ট্রিটমেন্টের অনুমোদন দিচ্ছেন না : অ্যাটর্নি জেনারেল

খালেদা জিয়ার হাত বেঁকে যাচ্ছে, মানবিক কারণে মুক্তি চাই : আইনজীবী

Looks like you've blocked notifications!
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ফাইল ছবি 

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ মেডিকেল রিপোর্ট চেয়েছেন হাইকোর্ট। এ রিপোর্ট আগামী বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে হাইকোর্টে দাখিল করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্যকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের জন্য খালেদা জিয়া সম্মতি দিয়েছেন কি না, সম্মতি দিলে চিকিৎসা শুরু হয়েছে কি না- তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। রিপোর্ট দাখিলের পরের দিন বৃহস্পতিবার এ মামলায় পরবর্তী আদেশ দেওয়া হবে।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় দণ্ডিত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ রোববার দুপুরে এ আদেশ দেন।

খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল।

অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, মমতাজ উদ্দিন ফকির ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।

দুপুর ২টা ১০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। শুনানির শুরুতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, এখানে আমাদের অনেক সিনিয়র আইনজীবী উপস্থিত রয়েছেন। আপনিও এর আগে এ মামলায় একটি আদেশ দিয়েছিলেন। এরপর আমরা আপিল বিভাগে গিয়েছি সেখানেও আপিল বিভাগ আদেশ দিয়েছেন।’

‘খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অনেক অসুস্থ, তাঁর ট্রিটমেন্ট দরকার। এ বিবেচনায় আমরা আবারও আপনার কাছে এসেছি। আপনি যদি আদেশ দেন তাহলে আমাদের কোনো বক্তব্য থাকে না। এরপরও বলছি, খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ। তাঁর উন্নত চিকিৎসা দরকার। আমরা আবেদনে দুটি যুক্তি তুলে ধরেছি। এ যুক্তিগুলো যদি দেখেন তাহলে আমাদের আর কোনো বক্তব্য থাকে না’, যোগ করেন জয়নুল আবেদীন।

এ সময় আদালত খালেদা জিয়ার আইনজীবীর কাছে জানতে চান, ‘বিএসএমএমইউ হাসপাতালে কি তাঁর ট্রিটমেন্ট হচ্ছে না?’

জবাবে আইনজীবী বলেন, ‘মাই লর্ড, এখানে ট্রিটমেন্ট হচ্ছে না। উন্নত চিকিৎসার দরকার। কী ট্রিটমেন্ট হচ্ছে তাও আমরা জানতে পারছি না।’  

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তাঁর বক্তব্য দেওয়ার জন্য দাঁড়ান। তিনি প্রথমেই এ মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট প্রদান প্রসঙ্গে আপিল বিভাগের আদেশটি পড়ে শোনান। একইসঙ্গে আপিল বিভাগে ওই সময়ে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের দেওয়া মেডিকেল রিপোর্টও পড়ে শোনান।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছিল- খালেদা জিয়ার বয়স ৭৪ বছর। তাঁর আর্থারাইটিসের সমস্যা রয়েছে। এজন্য বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত বায়োলোজিক্যাল থেরাপি রয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়া এ ট্রিটমেন্ট প্রয়োগের জন্য অনুমোদন দিচ্ছেন না। তিনি অনুমতি না দিলে কীভাবে ট্রিটমেন্ট দেবে?’

‘ট্রিটমেন্টের জন্য তো আপিল বিভাগ আদেশ দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো, উনারা ট্রিটমেন্ট নিবেন কি না। একদিকে ট্রিটমেন্টের অনুমতি দিবেন না, অপরদিকে জামিনের আবেদন করেন’, যোগ করেন মাহবুবে আলম।

জবাবে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আপিল বিভাগে আমাদের আবেদন খারিজ হয়েছে। কিন্তু আমাদের তো আদালতের কাছেই আসতে হবে। আমাদের তো যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। খালেদা জিয়া অনেক বেশি অসুস্থ। মানবিক কারণে আমরা জামিন চাই।’

এ সময় খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ব্রিফিংয়ের একটি প্রতিবেদন জয়নুল আবেদীন আদালতে পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বাম হাত বেঁকে যাচ্ছে। আমাদের আপনাদের কাছে ছাড়া যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।’

জবাবে আদালত বলেন, ‘খালেদা জিয়া চিকিৎসা দেওয়ার জন্য অনুমতি দিয়েছেন কি না?’

অনুমতি দিয়েছেন বলে জানান জয়নুল আবেদীন। তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু এখানে অ্যাডভ্যান্স ট্রিটমেন্ট হচ্ছে না।’

আদালত আবারও বলেন, ‘উনি (খালেদা জিয়া) ট্রিটমেন্টের অনুমতি দিয়েছেন কি না?’

তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবী আদালতকে বলেন, ‘আপনি এ বিষয়ে মেডিকেল বোর্ডকে আদেশ দিতে পারেন। বর্তমানে উনার কী অবস্থা আমরা তা জানতে পারছি না।’

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘রিপোর্ট তো রয়েছে। তাহলে নতুন করে রিপোর্টের দরকার কী?’

তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘এটা তো দুই মাস আগের রিপোর্ট। উনি আগের তুলনায় অনেক বেশি অসুস্থ। নতুন করে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন।’

পরে আদালত বাংলায় আদেশ দেন। আদেশে আদালত বলেন, ‘সম্প্রতি আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসা (অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট) দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে। এ বিষয়ে খালেদা জিয়া সম্মতি দিয়েছেন কি না, দিলে চিকিৎসা শুরু হয়েছে কি না, চিকিৎসা শুরু হলে খালেদা জিয়ার শরীরের সর্বশেষ অবস্থা আগামী বুধবার বিকেলে মধ্যে হাইকোর্টকে জানাতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্যকে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে এ রিপোর্ট দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

খালেদা জিয়ার মামলাটি হাইকোর্টের এই বেঞ্চের কার্য‌তালিকায় আজ এক নম্বরে রাখা ছিল। সকালে আদালতের বিচারকাজ শুরুর পর এ মামলা শুনানির জন্য তালিকায় এলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল এ মামলায় শুনানি করবেন। তিনি এখন অন্য মামলায় ব্যস্ত আছেন। এ জন্য দুপুর ১টা পর্য‌ন্ত সময় প্রয়োজন।’

তখন আদালত বলেন, ‘এটা দুপুর ২টায় হবে।’

এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের পক্ষে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাতে সায় দিয়ে বলেন, ‘এটা আদালতের বিষয়। আমাদের সমস্যা নেই।’

দুপুর ২টার পর জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হয়।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জামিন আবেদনটি উপস্থাপনের পর আদালত আজকের দিন ধার্য করেছিলেন। এর আগের দিন অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারি এই আবেদনটি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেওয়া হয়।

এর আগে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর এ মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন পর্যবেক্ষণসহ খারিজ করে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। তবে আবেদনকারী (খালেদা জিয়া) যদি সম্মতি দেন, তাহলে বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী তাঁর অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পেয়ে বন্দি রয়েছেন খালেদা জিয়া। আপিলের পর হাইকোর্টে যা বেড়ে ১০ বছর সাজা হয়। বর্তমানে তিনি কারা হেফাজতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন।

পরে ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর খালাস চেয়ে আপিল বিভাগে খালেদা জিয়া জামিন আবেদন করেন। তবে সেই আবেদন এখনো আদালতে উপস্থাপন করেননি তাঁর আইনজীবীরা।

২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের ৭ নম্বর কক্ষে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৫-এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান (বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি) জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন। একই সঙ্গে তাঁকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। একই সাজা হয়েছে মামলার অপর তিন আসামিরও।

দণ্ডাদেশ পাওয়া অপর তিন আসামি হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।

এরপর ওই বছরের ১৮ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এর বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। পরে গত বছরের ৩০ এপ্রিল জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের দণ্ডের বিরুদ্ধে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে অর্থদণ্ড স্থগিত ও সম্পত্তি জব্দ করার ওপর স্থিতাবস্থা দিয়ে দুই মাসের মধ্যে ওই মামলার নথি তলব করেছিলেন।

এরপর গত ২০ জুন বিচারিক আদালত থেকে মামলার নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। পরে ৩১ জুলাই বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ তাঁর জামিন আবেদন খারিজ করে দেন।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে জামিন চান খালেদা জিয়া। এ আবেদনের শুনানির পর ১২ ডিসেম্বর সেটি খারিজ হয়ে যায়।

২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা করা হয়। ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

তদন্ত শেষে ২০১২ সালে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদাসহ চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম শেষ হলে দুদকের পক্ষে এই মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণা করা হয়।