গঠনতন্ত্র না মেনেই অব্যাহতি, অভিযোগ ছাত্রলীগ নেতাদের

Looks like you've blocked notifications!

অনিয়ম আর শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ এনে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি সংগঠন থেকে যে ৩২ জনকে অব্যাহতি দিয়েছে তাদের মধ্যে ২১ জন নেতা অভিযোগ করেছেন, তাদের কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ (শোকজ) না দিয়েই ‘একতরফাভাবে’ অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে; যা গঠনতন্ত্রের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন।

সংগঠনের পদ থেকে শোভন-রব্বানীকে অব্যাহতি দেওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য গত ১৭ ডিসেম্বর সংগঠন থেকে ৩২ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর মধ্যে ১১ জন নিজেরাই সংগঠন থেকে অব্যাহতি চেয়ে চিঠি দেন। ফলে এই অব্যাহতি নিয়ে তাদের নিজেদের আর কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু বাকি ২২ জন কেন্দ্রীয় কমিটির বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র না মেনে অব্যাহতি দেওয়ার অভিযোগ আনেন।

তবে এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

অব্যাহতি পাওয়া ছাত্রনেতারা বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার কাছেও অভিযোগ করেছেন। তাদের মধ্যে অন্তত দুজনের সঙ্গে কথা বলেছে এনটিভি অনলাইন। দুই নেতাই বিষয়টি অবগত বলে জানিয়েছেন।  

এর মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক আজ বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমরা তাদের (জয়-লেখক) কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইব। তাঁরা শোকজ (কারণ দর্শানোর নোটিশ) ছাড়া এটা কীভাবে করেছেন।’

ছাত্রলীগের আরেক সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা আবদুর রহমান আজ বৃহস্পতিবার বলেন, ‘বিষয়টি আমরা খুব সিরিয়াসলি দেখছি। খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ 

ছাত্রলীগের নেতারা জানান, সংগঠনের ‘সাংগঠনিক নেত্রী’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গোলাম রাব্বানীর নাম ঘোষণা করেন। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রায় নয় মাস পর ২০১৯ সালের ১৩ মে সংগঠনের ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা দেন।

এই কমিটি ঘোষণা দেওয়ার পর পরই ছাত্রলীগ নেতৃত্ব পদবঞ্চিত নেতাদের তোপের মুখে পড়েন। তাঁরা ছাত্রলীগ নেতৃত্বে বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, বিবাহিত এ রকম নানা অভিযোগ এনে আন্দোলনে নামেন। এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটে।

একপর্যায়ে পদবঞ্চিতরা শোভন-রাব্বানীর নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ৯১ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলনও করেন। দীর্ঘ ৩৩ দিন ধরে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন। পরে ২৮ জুলাই থেকে টানা তিন দিন আমরণ অনশন করেন পদবঞ্চিতরা।

এর মধ্যে পদবঞ্চিতদের অভিযোগ আমলে নিয়ে শোভন-রাব্বানী নেতৃত্বাধীন কমিটি ১৫ মে কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিভিন্ন অনিয়মে জড়িত আছেন এমন ১৭ ‘বিতর্কিত নেতার’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কথা জানায়। তবে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা ১৬ জনের নাম ঘোষণা করেন। এবং জানান, এদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করা হবে।

এর কিছুদিন পর গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন অনিয়মের কারণে সংগঠন থেকে শোভন আর রাব্বানীকেই অব্যাহতি দেওয়া হয়। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান আল নাহিয়ান খান জয় এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন লেখক ভট্টাচার্য।

এই নেতৃত্ব সম্মেলন হয়ে থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ শাখার কমিটি দেওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা তা দিতে পারেননি। এ ছাড়া সারা দেশে প্রায় ১২০টির মতো কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও সেসব শাখার সম্মেলন করার ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগ নেননি বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগের নেতারা। বরং এই সময়ের মধ্যে ছাত্রলীগ নেতাদের পিটুনিতে বুয়েটে আবরার হত্যার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে, ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর ক্যাম্পাসে বারবার ক্ষমতাসীনদের এই ছাত্রসংগঠনের হাতে হামলার শিকার হয়েছেন। 

এই অবস্থার মধ্যে গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে নেতাদের আচার-আচরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি ঢাকায় যেসব ইউনিটের সম্মেলন শেষ হয়েছে সেসব শাখায় দ্রুত কমিটি দেওয়ারও নির্দেশ দেন।  

জয়-লেখক দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের মাথায় গত ১৭ ডিসেম্বর রাতে হঠাৎ করে গণমাধ্যমে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান। তাতে বলা হয়, অনিয়মের অভিযোগে ২১ জন আর নিজস্ব আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১১ জনকে ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

অব্যাহতি পাওয়া এই ২১ নেতার অভিযোগ, গঠনতন্ত্র অনুসরণ না করেই ছাত্রলীগ থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অব্যাহতি পাওয়া একাধিক নেতা গতকাল বুধবার ও আজ বৃহস্পতিবার এনটিভি অনলাইকে বলেন, তাঁরা গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে বিষয়টি অবহিত করেন।

ওবায়দুল কাদের তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে দেখার জন্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবীর নানক এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিমকে দায়িত্ব দেন। পরে অব্যাহতি পাওয়া ছাত্রনেতারা আওয়ামী লীগের তিন নেতারা কাছেই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাদের বহিষ্কারের ব্যাপারে প্রতিকার চান।

এ সময় সেখানে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সহসভাপতি তানজিল ভূঁইয়া তানভীর, আরেফিন সিদ্দিক সুজন, শাহরিয়ার কবির বিদ্যুৎ, সাদিক খান, রাকিব উদ্দিন, ইসমাইল হোসেন তপু, দপ্তর সম্পাদক আহসান হাবীব, উপদপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আব্দুল্লাহ বিন মুন্সী প্রমুখ নেতা উপস্থিত ছিলেন।

তবে অব্যাহতি পাওয়া সহসভাপতি বরকত হোসেন হাওলাদার ও সোহেল রানা, উপসাংস্কৃতিক সম্পাদক বি এম লিপি আক্তার, সহসম্পাদক রনি চৌধুরী ও সামিয়া সরকারসহ ছয়-সাতজন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে যাননি।

এ ব্যাপারে অব্যাহতি পাওয়া সহসভাপতি শাহরিয়ার কবির বিদ্যুৎ আজ বৃহস্পতিবার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়ে, মতামত না নিয়ে শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আমাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এটা ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে গিয়েছি। তাঁরা পরে এ বিষয়ে বিবেচনা করা হবে বলে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। অনতিবিলম্বে বিষয়টির সুরাহা না হলে আমরা আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে আবার যাব।’

অব্যাহতিপ্রাপ্ত উপদপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আব্দুল্লাহ বিন মুন্সী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের গঠনতান্ত্রিক কিছু নিয়ম রয়েছে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠাতে হয় এবং অভিযোগের বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হয়। অভিযোগের সত্যতা পেলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অথচ, অব্যাহতির বিষয়ে আমরা আগে থেকে কিছুই জানতাম না। জরুরি সভায় এ বিষয়ে কোনো রেজুলেশন বা এজেন্ডা ছিল না।’

‘আমাদের কাউকেই চিঠি পাঠানো হয়নি বা ডেকে নিয়ে এই বিষয়ে কিছুই জানতে চাওয়া হয়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয় ভাইয়ের কাছে গেলে তিনি বলেন, আমাদের কিছুই করার ছিল না। এই লিস্ট আমাদের উপর থেকে দেওয়া হয়েছে’, যোগ করেন মাহমুদ আব্দুল্লাহ।