অমর মিত্রের গদ্য
আমার লেখক দেবেশ রায়
দেবেশ রায়ের একটি গল্পের বই বেরিয়েছিল সারস্বত লাইব্রেরি থেকে। সেই আটষট্টি-ঊনসত্তরের কথা। এলা রঙের ওপর লাল একটি অঙ্কন, এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তখন অন্যরকম যাঁরা লিখতে চান, দেবেশ রায় ছিলেন তাঁদের অতি আগ্রহের লেখক। তিনি যেমন লেখেন তা আর সবার থেকে আলাদা। সে তাঁর গদ্য ভাষার জন্য হোক, গল্প বলার ধরন আর বিষয়ের গভীরতার জন্য। তিনি থাকতেন জলপাইগুড়ি। কখনো কলকাতায় এলে তরুণ, নবীন লেখকদের কাছে তা ছিল খবর। আমার পরিচিত দুই অগ্রজ লেখক, ৭৩ সালে দেবেশ রায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন শিয়ালদা স্টেশনের কাফেতে। ফিরে এসে তাঁদের কী উত্তেজনা। বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন, দেবেশ রায় তাঁদের বলেছিলেন, তাঁদের পত্রিকা তিনি পেয়েছেন, পড়েছেন। গল্প পড়ে মনে হয়েছে কিছু কিছু পাতা যেন লেখক লেখেননি। বা ছাপা হয়নি। বিষয়টা এখন বুঝি। তখন আন্দাজ করেছিলাম। সেই গল্পকাররা বুঝেছিলেন কি না জানি না আজো। দেবেশ রায় এমনি সরাসরি বলে দেন। রেখেঢেকে বলার অভ্যাস তাঁর নেই। সেই কারণে এখনো সন্ত্রস্ত হয়ে থাকি, তিনি কী বলবেন অমুক লেখাটি পড়ে। অবশ্য দেখা হলে বলবেন, কিন্তু ভালো লাগলে, দীর্ঘ মেসেজ পাঠাবেন। আমার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে। তরুণ লেখকদের কেউ কেউ সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন।
হ্যাঁ, যে কথায় আরম্ভ করেছিলাম, দেবেশ রায়ের সেই সেই গল্পের বইটির নাম, দেবেশ রায়ের গল্প। সেখানে ছিল দুপুর, নিরস্ত্রীকরণ কেন, কলকাতা ও গোপাল, আহ্নিকগতি ও মাঝখানের দরজা এই সব আলাদা গল্প। এখনো মনে পড়ে ওইসব গল্পের কথা যা প্রচলিত গল্পের বাইরে থেকে দেখা। দুপুর গল্প তো এখন মিথ হয়ে গেছে। তখন, সেই ১৯৭০-৭১-এর সময়, দেবেশ রায়ের লেখা পড়া ছিল আমাদের প্রস্তুতির একটি অংশ। যে অগ্রজদের সঙ্গে মিশতাম, তাঁরা তা বলে দিয়েছিলেন। ক্লাসিক এবং আধুনিক লেখকদের পড়তে বলেছিলেন তাঁরা। তখন দুটি গল্পগ্রন্থ আমাকে পড়তে বলা হয়েছিল, ক্রীতদাস ক্রীতদাসী এবং দেবেশ রায়ের গল্প। ৭৫ নাগাদ একটি গল্প, ভুলা মাসানের পাকে, কালান্তর শারদীয়তে পড়ি। দেশ এবং পরিচয় পত্রিকায় “আপাতত শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে”, গল্পকবিতা পত্রিকায় ‘ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে’, পরিচয় পত্রিকায় ‘কয়েদখানা’। ভুলা মাসানের পাকে বোধহয় তাঁর মফস্বলী বৃত্তান্ত উপন্যাসেরই একটি বা দুটি পরিচ্ছেদ ছিল পরে তা বুঝেছি। যেমন কি না মাদারি মায়ের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ছিল (আজকাল, শারদীয়, ১৯৮৬) তিস্তাপারের বৃত্তান্ত উপন্যাসেরই অংশ। এখানে ওখানে টুকরো টুকরো অংশ লিখে একটি বৃহৎ উপন্যাস লেখার প্রকরণ দেবেশ রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের শিখিয়েছেন। আমি তো শিখেইছি। দেবেশ রায় এই বছরে দুটি শারদীয় পত্রিকায় একই চরিত্র নিয়ে গল্প লিখেছেন। আরো লিখেছেন কি না জানি না। শুধু জানি এইগুলি জুড়ে জুড়ে একটি নতুন উপন্যাস—আখ্যান হবে। বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন কীভাবে বদলে যাচ্ছে সেই কথা তিনি বলতে শুরু করলেন ঘুমের ভিতরে হাইওয়ে দিয়ে।
আমি ১৯৭৫ কিংবা ১৯৭৬-এ প্রথম তাঁর উপন্যাস পড়ি, ‘মানুষ খুন করে কেন’। সে ছিল আমার উপন্যাস পাঠের নতুন অভিজ্ঞতা। সেই উপন্যাসের মূল চরিত্র ছিল একটি চা বাগানের অসৎ সেলস ম্যানেজার জাতীয় কেউ। উত্তরবঙ্গ, চা বাগান, মানুষের লোভ, পাপ নিয়ে ছিল সেই মহাউপন্যাস। মনে পড়ে তখন সেই উপন্যাস ছিল আমাদের আলোচনার বিষয়। গল্প-উপন্যাসের গদ্য ভাষাই লেখককে তাঁর উদ্দিষ্ট ক্ষেত্রে নিয়ে যায় তা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম। অন্তত দেবেশ রায়ের ক্ষেত্রে তা সত্য। পরে বুঝেছি সকল লেখকের ক্ষেত্রেই তা সত্য। সে দেবেশ হন, অতীন হন, শ্যামল বা সিরাজ, বা দিব্যেন্দু হন । দেবেশ রায় পড়তে পড়তে সেই সময়ে আমি বুঝতে পারছিলাম একজন লেখক কেন লেখেন, কী লিখবেন। তখন একটি দুটি গল্প নিয়ে ঘুরছি। ছাপা হচ্ছে আবার ফিরে আসছে। কিন্তু নিজেকে তৈরি করে নিতে চাইছি প্রবলভাবে। ঠিক করে নিচ্ছি আলাদা হতে হবে। যে যে লেখককে আমি পড়তে চাই, তাঁরা তাঁদের নিজস্বতা নিয়েই আমাদের আগ্রহের কারণ হয়েছেন। দেবেশ রায়ের উপন্যাসের লিখন প্রক্রিয়ায় (অনুপম গদ্যভাষা সহ) পরে খুঁজে পেয়েছি রাগ সঙ্গীতের প্রকরণ। আলাপে তার শুরু, তারপর তিনি প্রবেশ করতে থাকেন ঝালায়, রাগের অন্তঃস্থলে। ধরুন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা রবিশঙ্করের সেতার, আমজাদ আলির সরোদের মূর্চ্ছনা। এ আমার নিজের বোধ। সঙ্গীত শাস্ত্রে আমার কোনো জ্ঞানই নেই। কিন্তু অনুভব তো করতে পারি। শুনতে শুনতে নিশ্চুপ হয়ে যাই। টের পাই, চারদিকে যেন নেমে এল অখণ্ড নীরবতা, তাকে আমি সাংগীতিক স্তব্ধতা বলতে পারি। দেবেশ রায় পড়তে পড়তে তেমন মনে হয়। অনেকের সঙ্গে মিলবে না। সেই কবে থেকে দেবেশ রায়কে পড়ছি। কিন্তু এখনো সেই বোধ থেকে সরে আসার কারণ ঘটেনি।
এই বছর তিন আগে আরবীয় পুরাণকথা ইউসুফ জুলেখার কাহিনী নিয়ে যে উপন্যাস তিনি শুরু করেছেন, তার প্রথম অংশ পড়ে ফোনই করেছি। তিনি তো মেসেজে কথা বলেন। যা হোক শোনেন না শোনেন, আমার তো বলা হবে। না বললে তো বলা হয় না। মেসেজ কোনো বিকল্প হতে পারে না। সে তো দীর্ঘ এক কবিতা। মিউজিক। মরুভূমি, নদীর চর, সমুদ্র বালুকা পার হয়ে অন্বেষণের যে দীর্ঘ বৃত্তান্ত দেবেশ রায় লিখেছিলেন, তা আমি ভুলব না। নদীর চর পেরিয়ে জুলেখার স্বপ্নপুরুষ অন্বেষণের যে কথা তিনি লিখেছিলেন, তাও ছিল কবিতা। হ্যাঁ, এই কারণেই দেবেশ রায়কে আমি পড়ি। পড়তে পড়তে এখনো শিখি।
গত ২০১৪-য় একটি স্বল্পখ্যাত শারদীয়া, সমসাময়িক বাংলা (এখন ওই পত্রিকা বিলুপ্ত ) পত্রিকায় তিনি একটি উপন্যাস লেখেন, নাম একটি দিয়েছিলেন দীর্ঘ। এমনি হবে হয়তো, আমাদের জল্পেশগুড়ি শহরের দুই দিক থেকে সূযোর্দয় ঘটে থাকে, বা অমন কিছু। পত্রিকাটি আমার কাছে নেই, আমার কপিটাই আমি দিয়ে দিয়েছিলাম দেবেশদাকে। সেই উপন্যাসের বিষয়টাই হচ্ছে যে এক শহর থেকে তিস্তা নদীতে দাঁড়িয়ে সূযোদয় দেখা যায়। আবার সেই শহর থেকে শহরের পশ্চিমে কাঞ্চনজঙ্ঘায় তার রিফ্লেকশনটাও দেখা যায়। মানে একটা শহর থেকে দুটো সূর্যোদয় দেখা যায়। বিষয়টা এই। সেই শহরটার শহর হয়ে ওঠা নিয়েই উপন্যাসটি লেখা। এটাই ছিল কী-পয়েন্ট। বাকিটা নভেলাইজ করেছিলেন দেবেশ রায়। মানে একটি সূত্র ধরে একটি শহর গড়ে ওঠার কথা নিয়ে নভেল লিখেছিলেন। আর সেই উপন্যাস পাঠ ছিল কবিতা পাঠ। উপন্যাস নির্মাণ নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল দেবেশ রায়ের সঙ্গে, প্রসঙ্গ সেই জল্পেশগুড়ির শহর হয়ে ওঠা। কবিতা তিস্তাপারের বৃত্তান্ত উপন্যাসের গদ্যেও। তিস্তাপুরাণেও। ছিল সেই আশ্চয গল্প দুপুরেও। গ্রীষ্মের সেই দুপুরে বাতাসে ভেসে আসা বেহালার সুর এখনো কানে আসে। মনে পড়ে ‘নিরস্ত্রীকরণ কেন’ গল্পে মধ্য রাতে চলন্ত ট্রেনের বন্ধ দরজার বাইরে অবিরাম করাঘাত। কেউ উঠতে চায় ভিতরে। স্টেশনেও দরজা খোলে নি। এই সব গল্প আমাদের প্রচলিত গল্পের থেকে আলাদা। আরম্ভের দিনে দেবেশ রায়ের গল্প আমাকে বলে দিয়েছিল আলাদা লিখতে হবে।
দেবেশ রায় পড়ে এইটা বুঝেছিলাম, গল্প আসলে নির্মাণ। সূত্রটি কোথা থেকে তা আসবে লেখকও হয়তো জানেন না। শুধু দূরাগত বাঁশির সুরের মতো তা কানে এসে পৌঁছবে মধ্যরাতে কিংবা গ্রীষ্মের নিস্তব্ধ দুপুরে। তিনি সিনেমা করার কথা ভেবেছিলেন একসময়। ছবি তুলেছেন নেশার মতো। সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেসের হয়ে দেবেশ রায় অনেক শর্ট ফিল্ম করেছিলেন। জোছন দস্তিদারের সোনেক্সের হয়ে কতগুলো স্ক্রিপ্ট করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবিত ও মৃত গল্প নিয়ে ফিল্ম করবেন ভেবেছিলেন। এসব জানার পর বুঝি কেন ওইভাবে চিত্রময় এক আখ্যান তিনি ভাবতে পারেন। তিনি লিখতে পারেন একটি শহরের দুই দিক থেকে সূর্যোদয় হয় বা ইউসুফ জুলেখার পুরাণকথা নিয়ে উপন্যাস এই আশির কাছে গিয়ে।
আমি অবাক হয়ে যাই, তিনি এই বয়সেও কী ভাবে লেখেন, “সম্মুখ যুদ্ধগুলি গেরিলা যুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে”। সেই আখ্যানে প্রবেশ করতে করতে ক্রমশ বুঝতে পারি, রাষ্ট্রই গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে এক ভয়ানক কেলেংকারিকে চাপা দিতে। পড়তে পড়তে রাষ্ট্রের লুকোন দাঁত নখ দেখতে পাই। একের পর এক খুন হয়ে যাচ্ছে সেই কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যক্তিরা। প্রমাণ লোপের জন্য তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা জড়িয়ে ছিল লেনদেনের এই কেলেংকারির সঙ্গে। যে সাংবাদিক এই কেলেংকারি নিয়ে এসেছিল লোক চক্ষে, একের পর এক নথি স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমের কাছে জমা দিয়েছে, আরো দেবে, সে নিজেকে রাষ্ট্রের হাত থেকে রক্ষা করবে কী ভাবে রাষ্ট্রেরই নিরাপত্তা নিয়ে ? বিচারপতি কি বিচারপতির বিরুদ্ধে যাবেন ? জড়িয়ে গেছে যে মন্ত্রী, আমলা থেকে বিচারপতি, সবার নাম। তাহলে বিচার পাবে কী করে সে? চিনতে পারি সেই ভয়ানক এই বাস্তবতা। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারি এই আখ্যান পড়ে। গেরিলা যুদ্ধে নেমেছে রাষ্ট্র, সে হয়ে উঠেছে সব তথ্য নিয়ে ক্ষমতাবান। সেই ক্ষমতাকে ভয় পাচ্ছে রাষ্ট্রশক্তি। তাঁর চিন্তার গভীরতা আমাকে তাঁর নিবিড় পাঠক করেছে। দেবেশ রায়ের চিন্তা ক্রমশ বুঝি আরো শাণিত হচ্ছে। তাঁর উপন্যাস আর গল্পের ভিতরে এত নিবিড় করে ভাবতে পারেন তিনি, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার কথা ভাবেন তিনি, যা আমাদের সাহিত্যে বিরল। আমাদের সাহিত্যে দেবেশ রায় একক, তিনি আর কারোর মতো নন। তাঁর কোনো পূবর্সূরী নেই। উত্তরসূরী হবে না।
দেবেশ রায়কে প্রথম দেখি ১৯৭৬-এর প্রথমে। পরিচয় পত্রিকা দপ্তরে। তিনি এসেছিলেন কলকাতায়। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তখন পরিচয় সম্পাদক। সামান্য কয়েকটি গল্প লিখেছি, পরিচয়ে দুটি। তিনি চিনতে পেরেছিলেন আমাকে। সেই হয় তো শুরু ছিল অগ্রজ অনুজের সম্পর্ক নির্মাণ। মিশেছি অনেক। প্রতিক্ষণের আড্ডা আমাদের জীবনে ছিল পরম প্রাপ্তি। সেই আড্ডায় দিব্যেন্দুদা, শ্যামলদা কখনো, কখনো আসতেন। নিয়মিত আসতেন সন্দীপনদা। সেই আড্ডাই আমাদের দিয়েছে অনেক মূল্যবান পরামর্শ। তক্কো বিতক্কো হয়েছে অনেক। অনেক কথা মেনে নিইনি, কিন্তু টের পেয়েছি, তিনি যা বলতে চাইছেন, তা কেউ বলেনি এইভাবে। একটু ভেবেই দেখি না কেন।
আমি এখানে তাঁর একটি অচেনা গল্প ‘মানচিত্রের বাইরে’ নিয়ে কথা বলছি। দেবেশ রায় কাহিনী লেখেন না, গল্প লেখেন। চারদিকে কাহিনী কথকের কথাই শুনতে পাই আমরা। এই গল্প কোনো এক খবরের কাগজের কলম লিখিয়ে পরমহংস ও ফ্রিল্যান্স ফোটোগ্রাফার বিনয়ের। আবার এই গল্পে জড়িয়ে আছে পরমহংসের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়া তার স্ত্রী অনু আর কন্যা বাবিও। কোনো এক দোসরা শ্রাবণের জন্য অপেক্ষা করছিল পরমহংস। সেদিন সে অনুর কাছে যাবে। অনুর জন্মদিনের উইশ করতে। এই গল্প সেই দোসরা শ্রাবণের। সেই দিনের বিকেলটিকে পরমহংস খোলা রাখতে চায়। তার কাগজের নিউজ এডিটর পরের দিন থেকে একটি লেখা ছাপতে যাচ্ছেন, ক্যালকাটাজ ইজি ডেথ, ‘কলকাতার সহজ মৃত্যু’ এই শিরোনামে। লেখা দেওয়া হয়ে গেছে পরমহংসের। বিনয় দেবে ছবি। বিনয় যদি বিকেলের মধ্যে না আসে, আর ছবি যদি সন্ধের ভিতরে ঠিক না করে নিতে পারে পরমহংসের যাওয়া হবে না গলফ লিংক। বিচ্ছেদের পর অনুর সঙ্গে বা মেয়ে বাবির সঙ্গে তার দেখা হয় নি। বাবি একটি চিঠি তাকে দিয়েছিল, কিন্তু সেই চিঠির ভিতরে বাবির সম্বোধনে ছিল আড়ষ্টতা। পরমহংস টের পাচ্ছে এক নিষ্পত্তিহীন যৌন তাকে প্রবল টানছে। তার কোনো তৃপ্তি অন্যত্র নেই। এমন কী অনুতেও নেই। কিন্তু যৌন টান রয়েছে প্রবল। সকাল ১০টায় জানালা দিয়ে দেখা পাশের বাড়ির দেওয়াল, জানলায় নিমের ছায়ার দোলায় সেই যৌন মিশে যায়। মানিকতলা মোড়ে হঠাৎ বৃষ্টি ঝেঁপে আসার ভিতরে, রাস্তার আকস্মিক জনহীনতার ভিতরে… পরমহংসের দিন যাপনের ভিতরে, দোতলা বাসের উপর থেকে দেখা শহর, এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জে, দুরগাপুর ব্রিজের মাঝখান থেকে দেখা পশ্চিমমুখো রেললাইনগুলোর ধাবমান প্রান্তরে বয়ে যায় অনুর শরীরের শাণিত ইস্পাত।
দেবেশ রায় লিখছেন, ‘এই শহর কলকাতার অনুপ্রাসহীন সীমান্তহীন কলকাতার নাগরিক বিস্তারজুড়ে অনুর শরীর নিয়ত অন্বিত হয়ে থাকে পরমহংসের কাছে যৌনের আসঙ্গে।’ ওই যৌনই তাকে টানছে অনুর কাছে। টানছে অনেক দিন, কিন্তু সে এড়িয়ে থাকতে পেরেছে দোসরা শ্রাবণকে সামনে রেখে। যে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হয়ে গেছে, সেই স্ত্রীর প্রতি এই টান বোধ করার কোনো আইনি অধিকার, সামাজিক অধিকার তার নেই। গল্পের চালচিত্রে এই। আর গল্প হয় বিনয়ের ছবি আর তার নিবার্চন নিয়ে। পরমহংসের দ্বিধা আছে গলফ লিংক যাওয়ায়। তাই সে অনুর জন্মদিন এই দোসরা শ্রাবণ পযর্ন্ত তা পিছিয়ে রেখেছিল। আজ বিনয় কখন ছবি দেবে, তার উপর নির্ভর করছে তার যাওয়া। বিনয় কত ছবি নিয়ে বসে আছে তার নিজের ঘরে। পরমহংস যায় দুপুরে সেখানে। ফিরেও আসে। হাওড়া ব্রিজের একটা গর্ত থেকে আচমকা গলে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে এক পথচারীর। তা নিয়ে খুব হৈ চৈ হয়েছিল। তারপর এই শহরে যে যে সহজ মৃত্যুর বিষয় আছে, উপায় আছে সেই কাহিনী বেরোবে পরমহংসের পত্রিকায়। বিনয়ের সঙ্গে পরমহংস ছবির কথা বলতে থাকে। ঘেস চুরি করতে গিয়ে ঘেসের গুহার ভিতরে শিশুর মৃত্যু, রাস্তায় ঘুমন্ত পথচারীর ওপর মাতাল লরি, গঙ্গার তীরে শত বছরের পুরোন বাড়ির ছাদ ভেঙে মৃত্যু সেখানে আশ্রয় নেওয়া মানুষের। সেই ছবি নেওয়া হয়েছিল গঙ্গার ভিতর থেকে। মৃত্যুর খবরও সাজিয়ে পরিবেশন করতে হয়। তারা মৃত্যু নিয়েই কথা বলে যায়। গল্পের ভিতরে চলে আসে ঘেসের গুহার ভিতরে ঢুকে শিশু মৃত্যু। খোলা হাইড্রান্টে পড়ে শিশু মৃত্যু কমন, কিন্তু ক্রমাগত গর্ত খুঁড়ে ঘেসের ভিতরে ঢুকে গিয়ে পনের বিশটি বাচ্চার মৃত্যু স্টোরি হিসেবে অভিনব নিশ্চয়। আসলে এই গল্প মৃত্যুর গল্প। সহজ মৃত্যু সব সময় রহস্যময়। ঘেস দিয়েই এই মৃত্যুর কাহিনী খবরের কাগজে শুরু হবে। কলকাতার সব হাউজিং প্রজেক্টই ঘেস দিয়ে ভরাট করা জমিতে মাথা তোলা। আসলে তা কবরখানা।
‘ক্যালকাটা ইজ গোয়িং হাই অন গ্রেভস—’ আসলে মৃত্যুর কথাই বলতে বসেছেন দেবেশ রায়। সহজ মৃত্যু। এই যে সময় যায়, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে যায়, গলফ লিংক যাওয়ার সময় পেরিয়ে যায়। পেরিয়ে যাওয়া মানে আবার কোনো এক চৈত্র বা ফাল্গুনের জন্য অপেক্ষা করা। পরমহংসের কাছে বিনয় শুনতে চায় মৃত্যুর এক ধারাবিবরণ। পরমহংস তা শোনাতে আপত্তি করেনি। শোনাতে শোনাতে সে বোঝে অনু দূরে সরে যাচ্ছে। বিনয় তার কোলে ফেলে দিয়েছে অনেক মরা মানুষের ছবি। পরমহংস ঘাড় নামিয়ে থালাভরা জলে যেন গ্রহণের সূয দ্যাখে— মৃতদেহ ভাসা স্রোতে আরো যুগ-যুগান্তরের পারে চলে চলে যাচ্ছে দোসরা শ্রাবণ। আসলে একটি সম্পর্কের সহজ মৃত্যুর গল্প বললেন দেবেশ রায়। এই তাঁর প্রকরণ। আঙ্গিক। পড়তে পড়তে পাঠক যে বোধের কাছে পৌঁছায় তার দাম অনেক।