করোনা চিকিৎসায় অনন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

Looks like you've blocked notifications!
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী। ছবি : সংগৃহীত

যেন এক মৃত্যুপুরী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। করোনা ইউনিটে মৃত্যুর এই মিছিলে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। শুধু ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধরাই নন, মৃত্যু তালিকায় লেখা হচ্ছে তরুণ ও যুবকদেরও নাম। গত জুলাই মাসে হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা গেছে ৫৬৬ জন।

প্রতিদিন চোখের সামনে একের পর মৃত্যু দেখে ক্লান্ত চিকিৎসক, নার্সসহ হাসপাতালের অন্যান্য কর্মীরা। তাদের মাঝে একজনই ব্যতিক্রম। তিনি হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী। চিকিৎসক, নার্সসহ হাসপাতালের অন্যান্য স্টাফদের মনেই শুধু নয়, নিজে উপস্থিত থেকে করোনায় আক্রান্ত রোগী ও তাঁদের স্বজনদের মধ্যে আস্থা ও সাহস ফেরাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচালক হিসেবে যোগ দেন গত বছরের ৩ নভেম্বর। দুই মাস পর থেকেই রাজশাহীতে করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। তাঁর প্রচেষ্টায় হাসপাতালে এখন করোনায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত শয্যা ৬৫টি থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫১৩টি। তার প্রত্যেকটির সঙ্গেই সেন্ট্রাল অক্সিজেনের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আইসিইউ বেড ১০টি থেকে বাড়িয়ে এখন ২০টি। রয়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা। এসবের ফলে কমে এসেছে রোগী ভর্তি ও মৃত্যুর হার। ঈদের আগেও যেখানে বেডের বাইরে মেঝেতে রেখে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হয়েছে, সেখানে এখন করোনা ইউনিটে প্রতিদিনই বেড ফাঁকা থাকছে।   

পরিচালক শামীম ইয়াজদানী বলেন, আমাদের হাসপাতালে অক্সিজেনের কোনো কমতি নেই। যেখানে করোনার আগে হাসপাতালে প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার লিটার অক্সিজেনের প্রয়োজন হতো, এখন সেখানে প্রতিদিন অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় ১৫ থেকে ১৮ হাজার লিটার। অক্সিজেনের ফ্লো যাতে না কমে, সেজন্য প্রত্যেকটি লাইন মোটা করা হয়েছে। কারণ হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ব্যবহার করা হলে অন্য রোগীরা অক্সিজেন কম পায়। যাতে কোনো রোগীই অক্সিজেন কম না পায়, সেজন্য হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার লাইন আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। এতে সব রোগীই পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায়। এটা দেশের অন্য হাসপাতালে করা হয় না।

পরিচালক শামীম ইয়াজদানীর উদ্যোগে গত রোববার থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের সব ধরনের পরীক্ষা হাসপাতালের প্যাথলজিতে শুরু হয়েছে। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আর বাইরে যেতে হচ্ছে না। এতে সংক্রমণ কমার পাশাপাশি ডি-ডাইমার, ডি-হাইড্রোজেনেস, সিআরপি, সিরাম ফেরিটিনের মতো পরীক্ষাগুলো কম খরচে হাসপাতালে করতে পারছেন রোগীরা। এর মধ্যে সরকার নির্ধারিত ৬০০ টাকায় ডি-ডাইমার, ২৫০ টাকায় সিরাম ফেরিটিন, ১৫০ টাকায় ডি-হাইড্রোজেনেস ও সিআরপি পরীক্ষা করা যাচ্ছে। পাশাপাশি আইসিইউর রোগীদের আরও তিনটি পরীক্ষা একসঙ্গে ৬০০ টাকায় করা হচ্ছে। ইসিজির ব্যবস্থা আগে থেকেই ছিল। এর সঙ্গে এখন ট্রপোনিন আইও টেস্ট করা যাবে ৫০০ টাকায়।

রোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালের বাইরে এই পরীক্ষাগুলো করাতে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা নেওয়া হয়। ফলাফল পেতে সময় লাগে দীর্ঘক্ষণ। এতে গ্রাম থেকে আসা রোগীরা পড়তেন ব্যাপক ভোগান্তিতে। করোনা পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে অনেক রোগী পরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এখন সেখানে সিআরপি ডিডাইমার, সিরাপ ভ্যারিয়েন্ট, সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন রক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালে এক হাজার ৪০০ টাকার মধ্যেই করা যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন রোগীদের সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা কম লাগছে, তেমনি দ্রুত ফলাফলও পাওয়া যাচ্ছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এ অঞ্চলের মানুষের একমাত্র চিকিৎসাস্থল। ঢাকায় যেমন এক হাসপাতালে রোগী ভর্তি করতে না পারলে আরেক হাসপাতালে যায়, রাজশাহীতে তার সম্ভাবনা নেই। এজন্য আমরা কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দেই না। আবার রেফারাল হাসপাতাল হওয়ায় দূরের অনেক জেলার করোনা রোগীদেরও এই হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। তাদের পরিস্থিতি এতো খারাপ থাকে যে, আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। করোনা ইউনিটে বর্তমানে চিকিৎসাধীন বেশিরভাগ রোগী গ্রামের। তারা শেষ পর্যায়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। ফলে অনেক সময় তাদেরও বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, ভর্তি হওয়ার পরপরই মারা যাচ্ছে। চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না। এজন্য মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না। তারপরও আমরা আনওয়ান্টেড ডেথ কমানোর চেষ্টা করছি। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হাসপাতালের কর্মকর্তা, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, আয়া, সাধারণ ও সহায়ক শ্রমিকরা তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

দীর্ঘ সময় ধরে বিপুল সংখ্যক করোনায় আক্রান্তের চিকিৎসা নিশ্চিতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিরলসভাবে কাজ করছেন ৬৯৬ জনের করোনা প্রতিরোধ টিম। আর ক্লান্তিহীনভাবে টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন করোনাযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী। করোনা চিকিৎসায় দক্ষতা, মানবিকতা ও আন্তরিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ব্রিগেডিয়ার শামীম ইয়াজদানী রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের বিপুল প্রশংসা পেয়েছেন।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামিম ইয়াজদানীর নেতৃত্বে চিকিৎসক, নার্স এবং সকল সহকারীরা কোভিড-১৯ রোগীদের যেভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। যেভাবে রোগী বেড়েছে, তা যে কোন হাসপাতালের জন্য অনেক চেলেঞ্জিং। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেন তাদের মতো করে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা অব্যাহত রাখতে পারেন, তা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।’