‘ডাটাবেজ হলে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেবে প্রেস কাউন্সিল’
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। তাঁরা দেশ ও সমাজের কল্যাণে কাজ করছেন। আর সাংবাদিকদের কল্যাণে সরকার কাজ করতে বদ্ধপরিকর। তাদের জীবন-মান উন্নয়নে করতে কাজ করতে চায়। কিন্তু সাংবাদিকদের সঠিক তথ্য না থাকায় তাদের কল্যাণ কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই সারা দেশের সাংবাদিকদের ডাটাবেজ করা হচ্ছে। ডাটাবেজের কাজ শেষে সবাইকে সুনির্দিষ্ট পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। ডাটাবেজ হলে সাংবাদিক সুরক্ষার দায়িত্ব নেবে প্রেস কাউন্সিল। প্রেস কাউন্সিলের পরিচয়পত্রের বাইরে সাংবাদিকতার সুযোগ থাকবে না।’
গতকাল বুধবার কক্সবাজার সার্কিট হাউজের কনফারেন্স হলে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে সব সাংবাদিককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। এই পেশাকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছি।’
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কক্সবাজারের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের এই সভায় প্রধান অতিথি আরো বলেন, ‘সাংবাদিকদের আইন পড়তে হবে, জানতে হবে। সঠিক তথ্য ছাড়া সংবাদ করা যাবে না। মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় এমন সংবাদ যেন না হয়।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি আরো বলেন, ‘কে কোন মতাদর্শে বিশ্বাসী, সেটা বিবেচনা না করে সবাই একসঙ্গে কাজ করা দরকার। তাহলে পেশার মান বাড়বে। সবাই সমৃদ্ধ হবেন।’
পত্রিকার মালিকপক্ষের উদ্দেশে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বলেন, ‘সাংবাদিক-কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক বিষয়টি নিশ্চিত না করে পত্রিকার মালিকানা দাবি উচিত নয়।’
কক্সবাজার প্রেসক্লাবে ‘বঙ্গবন্ধু কর্ণার’ করা হবে। তার জন্য এক লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হবে বলেও জানান প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সদস্য ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘সাংবাদিকদের মর্যাদা, স্বাধীনতা ও অধিকারের কথা সংবিধানে লেখা আছে। যা অন্য কোনো পেশার ব্যাপারে তেমন নাই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দূরদৃষ্টি দিয়ে প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।’
ইকবাল সোবহান চৌধুরী আরো বলেন, ‘বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির জনক খুবই আন্তরিক ছিলেন। নিজেই সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর হাত ধরেই ১৯৭৪ সালে প্রেস কাউন্সিলের যাত্রা শুরু। সংবাদপত্র রঙিন কিন্তু সাংবাদিকদের ভাগ্য রঙিন নয়। আইন আছে, অধিকার বাস্তবায়নে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। সেজন্যই সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাব রয়েছে।’
পত্রিকার মালিকদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘যারা বেতনভাতা দেবেন না তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আন্দোলন করতে হবে। তাতে আমাদের সর্বোচ্চ সমর্থন থাকবে। সাংবাদিকদের জন্য আইন আছে। তা বাস্তবায়নে নিজেদের সচেষ্ট থাকতে হবে। যেসব মিডিয়া হাউজ ওয়েজবোর্ড ফলো করে না; সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা দেয় না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি বিজ্ঞাপন কীভাবে পায়, তা দেখতে হবে।’
ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘স্বাধীন সাংবাদিকতা ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। যে রাষ্ট্রে সাংবাদিকতা যত নিরাপদ ও স্বাধীন হবে সেই রাষ্ট্র ততো এগিয়ে যাবে, সমৃদ্ধ হবে। সারা দেশের সাংবাদিকদের ডাটাবেজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রেস কাউন্সিল থেকে কিছু নীতিমালা ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট পেলে ডাটাবেজে স্থান হবে। দেওয়া হবে একটি পরিচয়পত্র। তখন সত্যিকার সাংবাদিক পরিচয় নিশ্চিত হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ডাটাবেজের অন্তর্ভুক্ত কেউ সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হলে প্রেস কাউন্সিল থেকে সহায়তা দেওয়া হবে। কোড অব ইথিকস ভঙ্গ করলে পরিচয়পত্র বাতিল ও ডাটাবেজ থেকে তাঁকে ডিলিট করে দেওয়া হবে। সাংবাদিকদের দায়বদ্ধতার মধ্যে নিয়ে আসা হবে।’
সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে এই পেশায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে জানিয়ে সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘সংবাদ হতে হবে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ। বিভ্রান্তিকর কোনো সংবাদ করা যাবে না। সংবাদের প্রয়োজনে কোনো সরকারি কর্মকর্তার কাছে গেলে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। যারা তথ্য দিতে গড়িমসি করবেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সরকারের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কীভাবে সাংবাদিকতা করতে হবে তার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।
সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সদস্য সচিব মোহাম্মদ শাহ আলম। সেইসঙ্গে তিনি মতবিনিময় সভার সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মাসুদুর রহমান মোল্লার সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক সৈকত পত্রিকার সম্পাদক মাহবুবর রহমান।
কক্সবাজারে কর্মরত সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন দৈনিক কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি তোফায়েল আহমদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম মহাসচিব ও দৈনিক নয়া দিগন্তের কক্সবাজার প্রতিনিধি জি এ এম আশেক উল্লাহ, অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান, দৈনিক প্রথম আলোর কক্সবাজার অফিস প্রধান আবদুল কুদ্দুস রানা, সাংবাদিক ইউনিয়ন কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক আনছার হোসেন, আরটিভির কক্সবাজার প্রতিনিধি সাইফুর রহীম শাহীন, বাংলাদেশ অবজারভারের প্রতিনিধি ফরহাদ ইকবাল, ইউএনবির প্রতিনিধি দিপক শর্মা দীপু, দৈনিক সাঙ্গুর নিজস্ব প্রতিবেদক ও কক্সবাজার নিউজ ডটকমের (সিবিএন) বার্তা সম্পাদক ইমাম খাইর। সাংবাদিকদের নিবন্ধিতকরণ ও ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারিত করতে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা।
তাঁরা বলেন, ‘গণমাধ্যমের প্রসারের কারণে সাংবাদিকতার প্রসার ঘটেছে, সাংবাদিক বেড়েছে। সেটা পজেটিভ বিষয়। দুঃখের বিষয় হলো গণমাধ্যমের প্রয়োজনে মানসম্মত সাংবাদিক যেমন রয়েছে তেমন মানহীন লোকজনও এই পেশায় ঢুকে পড়েছে। এজন্য নীতিমালা করে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ দরকার। সেইসঙ্গে সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করারও দাবি তোলেন বক্তারা।’
সভাপতির বক্তব্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মাসুদুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে ভিন্ন কক্সবাজার। এখানকার মানুষ দরিদ্র হলেও প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়েছে। নিজে না খেয়ে রোহিঙ্গাদের খাবার দিয়েছে। সাহায্য করেছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ৭৯টি অগ্রাধিকার প্রকল্প কক্সবাজারকেন্দ্রিক চলছে। যার প্রচার করছেন এখানকার সংবাদকর্মীরাই। যা মূলত দেশের পক্ষেই রিপ্রেজেন্ট করছেন কক্সবাজারের গণমাধ্যমকর্মীরা।’ সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কয়েকটি প্রস্তাবনা পেশ করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো সংবাদকর্মী আক্রান্ত হলে তাঁর সম্পূর্ণ চিকিৎসার ভার সরকারকে নেওয়ার আহ্বান, কক্সবাজার প্রেসক্লাবকে উন্নয়নের আওতায় আনার প্রস্তাবনা দেন।