নজরুল-ব্রত

Looks like you've blocked notifications!

কালবৈশাখী নামের যে প্রলয়ঙ্করী ঝড়কে আমরা চিনে আসছি, তা কখনো কখনো জ্যৈষ্ঠেও হতে পারে। বাংলায় সে ঝড়ের জন্ম হয়েছিল ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে। ঝড়ের প্রচণ্ড গর্জন, গতি এবং ঘূর্ণিতে বঙ্গবাসীর ভিনদেশি ছাল-বাকল চটকে গিয়ে তার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ল। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো, উয়ারী-বটেশ্বরের পরিত্যক্ত-পোড়োবাড়ি যেন নতুন করে তার সমৃদ্ধি, শৌর্য ও সৌহার্দ্যের টাটকা সুগন্ধি ছড়িয়ে দিল বাংলার মানুষে, মননে ও মৃত্তিকায়। নালন্দা-তক্ষশীলা-মহাস্থানগড়ের বোধিবৃক্ষ যেন পুনরুত্থিত হলো প্রাণবন্ত পত্র-পল্লবের জোয়ারে। বাইরের খানাখন্দ পেরিয়ে অন্দরে প্রবেশের জুঁতসই পথ পাওয়া যাচ্ছিল না দীর্ঘদিন ধরেই। ফলত বাঙালি একটি ক্ষয়িষ্ণু পলায়নপর আত্মপ্রবঞ্চক ও কলহপ্রিয় জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছিল। বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলার পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবী মহল মনের সুখে যখন বাঙালির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছিলেন এবং জাত-পাত বিভেদের চূড়ায় তুলে তাকে যখন কলহ-দাঙ্গার অতল খাদে নিক্ষেপ করে পাজরের সব হাড় গুঁড়িয়ে দিয়ে অভিশাপে জর্জরিত করছিলেন; অর্ধমৃত সেই বাঙালিকে তার নিজস্ব তেজস্বীয়তায় প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল উত্তাল প্রলয়ের ঝঞ্ঝামুখর মদির উন্মাদনা। নিস্তেজ মলিন মৃতপ্রায় বাঙালির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল কেউ এসে তাকে সিগ্ধ কণ্ঠে মায়াময় আদরে বলুক—

‘এস আমাদের লক্ষ্মীছাড়ার দল।...এই দুর্দিনে তোমাদের ঘরে ডেকে নেওয়ার কেউ নেই, তোমাদের ডাক দিয়েছে ঐ ঝড়-বাদলের উতল হাওয়া আর মাটির মায়ের সিক্ত কোল। ...গরল আমাদের তৃষ্ণার জল, দাবানল-শিখা আমাদের মলয়-বাতাস, নিদাঘ-আতপ আমাদের তৃপ্তি, জাহান্নাম আমাদের শান্তি-নিকেতন, এস আমার শনির শাপদৃপ্ত ভাইরা!’ (আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল)।

এমনই দয়ার্দ্র আগ্নেয়গিরি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির মেধা-মনন-চেতনায় তীব্র আঘাত ও ভালোবাসার মৃত্যুঞ্জয় সঞ্জীবনী সুধায় অনুপ্রাণিত করে ভেঙে দিয়েছেন তমসাচ্ছন্ন নিদ্রার ঘোর। পশ্চাৎপদতাকে ভাগ্যলিপি হিসেবে চালিয়ে দিয়ে সব অত্যাচার-নির্যাতন-শোষণকে বৈধতা দেওয়ার যে আয়োজন, তার সামনে বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ালেন তিনি। তাঁর গগনবিদারী প্রলয় উল্লাসে যেন থমকে গেল পুরো ভারতের মানুষ, অমানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতি। উৎপীড়িত ও অত্যাচারী, প্রেমিক ও পাষণ্ড, গরল ও অমৃত, শোষক ও নিগৃহীত, তরঙ্গ ও স্তব্ধতা প্রত্যেকেই নতুন করে ভাবতে শুরু করল নিজেদের অহমিকা ও অন্ধকার নিয়ে। নিজেদের অস্তিত্বের টলটলায়মান বাস্তবতায় শিউরে উঠল বঙ্গবিরাগী, অনুরাগী ও নিস্পৃহ, নিষ্পেষিত কৃষক শ্রমিক-মজুর ও মহাজনের শিরা-উপশিরা। মানুষী চৈতন্যের অভেদকে চারিয়ে দিয়ে, বাঙালির আত্মায় আলোড়ন তুলে কাজী নজরুল ইসলাম জানিয়ে দিলেন, আমরা ঘোর গ্রস্ততায়, বিভ্রান্তির ভিতরে দিনাতিপাত করছি। আমরা বাস্তব নই, বরং পুনরুৎপাদিত বাস্তবের প্রতিরূপ। আমরা কোথাও নিখোঁজ হয়ে আছি। অতি-বাস্তব আমাদের স্থানচ্যুত করে প্রকৃত বাস্তবতাকে প্রতিস্থাপিত করে নিয়েছে তার স্থূল ভোগবাদিতা আর অন্ধকারকে প্রলম্বিত করার নিকৃষ্ট লিপ্সায়। আমাদের সংস্কৃতি-দেশ-কাল-ভাষার সব সমৃদ্ধিকে মৃত ঘোষণা করার এই আগ্রাসী কৌশলকে স্বাভাবিকতা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, কর্মহীনতা ও ভিক্ষাবৃত্তিতে অনাড়ম্বর, স্পন্দনহীন এবং অনড় সমাজের যে চিত্র আঁকা হয়েছে, তা অতি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদী শিল্পীর নিখুঁত ও অলীক চিত্রকর্ম। নীহাররঞ্জন রায় কথিত বেতস লতাই বাঙালির একমাত্র চরিত্র বৈশিষ্ট্য নয়, দেবদারুর মতো ঋজু ভঙ্গিতে সটান দাঁড়িয়ে সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করবার দৃঢ়তাও বাঙালি চরিত্রেরই অংশ। বহিরাগত শাসক-শোষকের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা বাঙালি আসল নয়, বরং সে সাম্রাজ্যবাদের চাহিদা অনুপাতে উৎপাদিত বাস্তবধর্মী বিকৃত পণ্য। উত্তরাধুনিক সময়ে এসে বদ্রিয়ার যাকে বলছেন পিওর সিমুলাঁক্রা—

‘…today reality itself is hyperrealist… reality has already incorporated the hyperrealist dimension of simulation so that we are now living entirely within the `aesthetic’ hallucination of reality.’

বাঙালির বাস্তবতাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের ভরসার মূল জায়গা। অন্যথায় বাঙালি বিষয়ে প্রচলিত বিবিধ অমূলক প্রত্যক্ষণ বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। বাংলায় তিনিই একমাত্র মানুষ, যিনি মুসলিম এবং হিন্দু পরিচয়ের অভ্যন্তরে ঢুকে দুটোকেই অসার হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। বাংলার মানুষের কূপমণ্ডূক অংশ প্রতারক প্রবঞ্চক পুরোহিতপাড়া তাঁর এমন নিরেট বাঙালি হয়ে ওঠাকে মেনে নিতে পারেনি। বিভেদ-বিরোধে সব সময়ই রক্ষিত হয় ক্ষমতাবানের কূটকৌশল। কাজী নজরুল ইসলাম পারিপার্শ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতিকে তোয়াক্কা না করে মিলিয়ে দিতে চেয়েছেন ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের ভেদরেখা। মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন তিনি। তাঁর হিন্দু মুসলমান প্রবন্ধে লিখেছেন—

“একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন : দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?

হিন্দু-মুসলমানের কথা মনে উঠলে আমার বারেবারে গুরুদেবের ঐ কথাটাই মনে হয়।...ন্যাজ যাদেরই গজায় তা ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক তারাই হয়ে ওঠে পশু।...এই যে ভেতরের ন্যাজ, এর উদ্ভব কোথায়? আমার মনে হয় টিকিতে ও দাড়িতে। টিকিপুর ও দাড়ি-স্তানই বুঝি এর আদি জন্মভূমি। পশু সাজবার মানুষের একি ‘আদিম’ দুরন্ত ইচ্ছা! ন্যাজ গজাল না বলে তারা টিকি দাড়ি জন্মিয়ে যেন সান্ত্বনা পেল।”

বঙ্গবাসীর এই যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়াল, তারা মানুষ পরিচয়ে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। ধর্মবোধ তার কাছে বড় হয়ে দাঁড়াল, মানুষ তার দ্বিতীয় পরিচয় এবং বাঙালি সম্ভবত তৃতীয় সারিতে নেমে এসেছে। মনুষ্যত্ব বোধ থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাওয়ার ফলে সে তার মৌলিকতা হারিয়েছে। গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে ভাগ্যগণনার হিড়িক, দেহ-মন-কর্মশাস্ত্রের অসংখ্য প্যাঁচের রজ্জুতে বাঁধা। আনুগত্য, অনুসৃতি ও অনুকৃতির বিচারবিমুখ আচরণে আকীর্ণ সমাজ। ভরতমুণি, ভামহ, কৌটিল্য, চাণক্য, নাগার্জুন, শীলভদ্র, মাধবাচার্য, রামমোহন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত, মাইকেল, অরবিন্দ, বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথের শত সাধনার পরও কোথায় যেন একটি ফাঁক থেকে গেল। নিস্পন্দ, নিথর হয়ে যেন দিন গুজরান করে দেওয়াই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠল বাঙালির। সহস্র বছরের পরিচিত এই বাংলা কেমন অপরিচিত হতে থাকল ক্রমান্বয়ে। শাস্ত্রসম্মত আচার-আচরণ ও দৈনন্দিন জীবনের অচলায়তনে বাঙালির মানস কাঠামো জড়াগ্রস্ত বৃদ্ধের মতো নিস্তেজ হতে হতে কাতর, করুণ হয়ে উঠল। এই অলস, আর্ত-আত্মার চারপাশে প্রলয়-ভেরী বাজিয়ে উত্তাল হয়ে উঠল নজরুলের প্রলয়ঙ্করী শব্দ-বর্শা। এই ঘোরগ্রস্ততাকে আঘাতে আঘাতে চুরমার করে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার সংকল্পে তিনি রচনা করেছেন অজস্র পাথুরে পঙ্‌ক্তি।

‘আজ চাই মহারুদ্রের ভৈরব গর্জন, প্রলয় ঝঞ্ঝার দুর্বার তর্জন, দুর্দম দুর্মদ উচ্চৈঃশ্রবা ঐরাবতের প্রমত্ত বিপুল রণ-উন্মাদ আর তাদের হ্রেষা বৃংহনের গগনবিদারী প্রচণ্ড নাদ। আজ অলক-তিলকের সুচারু বিন্যাস মুছে ফেলে ধকধক জ্বলন্ত বহ্নিশিখার মতো ললাটে ভস্ম ত্রিপুরক পরতে হবে। আজ কোমল কুসুম-মালা ছিঁড়ে দিয়ে মিথ্যাচারী অসুরের অস্থি কপালের মালা প্রমত্ত বিক্রমে স্ফীত বক্ষে দোলাতে হবে। এ শ্মশানে আজ সবার মুখে স্তিমিত মধুর হাসি নিভে গিয়ে দেখা দিক এক বিকট মৃত্যু-করাল রক্তলোলুপ দুর্নিবার অধর্ম-বিদ্বেষ। আজ অবিচার-কদাচারে ভরা এই বিলাস-আলয়ের কেলি-কুঞ্জে যমরাজ তাঁর যত সব হিংস্র শৃগাল-কুকুর-শকুনি-গৃধিনীকে একবারে বল্গা আলগা দিয়ে লেলিয়ে দিন। এই মোহ-সুপ্ত মরণ-মগ্ন জাতির বুকের উপরে প্রেত-পিশাচের তাণ্ডব চলতে থাকুক। আজ মিথ্যার সকল সন্ধি, গ্রন্থি ছিন্ন বিদীর্ণ হোক। মিথ্যা-মদিরার সব পেয়ালা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাক, শয়তানের আরামের আসর হতভম্ব হোক, সারা দেশটা ভরা আজ এক বিকট উন্মাদলীলা, শুধু মতিচ্ছন্নের প্রলাপ আর ক্লীবের ক্রন্দন। যেখানে যত দোকান-পাট ঘর-সংসার সাজ-সরঞ্জাম সকলের মাঝে এর বিরাট ভন্মি, ধর্মের নামে ফাঁকিবাজি।’ ( প্রবন্ধ : আজ চাই কি)

ভগ্ন হৃদয়, নৈরাশ্যে নিমজ্জিত বাঙালির সকল ব্যথাকে ধারণ করে তিনি হয়েছেন নীলকণ্ঠ। প্রগাঢ় অভিমানে ক্ষোভে-বিক্ষোভে হয়েছেন রুদ্র প্রলয়ঙ্কর মহাবিদ্রোহী। তাঁর অস্তিত্বের গভীরে লুকানো ছিল নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি অগাধ অনুরাগ। তিনি ছিলেন দরিদ্র, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি। তাঁর সম্প্রদায় প্রথমত মানুষ, দ্বিতীয়ত বাঙালি মানুষ, তৃতীয়ত দরিদ্র বাঙালি মানুষ। সমসাময়িক তকমাধারী সাবলটার্ন আখ্যানের সারাৎসার পাওয়া যাবে নজরুলের চিন্তা-চেতনা ও কর্মে। অবহেলিত, অপমানিত ও বঞ্চনার শিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে বোবা, কালা ও অথর্ব হিসেবে চিত্রিত হয়ে আসছিল; এসব চিত্রায়ণের উদ্দেশ্য, গন্তব্য ও আগ্রহীদের দিকে দৃষ্টি দিলে নতুন কিছু চিত্রকল্প তৈরি হবে; নতুন চিত্রকল্পের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নির্মাণ করতে গেলে অনিবার্যভাবে চলে আসবে নজরুলের সম্প্রদায় ভাবনা। যে সম্প্রদায়ের বসবাস সমাজের তলানিতে এবং যৌক্তিক কারণেই হাড়জিরজিরে সুবিধাবঞ্চিত। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী লোলুপ নৃতাত্ত্বিকদের দৃষ্টিতে যাদের রক্ত-শুদ্ধতা নেই, বিশুদ্ধ উত্তরাধিকার যাদের বলাৎকার হয়ে গেছে, অসংখ্য বহিরাগত বীর্যপাতে যাদের মা ও মাতৃভূমির গর্ভে নষ্ট ভ্রূণের জন্ম দিয়েছে। বাঙালিকে এসব অবাঞ্চিত অভিধায় কলঙ্কিত করে তাদের বলা হয়েছে নিকৃষ্ট রক্ত-সংকর।

‘বাংলাদেশের বুকে বিভিন্ন জাতির রক্তমিশ্রণের এই ধারা প্রাগৈতিহাসিক যুগ পেরিয়ে ঐতিহাসিক কালের প্রাচীন বাংলায়ও সমানে বয়ে চলল। সে-ধারা আজও থেমে যায়নি। আজও নানা জনের নানা রক্তধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠছে।’

এমন প্রোপাগান্ডামূলক গবেষণার মুখোশটি ধরে হ্যাঁচকা টানে আসল চেহারার বীভৎসতাকে আমাদের সামনে ছুড়ে ফেলেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর সম্প্রদায়কে চিনিয়ে দিয়েছেন শত্রুশিবিরের অবস্থান—

‘আমাদের হিন্দুস্থান যেমন কীর্তির শ্মশান, বীরত্বের গোরস্থান, তেমনি আবার তাহার বুক অত্যাচারীর আততায়ীর আঘাতে ছিন্নভিন্ন। সেই সব আঘাতের কীর্তিস্তম্ভ বুকে ধরিয়া স্তম্ভিতা এই ভারতবর্ষ দুনিয়ার মুক্তবুকে দাঁড়াইয়া আজ শুধু বুক চাপড়াইতেছে। অত্যাচারীরা যুগে যুগে যত কিছু কীর্তি রাখিয়া গিয়াছে, এইখানে তাহাদের সবকিছুরই স্মৃতিস্তম্ভ আমাদের চোখে শূলের মতো বাজিতেছে। কিন্তু এই সে দিন জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়া গেল, যেখানে আমাদের ভাইরা নিজের বুকের রক্ত দিয়া আমাদিগকে এমন উদ্বুদ্ধ করিয়া গেল, সেই জালিয়ানওয়ালাবাগের নিহত সব হতভাগ্যেরই স্মৃতিস্তম্ভ বেদনা-শেলের মতো আমাদের সামনে জাগিয়া থাক্, ইহা খুব ভাল কথা, কিন্তু সেইসঙ্গে তাহাদেরই দুশমন ডায়ারকে বাদ দিলে চলিবে না। ইহার যে স্মৃতিস্তম্ভ খাড়া করা হইবে, তাহার চূড়া হইবে এত উচ্চ যে ভারতের যে কোন প্রান্তর হইতে তাহা যেন স্পষ্ট মূর্ত হইয়া চোখের সামনে জাগিয়া ওঠে। এডায়ারকে ভুলিব না, আমাদের মুমূর্ষু জাতিকে চির সজাগ রাখিতে যুগে যুগে এমনই জল্লাদ-কসাই-এর আবির্ভাব মস্ত বড় মঙ্গলের কথা। (ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ)’

মেরুদণ্ড হারিয়ে নির্জীব-নিঃস্বে পরিণত হওয়া, নিজভূমে পরবাসী বাঙালি দীর্ঘদিন ভুলে ছিল কাকে বন্দনা করতে হয় আর কাকে ভর্ৎসনা। নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে বিদেশি লুণ্ঠনকারী ইন্দ্রিয়াসক্ত কুৎসিত উদ্বাস্তুদের স্তুতিগাথায় মশগুল হয়ে থাকা শিক্ষিত সমাজের স্বার্থান্বেষী অংশ বাঙালির রক্তকণিকাকে ক্রমাগত হীনবীর্য করে তুলছিল। শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় তোষামোদকারীদের ফুলেফেঁপে ওঠার অপর পিঠে তৈরি হচ্ছিল অতলান্তিক খাদ। শৃঙ্খলিত বাঙালি শৃঙ্খলকেই যেন ভালোবাসতে শুরু করেছিল। বাঙালির দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-সামাজিক উত্তরাধিকারকে বিষম ধাঁধায় ফেলে দিয়ে চতুর শোষক তৈরি করেছিল তাদের স্থানীয় মোসাহেব। আধিপত্য টিকিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে ক্ষমতার সকল হাতিয়ার ব্যবহার করেছে অত্যন্ত নির্মম প্রক্রিয়ায়। পরিচিত বাঙালি পণ্ডিতদের ব্যবহার করেছে তাদেরই জ্ঞাতিগোষ্ঠী বাঙালিকে ‘জাতি তুলে’ গালাগাল করবার জন্যে। ‘আজ আমরা আমাদের নিজস্ব মাটিকেই না চেনার চেষ্টা করি, ঘৃণা করি। কারণ আমাদের প্রভু ইংরেজ ঐ মাটিকে ঘৃণা করত, করতে শেখাত। এভাবেই আমরা আমাদের অতীতকে অস্বীকার করতে শিখে গেছি। এই দৃষ্টিভঙ্গি যে আমাদের কত ক্ষতি করেছে, করছে, তা আর বলে শেষ করা যাবে না। নিজেদের অতীতকে ঘৃণা করতে শিখে, আমরা শিক্ষিত বাঙালিরা, ক্রমে একদিন মানসিকভাবে অনাথ হয়ে যাই।’

শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে আমাদের বাঙালিদের ঐতিহ্যহীন, উন্মূল, অধোপতিত, ভীরু, লম্পট, অলস, অভাবী, নিঃস্ব, চরিত্রহীন, প্রতারক বলে মনোবল ভেঙে দেওয়া হয়েছে; যেন দখলদারের ওপর রুষ্ট হলেও ঘুরে দাঁড়ানোর মতো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ না থাকে। শোষকের মর্জিমতো শিক্ষিত সুবিধাভোগীদের দিয়ে শাসকের প্রশংসা কীর্তন করে বাঙালিকে তার দগদগে ক্ষত ভুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সুচারুভাবে। আধিপত্যবাদ অর্থনৈতিক স্তরের বাইরেও তার আগ্রাসী হাত ছড়িয়ে রাখে, পুনরুৎপাদনের প্রয়োজনে শুধু উপরিতল নয়; অভ্যন্তরীণ গ্রন্থিগুলোই তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আধিপত্যের বিস্তার তাই শুধু বাহ্যিক ক্ষমতা কাঠামোতেই শেষ নয়। আধিপত্য ও অধস্তনতার সম্পর্ক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আদর্শিক স্তরের সর্বশেষ পর্দা পর্যন্ত। সমাজের সাংগঠনিক, সৃজনশীল ও মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলোর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার কূটকৌশল চলতেই থাকে। যে কৌশলের মর্মান্তিক শিকার জাতিগতভাবে বাঙালি তথা এ অঞ্চলের জনমানুষ। সুদীর্ঘকাল অধস্তনতার নিষ্পেষণে জর্জরিত বাঙালি এখনো তার ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। এখনো তার সম্প্রদায় হাজারোভাবে বিচ্ছিন্ন। বিভক্তির বীজগুলো বড় হয়ে এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এসব মহীরুহ তাদের অজস্র উত্তরাধিকার ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলার পথে-প্রান্তরে, ঘরে-বাইরে, শরীরে-অন্তরে। এমন জঞ্জাল দূরে সরিয়ে নজরুলের সম্প্রদায়কে চিনতে হবে। তাঁর সম্প্রদায়কে চিনতে হলে আমাদের প্রচলিত জ্ঞানের বৈধতা নিয়েও কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হবে। নিয়ন্ত্রিত জ্ঞান কাঠামোর সীমাবদ্ধতাসহ তাকে অনুসরণ করার বিপদ আছে, কাজেই নিয়ন্ত্রণের বাঁধনগুলো আলগা না করে যথেষ্ট আলো-বাতাসের আশা করা অর্থহীন। আমাদের ভাবভঙ্গি-অভিপ্রায় অনেকাংশেই সন্দেহজনক। ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতিকে গুলিয়ে নিলে যে শরবত পাওয়া যায়, তার পুরোটাই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) যেমন বলেন—

‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয় এটি একটি বাস্তব সত্য। মা-প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছে যে তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-শাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।’

নজরুল তাঁর সম্প্রদায়কে বাঙালি হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। দীর্ঘ সময় ঔপনিবেশিকতায় পিষ্ট হয়ে বাঙালির আত্মায় অনেক গরল ঢুকেছে এবং তার ভাষা-সংস্কৃতি ও ধর্মাচরণে বিস্তৃত হয়েছে সেই বিষ। খণ্ড-বিখণ্ড বাঙালির সেই শতচ্ছিন্ন অন্তরকে একীভূত করার বাইরে তার মুক্তি নেই। তার সম্পদ, তার মেধা, তার পরিশ্রম ও পরোপকারের উত্তরাধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে নিজস্ব শ্যামল কোমল মায়াময় শান্তির অবারিত বাসভূমি। বাঙালির বাঙলা প্রবন্ধে নজরুল এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তাঁর স্বভাব সুলভ ভাষায়—

“বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে ‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।...বাংলার শিয়রে প্রহরীর মত জেগে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গিরি হিমালয়। এই হিমালয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুনি-ঋষি-যোগীরা সাধন করেছেন। এই হিমালয়কে তাঁরা সর্ব দৈবশক্তির লীলা-নিকেতন বলেছেন। এই হিমালয়ের গভীর হৃদ-গুহার অনন্ত ধারা বাংলার শত শত নদ-নদী রূপে আমাদের মাঠে-ঘাটে ঝরে পড়েছে।...বাংলার জল নিত্য প্রাচুর্যে ও শুদ্ধতায় পূর্ণ। বাংলার মাটি নিত্য উর্বর। এই মাটিতে সোনা ফলে। এত ধান আর কোন দেশে ফলে না।...বাংলার মাঠে মাঠে ধেনু, ছাগ, মহিষ। নদীতে ঝিলে বিলে পুকুরে ডোবায় প্রয়োজনের অধিক মাছ। আমাদের মাতৃভূমি পৃথিবীর স্বর্গ, নিত্য সর্বৈশ্বর্যময়ী। আমাদের অভাব কোথায়?...আমাদের মাছ ধান পাট, আমাদের ঐশ্বর্য শত বিদেশি লুটে নিয়ে যায়, আমরা তার প্রতিবাদ তো করি না, উল্টো তাদের দাসত্ব করি; এ লুণ্ঠনে তাদের সাহায্য করি।... যে বাঙালি সারা পৃথিবীর লোককে দিনের পর দিন নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে পারে, তারাই আজ হচ্ছে সকলের দ্বারে ভিখারি। যারা ঘরের পাশে পাহাড়ের অজগর বনের বাঘ নিয়ে বাস করে, তারা আজ নিরক্ষর বিদেশির দাসত্ব করে। শুনে ভীষণ ক্রোধে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে, সারা দেহ মনে আসে প্রলয়ের কম্পন, সারা বক্ষ মন্থন করে আসে অশ্রুজল। যাদের মাথায় নিত্য সিগ্ধ মেঘ ছায়া হয়ে সঞ্চরণ করে ফিরে, ঐশী আশীর্বাদ অজস্র বৃষ্টিধারায় ঝরে পড়ে, শ্যামায়মান অরণ্য যাকে দেয় সিগ্ধ-শান্তশ্রী, বজ্রের বিদ্যুৎ দেখে যারা নেচে ওঠে, হায় তারা এই অপমান এই দাসত্ব বিদেশি দস্যুদের এই উপদ্রব নির্যাতনকে কি করে সহ্য করে?’

বর্তমান বাংলা অথবা রাজনৈতিক বাংলাদেশ উপর্যুক্ত বর্ণনা থেকে খুব কিছু আলাদা নয়। এখনো আমরা বাঙালি হিসেবে সম্প্রদায় হয়ে উঠতে পারিনি, ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভবত অনেক দূরের ব্যাপার। বরং ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতি-অর্থনীতির নিরিখে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল উপদলে বিভক্ত হয়ে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছি ক্রমান্বয়ে। সাম্প্রদায়িক বিভক্তি বাংলার সকল অগ্রগতির সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বাঙালিকে ক্রমাগত পিছিয়ে দিচ্ছে। বাহ্যিক দাসত্বের অবসান হলেও মানসিক দাসত্ব আরো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। বিদেশি দস্যুদল এখন আর মাটির দখল নিতে হামলে পড়ে না, বরং মগজের দখল নিয়ে সকল সম্পদের উপড়ে অনায়াসে কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। এখনকার পদ্ধতি আরো সুবিধাজনক, সূক্ষ্ম এবং সর্বত্রগামী। মগজ-মেধা-মনন দখলের প্রক্রিয়া অনেক আগেই সমাধা করে রাখা আছে। বাংলার সর্বত্র প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিগুলো বিদেশিদের সাজানো ছকে চলমান আছে, এবং এসব পদ্ধতির সাফাই গাওয়ার জন্য ঐসব প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবী-সুবিধাভোগীশ্রেণি সর্বদাই তৎপর আছেন। তাই বাঙলার জনজীবনে সহসাই নতুন সূর্যোদয়ের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।

নজরুলের স্বদেশ তাই মনোজাগতিক প্রেক্ষিতে আজ চূড়ান্ত পরবাসে পরিণত হয়েছে। স্বদেশ স্বসম্প্রদায় সম্পর্কিত নতুন নতুন ডিসকোর্সের আমদানি হচ্ছে ক্রমাগত। আধিপত্যবাদ এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি তত্ত্বের জোগানদাতা। ‘হেজিমনির হাতিয়ার হিসেবে গ্রামসি বুদ্ধিজীবীগণকে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, শাসকশ্রেণি সিভিল ও পলিটিক্যাল সোসাইটির ওপর ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতাচর্চার দ্বারা হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করে থাকে। সিভিল সোসাইটির ঐ হেজিমনি তৈরিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখেন বুদ্ধিজীবীগণ।’ কূটচাল-কৌশলের বুদ্ধিবৃত্তিক পণ্য বিক্রি হচ্ছে দেদার। মেধা ও বুদ্ধি প্রতিস্থাপিত হয়েছে অস্ত্র হাতে যুদ্ধের পুরোনো কৌশলকে হটিয়ে দিয়ে। বিদেশি দস্যুদল এখন হাত গুটিয়ে বসে আছে, তাদের উপঢৌকন সঠিক সময়ে দরবারে পৌঁছে দেওয়া হয়। উত্তরাধুনিক সময়ে এসে শোষণ লুণ্ঠনের মাত্রা আরো ভয়াবহ, বহুমাত্রিক। পণ্য ভারাক্রান্ত সমাজে বহুবিধ পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, প্রচারণা-প্রতারণার ফাঁদে ফেলে শোষণকে দেওয়া হয়েছে বৈধতা। গোলকায়নের গোলকধাঁধায় স্বদেশ-বিদেশ একাকার হয়ে যাচ্ছে। এখন আর কেউ বোন-বন্ধু-আত্মীয়-আপন নয়, স্বদেশি নয়, সকল সম্পর্কের বাজারমূল্য আছে। মালিকানাপন্থী মানসে ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসাবটাই প্রধান। এ ধরনের মানসিক গড়ন নতুন নয়, নজরুলের সমকালেও ছিল, তবে অন্য আদলে। কেউ স্বায়ত্তশাসন কিংবা স্বাদেশিকতার নাম করে হয়তো কিছুটা বাড়তি সুবিধা নেওয়ার আশায় স্লোগান তোলেন। নজরুল এসব দোআঁশলা মনোভাবের বিরুদ্ধে উদ্ধত কণ্ঠে ঘোষণা করেন “সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।”

১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের আহমেদাবাদ অধিবেশনে মাওলানা হস্রৎ মোহানী ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেন, মহাত্মা গান্ধীর তীব্র বিরোধিতায় প্রস্তাবটি পাস হতে পারেনি। তবে রাজদ্রোহের অপরাধে সাজা ভোগ করতে হয়েছিল হস্রৎ মোহানীকে। তার মামলার রায় ঘোষিত হয় ১১ জুলাই ১৯২২ সালে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পুলিশি হয়রানির ভয়েই হোক অথবা আকাঙ্ক্ষার ঘাটতি থেকেই হোক স্বাধীনতার দাবিকে জোরালো করার কথা ভাবেননি। কিন্তু নজরুল ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া, নিজ দেশে বিদেশি প্রভুর খবরদারিকে তিনি কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করতে পারেননি। কঠিন শাস্তি এমনকি মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাবনা সামনে থাকা সত্ত্বেও তিনি চাঁছাছোলা ভাষায় প্রকাশ্যে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানালেন তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র মাধ্যমে ১৯২২ সালের ১৩ অক্টোবর—

‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেন না, ওকথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দ্বায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসন-ভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোন বিদেশীর মোড়লী অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তারা শুনবে না। তাদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকু দূর করতে হবে।’

তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ যা ভাবতেও কুণ্ঠিত ছিলেন, নজরুল অবলীলায় তা প্রকাশ্যে পত্রিকায় ঘোষণা করলেন। রাজদ্রোহের বিষয়ে ইংরেজ সরকার যখন অত্যন্ত অনমনীয় অবস্থায়, নজরুল তখন এতটা নির্ভয় নির্ভীক হলেন কী করে? এখানেই তাঁর সত্য সাধনের তপস্যা। ‘কে দিবে আঘাত? কে জাগাবে দেশ? কই সে সত্য প্রাণ?’ (সত্য-কবি : কাজী নজরুল ইসলাম)। ভারতবাসীর চরম দুর্দিনে কে তাদের পথ দেখাবে, দেশের আত্মাকে জাগিয়ে তুলে তার দুঃখ-দুর্দশা দুর্বিপাকের চক্র থেকে আগল ভেঙে মুক্ত বাতাসে কে ছড়াবে স্বাধীনতার সৌরভ, নজরুলের অন্তর্জগৎ এসব ভাবনা-উদ্দীপ্ত থেকে সমাধান খুঁজেছে সর্বক্ষণ। কিন্তু সমসাময়িক নেতৃত্বের ওপর তাঁর ভরসা ছিল না। কারণ, নেতৃবৃন্দ সময়ের ক্ষুধার বিপরীতে যথেষ্ট পরিমাণ পলায়নপর ছিলেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দুটোই নিজেদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থে চালিত হচ্ছিল, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সাংস্কৃতিক মহারথীগণের আপসকামিতা, ন্যাকামি ও ভণ্ডামি যা প্রকারান্তরে অনাচার-অবিচারকেই প্ররোচিত করেছে। অবাস্তব উচ্ছ্বাস আর ভাববাদিতার চেয়ে তাঁর কাছে নগ্ন বাস্তবতার দাবি মেটানো ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভাবের আচ্ছাদনে মনুষ্যত্বকে গোপন করা তাঁর কাছে নির্মম নিষ্ঠুর পাশবিকতা। ভান-ভন্মির ফাঁকি থেকে মুক্ত হয়ে নিজের অন্তরের সত্যকে প্রকাশের অসংকোচ অভিলাষে তিনি নিগৃহীতও হয়েছেন বারংবার। সুনাম-দুর্নাম, লোভ-লালসা, ভীতি-বিড়ম্বনা কোনো কিছুই তাঁকে তাঁর উপলব্ধ সত্য থেকে টলাতে পারেনি। সত্যের সাধন ছিল নজরুলের চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং সকল দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিভূমি। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ তাঁর সত্যকে করে তুলেছে ক্ষুরধার এবং মিথ্যার কণ্ঠনালি বিচ্ছিন্ন করে ফেলার মতো শানিত। অন্তরের সত্যকে গোপন করেননি বলেই নজরুলকে কখনো কখনো দুর্বোধ্য মনে হয়। সত্য প্রকাশের তাগিদেই তিনি প্রবল পরাক্রমশালী ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারেন। দেশীয় মোল্লা-পুরুত, ধর্মীয় গোড়ামি, ভন্মি, জাত-পাতের অলীক কল্পকাহিনীকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সকল পক্ষের সাধারণ শত্রুতে পরিণত হওয়ার কথা দ্বিতীয়বার ভাবার প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। সত্য সাধনাই নজরুলের জীবনে এনেছে বিপুল বৈপরীত্য ও বৈচিত্র্যের সমারোহ। একমাত্র সত্যের কাছেই তিনি নত মস্তকে আত্মসমর্পণ করেন।

‘আমি যতটুকু বুঝতে পারি, তার বেশি বুঝবার ভান ক’রে যেন কারুর শ্রদ্ধা প্রশংসা পাবার লোভ না করি। তা সে মহাত্মা গান্ধীরই মত্ হোক আর মহাকবি রবীন্দ্রনাথেরই মত্ হোক কিংবা ঋষি অরবিন্দেরই মত্ হোক, আমি সত্যিকার প্রাণ থেকে যেটুকু সারা পাই রবীন্দ্র, অরবিন্দ বা গান্ধীর বাণীর আহ্বান ঠিক ততটুকু মানবো। তাঁদের বাণীর আহ্বান যদি আমার প্রাণে প্রতিধ্বনি না তোলে, তবে তাঁদের মানব না।’ (ধূমকেতু’র পথ)

তাঁর প্রাণে প্রতিধ্বনিত সত্যের অনুগমনে সকল বাধা বিষবহ্নি উদ্গার করে ঝলসে দিয়েছেন তিনি। সস্তা জনপ্রিয়তা কিংবা যাপনের কোনো প্রলোভন তাঁর কাছে অতি নগণ্য এবং ঘৃণার বিষয় । মিথ্যা মন্ত্রের পীড়ন-যন্ত্রণায় পিষ্ট হওয়া স্বজাতির প্রতি তাঁর ছিল আক্রোশপূর্ণ করুণা। জড়তা, অজ্ঞতা, অক্ষমতা ও আড়ষ্টতার ধাত্রী সব মিথ্যার গৃহেই বসবাস করে। সত্যের কোনো ভান-ভণ্ডামি নেই, সে সহজ খোলামেলা, যেখানে নির্মল হাওয়ার অবাধ চলাচল। নজরুল সত্য-সাধক, তাই তিনি কোনো অনাচার-অবিচার-অসংগতি দেখে চুপ মেরে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চাতুরী রপ্ত করেননি। পাহাড়ি ঝর্ণাধারার মতো তাঁর উচ্ছ্বাস সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত। কোথাও কোনো গোঁজামিল বা জোড়াতালির ব্যাপার নেই, বরং পুরো পৃথিবীই তাঁর কাছে নতশির, ভীত-কম্পমান, কারণ তিনি সত্যের মূর্ত প্রতীক; ঋজু-ধারালো-উদ্ধত আগুনের জ্বলন্ত শিখা।

‘আজ সাগর-ভূধর-সংসার-কানন-মরু দলিত-মথিত করে আসা চাই মহাপ্রলয়ের মহা আলোড়ন। ভারতের জীবনের অণু-পরমাণু আজ পচাগলা বিষবিষ্ঠার বাসা হয়েছে; আজ পরিপূর্ণ সৃষ্টির আয়োজনের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই আমূল ধ্বংসের প্রয়োজন হবে। এই সত্যযজ্ঞে সকল মিথ্যা অত্যাচারকে পুড়িয়ে ভষ্ম না করতে পারলে যজ্ঞ পূর্ণ হবে না।’ (প্রবন্ধ : আজ চাই কি)।

মিথ্যাকে ছাই-ভষ্মের মতো জ্বালিয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। ইতোপূর্বে আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল দুরকমের ব্রত। কিছু শাস্ত্রীয় ব্রত আর কিছু শাস্ত্র কথিত যোষিৎপ্রচলিত বা মেয়েলি ব্রত। কিন্তু নজরুল এসে সম্প্রদায়, স্বদেশ ও সত্য-সাধনের মাধ্যমে স্থাপন করলেন নতুন এক তপস্যা যাকে বলা যায় ‘নজরুল-ব্রত’। আমাদের লৌকিক ব্রতগুলো ধর্মীয় প্রসাধনে এমনভাবে আচ্ছাদিত করা হয়েছে যে তাদের আর কর্মের সাথে, উদ্দেশ্য সাধনের সাথে কোনো সংযোগই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন দশাবিপর্যয় ঘটতে ঘটতে বাঙালি তার কর্ম-ব্রতকে হারিয়ে ফেলেছে। নজরুল বাঙালির কর্ম-ব্রতের বাস্তব প্রতিভূ। নজরুলের সমকালেই গুরুসদয় দত্তের তদারকিতে তৈরি হয় ব্রতচারী আন্দোলন। ব্রতচারীতে নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম, শ্রেণি-বয়সের কোনো বিধিনিষেধ নেই, এর মূল লক্ষ্য আত্মিক ও শারীরিক উন্নতি। পাঁচটি ব্রতে দীক্ষিত হতে হতো ব্রতচারীদের চরিত্রগঠন ও দেশসেবায় আত্মোৎসর্গ করার জন্য, এই পঞ্চব্রত হলো জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য ও আনন্দ।প্রতিজ্ঞা করতে হতো ষোলটি, আমি বাংলাকে ভালোবাসি, আমি বাংলার সেবা করব, আমি ব্রতচারী হবো থেকে জ্ঞানের সীমা প্রসারণ পর্যন্ত। নজরুল-ব্রতকেও আমরা এভাবে চিহ্নিত করতে পারি। নজরুল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আপাদমস্তক একজন পরিপূর্ণ বাঙালি যার জীবনের প্রতিটি কর্মই সাধিত হয়েছে দেশ, জাতি, সত্যের প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। নজরুল-ব্রত বাঙালির সাধারণ সম্পত্তি। কোনো বিশেষ ধর্ম অথবা বিশেষ শ্রেণির একার নয়। স্বদেশপ্রেম, স্বজাতিপ্রীতি ও জাতীয়তাবোধ এগুলো মানবিক গুণ, সমস্যা হলো এসবের অপব্যবহারে। সব মানবিক বিষয়কেই অমানবিক করে তোলা যায় এবং তা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর মানসিকতার ওপর। আমদানীকৃত নতুন ডিসকোর্সে নতুন দিনের বিদ্বানগণ জাতীয়তাবাদে ফ্যাসিবাদের গন্ধ পাওয়ার উদগ্র বাসনায় বিবিধ বিসদৃশ বিলাপে বাঙালির কান ভারী করার তালে আছেন। মহা আখ্যানের পেটের ভেতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আখ্যানের দোহাই দিয়ে বাঙালি সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধার সৃষ্টি করছেন। অথচ এই ক্ষুদ্র আখ্যানগুলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আনন্দময় বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যকে ব্যাঙের দৃষ্টিতে দেখলে বড় বড় দেয়াল মনে হতে পারে। এসব স্বার্থবুদ্ধির একটা তাত্ত্বিক ঘেরাটোপ থাকে। বাইরের আবরণটুকু খসে গেলেই এমন নকল প্রতারণার ফাঁকি ধরা পড়ে যায়। সহৃদয় অন্তরে মানবকল্যাণই মর্মকথা, হিংসা-ভীতি-লোভের কারাগার থেকে মানুষ মুক্ত হয়ে যাবে। জাতীয়তার ভিত্তি হিসেবে ধর্মকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাঁয়তারায় উত্তরাধুনিক অ্যাপিস্টেমোলজিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন অনেকেই। এসব গোঁড়ামি কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে জীবন-ব্রতী নজরুল তাঁর সৃষ্টি, সংকল্প এবং চেতনাকে ব্যবহার করেছেন প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের মতো, সুতীব্র আক্রোশ ও নির্মম নিষ্ঠুরতায়। সম্প্রদায়, স্বদেশ ও সত্য সাধনে এই দৃঢ়চেতা মনোভঙ্গির যে স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণ তাকেই আমরা চিহ্নিত করতে চাই ‘নজরুল-ব্রত’ ।

তথ্যসূত্র :

১. Baudrillard, Jean, `Symbolic Exchange and Death’, From Modernism to Postmodernism : An Anthology, ed Lawrence Cahoone, Blackwell Publishers, 1996, p. 456.

২. সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বাঙালির ইতিহাস, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ-৫।

৩. কলিম খান, দিশা থেকে বিদিশায় নতুন সহস্রাব্দে প্রবেশ বার্তা, হাওয়া ঊনপঞ্চাশ প্রকাশনী, কলকাতা, ১৪০৬, পৃ-৩১।

৪. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ‘শহীদুল্লাহ স্মারক গ্রন্থ’ ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ-৩৯৩।

৫. আন্তেনিও গ্রামসি জীবন সংগ্রাম ও তত্ত্ব, খন্দকার সাখাওয়াত আলী সম্পাদিত, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ২০১১, পৃ-২৯৯।

৬. মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬, পৃ-১৬০।

৭. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার ব্রত, বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ : সংখ্যা ৪, কলকাতা, ১৪১৭, পৃ-৫।

৮. গুরুসদয় দত্ত, বাংলার লোকশিল্প ও লোকনৃত্য, ছাতিম বুকস্, কলকাতা, ২০০৮, ভূমিকা।

দ্রাবিড় সৈকত : সহকারী অধ্যাপক, চারুকলা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।