চাকরি নেই, অর্থ সংকটে তারা রাজধানী ছাড়ছেন
মাহবুবুর রহমান এআর লিংক নামের একটি ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসের সাব-এজেন্ট। তিনি মূলত গার্মেন্ট সামগ্রী দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিতেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের শুরু থেকেই কাজ কমতে থাকে প্রতিষ্ঠানটির। এখন একেবারে কাজ এবং আয় দুটোই বন্ধ রয়েছে মাহবুবের।
আর্থিক সংকটের কারণে মাহবুবুর রহমান তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছেন। ছেড়ে দিয়েছেন বাসা। এখন তিনি রাজধানীর মতিরঝিলের একটি মেসে উঠেছেন।
আক্ষেপ করতে করতে মাহবুব বলছিলেন, ‘ছেলে-মেয়ে ঢাকার স্কুলে পড়লেও বাড়িতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছি। বাসা ভাড়াসহ ছেলে-মেয়েদের খরচ চালাতে পারছিলাম না। তাই পাঠিয়ে দিযেছি। আমি একটি মেসে উঠেছি। পরিস্থিতি ভালো হলে তাঁদেরকে আবার নিয়ে আসব।’
মাজিদুল ইসলাম (৩৭) ঢাকার একটি বায়িং হাউজে চাকরি করতেন। কিন্তু করোনা এসে তাঁর জীবনের সবকিছু পাল্টে দিয়ে গেল। গত ১৮ এপ্রিল মাজিদুলকে তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে বলে দেওয়া হয়, ‘আপনি অন্য কোথাও চাকরি খুঁজে নেন।’
এরপর কোনো উপায় না দেখে মাজিদুল স্ত্রীকে নিয়ে থাকা সাবলেট বাসাটি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যান। গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে চলাচল, বাজারে যাওয়া সব করেছিলেন তিনি। একপর্যায়ে তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। পরে তার বাড়ির পাশের আরো দুজন করোনায় আক্রান্ত হন।
রাফিয়া খানম চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। গত মে মাসের ১ তারিখে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তিনি তাঁর এক মেয়ে সুফিয়া খানমকে সঙ্গে নিয়ে থাকতেন রাজধানীর কলাবাগানে। সুফিয়া সিটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। মায়ের চাকরি চলে যাওয়ায় আর বাসা ভাড়া দিতে পারছিলেন না। তাই বাসা ছেড়ে দিয়ে চলতি মাসের ২৫ তারিখে তিনি গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরাতে চলে গেছেন।
কথা প্রসঙ্গে আক্ষেপ করতে করতে রাফিয়া খানম বলছিলেন, ‘মেয়ের বাবা বেঁচে নেই। কত সখ ছিল মেয়েকে অনেক লেখাপড়া শেখাবো। কিন্তু চাকরি চলে যাওয়ায় বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে আসছি। এখন আমার মেয়ের কী হবে? আমি কিছুই ভাবতে পারছি না। আমার কোনো জমানো টাকা নেই যে, মেয়েকে সেই টাকা দিয়ে পড়াব। মেয়ের কথা ভেবে কষ্টে বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে আমার।’
শুধু মাহবুব, মাজিদুল বা রাফিয়া নয়; রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া এমন অন্তত ১০ জন ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এদের ভেতরে আরেকজন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘টাকা দিতে পারছিলাম না বলে বাড়িওয়ালা একদিন খারাপ ব্যবহার করেছিল খুব। তারপরের দিনই রাগে-ক্ষোভে আর কষ্টে বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলাম। স্ত্রীকে গ্রামে পাঠিয়ে দিযেছি। এখন আমি একটি মেসে উঠেছি।’
এ ব্যাপারে ভাড়াটিয়া পরিষদ নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার ধারণা, ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ এই করোনাকালে বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। এদের কেউ চাকরি হারিয়েছেন। কেউ নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না। টাকা না থাকলে বাসা ভাড়া দেবেন কীভাবে? এই পরিস্থিতি আরো অনেকদিন চলবে বলে সবাই ধারণা করছেন। সুতরাং এই সংকট আরো বাড়বে। সেজন্য সরকারকেই এই ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।’
বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্মারকলিপি দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম, ভাড়াটিয়াদের তিন মাসের বাড়িভাড়া মওকুব করার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে। এ ছাড়া বিদ্যুত বিল, গ্যাস বিল, পানি বিল এবং ট্যাক্স মওকুব করার কথা জানিয়েও ওই স্মারকলিপিতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু কেউ আমার কথা শোনেনি। আমি ভাবছি, আগামী সোমবার হাইকোর্টে যাব। গিয়ে বাসা ভাড়া মওকুবসহ বাকি দাবিগুলো জানিয়ে একটি রিট আবেদন করবো।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না এই পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। মানুষ টাকা আয় করতে না পারলে বাসা ছেড়ে দেবে সেটাই স্বাভাবিক। এখন দেখার বিষয় চাকরিচ্যুতদের জন্য সরকার কী ব্যবস্থা নেয়। তবে চাকরিচ্যুতির সংখ্যা আরো বাড়বে। তখন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে বলে আমার মনে হচ্ছে। অন্তত দুই কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি আসতে পারে।’