ডায়রিয়ায় শিশু ও বয়স্করা বেশি আক্রান্ত, বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ
প্রচণ্ড গরমের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখন ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে চলেছে। ডায়রিয়া প্রতিরোধে নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা। খবর বার্তা সংস্থা বাসসের।
বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে খাবার পানির সঙ্গে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সব এলাকায় ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ডায়রিয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশু ও নারীরাও। সময়মতো চিকিৎসা না দিতে পারলে এটি মারাত্মক হতে পারে। বিশেষ করে শিশুদের ডায়রিয়া প্রতিরোধে নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা। কেননা বড়দের চেয়ে শিশুদের শরীরের কোষের বাইরের পানি বা এক্সট্রা সেলুলার ফ্লুইড বেশি থাকে। ফলে ডায়রিয়া হলে সহজেই তাদের শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে। পানিশূন্যতা তীব্র হলে শিশু অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। কখনও কিডনি বিকল হতে পারে।
আইসিডিডিআরবি’র সূত্র বলছে, সম্প্রতি যে সংখ্যক ডায়েরিয়া রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি।
গরমকালে ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। ঠিকভাবে পানি ও লবণ পূরণ করা হলে, এটি কখনও গুরুতর আকার ধারণ করে না। বেশির ভাগ ডায়রিয়া এমনিতেই সেরে যায়। কিন্তু, ডায়রিয়া হলে ওরস্যালাইন খাওয়া, এমনকি এর চিকিৎসা নিয়ে এখনও রয়ে গেছে কিছু ভুল ধারণা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ রক্তচাপ আছে—এমন রোগীরা ডায়রিয়ার আক্রান্ত হলে ওরস্যালাইন খেতে বিভ্রান্তিতে ভোগেন। স্যালাইনে লবণ থাকায় তাঁদের আশঙ্কা—ওরস্যালাইন খেলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। এটি ভুল ধারণা। প্রতিবার পাতলা পায়খানার সঙ্গে শরীর থেকে প্রচুর পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। তা যথাযথভাবে পুরণ করা না হলে, রোগীর পানিশূন্যতা, লবনশূন্যতা, এমনকি রক্তচাপ কমে গিয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে, মৃত্যুও হতে পারে। ওরস্যালাইনে চিনি বা গ্লুকোজ থাকে। তাই, ডায়াবেটিক রোগীরা খেতে ভয় পান। অনেকে মনে করেন, ওরস্যালাইন খাওয়ার পরে ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু, মনে রাখতে হবে—ওরস্যালাইনে যে সামান্য চিনি বা গ্লুকোজ আছে, তা অন্ত্রে লবণ শোষণের কাজে ব্যয় হয়। সুতরাং ডায়রিয়ার সময় ডায়াবেটিস রোগীরা নিশ্চিন্তে ওরস্যালাইন খেতে পারবেন।
স্যালাইন কতটুকু খেতে হবে, তা নির্ভর করবে কতবার পাতলা পায়খানা হচ্ছে বা কতটুকু পানি হারাচ্ছেন তার ওপর। ডায়রিয়ার কারণে একজন মানুষ মাত্র কয়েক ঘণ্টায় এক থেকে দেড় লিটারের বেশি পানি হারাতে পারে। সহজ কথা হলো—প্রতিবার পায়খানা হওয়ার পর স্যালাইন খাওয়া এবং অল্প করে সারা দিন বারবার খাওয়া। এর বাইরে সারা দিন পানি ও তরল খাবার যেমন—স্যুপ, ডাবের পানি ইত্যাদি খেতে হবে। অনেক সময় ফুড পয়জনিংয়ের কারণে বমি বা পাতলা পায়খানা হয়ে থাকে। মানুষ স্বভাবতই ফার্মেসি থেকে বমি বা পাতলা পায়খানা দ্রুত বন্ধের জন্য ওষুধ খান, যা একেবারেই ঠিক নয়। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। কারণ, পয়জনিংয়ের ক্ষেত্রে বরং কিছু সময় বমি ও পাতলা পায়খানার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পয়জন বের হয়ে যায়। সব ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়া জরুরি নয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন দেহের লবণ ও পানিশূন্যতা পূরণ করা। দরকার হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী বারবার পাতলা পায়খানা করার ফলে শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। এর ফলে রোগী পানিশূন্য হয়ে পড়ে। সে কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। ডায়রিয়া শুরু হলে আধা লিটার বিশুদ্ধ পানিতে এক প্যাকেট খাবার স্যালাইন ভালোভাবে মিশিয়ে রোগীকে খাওয়াতে হবে। বয়স দুই বছরের নিচে হলে তাদের প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ১০ থেকে ২০ চা চামচ, দুই বছরের বেশি বয়সিদের ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৪০ চা চামচ করে যত বার পাতলা পায়খানা হবে, তত বারই খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। যেকোনো ওষুধ বা পানের দোকানেও আজ খাবার স্যালাইনের প্যাকেট পাওয়া যায়। বানানো খাবার স্যালাইন ছয় ঘন্টা পর্যন্ত খাওয়ানো যায়। এরপর প্রয়োজন হলে আবার নতুন করে খাবার স্যালাইন বানাতে হবে।
শিশুর ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি মায়ের বুকের দুধ বেশি করে খাওয়াতে হবে।
এ ছাড়া বড়দের স্বাভাবিক সব ধরনের খাবার খাওয়াতে হবে। তবে, তরল জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়াতে হবে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ভাতের মাড়, ডাবের পানি, চিড়ার পানি, লবণ-গুড়ের শরবত, খাবার স্যালাইন, বিশুদ্ধ খাবার পানি খাওয়াতে হবে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের জন্য পৃথক ইউনিট খোলা হয়েছে। সেখানে রোগীদের বিশেষভাবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বন্যা ও বর্ষণজনিত রোগ সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বর্তমান মৌসুমে আমাদের দেশে সাধারণত তিন মাস থেকে ১২ বছরের শিশুরা ডায়রিয়া, কলেরা, জ্বর, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, আমাশয় ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়। কারণ, একদিকে আবহাওয়ার পরিবর্তন; অন্যদিকে, অপ্রত্যাশিত বন্যা ও বর্ষণ। নিম্নআয়ের পরিবারের লোকদের মধ্যে এ রোগ বেশি হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে গরিব মা-বাবা শিশুদের প্রতি যত্নে দায়িত্বশীল হতে পারেন না, সঠিক সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন না। ফলে অকালেই মারা যায় অনেক শিশু।
পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, হাত না ধুয়ে কোনো কিছু খেলে বা বাসি, পচা খাবার খেলেও ডায়রিয়া হতে পারে। অনেকেই ওয়াসার সরবরাহ করা পানি পান করে। পানির মাধ্যমে ডায়রিয়ার জীবাণু বেশি ছড়ায়। তাই, পানি ফুটিয়ে পান করা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। আবার কেউ-কেউ রাস্তা-ঘাটে খোলা খাবার ও শরবত খেয়েও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। বারবার পাতলা পায়খানা হলে, বমি হলে, ঝুঁকি না নিয়ে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীকে ভর্তি হতে হবে।
ডায়রিয়া একটি সাধারণ রোগ। আজকাল ডায়রিয়া বা কলেরায় মৃত্যুর হার খুবই কম। কিন্তু, আক্রান্ত হলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, কার্যক্ষমতা কমে যায়। তাই, ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং টাটকা খাবার খেতে হবে। পচা ও বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। বাজারের খোলা খাবার খাওয়া যাবে না। বৃদ্ধ ও শিশুদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। এ সময় শিশু ও বৃদ্ধদের আঁটসাঁট পোশাক না পরে ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে। পোশাক সুতির হলে বেশি ভালো। মনে রাখতে হবে—‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।’