ওয়ান-ইলেভেনের সাহসিকতায় দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
ওয়ান-ইলেভেনের সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পক্ষে বিশেষ আদালতে লড়েছিলেন অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। সেই দুঃসময়ে পাশে থাকা সাহারা খাতুনকে মনে রেখে ক্ষমতায় আসার পর মূল্যায়ন করেছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সাহারা খাতুনকে দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন তিনি।
১৯৪৩ সালের ১ মার্চ ঢাকার কুর্মিটোলা গ্রামে বাবার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। তাঁর বাবার নাম আবদুল আজিজ ও মায়ের নাম তুরজান নেছা। তিনি ফার্মগেটের ৩৪ এয়ারপোর্ট রোড, তেজগাঁওয়ে বসবাস করতেন। বাবা আবদুল আজিজ মাস্টার ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক।
সাহারা খাতুন কুর্মিটোলা হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এরপর তাঁকে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। সেখানে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাই স্কুলে দশম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১৯৬০ সালে ইস্ট-পাকিস্তান বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর তিনি সিটি নাইট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে জগন্নাথ কলেজে বি.এ-তে ভর্তি হন। বি.এ (ফাইনাল) পরীক্ষার সময় অসুস্থ থাকায় এক বিষয়ে পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরে চাচা আবুল হাশেমের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি চলে যান। সেখানে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইংরেজি মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বি.এ (ডিগ্রি) অর্জন করেন।
সাহারা খাতুন ১৯৬৭ সালে ঢাকায় আসেন এবং পুরোদমে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে পুনরায় করাচি গিয়ে রেজাল্ট নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্রদের মধ্যে একটি নির্বাচনে তিনি ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। সেটি ছিল তাঁর জীবনের প্রথম নির্বাচন। এর পরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এত বেশি জড়িয়ে পড়েন যে আর ল পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে ৪ নভেম্বর তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পর্যন্ত মিছিল করেছিলেন। ৫ নভেম্বর চার নেতার লাশ পাওয়া যায়। তাঁর ল পরীক্ষার একটি বিষয় ছিল ৫ নভেম্বর। তিনি তখন ভাবলেন, পরীক্ষা পরেও দেওয়া যাবে, কিন্তু জাতীয় নেতাদের শেষ বিদায় জানানোর সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।
এ কারণে সে বছর আর পরীক্ষা দেননি সাহারা খাতুন। এর পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল (অনার্স) কোর্স শুরু হয়। তখন শিক্ষকদের পরামর্শে বিজয়নগরে সেন্ট্রাল ল কলেজে ভর্তি হন তিনি। আইনপেশায় আসার অদম্য ইচ্ছায় সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
সাহারা খাতুন বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে আইনপেশা পরিচালনার সনদপ্রাপ্ত হয়ে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। আইনপেশা শুরু করেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. জিল্লুর রহমানের জুনিয়র হিসেবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আইনপেশা পরিচালনার সনদ পান এবং আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। তিনি পরে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বার কাউন্সিলের ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা যখন গঠিত হয়, তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন সাহারা খাতুন এবং ঢাকা শহরে নারীদের প্রয়াত আইভি রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত করতে শুরু করেন। তখন থেকেই মিটিং-মিছিল সবকিছুতেই অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দিনও তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখনকার ছাত্রলীগ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের দিন সাহারা খাতুন আওয়ামী লীগের মহিলা শাখার অনেক নারী নেতাকর্মী নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন ঢাকা-৫ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সাহারা খাতুন। সে নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি। পরে একই আসনে খালেদা জিয়া আসন ছেড়ে দিলে শূন্য আসনের উপনির্বাচনেও তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সেই নির্বাচনেও তিনি পরাজিত হন। এরপর ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তাঁকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে হাজার হাজার মামলা দেয়। সাহারা খাতুন তখন আইনজীবীদের নিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে অধিকাংশ নেতাকর্মীর মামলা পরিচালনা করেন। আহত কর্মীদের হাসপাতালে এবং বাসায় দেখতে যেতেন। বিশেষ করে নারী কর্মীদের গ্রেপ্তার করে থানায় নিলে তাঁদের যাতে নির্যাতন করা না হয়, সে জন্য আইনজীবীদের নিয়ে থানায় যেতেন। পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে বাসায় ছুটতেন।
২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, রহমত আলী, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ আবু, অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম, মো. মোখলেছুর রহমান বাদল, আবদুর রহমান হাওলাদারসহ অনেকের সঙ্গে সাহারা খাতুনও পরিচালনা করেছেন। অন্য নেতাকর্মীদের মামলাও দেখতেন। তখন অনেকে জননেত্রী শেখ হাসিনার মামলাসহ নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনা করতে ভয় পেতেন। সব ভয়-ভীতি অতিক্রম করে সাহারা খাতুন সব আদালতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং সব কার্যক্রমে তিনি অংশ নিয়েছেন।
ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও সাহারা খাতুন জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং নেতাকর্মীদের জন্য সাংবাদিকদের কাছে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। তিনি প্রথমে নগর আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে মহিলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদিকা এবং একই সঙ্গে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহ-আইন সম্পাদক, পরে আইন সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন তিনি নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ এবং মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদকের পদ গ্রহণ করেননি।
এর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাহারা খাতুন ঢাকা-১৮ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় জোট ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সাহারা খাতুনকে চ্যালেঞ্জিং মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেদিন যুক্ত হয়েছিল প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পরে পৌনে চার বছরের মাথায় তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি পুনরায় ঢাকা-১৮ আসন থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সাহারা খাতুন পরবর্তী কাউন্সিলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। আমৃত্যু পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকেই তিনি মহিলা সমিতির সদস্য মনোনীত হন। তখন ড. নীলিমা ইব্রাহিম সভানেত্রী ও আইভী রহমান মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি পরিবার পরিকল্পনা সমিতির আজীবন সদস্য, ঢাকা আইনজীবী সমিতির আজীবন সদস্য, গাজীপুর আইনজীবী সমিতির আজীবন সদস্য, ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যশানাল অ্যালায়েন্স অব ওমেন্সের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাহারা খাতুন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আজীবন আস্থাশীল ছিলেন। আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি বহুবার নির্যাতিত হয়েছেন, জেল খেটেছেন। তারপরও তিনি কখনো থেমে থাকেননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন।
এই খ্যতিমান রাজনীতিক গত ৬ জুন জ্বর, অ্যালার্জিসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে অসুস্থ হয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ৭ জুলাই থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুদিন ভর্তি থাকার পর বাংলাদেশ সময় গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।