‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’ কী, মানছেন কয়জন?
সাজু মণ্ডল (৬২) প্রতিদিন বিকেলে চা পান করতে সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার স্থানীয় একটি বাজারে যান। এই অভ্যাস তাঁর অনেক দিনের। কিন্তু করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই তাঁর দুই ছেলে প্রতিদিন তাঁকে বাজারে চায়ের দোকানে যেতে নিষেধ করেন। তবে তিনি পরিবারের করোর কথা শোনেন না।
বাজারে যাওয়ার সময় যখন পরিবার থেকে সাজু মণ্ডলকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন তিনি তা মানেন না। সাজু একজন চাষি। তিনি যে দোকানে নিয়মিত আড্ডা দেন সেখানে আরো কয়েকজন বসেন। সারা দিন মাঠের কাজ সেরে বিকেলে বাজারে গিয়ে আড্ডা শেষে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে আরেকজনের নাম বাবু সরদার (৫৭)। তাঁকেও পরিবারের পক্ষ থেকে বাজারে যেতে নিষেধ করা হয় কিন্তু তিনিও শোনেন না। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এখনো মসজিদেই পড়েন।
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) এক আতঙ্কের নাম। বাংলাদেশেও সেই আতঙ্ক জোরেশোরে জেঁকে বসেছে। এই জেঁকে বসার কথা স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মুখ দিয়ে বারবার প্রকাশ পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আজকাল নিয়মিতই বলছেন, দেশে এখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে। ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। যেকোনো সময় যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে।
সাজু মণ্ডল ও বাবু সরদারসহ এমন অন্তত ১৫ জন বৃদ্ধা বা মধ্য বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে এনটিভি অনলাইন। তাঁদের কেউ-ই ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’ সম্পর্কে জানেন না বা বোঝেন না। তাঁদের সবারই ধারণা, এলাকায় বিদেশি লোক না গেলে কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না। এই চিন্তা-চেতনা থেকে তাঁরা নিয়মিত বাইরে যাচ্ছেন, যাচ্ছেন চায়ের দোকানের মতো জনসমাগমস্থলেও।
জানতে চাইলে এনটিভি অনলাইনকে সাজু মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের এলাকায় কেউ বিদেশি লোক নেই। তাই বাইরে যাই। আমাদের কিছুই হবে না। আর আল্লাহ যদি মরণ লিখে রাখে তাহলে কে ঠেকাবে? সারাদিন রাত বাড়িতে থাকা যায় না। মায়ের পেট থেকে পড়ার পর এমন কোনো দিন হয়নি যে বাজারে যাইনি।’
বাবু সরদার বলেন, ‘সারা জীবন মসজিদে নামাজ পড়ছি। এখন না গেলে আল্লাহ অখুশি হবেন। আল্লাহ ভাইরাস দিছে আমাদের মন পরীক্ষা করার জন্য। নামাজে গেলে কিছুই হবে না। আর সারা দিনে একবার বাজারে না গেলে শরীরে হাঁসফাঁস ধরে যায়। বিদেশি লোক এদিকে আসেনি তাই আমাদের কোনো সমস্যা হবে না।’
মজনুর রহমান (৫০) একজন শিক্ষিত চাষি। তিনিও ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন‘ সম্পর্কে জানেন না। মজনুর মতো ওই ১৫ জনের সবাই এই ব্যাপারে জানেন না। মজনুর রহমান বলেন, ‘প্রথমে আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের সংস্পর্শে না গেলে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। এরপর হঠাৎ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলতে শুরু করল, কমিউনিটি ট্রান্সমিশমন শুরু হয়েছে। কিন্তু কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কী, সেটা তো আপনাকে বোঝাতে হবে। আমি নিজেও জানি না এটা কী জিনিস। তাহলে গ্রামের এই একেবারে নিরক্ষর মানুষ কীভাবে বুঝবে? তাঁদের ভালোভাবে বাংলায় বলে বোঝাতে হবে। এই ভাইরাসের ভয়াবহতা আপনাকে বোঝাতে হবে। শুধু ঘরে থাকতে বললে হবে? মানুষ যখন চারিদিকে গড়পড়তা মরতে শুরু করবে তখন বুঝিয়ে লাভ কী?’
রাজধানী ঢাকার পান্থপথে বসবাস করেন খালিদ মিয়া। তিনি একজন শিক্ষক। তিনিও কমিউনিটি ট্রান্সমিশন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না বলে জানান। এ ছাড়া নাজমুল ইসলাম নামের একজন ব্যাংক কর্মকর্তাও এই ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানেন না বলে জানান।
খালিদ মিয়া বলেন, ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন সম্পর্কে আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য দেওয়া উচিত। তাতে করে আমরা সচেতন হতে পারব এবং করণীয় ঠিক করতে অসুবিধা কম হবে।’
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘প্রথম ধাপে যখন দেশে করোনাভাইরাসের দু-একজন করে করে রোগী শনাক্ত হতে শুরু করে তখন থেকে বলা হয় বিদেশি কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে এই ভাইরাসটি ছড়ায়। এরপর দ্বিতীয় ধাপে কন্ট্রাক্ট রেসিংয়ের (বিদেশির পরিবার) মাধ্যমে আক্রান্ত হতে থাকে, তৃতীয় ধাপে গিয়ে বলা হল, ওই পরিবারের সঙ্গে যারা মেলামেশা করেছিলেন তাঁরা আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। সর্বশেষ বা চতুর্থ ধাপে বলা এসে এখন হচ্ছে, দেশে এখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে। এখন আমরা করোনা আক্রান্তের চতুর্থ ধাপে আছি।’
অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, ‘চতুর্থ ধাপে এসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পুরো বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে নাগরিকের করণীয় কী হওয়া উচিত তার একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা দরকার জাতির সামনে।। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কী এটা অনেকেই বোঝেন না।। গ্রামের অনেক মানুষ এখনো ধারণা পোষণ করেন যে, স্রেফ বিদেশিদের মাধ্যমেই করোনা ছড়াবে। হয়তো এটা তাদের অজ্ঞতাও বটে। কিন্তু কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কী এবং কেন তার একটি ব্যাখ্যা জাতির সামনে তুলে ধরা উচিত। তাতে করে মানুষের সতর্ক হতে সুবিধা হবে।’
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে বলে আমরা পুরো দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছি। এই অবস্থাতে কোনোভাবেই ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ব্যাপারে আমরা এরইমধ্যে বলেছি, আগামীতে আরো বেশি বেশি বলব।, এই পরিস্থিতিতে আপনি ঘরের বাইরে বের হলেই আক্রান্ত হতে পারেন। কারণ, ভাইরাসটি এখন সব স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে।’
কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কী?
কমিউনিটি ট্রান্সমিশন নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা প্রায় একই তথ্য দিয়েছেন।
তাঁরা দুজনই বলেছেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এমন একটি পরিবেশকে নির্দেশ করে, যখন কোনোভাবেই বোঝা যাবে না মানুষ কোথা থেকে বা কার মাধ্যমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেখা গেল, একজন করোনায় আক্রান্ত রোগীর কোনো ধরনের লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা গেল না। অথচ তিনি আক্রান্ত হয়েছেন।। তার মানে, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি তাঁর নিশ্বাসে বিষ নিয়ে আপনার সামনে ঘুরছেন, আপনাকে আক্রান্ত করছেন কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না।। পরিবেশটা এমন যে, আপনি যে কারো কাছ থেকে অথবা যেকোনোভাবে আক্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু তার উৎস জানা যাবে না।
তাঁরা দুজন আরো জানিয়েছেন, ৮০ ভাগ করোনায় আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ বা লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।। আবার এই ৮০ ভাগের ভেতরে কারো কারো হয়তো মৃদ লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।। বাকি ২০ শতাংশের ভেতরে হয়তো ৫ শতাংশের অবস্থা খারাপ হতে পারে। আর ১৫ শতাংশ রোগীর লক্ষণ দেখা যাবে কিন্তু তারা সুস্থু হয়ে ফিরবেন।। এই সমস্ত পরিস্থিতিকে সামাজিক সংক্রমণ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলা হয়ে থাকে।’