কক্সবাজার সৈকতে ১২৫ ডিম দিয়ে গেল সামুদ্রিক কাছিম
দীর্ঘ আট মাস পর কক্সবাজারে নির্জন সৈকতে ১২৫টি ডিম দিয়ে গেল একটি সামুদ্রিক কাছিম। গতকাল মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারি ২০২৩) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পেঁচার দ্বীপ সৈকতে কাছিমটি এ ডিম দিয়ে যায়।
নেচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্টের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল কাইয়ুম জানান, পেঁচার দ্বীপ সৈকত এলাকায় একটি অলিভ রিডলে কাছিম ১২৫টি ডিম দিয়ে গেছে। ইউএসএআইডির ইকো লাইফ প্রকল্পের আওতায় ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (ন্যাকম) এক্স সিটু প্রদ্ধতিতে এসব ডিম সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ মৌসুমে কক্সবাজার এলাকায় এই প্রথম সামুদ্রিক কাছিমের দেখা মিলেছে। কাছিমটি ১২৫টি ডিম পেড়ে নিরাপদে সাগরে ফিরে গেছে।
ন্যাকমের মাঠকর্মী আব্দুল লতিফ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ডিম সংগ্রহ করে এক্স সিটু প্রদ্ধতিতে সৈকতের বালিয়াড়ির নিরাপদ স্থানে ডিমগুলো সংরক্ষণ করেন।
ন্যাকমের সহকারী পরিচালক ড. শফিকুর রহমান জানিয়েছেন, হ্যাচারিতে আগামী প্রায় তিন মাস ডিমগুলোর নিবিড় পরিচর্যা করা হবে। এরপর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে কাছিমের বাচ্ছাগুলো আবার নিরাপদে সাগরে অবমুক্ত করা হবে। সর্বশেষ কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের সৈকতে কাছিম ডিম দিয়েছিল গত বছরের এপ্রিল মাসে। সাধারণত সামুদ্রিক কাছিম সৈকতে ডিম দেয় সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল ও মে মাসে। কিন্তু বেশ কবছর ধরে কক্সবাজারে সৈকতে সামুদ্রিক কাছিম খুব কমই দেখা মিলছে। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে কাছিম ডিম পাড়ার সময় হলেও কাছিম এ সময়ে ডিম পাড়তে আসছে না। গত বছর জানুয়ারির ১৫ তারিখ কাছিম প্রথম ডিম দেয়। এ বছর জানুয়ারির ৩ তারিখ ডিম দিল।
ড. শফিকুর রহমান আরও জানান, ‘কক্সবাজারের দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও সোনাদিয়া দ্বীপে ১০টি হ্যাচারি রয়েছে, যেখানে কাছিমের ডিম সংরক্ষণ করা হয়। আর সোনাদিয়া সেন্টমার্টিন এবং দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের ৫২টি স্পটে এসে কাছিম ডিম পাড়ত, এখন সৈকতের ৩৪টি স্পটে এসে কাছিম ডিম দেয়। ২০২২ সালে এসব স্পটে কাছিম ডিম দিয়েছে পাঁচ হাজার ৬৫০টি। এই ডিম থেকে চার হাজার ৩০০-এর মতো বাচ্চা ফুটে।’
ন্যাকমের সহকারী পরিচালকের দেওয়া তথ্য মতে, ‘প্রতিটি হ্যাচারিতে দুই থেকে আড়াই হাজার কাছিমের বাচ্চা ফুটে। এই হিসাবে কক্সবাজারে ২০ বছরে এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় তিন লাখ কাছিমের বাচ্চা অবমুক্ত করা হয় সাগরে।’
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার জানান, ‘দীর্ঘদিন পর সৈকতে কাছিম আসা একটি সুসংবাদ। কাছিমটি ১২৫টি ডিম দিয়েছে। হ্যাচারিতে এই ডিম থেকে প্রায় তিন মাস পর বাচ্চা ফুটবে। বাচ্চাগুলো সাগরে অবমুক্ত করা হবে। বাচ্চাগুলো ফিরে যাবে হাজার মাইল দূরে মা-বাবার আবাসস্থলে। যদি অন্যকোনো বিপর্যয় না ঘটে তবে এই বাচ্চাগুলো একদিন বড় হয়ে আবার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে কোনো এক পূর্ণিমা রাতে ডিম পাড়ার জন্য এই পেঁচার দ্বীপেই ফিরে আসবে, যেখানে একদিন তার মা এসেছিল ডিম পাড়ার জন্য। যে বালিয়াড়িতে একদিন তার জন্ম হয়েছিল।’
ন্যাকমের সহকারী পরিচালক জানান, ‘বিস্ময়কর ব্যাপার হলো—কীভাবে একটি কাছিমের বাচ্চা তার মায়ের আবাসস্থল চিহ্নিত করে হাজার হাজার মাইল বিপদসংকুল উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছে, আবার প্রাপ্ত বয়সে ডিম পড়ার সময় হলে কীভাবে হাজার মাইল দূরে তার জন্মস্থান নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করে ঠিক সেখানেই ডিম পাড়তে আসে যে সৈকতের বালিয়াড়িতে এক পূর্ণিমা তিথিতে তার মা এসেছিল ডিম পাড়তে এবং যেখানে একদিন তার জন্ম হয়েছিল—এ রহস্য এখনও বিজ্ঞানিদের অজানা। সাধারণত পূর্ণিমার রাতে জোয়ারের সময় সামুদ্রিক কাছিম সৈকতের বালিয়াড়িতে ডিম পাড়তে আসে।
ন্যাকমের সহকারী পরিচালক আরও জানান, কক্সবাজারের দীর্ঘ সৈকতের বালিয়াড়িতে মানুষের নানা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে দিন দিন ডিম পাড়ার স্থান বিনষ্ট হচ্ছে।
ন্যাকমের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ব্যবস্থাপক আব্দুল কাইয়ুম জানান, সাগরপারে যত্রতত্র ট্যুুরিজম, বিচ বাইক চালানো, ডিম পাড়ার জায়গায় ঝাউ গাছ রোপণ, হোটেল মোটেল গড়ে ওঠা, সাগরপারে আলো জ্বালানো, কারেন্ট জাল, ভাসাজালে আটকে, শিকারি পাখি, শিয়াল, কুকুরের অবাধ বিচরণ ইত্যাদি কারণে কক্সবাজারের সৈকতের বালিয়াড়িতে কাছিমের আগমন কমে যাচ্ছে।