চিরনিদ্রায় মোস্তফা কামাল সৈয়দ
গণমাধ্যম, বিনোদনসহ বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষকে কাঁদিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান, বহুমুখী প্রতিভায় ভাস্বর মোস্তফা কামাল সৈয়দ চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আজ রোববার সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিটে তাঁর জানাজা হয়। এরপর ৬টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়। এ সময় তাঁর সহকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে আজ দুপুর দেড়টায় মোস্তফা কামাল সৈয়দ রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এ খবর প্রকাশের পর বিভিন্ন অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোক নামে এনটিভি পরিবারে। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষ। কর্মচঞ্চল এ মানুষটির মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউ।
স্বনামধন্য টিভি প্রযোজক, নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা, আবৃত্তিকার ও পরিচালক হিসেবেও পরিচিতি ছিল মোস্তফা কামাল সৈয়দের। বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) উপমহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি স্ত্রীসহ এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। তাঁর স্ত্রী কণ্ঠশিল্পী জিনাত রেহেনা।
মোস্তফা কামাল সৈয়দের মৃত্যুর খবরে এনটিভির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘জীবন-মৃত্যু মহান আল্লাহ তায়ালার হাতে। তবুও আমরা তাঁর সুস্থতা ও সুচিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। পাশাপাশি আল্লাহর করুণা লাভের আশায় ১৮টি মসজিদে কোরআন খতম করিয়েছিলাম।’
এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক আলফ্রেড খোকন বলেন, ‘প্রধান মোস্তফা কামালের মৃত্যুতে আমরা ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছি। এ খবর মেনে নেওয়ার মতো নয়। এনটিভি পরিবার মৃতের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।’
আলফ্রেড খোকন জানান, গত ১১ মে মোস্তফা কামাল সৈয়দ অসুস্থ হলে তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। আজ দুপুরে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
পর্দার পেছনের মানুষ হলেও মিডিয়া জগতে সজ্জন ও বিনয়ী মানুষ হিসেবে পরিচিত মোস্তফা কামাল সৈয়দের কণ্ঠ বাংলাদেশের দর্শকের কাছে খুব চেনা। আশি দশকের শুরুতে বিটিভির নাটকের শুরুতে সূচনা সংগীতের পাশাপাশি ভূমিকা কিংবা পুরো নাটকের সারমর্ম সূচনাপর্বে নেপথ্য কণ্ঠে ভেসে আসত। অনেক সময় নাটকের শেষে নেপথ্যে থেকে কিছু না বলা কথা প্রচার হতো। সে সময়ের বেশির ভাগ নাটকের ভূমিকায় কিংবা উপসংহারে শোনা যেত মোস্তফা কামাল সৈয়দের কণ্ঠ।
মোস্তফা কামাল সৈয়দের প্রযোজনায় বেশ কিছু নাটক দর্শকের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। সত্তর দশকের শেষের দিকে তাঁর প্রযোজনায় মমতাজউদদীন আহমদ লেখা ‘প্রজাপতি মন’, আশি দশকের শুরুতে আন্তন চেখবের গল্প অবলম্বনে মমতাজউদদীন আহমদের লেখা ‘স্বপ্ন বিলাস’ ছাড়াও ‘নিলয় না জানি’, ‘বন্ধু আমার’, ‘নীরবে নিঃশব্দে’, কাজী আব্দুল ওয়াদুদের লেখা ‘নদীবক্ষে’ উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘কুল নাই কিনার নাই’ ইত্যাদি সফল নাটকের সফল প্রযোজক ছিলেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ।
মোস্তফা কামাল সৈয়দের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে নাট্যনির্মাতাদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড। আজ দুপুর সাড়ের ৩টার দিকে ডিরেক্টরস গিল্ডের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে শোকবার্তা প্রকাশ করা হয়। শোকবার্তায় লেখা হয়, ‘টেলিভিশন নাটকের দর্শকরুচি তৈরিতে তাঁর অসামান্য ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিটিভির সেই সময়ে তাঁর প্রযোজিত নাটক দারুণ সাড়া ফেলেছিল। কুল নাই, কিনার নাই তার মধ্যে অগ্রগণ্য। এনটিভির দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের নাটক জনপ্রিয় করার নেপথ্য নায়ক ছিলেন তিনি। গল্প ভাবনা, নির্মাণ কৌশল সম্পর্কে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে নবীন-প্রবীণ সবার সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করে জনপ্রিয় সব নাটক উপহার দেন। সে কারণে এনটিভির নাটক দর্শকহৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে নেয়। তাঁর নির্মোহ দূরদৃষ্টি সমাজ এবং পরিবারের প্রতি ইতিবাচক ভাবনার সার্থক প্রয়োগ ঘটান এনটিভির নাটকে।’
মোস্তফা কামাল সৈয়দের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে আরো বলা হয়, ‘টেলিভিশন মাধ্যমের ১৫টি সংগঠন (আন্তঃসংগঠন) এই নিবেদিত প্রাণ নির্লোভ মহামানবের প্রয়াণে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। একই সাথে তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবার এবং তাঁর সব সহকর্মীর প্রতিও গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।’
মোস্তফা কামাল সৈয়দের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীসহ অনেকেই। জনপ্রিয় নাট্যনির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী নিজের ফেসবুক হ্যান্ডেলে লেখেন, ‘আঙ্কেল, সারাজীবন বলেছেন পজিটিভ নাটক বানাতে। আজ আপনি আমাদের সব নেগেটিভ করে দিয়ে চলে গেলেন! সারাজীবন বলেছেন, আপনার আল্লাহ আছেন, আপনি নামাজ পড়েন, আপনার কিচ্ছু হবে না; আঙ্কেল, আমাদের অভিভাবক আপনি, আপনি পিতাসম! কোথায় চলে গেলেন আমাদের একা করে দিয়ে! যেখানেই যান, আপনি আমাদের হৃদয়ে থাকবেন।’
নির্মাতা মোস্তফা কামাল রাজ ফেসবুকে লেখেন, ‘মেনে নেওয়া কষ্টকর কামাল ভাই! এইভাবে যেতে পারেন না আপনি। আমাদের আর কোনো অভিভাবক থাকল না।’
অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনা ফেসবুকে লেখেন, ‘মিডিয়াতে ভালো কাজের সাথে সাথে কত কিছুই করতে হয়, ভালো ব্যবহার, যোগাযোগ, বন্ধুত্ব, তেল দেওয়া এবং নেওয়া। তবে এই মানুষটির সাথে আমার কোনো পরিচয় ছিল না ব্যক্তিগতভাবে, তবুও এত এত বার ডিরেক্টরদের তিনি আমাকে নিতে বলেছেন, সবার কাছে আমার অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন, অনেক সময় (ডিরেক্টরের কাছ থেকে শোনা) জোরও করেছেন ভাবনাকে এই চরিত্রে নিতে হবে। আমাকে নিয়ে জোর করার মতো মানুষ নেই বললেই চলে, ঘুমন্ত শহরে আমার শেষ ধারাবাহিক নাটক এই করোনাকালের আগে, ডিরেক্টর রাজু ভাই আমাকে প্রতি লটে বলতেন ভাবনা, কামাল ভাই অভিনয়ের খুব প্রশংসা করছে। আমি অনেক উৎসাহ পেতাম, এই মানুষটা আমাকে অনেক সুন্দর সুন্দর চরিত্র উপহার দিয়েছেন। খুব ইচ্ছা ছিল একদিন গিয়ে তাকে প্রাণভরে ধন্যবাদ দেব, তা আর হলো না, আমার অভিনয়জীবনে আপনার ভূমিকা কখনো ভুলব না। আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালো রাখুক এই দোয়া করি। সুন্দর মননে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন বটে, তবুও আমাদের মনে আপনি থাকবেন চিরকাল।’
নির্মাতা আনিমেষ আইচ ফেসবুকে লেখেন, ‘এনটিভির হাত ধরে আমার পথচলা শুরু, সেখানে নাটকবিষয়ক নানান পরামর্শ দিয়ে তিনি সর্বদাই আমাকে ঋণী করে রেখেছেন। তাঁর সূক্ষ্ম রুচিবোধের বহিঃপ্রকাশ আপনারা দেখতে পেতেন এনটিভির পর্দায়। এই করোনা মহামারি আরম্ভ হওয়ার কয়েকদিন আগেও কত পুরোনো স্মৃতিচারণ করে এলাম তাঁর সঙ্গে। আমাকে বড় স্নেহ করতেন তিনি, আর আমি পিতার মতোই ভালোবাসতাম তাঁকে। কত শত স্মৃতি এই ভদ্রলোকের সঙ্গে, তা বলে শেষ করা যাবে না। এই করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পরেও নিয়মিত অফিসে যেতেন, তিনি তাঁর কর্মনিষ্ঠা দিয়ে সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। এমনই দুঃসময় যে তাঁকে অন্তিম বিদায়ে হয়তো কেউই উপস্থিত থাকতে পারব না। বিদায় কামাল ভাই, ওপারে দেখা হবে।’
অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা ফেসবুকে লেখেন, ‘বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তি! আজকে উনি চলে গেলেন! মোস্তফা কামাল সৈয়দ আমাদের দেশের টেলিভিশনের একজন দিকপাল! বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং এনটিভির অনুষ্ঠান প্রধান হিসাবে তিনি কেবল অগণিত শিল্পী এবং পরিচালকের বিকাশে সাহায্য করেছেন তা না, আমাদের রুচি তৈরিতেও বিশাল ভূমিকা রেখেছেন! আল্লাহ তাঁর বেহেস্ত নসিব করুন!’
মোস্তফা কামাল সৈয়দ কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন টিভি চ্যানেলে। ২০০৩ সালে এনটিভির শুরু থেকে তিনি অনুষ্ঠান বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। এর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠানপ্রধান ছিলেন। ৫২ বছরের কর্মজীবনে তিনি পাকিস্তান টিভিতেও শীর্ষ পর্যায়ে কাজ করেছেন।