টা যায় গা। লাজে-দুক্ষে তামানটা দিন আধা মরার লাহান পইড়া থাকে জুলেখার মায়ে।
সেই যে সেই বিয়ানের কালে জুলেখার মায়ের ওপরে পিক দেওন আর তার দোষ ধরোন শুরু হইলো; সেইটার আর থামাথামি হইলো না। বিয়ানের খাওনের দোষ ধরতে ধরতে বাড়ির বাইরা অয় জুলেখার বাপে! সন্ধ্যায় বাইত আইয়া আবার নয়া কইরা শুরু করে রাইতের খাওনের দোষ ধরোন। বিয়ানে পিক দেওন কম হইলে, রাইতের খাওনের দোষ বাইর হয় বেশি। নাইলে বিয়ানে বেশি হইলে, রাইতে হইতে থাকে কম। এমনে এমনে যায় কতোদিন।
খসমে যতো রান্ধনে পিক দিতে থাকে, ততো য্যান জুলেখার মায়ের হাতরথ অচল হইয়া যাইতে থাকে! কাম তার ভালা হইবো কী, আরো য্যান খরাপ হইতে থাকে। শরমে মোখ তোলতে পারে না জুলেখার মায়ে।
আইচ্ছা যাউক! নসিবে যা থাকে, তার বেশি পাইবো কেমনে মাইনষে!
এদিগে, পরথম কয়দিন যায় খালি খাওনের দোষ ধরুন্তি আর প্যানপ্যানানির ওপরে দিয়া। তার বাদে শুরু হয় সগল কামে পিক দেওন। জুলেখার বাপে তার বউয়ের সগল কিছুতে দোষ ধরুন্তি শুরু করে। হায় হায় হায়! জুলেখার মায়ের চলোনে দোষ। নড়োনে দোষ! চুলে দোষ! হাঁটোনে দোষ! কামে দোষ, শইল্লে দোষ! দোষ নাই কই! ঘরের খেতায় দোষ, চালে দোষ, রান্ধনের পাইল্লা-ঠিল্লায় দোষ!
প্রত্যেকটা দিন জুলেখার মায়ের দোষ ধরতে ধরতে হেয় বাড়ির তেনে বাইর হইতে থাকে। সন্ধ্যায় দোষ ধরতে ধরতে বাড়িতে রাইতেরে আনতে থাকে। এই না মতে আউজকা দিন পঁচিশ হয় সগল কিছুতে পিক দেওন, সগল কিছুতে গন্ধ পাওন—এইই চলতাছে এই বাড়িতে; রাইতে দিনে সগলটা সোমে।
তয়, তা নিয়া অন্তরে ধাক্কা খাইলেও জুলেখার মায়ে মন বেজার করে নাই পরথম পরথম। এতো যে পদে পদে, অষ্টপ্রহর, তার খুঁত পাইতাছে তার খসমে; সেই বিষয়খান নিয়া জুলেখার মায়ে শরম পাইছে ঠিক, কিন্তুক সেয় জুলেখার বাপের ওপরে গোস্বা হয় নাই। জুলেখার বাপে তো কোনো আকথা কইতাছে না! কইতাছে হাছা কথা। মাইয়াটায় নাই হইয়া যাওনের পরের তেনে, তার হাতরথ যে আর চলতে চায় না; এইটা তো সত্য।
কোনো কামই যে আর করতে বাসনা হয় না তার; এইটা তো আর মিছা না! কোনো কিছুর লেইগাই আর কোনো টান্ডা-বাসনা যে আহে না আর, তার দিলে!
খালি তার অন্তরটায় তারে কইতে থাকে, ‘ল, জুলির মা! যেইদিগে চউখ যায়, যাই গা! ল!’ সেয় না খালি খোদার দিগে চাইয়া এই ভিটিতে পইড়া রইছে! আর, পইড়া রইছে গুপ্ত আশাখান নিয়া! কী সেই আশা? না, জুলি যুদি ফিরা আহে! ফিরা আইয়া উয়ে অর মায়েরে বাইত পাইবো না! মাইয়ায় না কাতর হইয়া যাইবো তাইলে!
অন্তরের এমুন ফাতফাতানি অবস্থা নিয়া জুলেখার মায়ের দিবানিশি যায়। এইর মিদে কিয়ের রান্ধা কিয়ের বাড়া কিয়ের কী! তার পরান অই সগল বিষয়ের তেনে মোখ ফিরাইয়া থুইছে আউজকা চাইরটা বচ্ছর ধইরা!
সন্ধ্যাবাত্তি যুদি কোনোদিন জ্বালানের কথা কথা মোনে হয় তার, তয় সেই বাত্তি আর নিভানের খেয়ালটা আসে না! গাছের তেনে পাতা পড়তে পড়তে এই বাড়ির উঠানের মাটি আর দেখা যায় না। কোনোদিন যুদি সেই পাতার স্তূপ সরানের কথা মোনে আসে জুলেখার মায়ের, তখন সেয় শলার ঝাঁটাখান এট্টু হাতে নেয়। তয়, দুই-চাইর ঝাঁট দিতে না দিতেই ভেতরের তাগাদাখান নাই হইয়া যায়। পাতার জায়গায় পইড়া থাকে পাতা, তাগো লগে পইড়া থাকে শলা-ভাঙ্গা মুইড়া পিছাখান।
জুলেখার বাপের কাপড়চোপড় ধোওন লাগে, কারণ সেইটা ঠেকা কাম। বেটায় কর্মে যায়। তারটা যেমনে পারে হেঁচড়ানি দিয়া হইলেও করে জুলেখার মায়। নিজেরটা কেবল কোনোরকমে খলানি দিয়া সারে সেয়। এমনেই ত্তো চলতাছে এই বাড়ির জিন্দিগি! বেটায় এটি চক্ষে দেখতাছে না? দেখতাছে। আউজকা চাইর চাইরটা বচ্ছর ধইরা দেখতাছে।
বেটায় তাইলে বেজার হইবো না, তো কী হইবো! দিনের পর দিন যাইতাছে, জুলেখার মায়ে একটা দিনের লেইগাও যে সংসারটারে দর্দ দিয়া চালানি দিতাছে না; এইটা কার না চক্ষে পড়তাছে! দুনিয়ার সগলতেরই চক্ষে পড়তাছে। এই যে অখন জুলেখার মাওয়ে দুনিয়াদারিরে ফিরাও দেখতাছে না; এই নিয়া যুদি জুলেখার বাপের অন্তরে গোস্বা হয়, সেইটা তো আজাইরা গোস্বা না! ন্যায্য গোস্বা।
এমনে যে চলে না, এইটা তো একটা দুধের ছাওয়েও বোঝে! বেটাটায় বোজবো না?
এই তাই নানান কথা মোনে নিয়া নিজের মোনেরে বুঝ দেয় জুলেখার মায়ে। যেমনে ইচ্ছা লয়, তেমনে বুরা কথা কউক জুলেখার বাপে! তারও কি অন্তরে কম দুঃক্ষু! তাও তো সেয় সগল দুঃক্ষু ভিতরে চাপা দিয়া নিত্যি রোজগারে যাইতাছে। কামাই-রুজি করতাছে। এইখান যে পারতাছে সেয়, এই নিয়াই ত্তো জুলেখার মায়ে হাজার শুক্কুর আল্লার দরবারে।
অখন, মাইয়া-খোয়ানির জ্বালা তো খালি মায়েরই হয় নাই! বাপেরও হইছে! তার অন্তরের দুঃক্ষুরেও তো হিসাবে রাখা লাগবো জুলেখার মায়ের!
অন্তরের ভিতরে এই হুঁশখান থাকে বইল্লাই জুলেখার মায়ে খসমের কোনো প্যানাপ্যানি, কোনো নিন্দা-পিক নিয়া নিজের ভেতরে কোনো কষ্ট রাখে না। সেয় বোঝে যে, মাইয়া-খোয়ানির শোকে নিজের অন্তর দগ্ধাইতে দগ্ধাইতেই তারে তার খসমের খেদমত করোন লাগবো। আর কোনো প্রকারেই সেই খেদমতে গাফিলতি দেওন যাইবো না।
ধোক্কা খাইতে খাইতে, নিজেরে কোনোরকমে টাইন্না-মাইন্না নিয়া জুলেখার বাপের খেদমত করোন ধরে সেয়। বিয়ান বেইলে, বেটাটায় বাড়ির বাইরা হওনের আগে একবারও কাপড়ের আঞ্চলটারে বিছানি দিয়া জুলেখার মায় রান্ধনঘরের মাইজ্জালে কাঁইত হয় না। ভিতরে ভিতরে শইল-রথ তার ভাইঙ্গা গুঁড়া গুঁড়া হইয়া যাইতে থাকে, কিন্তুক বাইরে সেয় জুলেখার বাপের সামোনে নিজেরে একদম খাড়া দিয়া রাখে। নিজ চক্ষের পানি, পরানের দুঃক্ষু খসমরে দেখাইতে আর মনে চায় না জুলেখার মায়ের।
তার সগল কিছুই তরিজুত মতোন কইরা যাইতা ছিলো জুলেখার মায়, এই কুড়ি-পঁচিশ দিন ধইরা। কিন্তু হাবে-ভাবে সেয় বোঝতা ছিলো যে, কিছু দিয়াই য্যান জুলেখার বাপের দিল-খোশ করা যাইতাছে না! জুলেখার মায়েরে য্যান তার চক্ষের দুশমন মোনে হইতাছে। বেটাটায় খালি থাকতাছে চেতের উপরে। নাইলে এই দোষ অই দোষ লইয়া পেনোর-পেনোর, ঘেনোর-ঘেনোর করতাছে তো করতাছেই।
আর কেমনে সেয় আছুদা করবো নিজের খসমরে! যেট্টুক পারতাছে, করতাছে তো! কিন্তুক হেয় তো আছুদা হইতাছে না! জুলেখার বাপের কি স্মরণে নাই—তাগো কইলজার নিধি, এক মাত্র মাইয়ায় খোয়ানি গেছে! স্মরণে নাই তার? সেই মাইয়া আছে, না মরছে—সেই কথা ইস্তক ফায়সালা করোন যায় নাই যেইনে; সেইনে বাপ হইয়া সেয় কেমনে আরাম-জুইতের লেইগা এমুন করতাছে! কোন পরানে এমুন করে এই বেটায়!
এমনে এমনে জুলেখার মায়ের অন্তরে মাইয়া-হারানির কান্দনের লগে আরেক নয়া কান্দন আইয়া জোড়া বান্ধে। তার পরানের ঘুঁষ-ঘুঁষা, চিপা কান্দন যখন-তখন কেবল বিলাপ হইয়া আছড়াইয়া পড়তে চাইতে থাকে! জুলেখার বাপে যতখোন বাইত থাকে, ততখোন সেয় নিজেরে কঠিনমতে দমানি দিয়া রাখে।
আগে জুলেখার মায়ে এই দমানিটা দিতো না। অখন ক্যান জানি তার অন্তরে তারে কইতে থাকে যে, তার দুঃক্ষু নিয়া জুলেখার বাপের কোনো শোক-তাপ নাই! হেরে আর পরানের টাটানি, চক্ষের পানি দেখানের কাম নাই। কোনো কাম নাই! সেই কারোণে, অখন জুলেখার বাপের সামোনে পাষাণ-পাত্থর হইয়া থাকে সেয়। তার বাদে যেই বেটাটায় বাইরা হয়, তক্ষণই মাটিতে আছড়াইয়া পইড়া, ধুইচ্চা বিলাপ পাড়তে থাকে জুলেখার মায়ে!
যতখোন বিলাপ পাড়ে, ততখোন সেয় ভালা থাকে। ততখোন তার মোনে কোনো চিন্তা আসোনের উপায় থাকে না। একদিগে বিলাপ থামে, অমনেই কতো দুনিয়ার চিন্তা-ডর আইয়া তারে দগ্ধাইতে শুরু করে।
এক চিন্তা, ক্যান খোয়ানি গেলো তার নিধিখান! আরেক চিন্তা, জুলেখার বাপে কয়দিন ধইরা এইটা কী জোড়াইছে! কী হইছে বেটার! আরেকবার মোনে আহে যে, ইসুফ মিয়ার মায়ে ক্যান কয়দিন হয় আইতাছে না! সেয় আইলে পরানটা এট্টু শান্তি পাইতো জুলেখার মায়ের!
ইসুফের মায়ের ওপরে তো তার কোনো জোর নাই! সেয় হইলো পাড়া-পড়শি ভাশুর-বৌ। জুলেখার মায়ের জাল। আউজকা এই কয়টা বচ্ছর ধইরা সেয় যখন-তখন আইসা পইড়া থাকতাছে জুলেখার মায়ের কাছে। তার অন্তরে দর্দ আছে। দরদের টানে সেয় আইসা এতোকাল ধইরা বুঝ দিয়া চলছে জুলেখার মায়েরে!
তয়, মাইনষের ঠেকা বেঠেকা আছে না! কোন ঠেকার কারণে আউজকা কয়দিন ধইরা ভাউজে আসতাছে না, জুলেখার মায়ে সেইটা জানে না। একটা এমুন কেউ তার নাই; যেয় কি না ভাউজের সংবাদখান তারে আইন্না দেয়! একলা বাড়িতে একেক দিন দফায় দফায় বিলাপ পাড়ে জুলেখার মায়, আর ঢোকে ঢোকে ইসুফের মা ভাউজরে স্মরণ করে সেয়।
দেওভোগ গেরামের এই একজোনে খালি জুলেখার মায়েরে কইছে, ‘লোকে যা কয় কউক, তুই কানে নিস না জুলেখার মা। আমার অন্তরে কয় যে তর মাইয়া মরে নাই! মরে নাই! উয়ে বাইচ্চা আছে! আইবো ফিরা তর মাইয়া!’
কথাখান শুইন্না জুলেখার মায়ের চক্ষের পানি নদী ধারা হইয়া নামতে থাকছে! ভাউজে কী কয়! বাইচ্চা থাকলে কোনো সংবাদ কী কোনোখান তেনে পাওয়া যাইতো না! মাইয়া আর নাই তার। আহহারে! লুলা-টুন্ডা আতুর আন্ধা হইয়াও যুদি মাইয়াটা বাইচ্চা থাকতো! তাইলেও তো মাইয়াটায় চক্ষের সামোনে থাকতো!
বালাই-বেমার নিয়াও যুদি বিছনায় পড়া থাকতো! কতো মাইনষে কঠিন বিমারি হইয়া বিছনায়-পড়া থাকে না? থাকে তো! তার মাইয়াটায়ও তেমুন থাকতো যুদি! হোক বিমারি! মায়ের হাত দুইটা তো লাড়তে চাড়তে পারতো মাইয়াটারে!
কিছুর মিদে কিছু না; দিনে-দোপোরে গায়েব হইয়া গেলো সোনার পরতিমা! অখন এই ঠাটা-পড়া জিন্দিগি নিয়া বদ-নসিব মায় কী করবো! বিধি কি জুলেখার মায়েরে চক্ষে দেখে না?
এই হায়-আফসোসের কালে নিত্যি তিরিশটা দিন ইসুফের মায় ধামকি দিতে দিতে বুঝ দিছে, ‘দ্যাখ, জুলির মা! বিধির বিধানের ওপরে জোর চলে না। সবুর ধর তুই। মাইয়া যে মরছে, এই কথা তরে কে কইছে! মরে নাই! মাইয়া তর ফিরা আইবো দেখবি!’
কোন বিশ্বাসের জোরে ভাউজে এত্তা জোর দিয়া এই কথা কইতে পারে! কোন বিশ্বাসের জোরে! জুলেখার মায়ে ক্যান নিজের ভিতরে সেই বিশ্বাসরে পায় না! একবারও পায় না ক্যান সেয়!
হউক অইটা কথার কথা! তাও সেই কথাখানরে জাবড়ানি দিয়া ধইরাই না এতাটি দিন পার করতে পারছে জুলেখার মায়ে! এই আশায় আশায়ই না দেহ ধইরা রাখছে সেয়? এই কথাখানরে ভরসা কইরাই না জুলেখায় মায়ে খোদার তিরিশটা দিন লৌড় দিয়া চলছে ঠাকুর-বাড়ির ঘাটলার দিগে?
দিনে একবার মাইয়া খোয়ানি-যাওনের জায়গাখানরে চক্ষের দেখা না দেখলে, তার পরান ক্যান জানি শান্তি পায় না। খালি ধকপকায়, খালি ধড়ফড়ায়। সেই ঘাটলাটারে দেখলে তার পরান হায় হায় করে ঠিক, আবার য্যান শান্তিও লাগে। য্যান মোনে অয়, এই ঘাটলায় জানে তার জুলেখার সন্ধান। অখন কইতাছে না, কিন্তুক একদিন ঠিকই কইবো!
সেই দিনও মাটিতে কাইত হইয়া একলা একলা কতখোন বিলাপ পাড়তাছিলো জুলেখার মায়, কতখোন নাই-তাই কতো কথা মনে লাড়া-চাড়া দিতাছিলো! অমুন সোমে সেয় দেখে কোন ফাঁকে জানি জুলেখার বাপে আইয়া খাড়াইয়া রইছে তার শিথানের সামোনে! ধুছমুছাইয়া উইট্টা বইয়াও সারে না জুলেখার মায়ে, বেটায় কয়; ভাত দে জলদি।
আসরের ওক্ত। এই সোম তো কোনোকালেও জুলেখার বাপে বাড়িত আহে না! আসে সেয় সন্ধ্যাসন্ধি। সেই হিসাব মতোন জুলেখার মায়ে রান্ধন বসায় সন্ধ্যার এট্টু আগে। অখন তো থাকার মধ্যে আছে খালি কতাটি পানি দেওয়া ভাত। সকালে জুলেখার বাপেরে খাওয়ানের পরে যেই কয়টা ভাত আছিলো, সেইটিরে পানি-পান্তা বানাইয়া থুইছে সেয়।
জুলেখার মায়ে সেই ভাত কয়টাই গোছগাছ দিয়া জুলেখার বাপের সামোনে দেয়। অখন ভোখের মোখে এইটুক সেয় খাউক; তার বাদে জুলেখার মায়ে যতো জলদি পারে—দিতাছে তারে গরম ভাত রাইন্ধা!
সেই পান্তাভাতরে দেখো খসমে কী করে! সেয় ভাতের সানকিরে উঠানে ফিক্কা মারে! তার বাদে পানিভরা কাঁসার গেলাসখানরে আছাড়ানি দেয়। দিয়া জুলেখার মায়েরে একটা লাত্থি দিয়া কয়, ‘তরে দিয়া এমনে আমার দিন যাইবো না! আমি আবার বিয়া করমু!’
চক্ষের পানি আঁচলে মোছতে মোছতে কথাখান শোনে জুলেখার মায়। পরান তার ধক কইরা ওঠে। দ্যাখছো! এইটা কী কইতাছে বেটায়! জিদ্দের মোখে নি এমুন নাই কথা কয় মাইনষে!
কথাখান কোন মোখে কইলো জুলেখার বাপে! শোকেতাপে সেয় তাইলে এমুনই বেবোধা হইয়া গেছে! কী কইতাছে না কইতাছে—কিছুরই হুঁশ থাকতাছে না তার তাইলে অখন!
নিজেরে এমনে সেমনে বুঝ দেয় জুলেখার মায়। তয়, বেশি খোন আর তার নিজেরে এমুন বুঝানি দেওনের দরকার পড়ে না। পরদিন বিয়ানেই আবার বিষয়খান খোলসা করে জুলেখার বাপে। সেয় সত্যই নয়া-বউ ঘরে আনবো!
আনবো আষাঢ় মাসের পইল্লা শুক্কুরবারে। দিন-তারিখ সগল কিছুই ঠিক, অখন কামখান হইতে যা বাকি!
বিয়া না কইরা এই বেটায় করবো কী! তার সয়-সম্পত্তি খাইবো কেটায়! তার একখান ওয়ারিশ থুইয়া যাওন লাগবো না দুনিয়ায়?
জুলেখার মায়ের বোলে তিনকুলে কেউ নাই। সেই বিষয়টা মাথায় আছে জুলেখার বাপের। সেই কারণেই সেয় জুলেখার মায়েরে এই বাড়িতেই রাখবো। নাইলে তারে পাঠাইয়া দিতো তার মায়গো বাইত।
এই বাড়িতে জুলেখার মায় থাকবো ঠিকই, তয় বড়ো ঘরে তো তার থাকা চলবো না! সেই ঘরে খসমে থাকবো তার নয়া-বউরে লইয়া।
জুলেখার মায় তাইলে কই যাইবো?
তার লেইগা একখান কোনোরকম একচালা তোলা হইবো। সেই একচালায় থাকবো সেয়, আর ঘর-গিরস্থির কাম-কাইজ করবো।
সেই একচালা তোলা হইতাছে অখন ভিটির উত্তর সীমানায়।
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)