‘মাংসি’ মইনুল আলমের ম্রো-নৃগোষ্ঠীর দুর্লভ ছবির বই
‘মাংসি’ আলোকচিত্রী মইনুল আলমের ম্রো-নৃগোষ্ঠীর দুর্লভ একটি ছবির বই। বাংলাদেশে যেকজন আলোকচিত্রী প্রান্তিক জনজীবন নিয়ে নিভৃতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, মইনুল আলম তাঁদের একজন। ২০০১ সালে সমুদ্র উপকূলবর্তী দরিদ্র জেলেদের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের ছবি নিয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম আলোকচিত্রের বই ‘ছবিতে বাংলাদেশের জেলে জীবন ও জীবিকা’। বান্দরবানের ম্রো-নৃগোষ্ঠীর চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের উৎসব ‘চাংক্রান পই’য়ের সাদাকালো আলোকচিত্র নিয়ে ২০২১ সালে প্রকাশিত হয় ‘চাংক্রান পই’। সম্প্রতি প্রকাশিত হলো ম্রোদের নিয়েই নতুন আলোকচিত্রের বই ‘মাংসি’।
এতে বোঝা যায়, সমাজের নিম্নবর্গের জনজীবনই আলোকচিত্রী মইনুল আলমকে আকৃষ্ট করেছে গভীরভাবে। ‘মাংসি’ ২৩২ পৃষ্ঠার একটি দুর্লভ ছবির বই। এর সব ছবিই ৩৫ মিমি ফিল্মে তোলা। প্রায় ৭০০ বছর আগেকার দিনের ম্রোদের জীবনযাপন ও বান্দরবানের নিসর্গ চমৎকারভাবে বইটিতে ফুটে উঠেছে। ছবিগুলো রংবিন্যাসে যেমন চিত্তাকর্ষক, ধারণ কৌশলেও তেমনি বাঙ্ময়।
‘চাংক্রান পই’ উপলক্ষে প্রতিবছর মেলা বসে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার সাবেক বিলছড়ি মৌজায়, মাতামুহুরী নদীর তীরে। মইনুল আলম এই উৎসবকেন্দ্রিক মেলার প্রথম ছবি তোলেন ২০১৬ সালে। পরবর্তী বছর সেই ছবিগুলো বাছাই করে তিনি সাবেক বিলছড়িতেই চিত্রভাষায় ‘চাংক্রান পই’ নামে একটি একক চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করেন। ছবির মানুষগুলো নিজেদের বিচিত্র ভঙ্গিমা ও সাজপোশাকে টাঙানো ছবি দেখে, ছবিতে নিজেদের অন্যরকমভাবে ফিরে পেয়ে, অনির্বচনীয় আনন্দ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন তখন। ব্যতিক্রমী এমন চিত্রপ্রদর্শনী এর আগে বাংলাদেশে হয়েছে কি না জানা নেই। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা : বান্দরবান (২০১৪) বইয়ে ‘চাংক্রান পই’য়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকলেও সাবেক বিলছড়িতে অনুষ্ঠিত ম্রোদের প্রাচীন মেলাটির কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
দুইশতাধিক রঙিন আলোকচিত্রে শোভিত মাংসিতে ম্রোদের নিত্যদিনের জীবনচর্চা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজগোজ, দূরের পথে দল বেঁধে হেঁটে বা নৌকায় হাটে যাওয়া, মাতামহুরীর তীরে সামান্য ভাতমাছ রান্না করে খাওয়া-দাওয়া, ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, উৎসব—নানা শ্রেণি ও বিষয়ের ছবি ধারাবাহিকভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে পাতায়-পাতায়। শান্তস্বভাব ম্রো-জনগোষ্ঠীর অনাড়ম্বর জীবনযাপন মইনুল আলমের মনে যে স্থায়ী রেখাপাত করেছে, পরপর প্রকাশিত তাঁর দুটি ম্রো-কেন্দ্রিক আলোকচিত্রের বই সে কথাই প্রমাণ করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর করা মইনুল আলমের আলোকচিত্রজগতে আবির্ভাব ঘটে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। মাংসির ভূমিকায় জানা যায়, বরেণ্য আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন (১৯৪৮-২০১৮) ফ্রান্সযাত্রার আগে তাঁর নিক্কন এফ৩এক্স ক্যামেরাটি মইনুল আলমের কাছে বিক্রি করে যান। এই পুরোনো ৩৫ মিলিমিটার ফিল্ম ক্যামেরা নিয়েই মইনুল আলমের আলোকচিত্রাভিযানের শুরু। যদিও ছবি তোলার প্রথম প্রেরণা পেয়েছেন কৈশোরেই, তাঁর বাবা খ্যাতিমান চিকিৎসক ও অভিনেতা এ বি এম নুরল আলমের (১৯২৫-২০০৩) কাছে। চট্টগ্রামের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হীরামনে (১৯৬৭) এ বি এম নুরল আলম বিশিষ্ট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নিয়মিত মঞ্চনাটকে অভিনয় ও নাট্যনির্দেশনার পাশাপাশি তাঁর ছিল ছবি তোলার শখ। ষাট-সত্তরের দশকের চট্টগ্রাম শহর, রাঙামাটি ও কক্সবাজারের পথঘাট, চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) আগমন এবং আন্দোলনকামী জনতা ও বিভিন্ন জনসভার ছবি তুলেছেন সাদাকালো ফিল্মে। তাঁর নিজস্ব ফিল্ম ক্যামেরায়।
মাংসির ছবিগুলোতে বিশেষভাবে চোখে পড়বে সরল শিশুদের মুখ। গাঁয়ের ধুলোমাখা পথে লুঙ্গি-শার্ট পরা তিনটি শিশু স্কুলে যাচ্ছে—পিতলের ঘণ্টাও ঝুলছে একজনের হাতে। বাবার হাত ধরে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে এক অবুঝ শিশু। শিশুটির ব্যাকুল একজোড়া চোখ মুহূর্তেই মন কেড়ে নেয়। চিত্রশিল্পী মইনুল আলম সেসব ছবি এঁকেছেন ক্যামেরার ক্যানভাসে—শুধু মাধ্যমের বদল ঘটেছে, অন্তর্দৃষ্টির নয়।
ম্রো-ভাষায় ‘মাংসি’ মানে সবুজ রং। উৎসবের আগে ম্রো ছেলেমেয়েরা কাপড়ে লাল রং (রাংসি) ও সবুজ রং (মাংসি) লাগায়। পুরোনো দা-কে জলে ভিজিয়ে তার উপর কচি বাঁশে আগুনের ছ্যাঁক দিলে কালচে তরল তৈরি হয়। গরম অবস্থায় সেই তরল আঙুলে তুলে নিয়ে দাঁতে লাগান ম্রোরা। বিশেষ-উপায়ে-তৈরি এই প্রাকৃতিক রঙের নাম ‘চুলি’। রং লাগানোর পর এক সপ্তাহ টক-জাতীয় কিছু খাওয়া যাবে না। এতে দাঁত ভালো থাকে বলে মনে করেন ম্রোরা। ছেলেরা লম্বা চুল রাখে, চুড়ো করে খোঁপা বাঁধে, খোঁপায় চিরুনিও (‘সিরুট’) গুঁজে রাখে, যেমন রাখে মেয়েরা। মেয়েরা খোঁপা বাঁধে মাথার পিছনের দিকে আর ছেলেরা মাথার সামনের দিকে বা বামদিকে খানিকটা হেলিয়ে দিয়ে, তবে খোঁপায় ফুল গুঁজে রাখে অবিবাহিত তরুণরাই।
ম্রো পুরুষদের চেনা যায় মাথার সাদা বা ধূসর পাগড়ি ‘লাপং’ দেখে। মহিলারা কানের লতির ফুটোয় রুপোর দুলের ‘রাম সেং’ সঙ্গে বিভিন্ন ফুল ও ভেষজ লতাগুল্ম গুঁজে রাখেন। আজকাল অবশ্য ছেলেদের লম্বা চুল বা খোঁপা দেখা যায় না; তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের রংবাহারি সাজপোশাকে। হাটের রাস্তায় দাঁড়িয়ে একমনে ‘প্লুং’ বা বাঁশি বাজাচ্ছে—এমন কোনো আত্মমগ্ন কিশোরের দেখাও আর পাওয়া যাবে না সহজে।
মাংসির শুরুতেই আছে বান্দরবানের দীর্ঘ সর্পিল পথরেখা। হাতছানি-দেওয়া ধূলিধূসর এই পথরেখাও আর পাওয়া যাবে না। এখন বেশিরভাগ পথঘাট পিচঢালা অথবা ইটবিছানো। ছন ও বাঁশের বেড়ার ঘরের ছন সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে টিনের চাল, কোথাও বা উঠে গেছে ইটের দালান। ম্রো ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে স্কুল-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়েও। তারা নিজেরাই এখন নিজেদের ছবি তুলছে দামি স্মার্টফোনে। এ সবই ইতিবাচক পরিবর্তন, সন্দেহ নেই। এর নেপথ্যে আছে নিশ্চয়ই আর্থিক সচ্ছলতা, দোরগোড়ায়-আসা প্রযুক্তির নানা উপাচার। অবশ্য ধর্মান্তরও আরেকটি বড় কারণ। মারমাদের মতো ম্রোরা বৌদ্ধধর্মানুসারী হলেও ম্রোরা মূলত ছিল প্রকৃতিপূজারি ও সর্বপ্রাণবাদী। এখন অনেকেই ক্রামাধর্ম ও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত, কেউ-কেউ সনাতন রীতিতেই বিশ্বাসী। ১৯৮৫-৮৬ সালে ম্রো-জনগোষ্ঠীর কৃতী সাধক মেনলে ম্রো ম্রো-বর্ণমালা ও ক্রামাধর্ম আবিষ্কার করেন। এরপর থেকে ক্রামাধর্মাবলম্বী ম্রোরা গোহত্যা-উৎসব (চিয়াসদ পই) পরিত্যাগ করেছে। কারণ মেনলে ম্রোর মতে, যে ধর্মগ্রন্থ খেয়ে ফেলার অপরাধে এই নির্মম গোবধ-উৎসবের সূচনা, তা এখন অনাবশ্যক। ম্রোরা পেয়ে গেছে তাদের ক্রামাধর্ম।
এ রকম আরও বহু আচার-বিশ্বাসের রদবদল ঘটেছে। কিছু বিবরণ পাওয়া যাবে ইয়াংঙান ম্রোর লেখা ‘ক্রামাধর্মের উৎপত্তি ও ম্রো সমাজ’ বইয়ে।
তাহলে কেন আর দেখতে হবে পুরোনো দিনের ফিল্মে-তোলা ছবি, বিশেষত এই ডিজিটাল ক্যামেরার যুগে? হ্যা দেখতে হবে ইতিহাসচেতনা ও সৌন্দর্যবোধের টানে। বান্দরবানের এক প্রাচীন জুমনির্ভর জনগোষ্ঠীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনবাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ঔৎসুক্য মেটাতে পারে হারিয়ে-যাওয়া দিনের এই রঙিন চিত্রমালা। এখানেই হয়তো মাংসির চিরন্তন আবেদন, বা সমকাল-প্রাসঙ্গিকতা।