‘আলহামদুলিল্লাহ, ভাসানচরের সুযোগ-সুবিধায় সন্তুষ্ট’, এক রোহিঙ্গার অনুভূতি

Looks like you've blocked notifications!
আজ শুক্রবার প্রথম পর্যায়ে এক হাজার ৬০০-এরও বেশি আগ্রহী রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। ছবি :: ফোকাস বাংলা

রোহিঙ্গাদের একজন সৈয়দ উল্লাহ আজ শুক্রবার ভাসানচরে পৌঁছে সেখানকার সব সুযোগ-সুবিধাগুলো দেখে খুব খুশি হয়েছেন। তিনি পরবর্তী সময়ের যাত্রায় ভাসানচরে আসার জন্য কক্সবাজার ক্যাম্পে থাকা তাঁর স্বজনদের উৎসাহিত করেছেন।

সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আমরা অত্যন্ত খুশি। আমি কখনই ভাবিনি যে এত সুন্দর জায়গাটি, এত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’ তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবসহ বেশ কয়েকজনকে ফোন করেছেন যারা এখনো কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করছেন। তিনি কোনো দ্বিধা ছাড়াই ভাসানচরের দ্বিতীয় দলের যাত্রায় যোগ দিতে উত্সাহিত করেন তাদের।

সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘আমি তাদের কল করেছি। ভাসানচরে আসার পরে এটিই আমি প্রথম করলাম।’ ৩০ বছর বয়সী সৈয়দ উল্লাহ স্ত্রী, তিন মেয়ে ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বিকেলে ভাসানচরে পৌঁছেন। তিনি বলেন, ‘কেউ আমাদের এখানে আসতে বাধ্য করেনি। আমি স্বেচ্ছায় এখানে এসেছি। এখানকার সুযোগগুলো দেখার পরে সবাই এখানে আসতে রাজি হবে।’

‘আমরা এখন আরো বেশি খুশি। সবাই এখানকার সুযোগ-সুবিধা দেখে অনেক খুশি। আমরা যা ভেবেছি তার থেকে বেশি পেয়ে আমরা আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি,’ বলেন সৈয়দ উল্লাহ। তাঁর ভাই-বোনেরা এখনো কক্সবাজারে রয়েছেন, যদিও ভাসানচরে তার সঙ্গে দূর সম্পর্কের স্বজনরাও রয়েছেন।

চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে করে ভাসানচরে যাচ্ছে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা। ছবি : সংগৃহীত

সৈয়দ উল্লাহ কক্সবাজারের তুলনায় মসজিদ, আবাসন সুবিধাসমূহ এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।

কক্সবাজারের জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ এবং ভূমিধসসহ যেকোনো ঝুঁকি এড়াতে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর অপরিহার্য হয়ে উঠেছে বলে উল্লেখ করেছে সরকার।

ক্যাম্পগুলোতে নানান ঝুঁকি এড়াতে বাংলাদেশ সরকার পর্যায়ক্রমে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার প্রথম পর্যায়ে এক হাজার ৬০০ এর বেশি আগ্রহী রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের বাসে করে চট্টগ্রামে আনা হয় এবং রাতে একটি স্কুলে রাখা হয়েছিল। সকালে তারা ভাসানচরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। প্রথম দলটি বিকেল ৩টার দিকে ভাসানচরে পৌঁছে।

আজ শুক্রবার প্রথম পর্যায়ে এক হাজার ৬০০-এরও বেশি আগ্রহী রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। ছবি :: ফোকাস বাংলা

একজন রোহিঙ্গা নারী জনাকীর্ণ ক্যাম্প থেকে তাদের স্থানান্তরিত হওয়ার বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা ভাসানচরে যাচ্ছি। কেউই আমাকে বা আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের জোর করেনি।’

কেন স্থানান্তর?

সরকার জানায়, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে প্রতিবছর হাজার হাজার শিশু জন্ম নেওয়ায় রোহিঙ্গাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

কক্সবাজারের এই হতাশাগ্রস্ত লোকদের দীর্ঘাদিন থাকার কারণে তাদের নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য সরকার জরুরিভাবে ভাসানচরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা নেয়।

সূত্র অনুযায়ী, দ্বীপটির উন্নয়নে সরকার ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ১৩ হাজার একর ভাসানচর দ্বীপে বছরব্যাপী মিঠা পানি, চমৎকার হ্রদ ও যথাযথ অবকাঠামো ও আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

আজ শুক্রবার প্রথম পর্যায়ে এক হাজার ৬০০-এরও বেশি আগ্রহী রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। ছবি :: ফোকাস বাংলা

এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ, কৃষি জমি, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, দুটি হাসপাতাল, চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ, গুদাম, টেলিযোগাযোগ পরিষেবা, থানা, বিনোদন ও শিক্ষাকেন্দ্র, খেলার মাঠ ইত্যাদি রয়েছে।

এটি কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর অস্থায়ী কাঠামোগুলোর মতো নয়, ভাসানচরের আবাসনটি কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করা যা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও অক্ষত থাকবে। সুপার ঘূর্ণিঝড় আম্পানেও ভাসানচরে দ্বীপটি সুরক্ষিত ছিল।

দ্বীপ সম্পর্কে কিছু মহলের আশঙ্কার বিপরীতে ভাসানচর বিশাল ঝড়ের মধ্যেও সুরক্ষিত ছিল বলে সরকার জানায়। জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা সত্ত্বেও দ্বীপের এক হাজার ৪৪০টি ঘর এবং ১২০টি আশ্রয়কেন্দ্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। দ্বীপটি নৌপথ দিয়ে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত।

রোহিঙ্গাদের জন্য সুবিধা

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য উপযুক্ত স্যানিটেশন এবং চিকিত্সা সুবিধার পাশাপাশি পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করেছে।

আজ শুক্রবার প্রথম পর্যায়ে এক হাজার ৬০০-এরও বেশি আগ্রহী রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। ছবি :: ফোকাস বাংলা

এতে উপযুক্ত হাসপাতাল, পর্যাপ্ত কোভিড টেস্টিং এবং চিকিত্সার সুবিধা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। সরকারি সংস্থা ছাড়াও স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের জন্য সম্ভাব্য সকল সহায়তার জন্য প্রায় ২২টি এনজিও রয়েছে।

নারী পুলিশসহ পুলিশ সদস্য মোতায়েনের সঙ্গে দ্বীপে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং এলাকাটি পুরোপুরি সিসিটিভি ক্যামেরার আওয়তায় রয়েছে। তাদের স্থানান্তরের বিষয়ে সরকারের অবস্থান প্রথম থেকেই খুব স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। যারা আগ্রহী তাদেরকেই সেখানে স্থানান্তর করা হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ভাসানচরের সুবিধাগুলো দেখতে গিয়েছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি এনজিও ও সাংবাদিকরাও দ্বীপটি পরিদর্শন করেছেন। সবাই ভাসানচরে সুবিধাগুলো নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়।

একটি মিডিয়া টিম ও সিনিয়র সাংবাদিকদের একটি দল এরই মধ্যে ভাসানচরে রয়েছে। এ ছাড়া স্থানান্তরের আগে বিভিন্ন অংশীজনদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল বলে শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলা হয়।

আজ শুক্রবার প্রথম পর্যায়ে এক হাজার ৬০০-এরও বেশি আগ্রহী রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। ছবি :: ফোকাস বাংলা

জাতিসংঘের উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার ব্যবস্থা করা হয় জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা আশা করি যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘ খুব শিগগিরই এই প্রক্রিয়াতে যুক্ত হবে।’

‘আমরা এই নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়ার জন্য একটি আধুনিক দ্বীপ তৈরি করে বিশ্বে মানবতার আরেকটি অনন্য নজির স্থাপন করেছি,’ উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।

এর আগে, মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থার অভাবের কারণে ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের আগস্টে দুবার প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর প্রত্যাবাসন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার ২০১৮ সালের ১৬ জানুায়ারি ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ সম্পর্কিত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যা রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়েছিল।

কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।