করোনার সংক্রমণের বিপজ্জনক এলাকা চট্টগ্রাম

Looks like you've blocked notifications!

নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিপজ্জনক এলাকায় পরিণত হয়েছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। প্রতিদিন ১০০ জনের বেশি মানুষের শরীরে শনাক্ত হচ্ছে করোনা। আক্রান্তের পাশাপাশি নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি সামাজিকভাবে সংক্রমণের সংখ্যাও বেড়ে চলছে। অবাধ যাতায়াত ও স্বাস্থ্যবিধি না মানা এর জন্য দায়ী বলে মনে করছে স্বাস্থ্য বিভাগ। পাশাপাশি মহানগর ও জেলার অধিকাংশ এলাকায় ১০০ জনের বেশি রোগী শনাক্ত হওয়ায় নগরীর ১১টি থানা এলাকার পাশাপাশি ১০০ জনের বেশি আক্রান্ত এলাকাকে রেডজোন হিসেবে ঘোষণা করেছে জেলা সিভিল সার্জন ও প্রশাসন।

চট্টগ্রামে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত ৩ এপ্রিল। প্রথম করোনা শনাক্তের পর দুমাসের মধ্যে সংক্রমণ দ্রুতগতিতে বেড়েছে চট্টগ্রামে। এরই মধ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে তিন হাজার ৮১০ জন। যদিও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার সব হিসাব কাগজে কলমে আসছে না বলে অভিযোগ বিভিন্ন সংগঠনের।

এরই মধ্যে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফনসহ নানা কাজে সস্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান আল মানাহিল ফাউন্ডেশন জানায়, তারা চট্টগ্রামে ১২৩ জনের দাফন ও সৎকার করেছে। পাশাপাশি গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ গত ২ জুন একই দিনে  মহানগরসহ বিভিন্ন উপজেলায় ১১ জনের দাফনকাজ সম্পন্ন করেছে। এখন পর্যন্ত সংগঠনটি ৫০ জনের বেশি দাফন করেছে বলে জানান সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব মোছাহেব উদ্দিন বখতেয়ার। তবে অ্যাম্বুলেন্স সংকটের কারণে তাদের গতি বাড়ছে না। পাশাপাশি রয়েছে মানসম্মত পিপিই সংকট। তারপরও চেষ্টা করছেন মানবিক বিপর্যয়ে মানুষের সেবার কাজ করতে।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অ্যাকশন এগেইনস্ট করোনা চট্টগ্রামের সমম্বয়ক তানভীর হোসেন জানান, এ মুহূর্তে চট্টগ্রামে ২৫০ জনের বেশি আইসিইউ বেডের চাহিদা রয়েছে। আর চিকিৎসার অভাবে চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও পুলিশসহ প্রায় শতাধিক লোক মারা গেছেন। তাদের দাবি, দুর্যোগকালীন সময়কে টার্গেট করে বেসরকারি হাসপাতাল মালিকরা স্বেচ্ছাচারিতা করছে। দ্রুত নগরীতে অন্তত ১৬০টি আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটরসহ জরুরি অবকাঠামো রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করা না হলে, মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে, বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউগুলোকে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ করার দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করছে অ্যাকশন এগেইনস্ট করোনা চট্টগ্রাম। এ ছাড়া ১৯টি সংগঠনের সমম্বয়ে গঠিত প্লাটফর্ম আইনি লড়াইয়ে নামার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, করোনাকালে নগরীতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা মিলছে না। পাশাপাশি অন্য রোগীরাও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দুই মাস আগে থেকে চিকিৎসকরা ব্যক্তিগত চেম্বার যেমন বন্ধ করে দিয়েছেন, তেমনি বেসরকারি হাসপাতালগুলো ঘিরে চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। এতে চিকিৎসা না পেয়ে অনেকে মারা যাচ্ছেন।

ঢাকার পর চট্টগ্রাম করোনার জন্য বিপজ্জনক এলাকা। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত ও হতাহতের সংখ্যা আরো দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন নগর বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শিক্ষাবিদ ড. মো. হাসিনুর রহমান খান। তিনি গবেষণা করে দেখেছেন, আগামী ১৫ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় সাত হাজারে পৌঁছাবে। এর জন্য হাসপাতালের বেডের প্রয়োজন হবে এক হাজার ৩৭০টি। আর আইসিউর প্রয়োজন হবে ৪১১টি। সুস্থ হবে প্রায় ৪০০ জন।

হাসিনুর রহমানের মতে, লকডাউন শিথিল করার পর ব্যস্ততা বেড়েছে আগে চেয়ে বহুগুণ। বন্দর কেন্দ্রীক কাজে গতি পেয়েছে। গার্মেন্টসগুলোর কার্যক্রম বেড়েছে শতভাগ। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে শিথিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রতি ১০০ জনে তিনজন মৃত্যুবরণ করছে। ব্যবসা-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে দেশের নানা প্রান্ত থেকে লোকজন বাড়ছে নগরীতে। এছাড়া বেসরকারিখাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্হার অপ্রতুলতার কারণে মৃত্যু বেড়ে চলেছে।

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের যুগ্ম সম্পাদক ইফতেখার কামাল খান জানান, প্রাইভেট হাসপাতাল করোনার রোগী ভর্তি করছে না। করোনা রোগী বাড়লেও বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের চাপে করোনা রোগীদের ভর্তি করালেও অবহেলার শিকার হচ্ছে রোগীরা। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে চিকিৎসা বাধ্যতামূলক করা খুবই প্রয়োজন। চট্টগ্রামে নন কোভিড রোগীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা বাড়ানো ও তাদের প্রণোদনার দাবি জানান তিনি।

তবে সরকারি নির্দেশনার পর বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসা শুরু করা হয়েছে বলে জানান বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোরশেদ হোসেন বলেন, সরকারি নির্দেশনা পাওয়ার পর বেসরকারি হাসপাতাল কাজ শুরু করেছে। আশা করি, দ্রুত সবাই কাজ করবেন। তবে চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ সেবামূলক হাসপাতাল মা ও শিশু হাসপাতাল আগে থেকে করোনা রোগীর চিকিৎসা শুরু করেছে। আজ শনিবার থেকে ৩০ বেডের একটি আলাদা আধুনিক ওয়ার্ড চালু হয়েছে মা ও শিশু হাসপাতালে।

সৈয়দ মোরশেদ হোসেন জানান, করোনা ওয়ার্ডে ২০টি আইসোলেশন ওয়ার্ড, ১০টি আইসিইউ বেড থাকবে। সদ্য নির্মিত বহুতল ভবনের দুটি ফ্লোরে করোনা ওয়ার্ডের কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।

জেলার সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জানান, করোনা আক্রান্ত রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল ও আইসিইউ বেড বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা বাড়ানোর কাজ করছে সরকার। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ বেডের পাশাপাশি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঁচটি আইসিইউ বেডের কাজ শুরু হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতাল পার্কভিউয়ে দুটি আইসিইউ বেড প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।