কোমর তাঁতবস্ত্রের কদর বাড়ছে, স্বাবলম্বী হচ্ছেন পাহাড়ের নারীরা
কদর বাড়ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের তৈরি ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁতবস্ত্রের। রুচিশীল ও বৈচিত্র্যময় ডিজাইন, দেখতে সুন্দর, টেকসই, পড়তে আরামদায়ক হওয়ায় এবং বাণিজ্যিক সুবিধা থাকায় কোমর তাঁতবস্ত্র তৈরি বাড়ছে বান্দরবান জেলায়। পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকেরা পাহাড়ি নারীদের কোমর তাঁতে বুনা বিভিন্ন ধরনের কাপড় কিনে নিয়ে যান। এতে স্বাবলম্বী হচ্ছেন পাহাড়ের নারীরা।
কোমর তাঁতের কাপড় দিয়ে অনেকে তৈরি করছেন সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি, শার্ট, গায়ের শাল, বেডশিট, শোপিস, মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ, কুশনসহ হরেকরকম পণ্য। রং-রেরঙের কাপড়ে বিভিন্ন ধরনের কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হয় পোশাকে। এগুলো এখন পাহাড়িদের পাশাপাশি স্থানীয় বাঙালি এবং বেড়াতে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকেরাও কিনে নিচ্ছেন। এমনকি পাহাড়ে ভ্রমণে আসা বিদেশি পর্যটকরাও কিনে নেন তাঁতের পোশাক। পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের তৈরি এসব পোশাক বাঙালিসহ পর্যটকদের কাছে পরিচিত হচ্ছে উপজাতীয় পোশাক হিসেবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মধ্যে বম, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা, মুরুং, খেয়াং, খুমী, লুসাই ও মারমাসহ এগারোটি ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর নারীরা তাঁতের পোশাক তৈরিতে পারদর্শী। পাহাড়ে চাষ করা তুলা থেকে সুতা তৈরি করে কোমর তাঁতে কাপড় বুনে পাহাড়ি নারীরা। তাঁতে বুনা কাপড়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন ধরনের পোশাক। যা বর্তমানে প্রাধান্য পাচ্ছে দেশের তরুণ-তরুণীদের ফ্যাশনে। কোমর তাঁতে বুনা কাপড় বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন পাহাড়ের নারীরা।
লাইমী পাড়ার বাসিন্দা প্রীতি বম বলেন, ছোট্টবেলা থেকে মায়ের কাছে কোমর তাঁতে কাপড় বুনা শিখেছি। শুধু আমরা নয়, পাহাড়ের প্রতিটি নারীই কাপড় বুনতে পারদর্শী। সকলেই পরিবারের কাছ থেকেই শিখেছে কামর বুনার কাজ। কৃষি ও ঘরের কাজের ফাঁকে অবসর সময়ে পাহাড়ের নারীরা কাপড় বুনে পোশাক তৈরি করে। একটা সময় ছিল পাহাড়ের নারীরা শুধু নিজেদের জন্য কাপড় বুনতেন। কিন্তু এখন সংসারে আয় বাড়াতে উপার্জনের জন্যও কাপড় বুনছেন। কাপড় বিক্রি করে স্বচ্ছলতা এসেছে অনেক পরিবারে। অনেকের সংসার চলছে এখন তাঁতে বুনা কাপড় বিক্রি করে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী অ্যালেক্স বম বলেন, পাহাড়ের নারীদের তৈরি করা কোমর তাঁতের কাপড় পাহাড়ি গ্রামগুলো থেকে সংগ্রহ করে কাপড়ের ব্যবসা করি। নীলাচল পর্যটনস্পটে আমাদের একটি কাপড়ের দোকান রয়েছে। মূলত স্থানীয়ভাবে কোমর তাঁতের পোশাকে প্রধান ক্রেতা হচ্ছে পর্যটকেরা। কিন্তু নানা কারণে পর্যটকদের আনাগোনা কমে যাওয়ায় বিক্রিও একদম কমে গেছে। তবে জেলার বাইরে ঢাকায় পাইকারি দামেও কাপড় সরবরাহের কাজ করি।
জেলা কুটির শিল্প সংস্থার মতে, বান্দরবান জেলায় প্রায় বিশ হাজারের বেশি পাহাড়ি নারী কোমর তাঁতে কাপড় তৈরির (বুনার) সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। পাহাড়ি নারীরা কোমর তাঁতে তৈরি করছে, থামি (পরণের কাপড়), গামছা, কম্বল, রুমাল, গায়ের শাল, টুপি, ওড়না, বিছানা চাদরসহ বিভিন্ন রকমারি পোশাক। পাহাড়ি নারীদের তৈরি একটি কম্বল বুনতে সময় লাগে এক থেকে তিন দিন। জেলায় প্রতিটি ঘরে ঘরে পাহাড়ি নারীরা কোমর তাঁতে কাপড় বুনলেও বান্দরবান জেলায় এখনো পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি কোনো ধরনের বিসিক শিল্প কারখানা। শিল্প কারখানা গড়ে না ওঠায় বান্দরবানের তাঁতশিল্প অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারছে না বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। স্বল্পপুঁজিতে কোমর তাঁতে কাপড় বুনা সম্ভব বলে পাহাড়ি নারীরা কাজের ফাঁকে অবসর সময়ে কোমর তাঁতে কাপড় তৈরি করে সংসারে বাড়তি আয় বাড়াচ্ছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কোমর তাঁতশিল্প পাহাড়ি নারীদের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। পাহাড়ের তাঁতে বুনা এসব কাপড় রপ্তানি হচ্ছে মিয়ানমার-ভারতসহ বেশকিছু দেশেও। স্থায়ীভাবে বান্দরবানের অন্যতম দর্শনীয় স্থান শৈলপ্রপাত, নীলাচল, চিম্বুক পর্যটনস্পটে পাহাড়ি নারীরা নিজ উদ্যোগে অস্থায়ী বাজার গড়ে তুলেছেন। এছাড়াও স্থানীয় পর্যটন মার্কেটগুলোতেও বিক্রি হচ্ছে তাঁতের পোশাক। বেড়াতে আসা পর্যটকেরা হচ্ছে এসব কাপড়ের দোকানের প্রধান ক্রেতা।
বান্দরবানের বালাঘাটা তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টারের কর্মকর্তা মিল্টন আলী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, পাহাড়ের নব্বশ শতাংশ নারীই কোমর তাঁতে কাপড় বুনতে পারে। কোমর তাঁতে পারদর্শী ৬১০ জন নারীকে দুই কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে জনবল সংকটে কোমর তাঁতে সম্পৃক্তদের সঠিকভাবে সরকারি সেবা দিতে সমস্যা হচ্ছে।