আজ মানিকগঞ্জ হানাদারমুক্ত দিবস

Looks like you've blocked notifications!
মানিকগঞ্জে ১৯৭১ সালে শহীদ হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। ছবি : এনটিভি

আজ ১৩ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে মানিকগঞ্জ জেলা (তৎকালীন মহকুমা) পাক বা‌হিনীমুক্ত হয়। হানাদারমুক্ত দিবসকে ঘিরে জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন দলীয় সংগঠন নানান কর্মসূচি পালন করবে বলে জানা গেছে।

আজ থেকে ঠিক ৫১ বছর আগে এইদিনে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পিছু হটে যায় মহকুমা শহরে অবস্থান নেওয়া হানাদার বাহিনী। ‌সে সময় পাক বাহিনী ঘাঁটি ব‌সি‌য়ে‌ছিল মানিকগঞ্জের সিঅ্যান্ডবির ডাকবাংলো‌তে। এখান থেকেই ‌জেলার বি‌ভিন্ন এলাকায় রাজাকারদের নিয়ে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করতো পাক বা‌হিনী।

পাক বাহিনীর মূল ব্যারাক ছিল মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন পিটিআই ভবনে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে মানিকগঞ্জের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য ঐদিনই মানিকগঞ্জে অ্যাডভোকেট খোন্দকার চাঁন মিয়াকে চেয়ারম্যান করে প্রয়াত মো. মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া, প্রয়াত ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী, প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী, মীর আবুল খায়ের ঘটু ও মফিজুল ইসলাম খান কামালকে নিয়ে সাত সদস্যবিশিষ্ট এক‌টি কমিটি গঠন করা হয়। 

বিপ্লবী কমান্ডের সিদ্ধান্তে মানিকগঞ্জ ট্রেজারিতে রক্ষিত অস্ত্র-গোলাবারুদ ও ক্যাপ্টেন আবদুল হালিমের লাইসেন্স করা বন্দুক-পিস্তল মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার করা শুরু হয়। জেলা কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যরা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য শপথ গ্রহণ করেন। এছাড়াও ভারতের কল্যাণীতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন কয়েকটি তরুণ দল।

মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আরিচা ফেরিঘাট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু, ১ এপ্রিল হেলিকপ্টারে করে সেনা নামিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দখল করে নেয় পাক বা‌হিনী। ঐদিনের মধ্যেই মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। জুলাই মাসে রাজাকার, আল-বদর ও শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকাররা মা‌নিকগঞ্জবা‌সী‌দের হত্যা, ধর্ষণ ও ধংসযজ্ঞে সহায়তা করতে থাকে পাকবাহিনীদের। ভারত থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রতিরোধ শুরু করেন। 

পাকবাহিনী, আল-বদর, আল-শামস, রাজাকারদের আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে মানিকগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধারা দুটি সেক্টরে কা‌জ করেন। অক্টোবরের আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সব কাজই অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে চলে। ১৭ জুলাই ঘিওর থানা আক্রমণ করে পাক সেনাদের আহত করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নি‌জে‌দের দখ‌লে আনে মুক্তিযোদ্ধারা। ১৮ আগস্ট হরিরামপুর থানায় প্রবেশ করলে মুক্তিবাহিনীর গর্জ‌নে পিছু হটে পাক বাহিনী।

এরপর ১৩ অক্টোবর সিও কার্যালয়ে সংরক্ষিত পাকবাহিনী ক্যাম্প দখলের জন্য মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করলে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। এ সময় পাকবাহিনীর পাঁচ সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ অবলম্বন করে। তখন পাকবাহিনীর ৭০টি রাইফেল, তিনটি এলএমজি ও সাত বক্স গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের দখ‌লে আসে। পাকবাহিনী ক্যাম্প দখলের পর সেখানকার ওয়্যারলেস কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়ার সময় আগুনে পুড়ে মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান শহীদ হন ও মুক্তিযোদ্ধা পানু মোল্লা আহত হন। পরবর্তীতে ৫ অক্টোবর সিংগাইর থানার বায়রা নামক স্থানে ধলেশ্বরী নদীর উত্তর পাড় থেকে নৌকায় চলাচলকারী পাকবাহিনীর ওপর ব্রাশফায়ার করলে ১৫ পাকসেনা নিহত হয়।

মানিকগঞ্জে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ বলে খ্যাত সিংগাইরের গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধ। এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন তোবারক হোসেন লুডু। ১৯৭১ সালের ১৯ অক্টোবর শুক্রবার। সেদিন গোলাইডাঙ্গা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প দখলের জন্য তিন শতাধিক পাকবাহিনী ১০ থে‌কে ১২টি নৌকায় সেখানে আসে। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে দ্বিমুখী আক্রমণে একজন কর্নেলসহ ৮১ পাক সেনা মারা যায় । এছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে শহীদ হন ৯জন। ১৪ অক্টোবর বালিরটেক ও ১৫ অক্টোবর সুতালড়িতে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়। বালিরটেক যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

২২ নভেম্বর পাক হানাদার বাহিনী গভীর রা‌তে তেরশ্রী, সেনপাড়া, বড়রিয়া এবং বড়বিলা গ্রামের ঘুমন্ত মানুষের ওপর নারকীয় তাণ্ডব চালায়। নির্বিচারে গুলি, বেয়নেট চার্জ ও বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে তেরশ্রী জমিদার সিদ্ধেশ্বর প্রসাদ রায় চৌধুরী এবং অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানসহ ৪৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।

১০ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার মিরপুর গ্রামে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইসমাইল উদ্দিন মোল্লার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পাকিস্তানী বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায়। এতে মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা প্রতিরোধ করলে প্রায় দুই ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আলম গুলিতে আহত হন। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী এলাকার কোকারাম মণ্ডলকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং পুড়িয়ে দেয় গ্রামটির প্রায় অর্ধশত বাড়ি।

এরপর ১২ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীরা অবস্থান নেয় মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্যাম্পে। হঠাৎ করেই দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর হায়দার ক্যাম্পে এসে উপস্থিত হন। খবর আসে দক্ষিণাঞ্চল থেকে একটি বিশাল পাক হানাদার বাহিনী মানিকগঞ্জ দিয়ে ঢাকার অভিমুখে (বর্তমান ঢাকা আরিচা মহাসড়ক ধরে) যাত্রা করছে। সে সময় মুক্তিবাহিনী মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন মানোরা নামক এলাকায় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর পরই মানিকগঞ্জের বিজয় নিশ্চিত হয় এবং পুরো শহর আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে ।

১৩ ডিসেম্বর বিজয়ী বেশে মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে সমবেত হন। সেদিন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মাজহারুল হক চাঁন মিয়ার সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমাবেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেই থেকেই মানিকগঞ্জ জেলাবাসী (মানিকগঞ্জ মহকুমা) আজকের এই দিনটিকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নানান বাঙালি ঐতিহ্যের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালন করে আসছেন।