টক শো থেকে কাদামাটিতে, হাতে হাতকড়া
টক শো ব্যক্তিত্ব তিনি। বেশ কয়েকটি টেলিভিশনের টক শো অনুষ্ঠানের নিয়মিত মুখ ছিলেন তিনি। টক শোতে দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্য দিয়ে কাঁপিয়ে ফেলতেন।
বলছিলাম করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম প্রসঙ্গে।
গত ৬ জুলাই। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) নমুনা পরীক্ষা না করে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়াসহ নানা অভিযোগে মো. সাহেদের মালিকানাধীন রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালের দুই শাখায় অভিযান চালান র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই রাতেই আটক করা হয় আটজনকে। তাদের কাছ থেকে একে একে বেরিয়ে আসে সাহেদের প্রতারণার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
তবে এত দিন সাহেদ ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাহেদকে গ্রেপ্তার নিয়ে শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৌড়ঝাঁপ।
এরপর ৭ জুলাই রাজধানীর উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেন্ট গ্রুপের মূল কার্যালয় সিলগালা করে দেওয়া হয়। ওই রাতেই সাহেদসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি প্রতারণার মামলা দায়ের করে র্যাব। পরদিন, অর্থাৎ ৮ জুলাই রিজেন্টের মিরপুর শাখাও সিলগালা করে দেওয়া হয়।
রিজেন্ট হাসপাতালের নানামুখী প্রতারণার খবর প্রকাশ হওয়ার পর সব মহল থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, সাহেদকে কেন গ্রেপ্তার করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রশ্ন ওঠে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সখ্য থাকায় তাঁকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে কি না। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সাহেদের সখ্যের খবরের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। এর পর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, সাহেদকে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি বৈধ অথবা অবৈধপথে দেশত্যাগ করতে পারবেন না। কারণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাঁর দিকে সতর্ক নজর রেখেছে।
সাহেদকে গ্রেপ্তারের আলোচনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই, অর্থাৎ ১০ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যকেও ছাড় দেননি। দলীয় নেতাদেরও তিনি ছাড় দিচ্ছেন না। যার (সাহেদ) কথা আপনারা বলছেন, তিনি যত বড় ক্ষমতাবানই হোক না কেন, যদি অপরাধ প্রমাণিত হয় তাহলে তাঁকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ এর পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলতে থাকেন, সাহেদকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলতে থাকবে। সারা দেশের সব সীমান্তে নজর রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এভাবে সাহেদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে আরো ধোঁয়াশা তৈরি হলে ১৩ জুলাই সিলেট বিভাগে তিনি অবস্থান করছেন এবং সিলেট বিভাগের যেকোনো সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন, এমন আশঙ্কায় তৎপরতা শুরু করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সেদিন সিলেট নগরীর পাঠানপাড়ায় অবস্থিত সাহেদের শ্বশুরবাড়িতেও নজরদারি করছিল তারা। এই ব্যাপারে মৌলভীবাজার জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ফারুক আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা শুনেছি মো. সাহেদ মৌলভীবাজারে পালিয়ে রয়েছেন। যেকোনো সময় তিনি সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যেতে পারেন। সে জন্য পুরো জেলার পাঁচটি থানার সীমান্তে আমরা সতর্ক রয়েছি।’ কিন্তু সাহেদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে কোনো তথ্য মেলেনি সেদিন।
গতকাল মঙ্গলবার সাহেদের ব্যাপারে কথা হয় র্যাবের সাতক্ষীরা কোম্পানি কমান্ডার বজলুর রশীদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা সাতক্ষীরার সব সীমান্তে নজর রাখছি, যাতে করে সাহেদ পালিয়ে ভারতে চলে যেতে না পারে। র্যাব সদর দপ্তর থেকে আমাদের ওপর তেমন নির্দেশনা আছে। আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে, সাহেদ সীমান্ত দিয়ে পালাতে পারেন। যাতে কোনোভাবেই দেশ ত্যাগ করতে না পারে, সে জন্য আমরা আমাদের টহল জোরদার করেছি।’
অবশেষে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে র্যাব সদর দপ্তর থেকে গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান সারওয়ার বিন কাসেমসহ অন্যান্য সদস্য হেলিকপ্টারে করে চলে যান সাতক্ষীরার দেবহাটার উপজেলার সীমান্তে। সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ওই উপজেলায় রাতভর অভিযান পরিচালনা করে র্যাব। অভিযান পরিচালনার মধ্যে র্যাব জানতে পারে, সাহেদ সীমান্ত দিয়ে নৌকায় করে ভারতে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন।
র্যাবের অভিযানকালে আজ বুধবার ভোর ৫টার দিকে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর সীমান্ত এলাকার বেইলি ব্রিজের নদীতে যান র্যাব সদস্যরা। ভোর ৫টা ১০ মিনিটের দিকে র্যাব সদস্যরা দেখতে পান, কোমরপুরের ইছামতি খালের পাশে ভারতীয় সীমান্ত পার হবেন রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। যারা সীমান্ত পারাপারের কাজ করে, তারা সব প্রস্তুত রেখেছিল। বাচ্চু মাঝি বা বাচ্চু দালালের নৌকায় সাহেদকে ভারতে পার করে দেওয়ার কথা ছিল।
এ সময় সাহেদ জিন্সের প্যান্ট ও নীল রঙের শার্টের ওপর কালো রঙের বোরকা পরে ছিলেন। সে সময় পিস্তল ও তিনটি গুলিসহ র্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় র্যাব সদস্যদের সঙ্গে সাহেদের ধস্তাধস্তি হয়। এতে সাহেদের বোরকা ও শার্টে কাদা লেগে যায়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক আশিক বিল্লাহ এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারের পর সাহেদকে আজ সকাল ৯টার সময় হেলিকপ্টারযোগে ঢাকার তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে সাহেদকে নিয়ে যাওয়া হয় র্যাব সদর দপ্তরে। তারপর তাঁকে নিয়ে উত্তরার রিজেন্ট গ্রুপের দ্বিতীয় অফিসে অভিযানে যায় র্যাব। অভিযান শেষে পুনরায় সাহেদকে নিয়ে যাওয়া হয় সদর দপ্তরে।
জানতে চাইলে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক সারওয়ার বিন কাসেম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মো. সাহেদ চেয়েছিলেন বোরকা পরে লোকচক্ষুর আড়ালে অবৈধপথে ভারতে পাড়ি জমাতে। কিন্তু তিনি পালাতে পারেননি। কারণ, র্যাব তাঁর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল নয় দিন ধরে। আজ ভোরেই সাহেদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে র্যাব যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করে, পালানোর জন্য তখন তিনি র্যাব সদস্যদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিও করেন। এ কারণে সাহেদের বোরকা ও প্যান্টে কাদা লেগে যায়।’
সারওয়ার বিন কাসেম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে মো. সাহেদ গোপনে দেশ ত্যাগ করার উদ্দেশে দেবহাটা সীমান্তের জিরো পয়েন্টে যান। কিন্তু তিনি দেশত্যাগ করতে পারেননি। কয়েক দিন ধরেই মো. সাহেদ অবৈধপথে দেশত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারতের প্রতিটি সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ দৃষ্টি ছিল। এই ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছিলেন সাহেদ। আর সে কারণেই তিনি বিভিন্ন সময় স্থান বদল করছিলেন। স্থান বদল করতে করতে নানা সময় তাঁর আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু আত্মীয়রা তাঁকে থাকতে দেননি ভয়ে। তাঁকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। তা ছাড়া সামাজিকভাবেও সাহেদকে এখন ভালো চোখে দেখা হচ্ছে না।’