আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
‘বাজি ধরে লিখলাম গল্প’

বাঁশি হাতে উদ্ভ্রান্তের মতো মাঠে-ঘাটে গান গেয়ে বেড়ানো ছিল আমার স্বভাব। এই বাঁশি বাজানোর নেশার কথা আমার প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘অতসীমামী’তেও উল্লেখ আছে। এ ছাড়া ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানদের সঙ্গে গল্পগুজব করে রাত পার করে পরদিন সকালে বাড়ি ফেরা, এমনকি মাঝিদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদের সঙ্গে দু-চারদিন কাটানো ছিল আমার অশান্ত ও কৌতূহলী মনের প্রকাশ। আমার ওই সময়টা নিয়ে ড. সরোজমোহন মিত্র লিখছেন- ‘১৪/১৫ বৎসরের ছেলে স্কুলের ছাত্র মানিককে দু-তিনদিন খুঁজে পাওয়া যায় না। যায় কোথায়! জননী কেঁদেকেটে অস্থির, খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টাঙ্গাইলের নদীর ধারে যে নৌকাগুলি নোঙর করা থাকে, তাদের মাঝি-মাল্লার সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদের মধ্যে সে দু-চারদিন থেকে আসে। নৌকার মধ্যে তাদের অন্ন খায় পরম তৃপ্তিতে। এর আরেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। অদ্ভুত পাগলামি।’
মায়ের মৃত্যু আমার জীবনে একটি বড় ঘটনা। যে মা আমাকে সব সময় আগলে রাখত, তার মৃত্যুতে আমাকে তখন করে তোলে একেবারে ছন্নছাড়া। মনে আছে, ১৯২৪ সালের ২৮ মে মাসে টাঙ্গাইলে ডবল নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মা মারা যান। এই মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে আঘাত করে। মায়ের অভাব তীব্রতর প্রতিক্রিয়া ফেলে আমার সংবেদনশীল মনে। পাশাপাশি মায়ের মৃত্যুর পর পরই টাঙ্গাইল ছেড়ে চলে যাই আমরা। ড. নিতাই বসুর ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাজজিজ্ঞাসা’ বইটিতে আমার মায়ের কথা উল্লেখ আছে : “মানিকের মায়ের নাম নীরদাসুন্দরী দেবী পুতুলনাচের ইতিকথা উল্লেখিত গাওদিয়া গ্রামের মেয়ে ছিলেন তিনি। ...মানিকের মায়ের মৃত্যুর পর মানিকের পিতামহ করুণাচন্দ্র গাওদিয়ার পার্শ্ববর্তী মালপদিয়া গ্রামে মাতুলালয়ের সাহায্যে ও সহায়তায় বসবাস করতে শুরু করেন। মোটামুটি এই সামান্য ঘটনাগুলো বাদ দিলে নীরদাসুন্দরী সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত আর কিছুই জানা যায়নি। সুদীর্ঘ সাহিত্যজীবনে মানিক জননীর বিষয়ে আশ্চর্যরকম নীরব, যদিও প্রকাশিত প্রথম উপন্যাসটির নামই ‘জননী’, চিঠিপত্রে বা আলাপচারিতায় মাতৃপ্রসঙ্গ অনুপস্থিত; শৈশবসংক্রান্ত যাবতীয় স্মৃতিচারণায় জননীর রক্তমাংসহীন সত্তার গৌণ উপস্থিতি নজরে আসে। দুর্দান্ত বেপরোয়া মানিক শৈশবের দুরন্ত দিনগুলোর সীমা ছাড়িয়ে যে মুহূর্তে কৈশোরে পদার্পণ করেন সেই সময়েই ঘটে তাঁর মাতৃবিয়োগ এবং ‘কী’ ও ‘কেন’র রোগে আক্রান্ত ওই তরুণ বালক অতঃপর বলগাহীন বেপরোয়া উদ্দাম জীবনচর্চায় অভ্যস্ত হতে থাকেন।”
মেঝদা, মানে সন্তোষকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মস্থল ছিল তখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ছোট্ট শহর কাঁথিতে। তিনি তখন সদ্য ডাক্তারি পাস করে প্র্যাকটিস শুরু করেছেন মাত্র। সেখানেই আশ্রয় নেয় আমাদের পুরো পরিবার। সেখানকার কাঁথি মডেল স্কুলে ভর্তি করা হয় আমাকে। তবে বেশি দিন আমি ওই শহরে থাকতে পারিনি। স্কুলে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিন পরেই কালাজ্বরে আক্রান্ত হই আমি। হাওয়া বদলের জন্য তখন আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মেদিনীপুরে, বড়দি শিশিরকুমারী চট্টোপাধ্যায়ের শ্বশুরবাড়িতে। এই কালাজ্বরে ভুগতে হয় আমাকে দীর্ঘদিন। একসময় সুস্থ হলে বড়দা আমাকে ভর্তি করে দেন মেদিনীপুর জেলা স্কুলে। মেদিনীপুরে আমার জীবন ছিল বড় বিচিত্রময়। সেখানে আমার আকর্ষণের বিষয় ছিল বস্তিতে বসবাসকারী গরিব মানুষ, শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কাঁসাই নদী, তার পাশে কুঁড়েঘর দিয়ে সাজানো গ্রাম, রেললাইনের পাশের ধু ধু ফাঁকা মাঠ, শহর পেরিয়ে বিশাল শালবনসহ আরো কত কি! যেসব নিম্ন পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে মিশত না সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষেরা- আমি তাদের সঙ্গে মেলামেশা তো করতামই, বরং তাদের সঙ্গে খেলাধুলা, হইচই করা, আড্ডা দেওয়াও চলত নিয়মিত। এমনকি গ্রামে আগুন লাগলে পরে সেখানেও ছুটে গেছি কিশোর বয়সে। তবে এ সময়টাতেই প্রতিটি মানুষের মনের ও শরীরের নানা পরিবর্তনের ছাপ পড়ে। দুরন্ত এই আমি তখন নিজেকে গুটিতে নিতে থাকি সবকিছুর থেকে। মানুষের সঙ্গ পাওয়ার চেয়ে তখন আমার কাছে নিঃসঙ্গতা প্রিয় হয়ে ওঠে। কোলাহল থেকে নিজে বাঁচিয়ে আমি তখন নির্জনতা খুঁজি। আবেগপ্রবণ এই আমি তখন বুঝতে ও ভাবতে শিখি। সারা দিন ছোটাছুটি রেখে লেখাপড়ায় মন দিই খানিকটা। পরিবারের অন্য সবাই যখন আমার পড়াশোনা, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, বিশেষ করে বড়দি শিশিরকুমারী, তখন সবাইকে তাক লাগিয়ে দিই আমি। ১৯২৬ সালে আমি মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করি। তা যেনতেন পাস নয়; গণিতে বিশেষ কৃতিত্ব নিয়ে প্রথম বিভাগে পাস। আমার এ অপ্রত্যাশিত ফলাফলে তখন পরিবারের সবার মুখে ফুটে ওঠে প্রশান্তির হাসি।
প্রবেশিকা পাস করার পর আমি চলে আসি বাঁকুড়ায়। সেখানকার ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজে ভর্তি হই বিজ্ঞান বিভাগে। বাঁকুড়ায় হোস্টেল-জীবনে আমি হয়ে ওঠে আরো বেশি নিঃসঙ্গপ্রিয়। একা একা থাকতে ভালো লাগে আমার। কারো সঙ্গে কথা বলা, কিংবা বললেও খুব একটা ঘনিষ্ঠ না-হওয়া রোগে ধরে আমাকে। এ সময় বড় বেশি বিষণ্ণতা পেয়ে বসে আমার মনে। সঙ্গী হিসেবে তখন নিই সিগারেট, আসক্ত হয়ে পড়ি ধূমপানে। পাশাপাশি মাঝেমধ্যে খাওয়া হয় মদ। তবে ধূমপায়ী হই, আর মদ্যপায়ী হই, আমার ব্যক্তিত্ব টলে না তাতে। তরুণ বয়সের আমার এ দৃঢ় ব্যক্তিত্বকে তখন সমীহ করে চলে অনেকেই। নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হয় তখন আমার বাঁশি ও গান। সময়-সুযোগ পেলে চলে বাঁশি বাজানো কিংবা আনমনে গান গাওয়া। এ দুটো যেন জীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠে আমার। এসময়টাতে আমি বাম রাজনীতির গোপন ‘অনুশীলন’ দলের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলি। এদিকে মিশনারি কলেজের লাইব্রেরি থেকে পড়া বাইবেল পাঠের মধ্য দিয়ে চলে যায় আমার ভেতরকার ধর্মীয় গোঁড়ামি। পাশাপাশি ‘সেন্ট জন অ্যাম্বুলেন্স কোর’-এ ভর্তি হয়ে ডিপ্লোমাও করি আমি। বাঁকুড়াতে আমি ছিলাম সব মিলিয়ে দুই বছর। এর মধ্যেই এত সব পরিবর্তন ঘটে যায় আমার ভেতর। এ ছাড়া এ সময়টাতে আমি পাঠ করতে থাকি দেশি-বিদেশি নানা সাহিত্য। ফলে ক্রমেই পাঠ্য বইয়ের প্রতি কমে আসে আমার আকর্ষণ। সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে খুঁজতে থাকি জীবনের আসল মানে। এতকিছু সত্ত্বেও আইএসসি পরীক্ষা দেই। সেই পরীক্ষায়ও প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করি আমি।
আইএসসি পাস করার পর আমি চলে আসি কলকাতায়। গণিতে অনার্স নিয়ে আমি বিএসসিতে ভর্তি হই কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেই কলেজজীবনেই বিরাট এক কাণ্ড ঘটে যায়। বয়স তখন কতই বা, বড়জোর কুড়ি। কোনো একদিন আমি আমার সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম কলেজের ক্যান্টিনে বসে। এ সময় এক বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরি- নিজের লেখা গল্প আমি ছাপাব তখনকার সময়ের শ্রেষ্ঠ পত্রিকা ‘বিচিত্রিা’য়। সে সময় বিচিত্রা ছিল অত্যন্ত বিখ্যাত পত্রিকা। আর তাতে কেবল নামকরা লেখকরাই লিখে থাকেন। আমার এমন প্রায় অসম্ভব বিষয়ের ওপর বাজি ধরাতে স্বাভাবিকভাবেই হাসাহাসি করেছিল বন্ধুরা। কিন্তু আমার জেদি মন তখন হারবার পাত্র নয়। লিখে ফেলি প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’। গল্পের নিচে লেখকের নাম হিসেবে স্বাক্ষর করি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তা পাঠিয়ে দেই বিচিত্রার সম্পাদক বরাবর। নিজের ভালো নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ছেড়ে ডাকনামেই ছাপতে দেই সেই গল্প। লেখা পাঠানোর প্রায় চার মাস পর ১৩৩৫ সনের পৌষ সংখ্যায় (ডিসেম্বর ১৯২৮ সাল) ছাপা হয় আমার সেই গল্প। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক মহলে সাড়া ফেলে গল্পটি। সেই থেকে সাহিত্যজগতে প্রবেশ ঘটে আমার। এর পর থেকে নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকি। আর তারই সঙ্গে ‘প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়’ নামটি চাপা পড়ে যায় ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ নামের তলে।
ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন, যা আমাকে এতটা জেদি করে তুলেছিল? ঘটনাটি না হয় একটু বিস্তারিত বলা যাক। ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার এক ফাঁকে এক সহপাঠী বলে উঠলেন, নামকরা লেখক বা দলের লেখক না হলে পত্রিকাওয়ালা লেখা ছাপায় না। আরেক সহপাঠীর লেখা গল্প বিভিন্ন কাগজ থেকে ফেরত এসেছে অমনোনীত হয়ে। এ সময় সেই সহপাঠী গালিগালাজ করতে লাগলেন সম্পাদকদের উদ্দেশ করে। তখন আমি বললাম, এমনটা বাজে বকছো কেন? নামকরা লেখক বা দলের লেখক না হলে লেখা ছাপা হয় না, এটা হতে পারে না। ভালো লেখা হলে কেন ছাপবে না, অবশ্যই ছাপবে। সহপাঠীর উত্তর, ‘আমারটা ছাপেনি তো।’ আমার পাল্টা জবাব, ‘তোমারটা ভালো হলে নিশ্চয়ই ছাপা হতো।’ এবার খেপে উঠলেন সহপাঠী। বললেন, ক্ষমতা থাকে তো একটা গল্প লিখে ছাপিয়ে দেখাও দেখি।’ এ কথা শুনে আমারও জেদ চেপে যায় মনে। বললাম, ‘ঠিক আছে, তাই হবে। আমি গল্প লিখব, এবং সেটি বিখ্যাত কোনো পত্রিকায় ছাপিয়ে প্রমাণ করব তোমাদের ধারণা ভুল।’ সহপাঠীর চ্যালেঞ্জ, ‘তাহলে বাজি ধরো।’ আমার উত্তর, ‘বাজি।’ এই বাজি ধরে আমি লিখলাম গল্প ‘অতসীমামী’। আর তা লিখতে তিন মাস লাগেনি আমার, মাত্র তিনদিন লেগেছিল। জমা দিয়ে এলাম বিচিত্রা পত্রিকায়। সেই গল্প পড়ে পত্রিকার সম্পাদকের এতটাই ভালো লেগে গিয়েছিল যে, নিজেই চলে আসেন আমার কাছে। নগদ কুড়ি টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আরো একটা গল্প চাই।’
অনেকের কাছে প্রশ্ন, মাত্র ২০ বছর বয়সে বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরে গল্প লেখা, বিচিত্রার মতো পত্রিকায় সেই গল্প প্রকাশ ইত্যাদি সমস্তই কি আকস্মিক বিষয়? হঠাৎ বাজিমাত করা ব্যাপার? নাকি অনেক আগে থেকেই নিজেকে সাহিত্যিক হিসেবে প্রস্তুত করছিলাম আমি। মাত্র ২০ বছর বয়সে একজন মানুষের জীবনে কী-ই বা এমন জীবনের অভিজ্ঞতা কিংবা উপলব্ধি থাকতে পারে? এ বিষয়ে আমার কথা হলো, “সাহিত্য জীবন আরম্ভ করার একটা গল্প আমি এখানে ওখানে বলেছি। ছাত্রজীবনে বিজ্ঞান শিখতে শিখতে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে ‘অতসীমামী’ গল্পটি লিখে বিচিত্রায় ছাপানো এবং হঠাৎ এভাবে সাহিত্যজীবন শুরু করে দেওয়ার গল্প। কিন্তু একটা প্রশ্ন দাঁড়ায় এই : কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই কি একজন লেখকের সাহিত্য জীবন শুরু হয়ে যেতে পারে? আমি বলব, না, এ রকম হঠাৎ কোনো লেখকই গজান না। রাতারাতি লেখকে পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই তার প্রস্তুতি চলে। লেখক হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে আসতেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব।”
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের গল্প-উপন্যাস গভীরভাবে পাঠ করেছি আমি। আর সেই পাঠের মধ্য দিয়ে নিজেকে এমন এক জায়গা দাঁড় করাতে চেয়েছি- যেখানে আমার আগের লেখকরা পৌঁছাতে পারেননি। এ কথাটি আমি আমার ‘গল্প লেখার গল্প’ প্রবন্ধে বলেছি। সেখানে আমি লিখেছি, “বারো তেরো বছর বয়সের মধ্যে ‘বিষবৃক্ষ’, [বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়] ‘গোরা’ [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর], ‘চরিত্রহীন’ [শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়] পড়া হয়ে গিয়েছে। ...বড় ঈর্ষা হতো বই যাঁরা লেখেন তাঁদের ওপর।” তবে এ কথা সত্য, আমি আমার অগ্রজ লেখকদের প্রতি অশ্রদ্ধ ছিলাম না। বরং তাঁদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই কাজ করে গেছি আমি। আমার কথা হলো, পূর্বসূরি লেখকরা জীবনের বাস্তবতার যে দাবি মেটাতে পারেননি, সেখানে আমি আমার সাহিত্যে সেটার মীমাংসা করার প্রয়াস করেছি মাত্র।
তবে ‘অতসীমামী’ গল্প সম্পর্কে পরিণত বয়সে আমার মূল্যায়ন ছিল এমন : “রোমান্সে ঠাসা অবাস্তব কাহিনী। কিন্তু এ গল্প সাহিত্য করার জন্য লিখিনি- লিখেছিলাম বিখ্যাত মাসিকে গল্প ছাপানো নিয়ে তর্কে জিতবার জন্য। এ গল্পে তাই নিজের আসল নাম দিইনি, ডাক নাম ‘মানিক’ দিয়েছিলাম।” আমার এ বক্তব্যের আরো বিস্তারিত পাওয়া যাবে আমার ‘উপন্যাসের ধারা’ প্রবন্ধে। সেই প্রবন্ধের এক জায়গায় আমি লিখেছি, “প্রথম লিখলাম একটি গল্প- তাও লেখার খাতিরে নয়, কয়েকটি ছাত্রবন্ধুর সঙ্গে তর্কের ফলে সাধারণ একটা বাস্তব সত্যকে হাতেনাতে প্রমাণ করার জন্য। এ ঘটনার মধ্যেও প্রকাশ পেয়েছিল আমার ঔপন্যাসিকের ধাত, সাধারণ যুক্তিবোধ, বাস্তব-বোধ। তর্কটা ছিল মাসিকের সম্পাদক-মশাইদের অবিবেচনা, উদাসীনতা, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি দোষ নিয়ে। সম্পাদকরা কী রকম জীব কিছুই জানতাম না, কিন্তু ভালো একটা লেখা হাতে পেলেও শুধু লেখকের নাম নেই বলেই লেখাটা তাঁরা বাতিল করে দিয়ে থাকেন, এটা কোনোমতেই মানতে পারিনি। কোনো যুক্তিই পাইনি সম্পাদকদের এই অর্থহীন অদ্ভুত আচরণের। ভালো লেখার কদর নেই, কদর আছে শুধু নামকরা লেখকের- এ তো স্রেফ পরস্পরবিরোধী কথা। যদি ধরা যায় যে, ভালো গল্প লেখা অতিসহজ, গাদাগাদা ভালো গল্প তৈরি হওয়ায় সম্পাদকের কাছে তার বিশেষ কোনো চাহিদা নেই- তা হলে নামকরা লেখকের নামেও কোনো মানেই থাকে না। এত সোজা কাজ করার জন্য নাম হয় কিসে? ভালো লেখা অন্যান্য কারণে সম্পাদকীয় অবজ্ঞা লাভ করতে পারে, লেখক নতুন বলে কখনোই নয়! এই সত্যটা প্রমাণ করার জন্য নিজে একটি গল্প লিখেছিলাম। সাহিত্যজগতের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ না থাকলেও উপলব্ধি করেছিলাম যে, সাহিত্যের জগৎও মানুষেরই জগৎ, সংসারে সাধারণ নিয়মকানুন সাহিত্যের জগতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে না।
মোটামুটি ভালো এক গল্প লিখলে যে কোনো সম্পাদক যে সেটা নিশ্চয় সাগ্রহে ছাপবেন এ বিষয়ে এমনই দৃঢ় ছিল আমার বিশ্বাস যে তখনকার সেরা তিনটি মাসিকের যে কোনো একটিতে ছয় মাসের মধ্যে আমার গল্প বার করা নিয়ে বাজি রাখতে দ্বিধা জাগেনি। কবি মনের ঝোঁক নয়, ঔপন্যাসিকের প্রতীতি- যা আসে বাস্তব হিসাবনিকাশ থেকে। গল্পটা লেখার মধ্যে ছিল এই বাস্তব বিচার-বিবেচনা, কী হয় আর কী না হয় তার হিসাব। এর মধ্যেও সন্ধান পাওয়া যাবে যে, ভবিষ্যৎ ঔপন্যাসিক একদিকে কী রকম নির্বিকার। নিরপেক্ষভাবে বাস্তবতার সমগ্রতাকে ধরবার চেষ্টা করেন, অন্যদিকে তারই মধ্যে বজায় রেখে বলেন আবেগ অনুভূতির সততা- মেদহীন, মমতাহীন বিশ্লেষণে সত্যকে যাচাই করে নিয়ে তার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করেন (যার যেমন বিশ্লেষণ ও যার যেমন প্রাণ!)। প্রথমে হিসাব করেছিলাম কী ধরনের গল্প লিখব। সবদিক দিয়ে নতুন ধরনের নিশ্চয় নয়! একেবারে আনাড়ি, হঠাৎ একদিন কলম ধরে নতুন টেকনিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন বিষয়ের গল্প খাড়া করা সম্ভবও নয়, বেশি ‘নতুনত্ব’ সম্পাদকের পছন্দ নাও হতে পারে। ভেবেচিন্তে স্থির করেছিলাম যে, রোমান্টিক গল্প লেখাই সবচেয়ে সহজ, এ রকম গল্প জমে গেলে সম্পাদকেরও চট করে পছন্দ হয়ে যাবে।
আদর্শ অপার্থিব প্রেমের জমকালো গল্প ফাঁদতে হবে। কিন্তু সমস্তটাই আজগুবি কল্পনা হলে তো গল্প জমবে না, বাস্তবের ভিত্তিও থাকা চাই গল্পের। কী হবে এই ভিত্তি? কাহিনী যদি দাঁড় করাই প্রেমাত্মক অবাস্তব কল্পনার, গল্পের চরিত্রগুলিকে করতে হবে বাস্তব রক্ত-মাংসের মানুষ।
অতিজানা, অতিচেনা মানুষকে তাই করেছিলাম ‘অতসীমামী’র নায়ক-নায়িকা। সত্যই চমৎকার বাঁশি বাজাতেন চেনা মানুষটি, বেশি বাজালে মাঝে মাঝে সত্যই তাঁর গলা দিয়ে রক্ত পড়ত এবং সত্যই তিনি ছিলেন আত্মভোলা খেয়ালি প্রকৃতির মানুষ। ভদ্রলোকের বাঁশি বাজানো সত্যই অপছন্দ করতেন তাঁর স্ত্রী, মাঝে মাঝে কেঁদে কেটে অনর্থ করতেন।
শুধু এটুকু নয়। সত্যই দুজনে তাঁরা একেবারে মশগুল ছিলেন পরস্পরকে নিয়ে। এঁদের দেখেছিলাম খুবই অল্প বয়সে, সেই বয়সেও শুধু এঁদের কথা বলা, চোখে চোখে চাওয়া দেখে টের পেতাম অন্যান্য অনেক জোড়া চেনা স্বামী-স্ত্রীর চেয়ে এঁদের মধ্যে বাঁধনটা ঢের বেশি জোরালো, সাধারণ রোগে ভুগে ভদ্রলোক মারা গেলে কিছুকালের জন্য তাঁর স্ত্রী পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।
‘অতসীমামী’ লেখার সময় এঁদের দুজনকে আগাগোড়া মানস চোখের সামনে রেখেছিলাম। শুধু তাই নয়। সোজাসুজি কাহিনীটা লিখে না গিয়ে নিজে আমি অল্পবয়সী একটি ছেলে হয়ে গল্পের মধ্যে ঢুকে তার মুখ দিয়ে গল্পটা বলেছিলাম।”
(চলবে)