নাসিরউদ্দিনের রিমান্ড শুনানিতে আইনজীবী

আসামি এলিট শ্রেণিভুক্ত, রিমান্ডে নেওয়ার কিছু নেই

Looks like you've blocked notifications!

মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যবসায়ী নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমির সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এ ছাড়া অপর তিন আসামির তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। আজ মঙ্গলবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিভানা খায়ের জেসি এই আদেশ দেন।

এর আগে আজ বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আসামি পাঁচজনকে একটি মাইক্রোবাসে হাজির করে পুলিশ। এর পরে তাঁদের আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। বিকেল ৪টায় কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় তাঁদের ঢাকার সিএমএম আদালতের নবম তলায় অবস্থিত ২৪ নম্বর আদালতের এজলাসে হাজির করে পুলিশ।

আসামিদের হাজির করার পর বিচারক এজলাস গ্রহণ করলে আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) মাহমুদুল রহমান রিমান্ড শুনানির পক্ষে শুনানি করেন। তিনি বলেন, আসামিদের কাছ থেকে চারটি মদের বোতল, এক হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এই সব মাদকের উৎস কোথায় এবং আসামিদের কাছ থেকে বাকি মাদকগুলো উদ্ধার করার জন্য রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। 

এর পরে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু শুনানিতে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আজকের মামলাটি মাদকদ্রব্য আইনে দায়ের করা। ঘটনার সূত্রপাত নায়িকা পরী মণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা থেকে। এ মামলায় পরী মণি সাভার থানায় মামলা দায়ের করেন। ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার করে। এর পরে পুলিশ তাঁদের খোঁজ পায়, আসামিরা উত্তরার একটি বাসায় আছে। সেখান থেকে নাসির উদ্দিনসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।’

রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘আজকের আসামিরা বাড়ির মালিক না। সেখানে গিয়ে তারা আমোদ-ফূর্তি করে, যা ঘৃণিত কাজ। সেখান থেকে মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। এ ধরনের ভদ্র মুখোশধারী লোকজন সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা বিভিন্ন লোকদের প্রলোভন দেখিয়ে এবং অভিনয় করে নিকৃষ্ট কাজে সম্পৃক্ত করছে। এ কাজে আর কারা কারা জড়িত এবং কারা মাদক সরবরাহ করে, তাদের চিহ্নিত করতে রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করছি।’

এরপরে নাসির উদ্দিনের পক্ষে ঢাকা বারের সভাপতি আব্দুল বাতেন, সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মোহাম্মদ হযরত আলী, এ এইচ এম রুহুল কাউসার রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন।

শুনানিতে এ এইচ এম রুহুল কাউসার বলেন, ‘মাননীয় আদালত এখানে মামলায় বলা হয়েছে চার বোতল বিদেশি মদ, সোডা, ইয়াবা এবং খালি মদের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। আমি তো এই বাড়ির কোনো কিছু না। আমাকে ধরা হয়েছে মিরপুর থেকে। মিথ্যা মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, মামলায় যে খালি বোতলের কথা বলা হয়েছে, এ রকম খালি মদের বোতল সবার বাসায় আছে।

এই বক্তব্যের পরেই আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও সাধারণ আইনজীবীরা প্রতিবাদ করেন। এরপরে এ এইচ এম রুহুল কাউসার আবার শুনানি চালিয়ে যান। তিনি বলেন, নাসিরউদ্দিন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি সরকারকে নিয়মিত ট্যাক্স পরিশোধ করেন। তাঁর কাছ থেকে যে উদ্ধার করা হয়েছে, তা মিথ্যা। তিনি বয়স্ক ব্যক্তি ও এলিট শ্রেণিভুক্ত। তাঁকে রিমান্ডে নেওয়ার কিছু নেই। আমরা আজ তাঁর জামিনের আবেদন করছি। তিনি পলাতক হবেন না। 

অপর আইনজীবী ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হযরত আলী বলেন, ‘মাননীয় আদালত, ঘটনা গত ৮ জুন।  সাভার থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে ছয় দিন পর। সেই মামলা থেকে এই মামলা এসেছে। দেখা যাচ্ছে, মাদক উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে।  কিন্তু নাসিরউদ্দিন ওই বাসায় ছিলেন না। তাঁকে মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করে এ বাসায় নিয়ে এসেছে। ওই বাসা কার তা তার দেখার বিষয় না। পরী মণির ওই ঘটনা না ঘটলে খালি বোতল, সোডার বোতল উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হতো না। তাঁদের বিরুদ্ধে এর আগে কোনো ধরনের মামলা হয়নি। এ মামলাটি পরিকল্পিত। রিমান্ডে নেওয়ার যুক্তি নেই।’

আইনজীবী হযরত আলী বলেন, প্রথম যে মামলাটি হলো সে মামলার বাদী নায়িকা পরী মণি। কিন্তু বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে আসার পরে চাপে পড়ে এ মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। যদি সত্যি কোনো ধর্ষণ চেষ্টা বা হত্যা চেষ্টার ঘটনা ঘটতো তাহলে সে মামলায় প্রথমে গ্রেপ্তার দেখানো হতো।

ঢাকা বারের সভাপতি আব্দুল বাতেন শুনানিতে বলেন, ‘নাসিরউদ্দিনকে যে মামলায় গ্রেপ্তার করতে গেছেন, সেই মামলায় তো তাঁকে গ্রেপ্তার দেখাননি। বাসা তাঁর না। তাঁর শরীর থেকেও কিছু পাননি। বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আসলে বিষয় কিছু না।  কিছুই পায়নি। ২৪ ঘণ্টা আগে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিছুই পায়নি।’

আব্দুল বাতেন বলেন, ‘তিনি (নাসিরউদ্দিন মাহমুদ) একজন সম্মানিত ব্যক্তি, ব্যবসায়ী। প্রেক্ষাপটের আলোকে এখানে আসতে হয়েছে।  লাখ লাখ টাকা তিনি সরকারকে ট্যাক্স দেন। আর উনি গেছেন এসব মাদক খাটের নিচে রাখতে? তিনি ভিকটিমাইজ। সমাজের এলিটপারসন। যেভাবে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এতে তাঁর মানসম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তিনি অসুস্থও। যা উদ্ধার করার তা হয়েছে।  রিমান্ডের যৌক্তিকতা নেই। প্রয়োজনে তাঁকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক।’

আব্দুল বাতেল আরও বলেন, পরী মণি রাতে বাকিতে মদ কিনতে গিয়েছিল, কিন্তু তাঁকে বাধা দেওয়ায় উত্তেজিত হয়ে এ মিথ্যা ঘটনা দেখিয়েছে। মামলাটি মিথ্যা ও বানোয়োট। নাসিরউদ্দিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ একাধিক প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি কাজ করেন। তিনি সরকারকে অনেক টাকা ট্যাক্স দেন। তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলা মিথ্যা। আমরা তাঁর জামিন চাচ্ছি। তিনি বয়স্ক ব্যক্তি। তাঁর বয়স ৬৫ বছর। রিমান্ডে গেলে এই মুহূর্তে তাঁর অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

অপরদিকে তিন নারী আসামির পক্ষে আইনচীবী মুহাম্মদ জুয়েল রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করেন। তিনি বলেন, ‘এদের অন্য জায়গা থেকে ধরে এনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা নির্দোষ। ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানে না। রিমান্ড বাতিল করে তাঁদের জামিনের প্রার্থনা করছি।’

এরপরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিএমপির গুলশান জোনাল টিমের পুলিশ পরিদর্শক (নি.) উদয় কুমার মন্ডল বিচারকের উদ্দেশে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, এই আসামিদের রিমান্ডে নিলে আমরা দেশের অনেক মুখোশধারী অপরাধীদের বের করে আনতে পারব। তাঁদের রিমান্ডে নিলে অনেক তথ্য পাব। কিছু তথ্য দিয়েছে, আরও কিছু তথ্য প্রয়োজন।’

এদিকে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টা মামলার এজাহারে পরী মণি উল্লেখ করে বলেন, গত ৮ জুন রাত ১১ টা ৩০ মিনিটে আমি বাসা থেকে আমার কসটিউম ডিজাইনার জিমি, অমি এবং বনিসহ দুটি গাড়ি যোগে উত্তরার উদ্দেশে রওনা হই। পথের মথ্যে আমি বেড়িবাঁধস্থ ঢাকা বোট ক্লাব লিমিটেডে, অমি বলে তাঁর দুই মিনিটের কাজ আছে। আমি অমির কথামতো ঢাকা বোট ক্লাবের সামনে গত ৯ জুন রাত অনুমান ১২টা ২০ মিনিটে গাড়ি দাঁড় করাই। কিন্তু বোট ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অমি কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে। তখন ঢাকা বোট ক্লাবের সিকিউরিটি গার্ডরা গেইট খুলে দেয়। তখন অমি ভেতরে যায় এবং অমি অনুরোধ করে এখানে পরিবেশ অনেক সুন্দর; তোমরা নামলে নামতে পারো।’

আরও বলা হয়, এরপরে আমার ছোট বোন বনি প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিলে আমরা ঢাকা বোট ক্লাবে প্রবেশ করে বারের কাছের টয়লেট ব্যবহার করি। টয়লেট থেকে হতে বের হতেই এক নম্বর আসামি নাসিরউদ্দিন আমাকে ডেকে বসার জন্য অনুরোধ করেন এবং কফি খাওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন। আমরা বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলে অমিসহ ১ নম্বর আসামি (নাসিরউদ্দিন মাহমুদ) মদ্যপান করার জন্য জোর করেন। আমি মধ্যপান করতে না চাইলে এক নম্বর আসামি জোর করে আমার মুখের মধ্যে মদের বোতল প্রবেশ করে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করে, এতে আমার সামনের দাঁতে ও ঠোটে আঘাত প্রাপ্ত হই। ১ নম্বর আসামি আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং আমার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে ও আমাকে জোর করে ধর্ষণের চেষ্টা করে। উক্ত ১ নম্বর আসামি উত্তেজিত হয়ে টেবিলে রাখা গ্লাস ও মদের বোতল ভাঙচুর করে আমার গায়ে ছুড়ে মারেন। তখন আমার কসটিউম ডিজাইনার জিমি বাধা দিলে ১ নম্বর আসামি তাঁকেও মারধর করে নীলাফোলা জখম করে। আমি প্রথমে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ কল দিতে গেলে আমার ব্যবহৃত ফোনটি টান মেরে ফেলে দেয়। পুনরায় ফোনটি উঠিয়ে কল দিতে চাইলে আবার ফোনটি টেনে ফেলে দেয়। 

এ ঘটনার পরে গত রোববার সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিচার চেয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন পরী মণি। তিনি দাবি করেছেন যে, ছয়জন তাঁকে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা করেছিল। ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর গত রোববার রাত ১০টায় তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।

সংবাদ সম্মেলনে নায়িকা পরী মনি জানান, তিনি জীবনের নিরাপত্তহীনতায় ভুগছেন। নিজ বাসায় তিনি নিজেকে নিরাপদ বোধ করছেন না। পরী মণি বলেন, ‘আমি সুইসাইড (আত্মহত্যা) করার মতো মেয়ে না। আজকে যদি আমি মরে যাই, সবাইকে জানাতে চাই, আমি সুইসাইড করব না।’

জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা করা নাসিরউদ্দিন মাহমুদ পেশায় একজন উচ্চপর্যায়ের ঠিকাদার। সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি), রাজউক, রেলওয়েসহ সরকারি-বেসরকারি নানা ঠিকাদারি কাজ করেন।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সাবেক নির্বাহী পরিষদের সদস্য নাসির ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের উত্তরা ক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি, লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের সাবেক জেলা চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হল ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কুঞ্জ ডেভেলপার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান নাসির এক সময় ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগেও খেলেছেন।

গতকাল গ্রেপ্তারের পর নিজেকে নির্দোষ দাবি করে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি বুধবার (৯ জুন) রাতে যখন ক্লাব (ঢাকা বোট ক্লাব) থেকে বের হই, তখন পরী মণি ও তাঁর বন্ধু মদ্যপ অবস্থায় ক্লাবে প্রবেশ করেন। তাঁদের মধ্যে একটি ছেলে উশৃঙ্খল আচরণ করছিলেন। ক্লাবে ঢোকার পর আমাদের বারের কাউন্টার থেকে বড় বড় ও দামি ড্রিংকসের বোতল জোর করে নেওয়ার চেষ্টা করলে আমি বাধা দিই। একপর্যায়ে আমি আমার নিরাপত্তাকর্মীদের ডাক দিলে তাঁরা পরী মণি ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যান।’