ট্রাংকের মধ্যে তরুণীর লাশ, ছয় বছর পর ধরা পড়ল আসামি
ঘটনাটি ২০১৫ সালের। রাজধানী গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম থেকে আসা একটি বাসের ট্রাংক থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ছয় বছর পর সেই লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল শুক্রবার রেজাউল করিম স্বপন নামের একজনকে কুমিল্লার ইপিজেড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আজ শনিবার পিবিআইয়ের প্রধান ও উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার রাজধানী ধানমন্ডির প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পিবিআইকে মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয়। তদন্তে নেমে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অজ্ঞাত তরুণীর পরিচয় শনাক্ত করে পিবিআই। গ্রেপ্তারকৃত রেজাউল করিম স্বপনও হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
লাশ উদ্ধার যেভাবে
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহণের একটি বাসের ট্রাংকে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর লাশ পাওয়া যায়। ২০১৫ সালের ৩ মে সকাল ৯টার দিকে চট্টগ্রামের এ কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহণের কাউন্টারে টিকেট কেটে একজন ব্যক্তি একটি ট্রাংক তুলে দেন বাসের বক্সে। বাসের হেলপারকে বলেন সামনের ভাটিয়ারী কাউন্টার থেকে ওই টিকেটের যাত্রী উঠবে। কিন্তু পরবর্তী কাউন্টারে বর্ণিত যাত্রী না উঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় এবং বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে গাবতলীতে পৌঁছায়। শেষ গন্তব্যে সব যাত্রী যে যার মতো তাদের জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যায়। পরবর্তীতে হেলপার দেখেন একটি ট্রাংক বাসের বক্সে মালিকবিহীন পড়ে আছে। তখন বাসের ড্রাইভার হেলপার মিলে ট্রাংকটি নামিয়ে দেখেন এটি খুব ভারী। তাদের সন্দেহ হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে দারুস সালাম থানায় খবর দিলে থানা পুলিশ হাজির হয়ে ট্রাংকটি খুলে একজন অজ্ঞাতনামা তরুণীর লাশ দেখতে পান।
লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। লাশের পরিচিতি শনাক্ত না হওয়ায় অজ্ঞাত পরিচয় লাশ হিসেবে দাফন করা হয়। কেউ বাদী না হওয়ায় থানা পুলিশের পক্ষে উপপরিদর্শক (এসআই) জাহানুর আলী বাদী হয়ে আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে দারুস সালাম থানায় মামলা করেন। মামলা নম্বর : ৬, তারিখ ৩ মে ২০১৫। দণ্ডবিধির ৩০২/২০১/৩৪ ধারায় মামলা করা হয়।
সফল পিবিআই
মামলাটি রুজু হওয়ার পর থেকে শুরুতে প্রায় তিন মাস থানা পুলিশ তদন্ত করে। এরপর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) প্রায় চার বছর তদন্ত করে লাশ শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করে। আদালত মামলাটি লোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর হওয়ায় দাখিলকৃত চূড়ান্ত রিপোর্ট গ্রহণ না করে রহস্য উদঘাটনের স্বার্থে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। এরপর ঢাকা মেট্রো উত্তর পিবিআইয়ের ইনচার্জ ও বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলমের তত্ত্বাবধানে তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি চৌকসদল নিরলসভাবে পরিশ্রম করে ভিকটিমের পরিচয় শনাক্ত করে। মূল আসামি রেজাউল করিম স্বপনকে গ্রেপ্তারে গত বৃহস্পতিবার রাতে কুমিল্লায় অভিযান শুরু করে তারা। অভিযানে ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক আশরাফুজ্জামান, সাব্বির মোহাম্মদ সেলিম, তরিকুল ইসলাম ও জুয়েল মিয়া, এসআই ফরিদুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজনসহ পিবিআই কুমিল্লা টিম। শুক্রবার ভোরে কুমিল্লা জেলার ইপিজেড এলাকার ভাড়া বাসা থেকে আসামি রেজাউল করিম স্বপনকে গ্রেপ্তার করে তারা। আসামি ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিয়েছেন।
যেভাবে রহস্য উদঘাটন
পিবিআইয়ের ডিআইজির বিশেষ নির্দেশনায় তদন্ত কর্মকর্তাকে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা এলাকার সব থানায় ২০১৫ সালে এন্ট্রিকৃত নিখোঁজ সাধারণ ডায়েরিগুলো (জিডি) অনুসন্ধান করে তথ্য নিয়ে আসার জন্য পাঠানো হয়। তদন্ত কর্মকর্তা এক সপ্তাহ নিরলস পরিশ্রম করে ওই সময়ে কাছাকাছি ১০-১২টি নিখোঁজ জিডির তথ্য উদঘাটন করেন। ওই জিডিগুলোর মধ্যে ১০ জুনের ৫৯৯ নম্বর জিডিতে দেখা যায়, খুলনার দৌলতপুর থানাধীন দেওয়ানা উত্তরপাড়ার ইলিয়াস শেখের মেয়ে শম্পা বেগম উক্ত তারিখে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। ওই ঘটনায় ভিকটিম শম্পা বেগমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান ১০ জুন পাহাড়তলী থানায় জিডি করেন।
প্রথমে প্রেম
পিবিআই জানিয়েছে, ওই জিডির সূত্র ধরে তদন্ত কর্মকর্তা জিডি রুজুকারী ভিকটিমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান ও বাবা ইলিয়াস শেখের (অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য) সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ২০১৩ সালে রেজাউল করিম স্বপন (নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য) খুলনা তিতুমীর নৌঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। তখন শম্পা বেগম হাসপাতালে মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্টের কাজ করতেন। হাসপাতালে ইলিয়াস শেখের স্ত্রীর চিকিৎসার তাঁর মেয়ে শম্পা বেগমের সঙ্গে আসামি রেজাউলের পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের সূত্রে প্রথমে প্রেম হয়। পরে ভিকটিম তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে তিনি বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন।
বিয়ে না করেই সংসার
রেজাউলের পর শম্পাও কিছুদিন পরে চট্টগ্রামে চলে আসেন। চট্টগ্রামে এক ফুফুর বাসায় তারা কিছুদিন থাকেন। এরপর ফয়েজ লেক এলাকায় একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করেন। পরবর্তীতে পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আনোয়ার হোসেনের টিনশেড বাড়ির একটি বাসায় সাবলেট নিয়ে বসবাস শুরু করেন তারা। এভাবে তারা ২০১৪-২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত একত্রে বসবাস করেন। তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলেও বিয়ে করেননি।
যে কারণে হত্যার শিকার শম্পা
পিবিআই জানিয়েছে, একসঙ্গে বসবাস করার পরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শম্পা ও রেজাউলের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। রেজাউল ২০১৫ সালের ২ মে গভীর রাতে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শম্পাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরপর লাশ গোপন করতে একটি ট্রাংকে ভরে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহণের একটি বাসে তুলে দেন রেজাউল। তিনি ভিকটিমের বাবাকে জানান, শম্পাকে খুলনার বাসে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে ভিকটিম তার বাবার বাড়িতে না পৌঁছালে তারা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেন। না পেয়ে ভিকটিমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় নিখোঁজ জিডি করেন। ভিকটিমের বাবা পরে রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী চট্টগ্রাম অফিসে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। গোপন তদন্তের ভিত্তিতে জানা যায়, উক্ত আসামিকে তার বাহিনী কর্তৃক তদন্তে বিভিন্ন অপরাধ সংশ্লিষ্টতার কারণে ২০১৯ সালে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।