ড্রেজিং ষড়যন্ত্রে অচল হওয়ার শঙ্কায় মোংলা বন্দর
মোংলা বন্দরে একদিকে বেড়েছে কর্মচাঞ্চল্য, অন্যদিকে ড্রেজিং না হওয়ায় বাড়ছে অচল হওয়ার শঙ্কা। ড্রেজিং প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হলেই অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে বলে বলছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বন্দরের আমদানি-রপ্তানিসহ জাতীয় অর্থনীতিতে।
জানা গেছে, মোংলা বন্দর দিয়ে পদ্মা সেতু, খানজাহান আলী বিমান বন্দর, রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, খুলনা-মোংলা রেললাইন, পদ্মা সেতু সংলগ্ন ভাঙ্গা-মোংলা মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ, রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানি, দেশের চলমান মেগাপ্রকল্পের মালামাল আমদানি, ঢাকার গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিসহ নানাবিধ সুফল দিচ্ছে। অথচ ২০০২-০৩ অর্থবছর থেকে ২০০৬-০৭ অর্থবছর পর্যন্ত এটি ছিল লোকসানি বন্দর। ওই সময় এ বন্দরকে মৃতপ্রায় অর্থাৎ ডেডহর্স বলেও ঘোষণা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোংলা বন্দরের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেন। পরে ধীরে ধীরে এটি ফিরে পায় গুরুত্ব।
মোংলা বন্দরটি বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ১৩১ কিলোমিটার উজানে পশুর নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত। বঙ্গোপসাগর হতে বন্দর চ্যানেলের প্রবেশ মুখ যা আউটার বার নাম হিসেবে পরিচিত। বন্দরের প্রবেশ মুখ থেকে চ্যানেলের হাড়বাড়ীয়া পর্যন্ত এই আউটার বার। সম্প্রতি এই আউটার বার ড্রেজিং করায় মোংলা বন্দরের হাড়বাড়ীয়া পর্যন্ত সাড়ে ৯ থেকে ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ অনায়াসে ভিড়তে পারছে। আর হাড়বাড়ীয়া থেকে বন্দর জেটি পর্যন্ত ২৩ দশমিক চার কিলোমিটার নৌপথে গভীরতা ৫ থেকে ৬ মিটার। ইনার বারে সাড়ে ৮ মিটার গভীরতার ড্রেজিং সম্পন্ন হলে বন্দর জেটিতে সাড়ে ৯ থেকে ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারবে। পশুর চ্যানেলের ইনার বার ড্রেজিং সম্পন্ন হলে মোংলা বন্দরকে চট্টগ্রাম বন্দরের সমান সক্ষমতার বন্দরে পরিণত হবে।
ইনারবার ড্রেজিং প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল ও হাইড্রোলিক বিভাগ) শেখ শওকত আলী জানান, ইনারবার ড্রেজিং প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার আগে ২০১৮ সালে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষায় পরামর্শকরা ড্রেজিংয়ের মাটি পাশের জমিতে ফেললে জমির ঊর্বরাশক্তি বৃদ্ধিসহ নানা উপকারিতার কথা তুলে ধরেন। কিন্তু, ওই জমিতে ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলায় বাধার সৃষ্টি করে আন্দোলনের নামে একটি মহল সরকারের উন্নয়নকে ব্যাহত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। যদিও ভূমি মন্ত্রণালয় ওই জমির ক্ষতিপূরণ বুঝে নিয়ে দুই বছরের জন্য মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়। ওই জমিতে দুই বছরের জন্য ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলার পর জমির মূল মালিকেরা তাদের মালিকানা আবারও ফিরে পাবেন। কিন্তু একটি মহল জমির মালিকদেরকে ভুল বুঝিয়ে নানা আন্দোলন সৃষ্টি করে সেখানে মাটি ফেলায় বাধার সৃষ্টি করছেন।
মোংলা বন্দর বার্থ অ্যান্ড শিপ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, ‘ইনার বার ড্রেজিং কার্যক্রম ব্যাহত হলে বন্দরের ভীষণ ক্ষতি হবে। এতে আমদানি-রপ্তানি ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে। একটি দুষ্টুচক্র এটি করছে, কিন্তু কোনোভাবেই চলমান উন্নয়ন ব্যাহত হতে দেওয়া যাবে না।’
মোংলা বন্দর কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়াডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি সুলতান হোসেন খাঁন বলেন, ‘ড্রেজিং প্রকল্প নিয়ে যারা ষড়যন্ত্র করছেন, তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।’
বন্দর ব্যবহারকারী ‘ইন্টারপোর্ট শিপিং এজেন্সি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন শাহিন ইকবাল বলেন, ‘যেকোনো ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে মোংলা বন্দরের স্বার্থে ইনার বার ড্রেজিং প্রকল্প চালু রাখতে হবে। তা না হলে আমরা রাশিয়া থেকে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান যে সব মালামাল আনছি, তা ব্যাহত হবে।’
এনসিয়েন্ট স্টিমশিপ কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘ড্রেজিং জটিলতায় বন্দর অচল হতে দেওয়া যাবে না। বন্দরের উন্নয়নের ড্রেজিংকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সকল প্রতিবন্ধকতা প্রতিহত করতে হবে।’
‘মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের ইনার বারে চলমান ড্রেজিং প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হলে জাতীয় অর্থনীতিতে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে’ বলে মন্তব্য করে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম মুসা বলেন, ‘পশুর নদীর উত্তোলিত বালু বাণীশান্তা এলাকায় ফেলার জন্য জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে খুলনা জেলা প্রশাসককে সাত কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে আর সমস্যা থাকার কথা না। বন্দরকে সচল রাখতে প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বন্দর সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।’