এমন ফাঁকা দেখেনি ঢাকা
ঢাকার স্থানীয় ব্যবসায়ী রাসেল শিকদার। বয়স ৬৭ বছর। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, ‘১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে বর্তমান সময়ের মতো এত ভীতিকর পরিবেশ কখনো সৃষ্টি হতে দেখিনি। মানুষের চোখে-মুখে আর মন আতঙ্কে ভরা। সেই আতঙ্কে ঢাকার রাস্তা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। জন্মের পর থেকে ঢাকার এই পরিবেশ আমি কখনো দেখিনি।’
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় রাসেল শিকদারের। তখন তিনি বলেন, ‘আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না করোনার কারণে। গত কয়েকদিন ধরে ঘরবন্দি। আর থাকতে পারছিলাম না। তাই হাঁটতে বের হলাম। হাঁটতে এসে মন খারাপ হয়ে গেছে। এমন শহর দেখতে ইচ্ছে করে না। ভূতুড়ে ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। কোথাও লোকজন নেই। পুরো শহর শাটডাউন!’
বৃহস্পতিবার দুপুর ঠিক সাড়ে ১২টায় ফয়সাল আহম্মেদ তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে রওনা দেন ঢাকার আমিনবাজারের উদ্দেশে। ফয়সালের চাচাতো ভাই মো. রবিন আমিনবাজার থেকে গাড়ি পাচ্ছেন না ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) গুরুতর অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার জন্য। সেজন্য রবিনকে আনতে ফয়সাল পান্থপথ থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত গেলেন মাত্র ১০ মিনিটে! আমিনবাজার পৌঁছে ফয়সাল বলেন, ‘আমার চাচি অসুস্থ, তাঁকে দেখতে ভাই যেতে পারছে না। তাই নিতে এলাম। এই ঢাকা বড় অচেনা। অন্তত সিএনজি হলেও তো পাওয়া যাওয়ার কথা। রাগও হচ্ছে আবার পরিস্থিতির কারণে চুপও থাকছি।’ যদিও শহরের নানা স্থানে টুকটাক মোটরসাইকেল ও রিকশা চলতে দেখা গেছে।
আমিনবাজার থেকে গাবতলীতে ফিরে কথা হয় সেখানে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্ট সুফিয়ানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত গাড়ি চলতে দিচ্ছি কিন্তু ভাড়ায়চালিত গাড়ি চলতে দিচ্ছি না। এই দেখেন দুই মোটরসাইকেল আটকে রাখছি। এরা ভাড়ায় চালাচ্ছিল।’
গাবতলীতে কথা হয় ঠিকাদার জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে। জাহাঙ্গীর ঢাকায় এসেছেন চাঁদপুর থেকে। জাহাঙ্গীরসহ তিনজনে মিলে ছয় হাজার টাকায় রাজধানীর ফার্মগেট পর্যন্ত এসেছেন একটি ট্যাক্সিতে। ফার্মগেট থেকে এক হাজার টাকায় উবারের একটি গাড়িতে চড়ে যান গাবতলী পর্যন্ত। জাহাঙ্গীর যাবেন সিরাজগঞ্জের নিজ বাড়িতে। একটি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে গাবতলী স্ট্যান্ডে। অন্তত ছয়জন যাত্রী গিয়ে ভাড়ায় যাওয়ার কথা বলছেন ট্যাক্সির চালককে। চালক অতিরিক্ত ভাড়া চাচ্ছেন। তাতে কেউ কেউ রাজি হচ্ছিলেন না। জাহাঙ্গীরও না।
সে সময় জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘চাঁদপুর থেকে ফার্মগেট আইছি ছয় হাজার টাকায়। ফার্মগেট থেকে এক হাজার টাকায় গাবতলী। এখন সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত যেতে হলে দিতে হবে আট হাজার টাকা! আগে জানলে মরে গেলেও বাসা থেকে বের হতাম না।’
গাবতলী থেকে বের হয়ে মিরপুর শাহ আলীর মাজারের দিকে যেতে দেখা যায়, ভেলি ডিজাইন গার্মেন্টস অ্যান্ড প্রিন্টিং নামের এক পোশাক কারখানার শ্রমিকরা দুপুরের খাবার খেতে বের হয়েছেন। পরে ওই গার্মেন্টসে ঢুকে দেখা যায় কয়েকজন শ্রমিক ভাত খাচ্ছেন। তাদের কয়েকজন জানান, আগামীকাল শুক্রবার অর্ধেক মাসের বেতন দিয়ে ছুটি দেওয়ার কথা বলেছেন মালিক। পরে পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আজ স্বাধীনতা দিবসে ছুটি দেওয়ার দরকার ছিল কিন্তু কাল তাদের অর্ধেক মাসের বেতন দিয়ে ছুটি দিয়ে দেব। তাছাড়া সরকার কিন্তু কারখানা বন্ধ করতে বলেনি।’
এরপর মিরপুর ১ নম্বর সেকশন থেকে মিরপুর ১৪ নম্বর সেকশন হয়ে মহাখালীতে গিয়ে কথা হয় হাবিবুল্লাহ রহমানের সঙ্গে। বাবার অসুস্থতার কথা শুনে বাসা থেকে বের হয়েছেন নরসিংদী যাবেন বলে। কিন্তু যাওয়ার কোনো যানবাহন খুঁজে পাচ্ছেন না। নেই কোনো গাড়ি। হাবিবুল্লাহ রহমান বলেন, ‘এমন অসহায় কোনোদিন লাগেনি। বাবা মারা যাচ্ছেন অথচ আমি যেতে পারছি না বাড়িতে। ঢাকায় থাকি ৩১ বছর ধরে। কখনো এমন কিছু নেই কিছু নেই মনে হয়নি। এমন ফাঁকা ঢাকাও কখনো দেখিনি আমি। এক ভাইরাস কতকিছু পরিবর্তন করে দিল। ভাবছি শুধু।’