ওরা ভয়ংকর, সাভারে ব্যবসা-চাকরির আড়ালে ছিনতাই
একজন স্যানিটারি ব্যবসায়ী, অন্যজন প্রাইভেটকার চালক। দিনের আলোয় এটাই তাঁদের পরিচয়। কিন্তু এসব পেশার আড়ালে তারা পেশাদার ছিনতাইকারী। একজন মুরগি চুরি করে হাত পাকিয়েছেন। অন্যজন ছ্যাঁচড়া চোর থেকে হয়ে উঠেছেন ভয়ংকর ছিনতাইকারী। ছুরির সামনে মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার কিংবা অর্থ দিতে দেরি হলেই বুকে বা পেটে ছুরি চালিয়ে দেন তাঁরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্রাক্তন শিক্ষার্থী মুস্তাফিজুর রহমানকে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনায় র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর বেরিয়ে এসেছে আজাদ শরীফ (২৯) ও রনি ওরফে ডগি রনির (৩০) ছিনতাইয়ের আদ্যোপান্ত। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দুজনই ঘটনায় নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। দলের অপর চারজনের মধ্যে একজন পুলিশের নজরদারির মধ্যে থাকলেও অন্যজন এখনো লাপাত্তা।
গত শনিবার ভোরে ঢাকার সাভারের শিমুলতলায় বাস থেকে নামা মাত্রই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন রাবির দর্শন বিভাগের ২০১৯ সালের স্নাতকোত্তরের সাবেক শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান।
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের মোস্তাফিজুর সাভারে গ্লোরিয়াস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। থাকতেন ঘটনাস্থলের অদূরে ডগরমোড়া মহল্লায়। সেদিন দূরপাল্লার বাস থেকে নেমেই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে উপর্যুপরি ছুরির আঘাতে প্রাণ দিতে হয় তাঁকে।
খুনের পর মোস্তাফিজুরের সঙ্গে থাকা একটি ব্যাগ ছিনতাই করেই দৌড়ে পালাতে দেখা যায় ছিনতাইকারীদের। পাশের একটি দোকানের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে তিনজন রুদ্ধশ্বাস বেগে পালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যজন আগেই ভিন্ন গলি দিয়ে চলে যান। পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে ভাগবাটোয়ারা করে প্রত্যেকে মাত্র দুই হাজার টাকা করে পান বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
ধরা পড়া ছিনতাইকারী সাভারের ডগরমোড়া এলাকার রনি ওরফে ডগি রনি পুলিশের খাতায় ‘কুত্তা রনি’ নামে অন্তর্ভুক্ত। রনি শিমুলতলায় আরিফ অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের একটি স্যানিটারি দোকানে পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার বড় রনির এই পরিচয়ের আড়ালে ছিনতাইটাই আসল পেশা। দুই মেয়ের বাবা রনি এলাকায় রীতিমতো একটি আতঙ্কের নাম।
অন্যদিকে আজাদ শরিফ পেশায় গাড়িচালক। ১৫ হাজার টাকা বেতনে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) গাড়িচালকের চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছেন তিনি।
র্যাব-৪-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার উনু মং বলেন, ‘উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আজাদ শরীফ (২৯) ও সাভারের ডগরমোড়া এলাকার রনি ওরফে ডগি রনিকে আটক করার পর তাঁদের ছিনতাই কর্মকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বেরিয়ে এসেছে।’
হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে তৎপর হয় সাভার মডেল থানা পুলিশ, র্যাব ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পর অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা করেন নিহতের বাবা মজিবুর রহমান। তিনি জানান, ঢাকায় আসার গাড়ি ভাড়াও ছিল না তাঁদের সঙ্গে। রাজশাহীর পুলিশ সুপারের সহায়তায় তিনি ঢাকায় এসেছেন। ভীত কণ্ঠে তিনি বলছিলেন, ‘আমি চাই আর কোনো বাবা যেন আমার মতো সন্তানহারা না হয়। পুলিশকে বলেছি, আপনারা ব্যবস্থা নেন। খুনিদের যেন দ্রুত ধরা হয়, যেন উপযুক্ত বিচার হয়। আমার মতো এভাবে সন্তান হারানোর কষ্ট যেন অন্য বাবাদের না হয়।’
স্ত্রী খাদিজা বেগম ও এক বছরের ছেলে মুসাকে নিয়ে সাভারে বসবাসের পরিকল্পনা করেছিলেন মুস্তাফিজুর। এ জন্য বাসাও ভাড়া করেছিলেন তিনি। তবে আসার দিন সন্তানের জ্বর থাকায় পরিবার ছাড়াই ঢাকার পথে রওনা দেন তিনি। শিমুলতলায় গাড়ি থেকে নামা মাত্রই পড়েন ছিনতাইকারীদের কবলে।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র্যাবের উপপরিদর্শক (এসআই) কায়সার মাতুব্বর বলেন, ‘রনি চোরাইপথে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।’
সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ জানান, ওই ঘটনায় চারজনের মধ্যে অপর দুজনকে আটক করতে অভিযান চলছে। ছদ্মবেশি ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করা সত্যিই জটিল। কারণ আমরা তদন্ত করে দেখেছি অর্থবিত্ত থাকার পরও তাঁদের অনেকে ছিনতাইয়ের মতো জঘন্য পেশায় জড়িয়েছেন। এমনকি ছিনতাই করতে গিয়ে তাঁরা অকাতরে মানুষ খুন করছেন।