আওয়ামী লীগ নতুন প্রজন্মকে ভ্রান্ত ইতিহাস জানাচ্ছে : মির্জা ফখরুল

Looks like you've blocked notifications!
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আজ রোববার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন। ছবি : এনটিভি

আওয়ামী লীগ সুপরিকল্পিতভাবে নতুন প্রজন্মকে ভ্রান্ত ইতিহাস জানাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাসের বদলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, দলীয় ধারণা জাতির ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

আজ রোববার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রথমবারের মতো ৭ মার্চ নিয়ে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় এমন মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের দিন উপলক্ষে আজ প্রথমবারের মতো আলোচনা সভার আয়োজন করে বিএনপি। দলটির স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটির উদ্যোগে এই আয়োজন করা হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের সব মাইফলক ও সত্য ইতিহাস দেশবাসীকে জানাতেই ৭ মার্চ নিয়েও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান বিএনপির নেতারা।

আর দলের মহাসচিবের বক্তব্যে উঠে আসে বর্তমান সময়ের রাজনীতির নানান প্রেক্ষাপট। এ সময় দেশে গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার নেই দাবি করে তা পুনরুদ্ধার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলেরও দাবি জানান তিনি।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এদেশের মানুষ পাকিস্তানিদের যে বৈষম্যমূলক চিন্তাভাবনা, তাদের যে পজিশন, বাংলাদেশের মানুষকে অভাবি করবার সম্পূর্ণভাবে যে উদ্যোগ তার বিরুদ্ধে এই দেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল। সবই আমাদের ছাত্ররা করে গেছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এভাবে প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি সময়ে এই দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা, তরুণরা, যুবকরা তাদের দেশের স্বাধীনতাকে আনার জন্যে, তাদের অধিকারকে রক্ষা করার জন্যে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নির্মাণ করার জন্যে তারা লড়াই করেছে, যুদ্ধ করেছে, বুকের তাজা রক্ত দিয়ে দিয়েছে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, আওয়ামী লীগ কী করেছে? আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই নতুন প্রজন্মকে সেই ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করে তাদের ভ্রান্ত ইতিহাস দিচ্ছে। একটা ধারণা দিচ্ছে যে, একটি মাত্র দল, একজনই মাত্র ব্যক্তি আর একটি গোষ্ঠী যারা এদেশের সব কিছু এনে দিয়েছে। সব স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, উন্নয়ন এনে দিয়েছে, এখানে মানুষের অধিকারগুলো এনে দিয়েছে। মিথ্যা ইতিহাস দিয়ে তারা প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা সেই ধারণা, সেই সত্যটা তুলে ধরতে চাই। আমরা তুলে ধরতে চাই এদেশের স্বাধীনতার জন্য কখন কবে থেকে কারা কারা প্রাণ দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, সংগঠিত করেছে, সংগ্রাম করেছে। একটা কথা দেখবেন, তাদের বক্তব্যের কোথাও.. এই তোফায়েল আহমেদের কথা খুঁজে পাবেন না। পাবেন না তারা যখন বক্তব্য দেয় তোফায়েল আহমেদের কথা। তারা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাম একবারও উচ্চারণ করে না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আজ রোববার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন। ছবি : এনটিভি

বিএনপির মহাসচিব বলেন, মুক্তিযুদ্ধের যে প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী ছিলেন তাঁর নাম একবারও উচ্চারণ করে না। এমনকি যুদ্ধের সময়ে যে প্রবাসী সরকার, যিনি নেতৃত্ব দিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ, তাঁর নাম একবারও উচ্চারণ করে না। এতো সংকীর্ণ এঁরা। কত ভয়ংকর যে, শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, নিজেকে মহিমান্বিত করার জন্য, একজন মানুষকে মহিমান্বিত করার জন্য, একটি পরিবারকে মহিমান্বিত করার জন্য তারা শুধু মিথ্যা ইতিহাস এদেশের মানুষকে চাপিয়ে দিতে চায়।

মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের উচ্চারণ করা প্রয়োজন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের কথা, উচ্চারণ করা প্রয়োজন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কথা, উচ্চারণ করা প্রয়োজন শেখ মুজিবুর রহমানের কথা, উচ্চারণ করা প্রয়োজন অলি আহাদের সাহেবের কথা। এরকম অসংখ্য মানুষ আছেন যারা এদেশের মানুষের পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করেছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, কেনো আজকে লেখক মুশতাক আহমেদকে জেলের মধ্যে মারা যেতে হয় বিনা চিকিৎসায়? কেনো আজকে কাটুনিস্ট কিশোরের ৬৯ ঘণ্টা কোনো খবর থাকে না? নির্মম নির্যাতন করা হয়। একটা দুইটা কেইস। আর আমাদের ছেলেরা যারা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে, লড়াই করতে গিয়ে তাদেরকে প্রাণ হারাতে হয়, তুলে নেওয়া হয়, গুম করা হয়….? কিশোর কি অপরাধ করেছিল? একটা কার্টুন এঁকেছিল। সেই কার্টুন হচ্ছে একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে একটা কার্টুন। তাহলে কি আমরা ধরে নেব ওই ব্যবসায়ীর সব কুকর্মের সঙ্গে আপনাদের সংযোগ আছে। তাহলে কেন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এভাবে মানুষকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করছে।

‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কেন তৈরি করছেন? এখনো বড় গলায় বলছেন এটা বাতিল হবে না, এটা প্রয়োজনে দেওয়া রয়েছে। কার প্রয়োজনে দিয়েছেন? আপনার নিজের প্রয়োজনে এই আইন করেছেন, আপনার দলকে রক্ষা করার প্রয়োজনে দিয়েছেন, আপনাদের অন্যায়-নির্যাতন, বেআইনি শাসনকে রক্ষা করার জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করেছেন।’ যোগ করেন মির্জা ফখরুল।

সভাপতির বক্তব্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটির আহ্বান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা কাউকে ছোট না বা কাউকে বড় করা বা ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য এখানে আলোচনা করতে আসিনি। আমরা জনগণের কাছে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্য এই আলোচনা অনুষ্ঠান করছি। ৭ মার্চ মানুষ আশা করেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা আসবে। আমি তখন উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে ছিলাম। লন্ডনে থেকে আমরা ছাত্ররা বাংলাদেশের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ নাম দিয়ে একটি সংগঠন করেছিলাম, যার আহ্বায়ক ছিলাম আমি। আমরাও মনে করেছি ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা হবে। তখন আমরা লন্ডনে আওয়ামী লীগ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন… যৌথভাবে হাইপার্স পিকারস কর্নারে সমাবেশ ডেকেছিলাম। সেই সমাবেশে আমরা কিন্তু স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন ও স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলাম। কারণ তখন এ রকমের মোবাইলের যুগ ছিল না। স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ দেশ-বিদেশে যে প্রত্যাশা করেছিল, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় নাই।

সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, যখন ওই সময় নির্বাচিত সংসদ ডেকে স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে, তখন সারা দেশে পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে গিয়েছিল। কেননা এটা গণতান্ত্রিক অধিকার, পাকিস্তানের সাংবিধানিক অধিকার যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। পাকিস্তানের জান্তা তারা নানা রকমের টালবাহানা করছিল। এমনি প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চের ভাষণ অবশ্যই ঐতিহাসিক এবং জনগণকে উদ্দিপ্ত করার জন্য, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কিছু নির্দেশনা ছিল। আমরা ইতিহাসকে অবজ্ঞা করতে চাই না, আমরা ইতিহাসকে মুছে দিতে চাই না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ৭ মার্চ পালনের কথা শুনে আওয়ামী লীগের গাত্রদাহ হয়েছে। কী আছে ৭ মার্চের ভাষণে? ৫০ বছরের ইতিহাসে ছোট একটা অংশ এই ৭ মার্চ। আল্লাহর রহমত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের কোনো পুঁজি নাই। ওই একটা পুঁজি তাদের ৭ মার্চের ভাষণ।

মির্জা আব্বাস বলেন, ৭ মার্চের ভাষণটা যখন হয়, আমি আমার এলাকার লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চের বাঁ দিকে বাঁশের বেরিকেডের সামনে উপস্থিত ছিলাম। ৭ মার্চ আমরা কী আশা করেছিলাম? বাঁশ নিয়ে গেছি, লাঠি নিয়ে গেছি… একটা ঘোষণা আসবে। কিন্তু না, কোনো ঘোষণা আসেনি। যদি কেউ বলেন, কোনো এক মেজরের ঘোষণায় এদেশ স্বাধীন হয় নাই, আমরাও বলতে পারি, ৭ মার্চের কারণে দেশ স্বাধীন হয় নাই। আমরা কাউকে ছোট করার জন্য কিছু বলতে চাই না। আমরা মনে করি, মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ জিয়াউর রহমানের অবস্থান ইতিহাস নির্ধারণ করে দেবে। আপনাদের বানানো ইতিহাস দিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমানসহ অন্যদের নাম মুছে ফেলতে পারবেন না।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী ক‌মি‌টির সদস‌্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বেগম সে‌লিমা রহমান প্রমুখ।